প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৮

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৮
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

বাড়ির দরজায় পা রাখতেই হায় হায় করে আমাদের দিকে তেড়ে আসেন একটা মহিলা।বেশ বয়সী মহিলা, হয়তো বা পূর্বের দাদী হবেন তিনি,দামী জামদানি শাড়ি পড়েছেন বাঙালি ডিজাইনে, ভারী গয়না গলায়,কানে। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,,,

‘ এই তুই কাকে বিয়ে করে নিয়ে এলি পূর্ব, এখন আমি লোকসমাজে মুখ দেখাই কি করে? চৌধুরী পরিবারের মানসম্মান তুই আর কিছুই বাকি রাখলি না রে বেটা।তোর বোন কয়েকদিন আগে তোর বাবার মুখে চুনকালি মেখে পালিয়েছে কোন জা’নো’য়া’রে’র হাত ধরে সেই চিন্তায় তোর বাবার রাতে ঘুম হয় না। আর আজকে তুই কি না, ছিঃ ছিঃ লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে পূর্বের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। পূর্ব একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তূর্যের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধা কে বিয়ে করেছে এই খবর টা ও তো বাসায় দেয়নি তাহলে আর কে দিবে? নিশ্চয়ই এই বেটা তূর্য খবরটা দাদীর কানে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

তূর্য ঢোক গিলে ইশারায় সরি বললো,ও নিজেও বুঝতে পারে নি দাদী ওভাবে রিয়েক্ট করবে ব্যাপারটায়। আমি কাঁদো কাঁদো চোখে পূর্বের দিকে তাকালাম, উনি একে তো আমাকে বিয়ে করে ফেঁ’সে গেছেন তার উপর বাসায় এসে ও আরেক বিপদের মধ্যে পড়লেন। উনি তো আমাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছেন কিন্তু বাসায় যদি উনার বাড়ির লোকজন আমাকে মেনে না নেয় তাহলে আমি কোথায় যাবো?যাওয়ার মতো তো আর কোনো জায়গা ও নেই আমার। পূর্ব হয়তো বুঝতে পারলেন আমার বিষয়টা। আমার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করলেন কোন সমস্যা হবে না আমাকে নিয়ে।

‘ কেন ডার্লিং? তোমার সতীন ঘরে চলে এসেছে বলে তুমি খুশি হওনি তাই না, তোমার হিংসে হচ্ছে খুব ওর উপর। তুমি কোন চিন্তা করো না গো, তোমার সতীন কে আমি যেমন ভালোবাসা দিবো,তোমাকেও না হয় তেমন……………….’
আর বেশি কিছু বলার আগেই কান ধরে টেনে ওকে ভিতরে নিয়ে গেলেন মহিলা টি। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে গেলাম উনার উপর, এমন সিরিয়াস মূহুর্তে এসেও নাকি উনার ফাজলামো। উনার কান মলে দিয়ে বললেন,,,,

‘ শোন পূর্ব এই মহুয়া চৌধুরী কখনো কারো সাথে হিংসে করে না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোর কান্ড কারখানা দেখে, এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে তুই এতোটা।এ কোন পূর্ব কে দেখছি আমি? শেষে কিনা চৌধুরী বংশের গর্ব চৌধুরী বংশের মান সম্মান সব ধুলায় মিশিয়ে দিল।’ (মহুয়া চৌধুরী)

পূর্ব কিছুটা থতমত খেয়ে দাদীর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর দাদী কে জড়িয়ে ধরে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে ধরলো, মহুয়া চৌধুরী ওকে ধ’ম’ক দিচ্ছেন বারবার ছাড়তে বলছেন উনাকে কিন্তু পূর্বের কোন হেলদোল নেই।ও মহুয়া চৌধুরী কে নিজের রুমে নিয়ে গেল কিছু বুঝানোর জন্য।

আমার তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বসার রুমে সোফায় একজন মাঝ বয়সী লোক বসে আছে আর উনার সাথে হয়তো বা উনার স্ত্রী ই হবেন যিনি এতক্ষণ ধরে আমাকে খেয়াল করছিলেন। তূর্য আর তাহমিমা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, মহুয়া চৌধুরী কে নিয়ে যাওয়ার পর তূর্য বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো।

সোফায় যেই মহিলা এতক্ষণ ধরে বসে আমাকে খেয়াল করছিলেন তিনি সহসা উঠে আমার কাছে এলেন। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।এসেই যা দেখতে হলো উনার দাদী বিষয়ক,না জানি আর কি কি দেখতে হবে। তখনই কেউ একজন আমার থুতনিতে হাত রেখে মাথাটা উপরে তুললেন, সামনে তাকিয়ে দেখি মহিলাটি নিজেই। আমার দিকে তাকিয়ে উনি মুচকি হেসে বললেন,,

‘ মাশাআল্লাহ, আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। এই যে মেয়ে শোনো, আমি কিন্তু তোমার নাম ধাম পরিচয় কিছুই জানি না তবে কোনো ব্যাপার না, সব জেনে নিবো তোমার থেকে।আসল কথা হচ্ছে তোমরা দুজন আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছো আর তাতে আমি আর তোমার শশুর দু’জনেই খুব রাগ করেছি। তোমরা ভালোবাসো একে অপরকে এটা তো ভালো কথা, আমাদের কে একবার বলতে পারতে এই বিষয়ে।

আমরা ধুমধাম করে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিতাম যেভাবে আমার আরেক ছেলে তূর্যের বিয়ে দেবো। এখন যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করে কাজ নেই। তুমি আমার শাশুড়ির কথায় কিছু মনে করো না, আসলে উনি রক্ষণশীল মানুষ তো তাই এমন।যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো দেখি,এক মা ছেড়ে এসেছো এখন তো আরেক মায়ের দায়িত্ব তার বউয়ের মতো মেয়েকে ভালো রাখা, হুম?’

আমি উনার এতো ভালো ব্যবহার হজম করতে পারলাম না। উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম। আমার হঠাৎ এভাবে কাঁদার কারণটা উনি ঠিক বুঝতে পারলেন না। মাথায় হাত দিয়ে শান্তনা দিলেন শুধু। তখন তাহমিমা এগিয়ে এসে বলল,,
‘ আন্টি ও আমার বড় বোন তাসনিয়া। আপনি শুনেছিলেন তো যে আমার বাবার আগের বউয়ের একটা মেয়ে ছিল।এই সেই। আমার মা তো কখনও আপুর মা হয়ে উঠতে পারে নি, আপনার মধ্যে হয়তো বা আপু তার মা’কে খুঁজে পেয়েছে তাই কান্না করছে।আর আপনি বিয়ে টা নিয়ে রেগে আছেন যে,,,'(বলতে বলতে তাহমিমার চোখ ও ভিজে উঠলো)
শাশুড়ি মা আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন,,,

‘ ধুর পাগলি মেয়ে, এভাবে কেউ কাঁদে নাকি হ্যা? আমি আছি তো। এখন থেকে আমাকে শাশুড়ি মা না ভেবে মা ই ভেবো বোকা মেয়ে।আর কখনো এভাবে কাঁদবে না। আমি তোমাদের বিয়ে নিয়ে এতো টুকু ও রেগে নেই।’
এরপর তিনি কাকে যেন ডাকলেন মরিয়ম বলে। মরিয়ম কোথা থেকে যেন তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে এলো, শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললো,,,

‘ কি অইছে আম্মাজান,ডাকছেন আমারে?'(মরিয়ম)
‘ হ্যা। এই যে আমার একমাত্র ছেলের বউ তাসনিয়া মা। ওকে একটু গেস্ট রুমে ফ্রেশ হতে নিয়ে যা তো। পূর্বের রুমে এখন মা আছেন, ওখানে নিয়ে গেলে মায়ের চেঁচামেচিতে বাসায় টেকা দায় হয়ে পড়বে।'(শাশুড়ি মা)
‘ আইচ্ছা, আম্মাজান।চলেন বউমনি,আমনেরে নিয়া যাই।'(মরিয়ম)

আমি মরিয়মের সাথে গেস্ট রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। তাহমিমা ও আমার সাথে গেল, ওর হাতে বাড়ি থেকে আনা আমার কাপড়ের লাগেজ টা আছে। বিয়ের ভারী শাড়ি আর গয়না সব খুলে একটা সাধারণ সিল্কের শাড়ি পড়লাম। এইসব ই তাহমিমার পছন্দে কেনা শাড়ি। সুতির শাড়ি ও কেনে বললেই চলে প্লাস আমাকেও কিনতে দেয় না।কালো রঙের শাড়ি আর তার সাথে ম্যাচিং করে কালো ফুল হাতা ব্লাউজ পড়লাম। মাথায় বউ খোঁপা করা ছিল, তাহমিমা সেটা খুলে সাধারণ বেণী বেঁধে দিলো। এরপর চোখের কোণ থেকে একটু কাজল হাতের আঙুলে লাগিয়ে আমার কপালের একপাশে লাগিয়ে দিয়ে বললো,,,

‘ আমার পরির মত আপু টার দিকে কারোর নজর না লাগুক ।’
আমি ওর এই পাগলামিতে হেসে উঠলাম। মরিয়ম হাসতে হাসতে বলল আমরার বউমনি হাছাই মেলা সুন্দর।বাইজান জিতছে এমন পরির লাহান বউ বিয়া কইরা। আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক হলেও ভিতরে ভিতরে আমি একটুও স্বাভাবিক হতে পারছি না। মনে বারবার জানান দিচ্ছে যে কোন না কোন সমস্যার মধ্যে আমাকে পড়তে হবে। তাছাড়া এই বাড়িতে ঢুকেই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এতোক্ষণ ধরে আছি এখানে অথচ এই হাতে গোনা কয়েকজন কে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। কৌতুহল হল প্রচুর।তাই মরিয়ম কে জিজ্ঞেস করলাম,,,,

‘ আচ্ছা মরিয়ম আপা, এই বাড়িতে কি আর কেউ থাকে না?’
আমার প্রশ্নের সাথে সাথে ই মরিয়মের মুখ খানি কালো হয়ে গেল। মুখের হাসি মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ওর।ভয় পাওয়া গলায় বলল,,,

‘ এই বাড়ির ইতিহাস জানতে চাইয়েন না বউমনি।যেমনে জানেন যেইটুকু জানেন ওইটুকু তেই ভালো হইবো আপনার। আমারে যাও জিগাইছেন,আর কাউরে ভুলেও কিছু জিগাইয়েন না।’

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৭

বিঃদ্রঃ আপনাদের রেসপন্স একেবারে কমে গেছে। এরকম চলতে থাকলে আমার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবো খুব শীঘ্রই। সেজন্য বলছি আপনারা সবাই একটু রেসপন্স করবেন আর গঠনমূলক মন্তব্য করে জানাবেন কেমন লাগছে। গল্পটা আকর্ষনীয় বড় ও সুন্দর করে তোলা এখন আপনাদের হাতে।

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৯