প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৩

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৩
লেখিকাঃ মাহযাবীন

পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী নিশি।সক্রিয়তার ক্ষেত্রে সবসময় ক্লাসে সবার থেকে এগিয়ে থাকে সে।শিক্ষকদের করা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজে একটু হিমশিম খেলেও নিজে শিক্ষকদের প্রশ্ন করে করে বিপদ থেকে মহাবিপদে ফেলার প্রতি তার যেনো তীব্র ঝোঁক।

এহসানের ক্লাসেও সে এর বিপরীত নয়।সদাসর্বদার ন্যায় কঠিন কঠিন সব প্রশ্নে আঁটকে দিতে চাচ্ছে সে এহসানকে।কিন্তু এহসানও কাঁচা খেলোয়াড় নয়।সে যেনো এ খেলায় ক্যাম্পিয়ন হবার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে আজ।
টান টান উত্তেজনা চলছে ক্লাসরুমে উপস্থিত সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে।কে জিতবে?এহসান নাকি নিশি?
অতঃপর ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো।উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটলো।প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর ও ব্যাখ্যা দিয়ে বিজয়ী ঘোষিত হলো এহসান।ঠোঁটে হাসি টেনে রেখে কক্ষ ত্যাগ করলো সে।
ক্লাসে প্রতিটা শিক্ষার্থীর মুখে মুখে ধ্বনিত হলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এহসান ভাই অনেক ব্রিলিয়ান্ট।দেখছিস কত নলেজ তার?কত সুন্দর করে বুঝায় সে!”
হেরে গিয়েও আফসোস হচ্ছে না নিশির।বরং হয়তো খানিক মুগ্ধই হলো সে।মানুষটার মধ্যে কিছু তো আছে!
এমনটা ভাবতে ভাবতেই আর্শির দিকে তাকালো নিশি।আর্শির দৃষ্টি খোলা জানালা ভেদ করে বাইরের ঝোড়ো হাওয়ায় নিবদ্ধ।তীব্র বেগে যখন বাতাস ছাড়ে, গাছপালা দোলে হাওয়ায়,রোদের তেজ হ্রাস পায়,পরিবেশ টা তখন মন কাঁড়ে।
নিশি হাত রাখে আর্শির কাঁধে। বলে ওঠে,

-কিরে,যাবি না?ব্যাগ গুছা।
ধ্যান ভাঙে আর্শির।উত্তরে কিছু না বলে ব্যাগ গুছাতে আরম্ভ করে সে।নিশিও নিজের ব্যাগ গুছাতে গুছাতে পুনরায় বলে ওঠে,
-এহসান ভাইর নলেজ ইমদাদ স্যারের থেকেও বেশি তাই না?অথচ ইমদাদ স্যার তার থেকে বয়সে ভালোই বড়।
আর্শি এ কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-হু।
-তোর মন খারাপ?
-নাহ।
-সত্যি কইরা ক তো কি হইছে?

আর্শি চুপ রইলো খানিকটা সময়।তার উত্তরটা হয়তো এমন হওয়া উচিৎ,
“জন্মের পর তোর বাপ-মা যদি তোর ভাইরে একটু মধু খাওয়াইতো আর মানুষরে ভালোবাসতে শিখাইতো তাইলে তো আর এমন কষ্ট পাইতে হইতো না আমার।খারুস ব্যাটা তার খারুসগীরি দিয়ে আমার জীবনটা তেজপাতা বানায়ে রাখছে।”
এ উত্তরখানা মনের মাঝেই রাখলো আর্শি,ঠোঁট অব্দি আনা বারণ যে।ফলে মিথ্যে বাহানা বানিয়ে নিতে হলো তার।সে বলে উঠলো,

-ঐ শকুনটার যে এতো সুনাম করতেছিস তোরা তাতে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।বুঝছিস?
হেসে উঠলো নিশি।এহসান ও আর্শির সেই সংঘর্ষের কাহিনি সে জেনেছে আজ।তাই বিষয়টা অনেকটাই পরিস্কার তার কাছে।উপভোগও করছে সে।
ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে সে কিছু বলতেই যাবে তার আগেই এক ভারী কন্ঠস্বর কানে আসে নিশির।
-এই শকুন টা কী আমি মিস.ব্লাইন্ড?

ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে রেখে উক্ত প্রশ্ন টা করে এহসান।আর্শির দিকে দৃষ্টি স্থির তার।উক্ত প্রশ্ন কানে আসতেই চোখ তুলে তাকায় আর্শি।চোখ রাখে এহসানের চোখে।প্রশ্নের উত্তর দিতে বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছুক নয় সে তবুও ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সে বলে উঠলো,

-যাক নিজেকে চিনছেন তাইলে।
-কি যে বলেন না,শকুন আর গরুর সম্পর্ক আমাদের।একে-অপরের কথার মিনিং না বুঝলে এ সম্পর্কের মান থাকবে?
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না এহসান।ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি খানা বজায়ে রেখেই ব্লাক মার্কার কলমটা নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে সে।নিশি ও আর্শি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তার পথ পানে।কি বুঝালো সে তার এই উক্তি দ্বারা?এটাই যে,আর্শি গরু?শকুন আর গরু মরার প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে সে এভাবে অপমান করে গেলো আর্শিকে?

এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বিহানের জীবন টা সুন্দর।ভীষণ সুন্দর।ঠিক যেমন টা সে চায় তার জীবন টা ওমনই।বিন্দাস বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরাফেরা করা অথবা নিজে নিজে ঘুরে বেড়ানো।দেশ-বিদেশ যেখানে ইচ্ছে সেখানে ট্যুর দেওয়া।নিজের ইচ্ছা মতো যেকোনো কিছু করতে পারা।বাঁধা দেওয়ার কোথাও কেউ নেই।স্বাধীন এক জীবন তার।

আর্শির সাথে যখন প্রতিদিন কথা হতো তখন ধীরে ধীরে এক সময় মনের অজান্তেই তাদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের থেকে অনেক উর্ধ্বে পৌঁছে গিয়েছিলো।দু’জনার দু’জনের প্রতি জন্মেছিলো তীব্র অধিকারবোধ।এই অধিকারের জোরেই অনেক ক্ষেত্রে আর্শি তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতো।এই যেমন কোনো মেয়ে ফ্রেন্ডকে নিজের বাইকে উঠালে মেয়েটা রেগে ঝগড়া করে বসতো।তার অন্য ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ডসরা তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ম্যাসেজ দিলেও আর্শি রাগ করতো।তার আশেপাশে কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারতো না আর্শি।এ নিয়ে অনেক সময়ই অযথা ঝগড়া হতো তাদের।এসবে ভীষণ বিরক্ত হতো বিহান।তার কাছে এই অযথা ঝগড়া গুলো এক চরম বিরক্তিকর প্যারায় পরিণত হয়েছিলো।যা সে তার সুন্দর জীবন টায় চাচ্ছিলো না।

এই বিরক্তিরও অবশ্য একটি কারণ আছে।বিশ্বাস না থাকলে সেখানে ভালোবাসা থাকে? আর্শি যদি তাকে সত্যিই ভালোবাসতো তাহলে তো তাকে বিশ্বাস করতো।আর যদি সত্যিই বিশ্বাসই করতো তাহলে তার মেয়ে ফ্রেন্ডস বা ভাবিদের বিষয় নিয়ে তখনও কী মেয়েটা এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখাতো?অবশ্যই মেয়েটার বিশ্বাস নড়বড়ে ছিলো নাহলে এসব বিষয়ে সে কখনোই ঝগড়া করতো না।

এসব ভেবে আর্শির রাগগুলো আরো বেশি বিরক্ত লাগতো বিহানের।এইযে এখন তাদের কথা হয় না।এখন বিহান স্বাধীন,প্যারামুক্ত।রোজ রোজ আর ঝগড়া সহ্য করতে হচ্ছে না তার।তবে আগের মতো এখন সে আর্শির ভালোবাসায় প্রশ্ন তোলে না।সে জানে তার প্রতি মেয়েটার অনুভূতি কতোটা তীব্র।
তবে প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ের প্রবণতা দেখা যায় সব থেকে বেশি।তা হলো, তারা স্বাধীন থাকতে চায়।কেউ যদি তাদের উপর বেশি খবরদারি করে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তাহলে তারা ঐ মানুষটার সঙ্গ হতে নিজেকে মুক্ত করে নিতে চায়।বিহানের ক্ষেত্রেও বিষয় টা এমনই।

এ সব কিছুর পরও,সুন্দর স্মৃতিগুলোকে তো আর মুছে ফেলা যায় না।মেয়েটার সাথে তার কতশত স্মৃতি।সময়ে-অসময়ে এই স্মৃতিগুলো তার হৃদয়েও তো কড়া নাড়ে।কথা বলার ইচ্ছেরা উঁকিঝুঁকি দেয়।কতবার আর্শির ইনবক্সে যেতে যেতেও ফিরে এসেছে সে।মেয়েটার বাচ্চামিত না এখন মেয়েটার উপর তার রাগ নেই তার, বিরক্তিও নেই।কিন্তু সে চায় মেয়েটা সামলে নিক নিজেকে।প্রশমিত হোক তার ভালোবাসা।
একদিন ঠিকই কথা হবে তাদের।ততদিনে তার বেসামাল আবেগরা শিখে নিক নিজেদের সামলানো।

সামনা সামনি বসে আছে মিয়ামি ও আর্শি।আর্শি ব্যস্ত মিয়ামিকে নোটস বুঝিয়ে দিতে আর মিয়ামি ব্যস্ত তার মনে লুকায়িত দুঃখ পাতাগুলো পড়ায়।
পড়া বুঝানোর মাঝেই আর্শি তাকায় মিয়ামির পানে।তার দিকে তাক করে রাখা মেয়েটার অপলক দৃষ্টির পানে চেয়ে ব্রু কুঁচকে এলো আর্শির।সে প্রশ্ন করে উঠলো,

-এভাবে কী দেখতেছিস?খাতার দিকে তাকা।
-বিহান ভাইর সাথে কথা হয় তোর?
-নাহ।
-কেন?
-উনি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেরে।উনার আচরণ এমন যেনো আমার সাথে কথা বলতে এখন আর উনার ভালো লাগে না।
মলিন হাসি ঠোঁটে টেনে রেখে উত্তর দিলো আর্শি।মিয়ামি পুনরায় প্রশ্ন করে উঠলো,

-কেমন পরিবর্তন?
-সব কিছুই চেঞ্জ।যেমন ধর,আগে আমাদের ঝগড়া হলে সর্বোচ্চ ১৬-১৭ দিন কথা বন্ধ থাকতো।যদিও এমন ১-২ বার হইছিলো।মোস্ট অফ দ্যা টাইম ৫-৭ দিনের মধ্যেই আমাদের রাগারাগি কমে আবারও সব ঠিক হয়ে যেতো।আর বেশিরভাগ সময় উনিই ঠিক করে নিতেন।কিন্তু এখন টানা ১ মাস কথা অফ আমাদের কিন্তু উনার তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
উত্তর শুনে কয়েক দন্ড নিরব রইলো মিয়ামি।গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

-তোর কী মনে হয় না যে তুই এমন একটা মানুষের আশায় বসে আছিস যে আসলে তোরে ভালোবাসে না?
-নাহ,আমার মনে হয় আমি এমন একটা মানুষের অপেক্ষায় আছি যে আমার মানসিক শান্তি।যার একটা ম্যাসেজ যথেষ্ট হয় আমার মন খারাপ মন ভালোতে পরিণত করতে।তার বকাগুলোও আমার কাছে প্রেমের কবিতা মনে হয়।তার খারুসগীরিতে আমি মুগ্ধতা খুঁজে পাই।

তার চেহারার দিকে তাকালেই মন যেনো জোরে জোরে চিল্লায়ে বলতে আরম্ভ করে,’এই মানুষটা আমার, একান্তই আমার’।আমার সবটুকু সুখ, সব প্রাপ্তি উনার মাঝে আবদ্ধ দোস্ত।আমার মন অন্য কোথাও আর শান্তি খুঁজে পাবে না।এই মন এখন আর অন্য কারো হইতে পারবে না।উনি কেনো বোঝে না দোস্ত? কেনো বোঝে না আমি আমার সবটুকু অনুভূতি উনার নামে লিখে দিছি?উনি ছাড়া এখন যে আমার নিজেকে খুব অনুভূতি শূন্য লাগে।

আর্শির চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা অশ্রু বিন্দু দৃষ্টি এড়ালো না মিয়ামি।বান্ধবীর ভিজে কন্ঠস্বর তার বুকেও যেনো ঝড় তুললো।ভিজে উঠলো তার চোখও।অনতিবিলম্বে সে জড়িয়ে ধরলো আর্শিকে।শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ রেখে বলে উঠলো,
-মানুষটা তোর হোক,দোস্ত।শুধু তোরই হোক।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১২

[আজ বিহান-আর্শির কাহিনিটুকু ৯০% সত্যি অর্থাৎ বাস্তব ছিলো♥️]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৪