প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৭

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৭
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

গাড়ির পিছনের সিটে চুপচাপ বসে আছি,গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে। পাশেই তাহমিমা বসে আছে ওর দিকে তাকালাম।ও তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে কাজেই ওকে আর ডাকলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ব আমার দিকে তাকাচ্ছেন একবার আরেকবার সামনের দিকে। চোখ নামিয়ে নিলাম, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে উনি নিজেই ফেঁ’সে গেলেন এতো বড় একটা বিপদের মধ্যে।কিছুক্ষণ আগে,,,,,,,,,,,,

‘ এইসব কি বলছো তুমি, আমার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে মানে?’
পূর্বের কথার সাথে সাথেই রিয়েক্ট করলো বাবা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি প্রচুর পরিমাণে অবাক হয়ে গেছেন, এরকম কিছু পূর্ব বলে বসবেন এটা উনি স্বপ্নেও ভাবেননি হয়তো বা। এতক্ষণ উপস্থিত কারোর মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই, পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে বাবা উঠে এসে পূর্বের গায়ে হাত তুলতে যাবে তখনই পূর্ব বাবার হাত ধরে ফেলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আমার মেয়ে কে নিয়ে একটা মিথ্যা কথা বলার আগে তোমার সবকটা দাঁত আমি চ’ড় দিয়ে ফেলে দেবো বেয়াদব ছেলে। তোমার বন্ধুর সাথে আমার ছোট মেয়ের বিয়ে হবে তাই বলে যে তুমি আমার বাড়ির মান সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে এটা আমি কখনও মেনে নিবো না। এখানে আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, বেড়িয়ে যাও এক্ষুনি তোমার বন্ধু কে নিয়ে,ওর সাথে দেবো না আমার তাহমিমা মায়ের বিয়ে।'(এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলেন বাবা)

পূর্ব তখনও বাবার হাত উপরে উঠিয়ে শক্ত করে ধরে আছে, দাঁতে দাঁত চেপে রাগ টাকে কন্ট্রোল করলো। হাজার হলেও স্নিগ্ধার বাবা ইনি,ইনার সাথে এখন বাজে ব্যবহার করা টা উচিত হবে না। হাতটা ছেড়ে দিল পূর্ব। মুখটা হাসি হাসি করে বললো,,,

‘ আপনি এমন কেন ভাবছেন শশুর মশাই? আরে ও আমার বউ তো, আমি যদি ওকে প্রটেক্ট না করি তাহলে কে করবে বলুন তো। হাজব্যান্ড হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে যে, আপনার মেয়ে তো,,,,,,’

পূর্ব আর কিছু বলার আগেই বাবা ওর গালে ঠাস করে একটা চ’ড় বসিয়ে দিলেন। এতক্ষণ যাও সবকিছু স্বাভাবিক ছিল কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই আর স্বাভাবিক রইলো না। আমি স্টেজের চেয়ারে বসে মুর্তিটির মতো সবকিছু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, আমাকে নিয়ে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে এখানে আর আমি কিছুই করতে পারছি না। পূর্বের গায়ে যখন বাবা হাত তুললেন তখন কেন জানি মনটা কেঁপে উঠলো, উনার অসম্মান টা আমি মেনে নিতে পারলাম না।স্টেজ থেকে নেমে এসে বাবাকে থামিয়ে দিলাম,,,

‘ বাবা, ভুলে যেও না তুমি কিন্তু আমাকে মেয়ের সম্মান টুকু দাও নি কখনও।আর সেখানে অন্য ছেলের কাছে মেয়ের সম্মান আশা করাটা তোমার বিলাসিতা মাত্র। কেমন বাবা তুমি? জেনে শুনে একটা মদখোর ডির্ভোসী লোকের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলে।কই তখন তো তোমার আমার জন্য মন পুড়ে নি তাহলে এখন একটা ছেলে এসে আমাকে তার বউ বলে স্বীকার করছে তার গায়ে কোন সাহসে হাত তুলতে পারো?মা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার কোন খোঁজ তুমি রেখেছো বলেও তো মনে পড়ছে না আমার, তুমি হয়ত জানো না যে আমি আগে থেকেই বিবাহিতা ‌। উনি সত্যি কথাই বলতে এসেছেন এখানে,এক মাস আগেই আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছি।’

আমার কথায় বাবা যতোটা না অবাক হয়েছেন তার থেকে বেশি অবাক হলো পূর্ব।গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে, এতো মানুষের সামনে চ’ড় খাওয়ার অপমান টা হজম করা কয়েক মুহূর্ত আগেও যতটা কষ্টকর ছিল ওর কাছে কিন্তু এখন সেটা হজম করা তার থেকে বেশি সহজ মনে হলো। আমার সামনে এসে দাড়ালো পূর্ব, চোখে অপমানে পানি চলে এসেছে ওর।গাল থেকে হাত নামিয়ে চোখের কোনের পানিটা মুছে হাসলো, এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘ এবার বিশ্বাস হয়েছে তো শশুর মশাই? এবার তাহলে আমরা আসছি, আপনি অন্য কারো সাথে এই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিন।’
‘ দাঁড়াও তুমি।’

পূর্ব আমার হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে কি বাড়ায়নি পিছন থেকে আব্বু হুংকার দিয়ে উঠলেন। পূর্ব সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তূর্য, তাহমিমা সহ সবাই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,বাবা আবার কি ঝামেলা করবে সেটা নিয়ে সবাই উত্তেজিত হয়ে গেল।বাবা বেশ সহজ ভাবেই কাজীর কাছে গিয়ে বললেন আগের কাগজ গুলো নষ্ট করে নতুন করে বিয়ের সমস্ত কাগজ পত্র রেডি করতে,কাজী জিজ্ঞেস করল কেন।বাবা বললেন,,

‘ আমার মেয়ে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে এটা সত্যি হলেও সত্যি, মিথ্যা হলেও সত্যি। জন্মদাতা পিতা তো আমি ওর তাই আমার চোখের সামনে ওর আবার বিয়ে হবে ওই ছেলের সাথেই। তোমার আপত্তি আছে কোনো?’
পূর্ব কে জিজ্ঞেস করলেন বাবা। আমি হকচকিয়ে গেলাম, এটা কি বলছে বাবা?

পূর্বের সাথে আমার বিয়ে দিবে আবার,তার মানে বাবা বিশ্বাস করেনি আমাদের মুখের কথা। পূর্ব যদি না রাজি হয় বিয়েতে তাহলে তো বাবা সবকিছু বুঝে নিবেন,আর আমার বিয়েটাও কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব হবে না। পূর্বের মুখের দিকে তাকালাম আমি,ও ও কিছুটা অবাক হয়ে গেছে বাবার প্রস্তাবে। আমি ওর উত্তরের অপেক্ষায় থাকতে পারলাম না, জানি উনি না করে দিবেন তাই আমি ই বললাম,,

‘ আমার আপত্তি আ,,,,,,’
‘ আমাদের কোনো আপত্তি নেই শশুর মশাই। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন,আমরা আবার বিয়ে করবো তাহলে আপনি খুশি হবেন তো?’

আমি কথা শেষ করার আগেই পূর্ব আমাকে বাধা দেয় এবং নিজেই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যায়।বাবা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল, এরপর কাজী সাহেব কে তাড়া দিল বিয়ের জন্য। আমি ঘোরের মধ্যে চলে গেছি,এক বিয়ে থামাতে গিয়ে আরেক বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে তা-ও আবার আমার অফিসের এমডি স্যার কে।স্যার ই বা কিভাবে রাজি হলেন বিয়েটা করতে? অসহায় চোখে তাহমিমা আর তূর্যের দিকে তাকালাম আমি,ওরা বেশ খুশি মনে হচ্ছে ব্যাপারটায়।
এদিকে কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন ওদিকে মা মেয়ে ফুঁসছে সাপের মতো।এটা দেখে তাহমিমা নানীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,,,

‘ তোমার কোন চাল খাটলো না বুড়ি। তোমরা মা মেয়ে খুব তো লাফালাফি করছিলে আজকের মধ্যেই আমার আপুকে একটা ব’দ’মা’ই’শ ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা শেষ করে দিতে। কিন্তু পারলে কই? শোনো বুড়ি, আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তুমি প্যাকাটি আর তোমার মেয়ে কটকটি কিচ্ছু টি করতে পারবে না আপুর। ইশ্ কিছু একটা পো’ড়া’র গন্ধ পাচ্ছি যেন আমি,,,,,,’

চোখ পাকিয়ে তাহমিমার দিকে তাকালেন নানী ওরফে মঞ্জিলা বেগম।তাহমিমার কথা শুনে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে উনার কিন্তু না পারছেন আদরের নাতনি কে কিছু বলতে আর না পারছেন ওই ফেলানী মেয়েটার এতো ভালো কপাল সহ্য করতে। এদিকে ছেলের শশুর বাড়ির লোকেদের কথার খোঁচা তো আছেই। এই ছেলে টা তাসনিয়া কে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কি ভূমিকম্প হতে পারে এটা ভেবেই আবার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হল মঞ্জিলা বেগমের।

গাড়ির হঠাৎ ব্রেকে হুঁশ ফিরে এলো আমার। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার মাঝে ডুব দিয়েছিলাম আমি। পূর্ব গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিল আমার জন্য। আমি এক নজর তাকালাম উনার দিকে, কেমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না তখনকার ঘটনার জন্য।

আমাকে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বললেন। আমি চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে এলাম। সামনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি,কি এক বিশাল রাজপ্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। সিনেমায় হিরোদের যেমন বাড়ি থাকে ঠিক সেরকমই এই বাড়িটা। আমাকে ওভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,,,

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৬

‘ এত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। এখন থেকে এই রাজপ্রাসাদের যুবরানী তুমি,এটাই তোমার শশুর বাড়ী।’

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৮