প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১২

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১২
লেখিকাঃ মাহযাবীন

বিহানের রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকাটা বিন্দু পরিমাণ ভালো লাগে না আর্শির।বিশেষ করে যখন তাদের কথা বন্ধ থাকে তখন।এইযে এখন তাদের কথা হয় না।এখন যখন রাত ১-২ টার মধ্যে বিহান অফলাইনে চলে যায় তখন একা একাই মৃদু হেসে ওঠে আর্শি।

হয়তো এটা ভেবেই খুশি হয় যে ছেলেটা অন্তত অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে না।সাধারণত ছেলেটা সবসময় রাত ১-২ টার মধ্যে ঘুমিয়ে যায়।তবে মাঝেমধ্যে সে অনেকটা রাত জাগে।রাত জেগে সিনেমা দেখে অথবা ওয়েব সিরিজ।আবার কিছু কিছু রাত বিহান আর্শির নামেও লিখে দিতো।তাদের কত যে গল্প হতো সে রাতগুলোয়!কত মুগ্ধতারা যে সুবাস ছড়াতো তখন!সুন্দর দিনগুলো এভাবে হারিয়ে যায় কেনো?কেনো সুন্দর সময় গুলো স্মৃতি হয়ে মনে বিষাদ জমায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর্শি।অপলক তাকিয়ে রয় বিহানের আইডিতে জ্বলতে থাকা সবুজ আলোর দিকে।বুকের কোথায় যেনো এক সূক্ষ্ণ দুঃখ নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।না চাইতেই তার মস্তিষ্ক বলে উঠলো,
“বিহান হয়তো অন্য কোনো মেয়েতে মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে”
মস্তিষ্কের এমন চিন্তের তীব্র বিরোধিতা জানালো হৃদয়।বলে উঠলো,

“নাহ,বিহান আমার।উনি ‘ভালোবাসি’ না বললেও আমি তো জানি উনি আমার।আমি ছাড়া অন্য কেউতে উনি মুগ্ধ হবেন নাহ।একটুও না।”
এ সান্ত্বনা বাক্যে মস্তিষ্ক খুব একটা সন্তুষ্ট হলো না।তবে বিরোধিতাও আর করলো না।যে চিন্তা মনকে একটু স্বস্তি দেয় তা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ক্ষতি কী?
আর্শির এসব চিন্তার মাঝেই নিশির খুদে বার্তা আসলো।বিহানের আইডি থেকে চোখ সরিয়ে নিশির ম্যাসেজ খানা দেখলো আর্শি।
খুদে বার্তা খানা,

“এহসান ব্যাটা টা দেখতে ভালোই, তাই না?”
মেজাজ বিগড়ে গেলো আর্শির।ক্রুদ্ধ চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে হাত চালালো সে।লিখলো,
-ঐ বজ্জাত ব্যাটারে তোর ভাল্লাগছে? চোখ আছে নাকি নাই? দেখলি না কী শকুনের মতো আচরণ তার?

আর্শির ম্যাসেজ চোখে পড়তেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো নিশি।হাসতে হাসতে লিখলো,
-তুই ক্লাসে মনোযোগ না দিলে অ্যাজ অ্যা টিচার সে তো বকবেই তাই না?
-সাপোর্ট করছিস ঐ লোকরে?এতো ভালো লেগে গেছে তারে?
-আরেহ নাহ।মানলাম তার চেহারা ভালো,আজ পড়াইছেও ভালো কিন্তু তাই বলে এতোও ভালো না যে প্রথম দিনেই তারে আমার ভালো লেগে যাইতে হবে।আচ্ছা দোস্ত ছুটির সময় আমরা যখন ক্লাস রুম থেকে বের হচ্ছিলাম তখন এহসান ভাই তোর কানের কাছে ফিসফিসায়ে কি বলছিলো রে?

নিশির প্রশ্নে তখনের কথা মনে পরলো আর্শির।ছুটির পর সবাই একে একে বেরিয়ে যাওয়ার পর সবার শেষে আর্শি ও নিশি বের হচ্ছিল।তখন এহসানের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় এহসান আর্শির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিলো,
“অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না মিস. ব্লাইন্ড”

এ কথা কানে আসতেই আর্শি চোখ গরম করে তাকিয়েছিলো এহসানের দিকে।দু’জনের চোখাচোখি হতেই এহসান বাঁকা হেসে সে স্থান ত্যাগ করেছিলো।
উক্ত স্মৃতি মনে পড়তেই রাগ হলো আর্শির।লিখলো,
-অনুরোধ করছিলো যেনো তার নামে অভিযোগ না করি।
খানিকটা অবাক হলো নিশি।ব্রু কুঁচকে রেখে বার্তা পাঠালো,

-আসলেই? দেখলি না ক্লাস শেষে সব স্টুডেন্টসরা কেমন সুনাম করতেছিলো তার।এখানে তুই একা অভিযোগ করলে তার কী-ই বা ক্ষতি হতো?এতোটা বোকা তো না এই লোক।শুধু শুধু অনুরোধ কেন করবে তোরে?
রাগের পরিমাণ আরো বাড়লো আর্শির।দাঁতে দাঁত চেপে হাত চালালো সে,
-নাহ সে বোকা না।আমি মিথ্যুক।খুশি? আর ম্যাসেজ দিবি না আমারে খবরদার।
অপাশ থেকে নিশির দ্রুত সাড়া মিললো।সে লিখেছে,

-দোস্ত,বিহান ভাইয়া কল দিছে।একটু ওয়েট কর।কথা শেষ করে রাগ ভাঙাচ্ছি তোর।
উক্ত বার্তায় দৃষ্টি স্থির রাখলো আর্শি।তার সময় যেনো ঐ ‘বিহান’ নাম টা দেখে ওখানেই আঁটকে গেছে।কেমন আছে ছেলেটা?কী চলছে এখন তার জীবনে? একটু কী জিজ্ঞেস করবে নিশিকে?
উহু নাহ।নিশি বিষয়টা ভালোভাবে নাও নিতে পারে।

মিয়ামি পড়ার টেবিলে।পড়ায় গভীর মনোযোগ তার। গত ১ ঘন্টা যাবত পড়ছে মেয়েটা।তার পাশেই আর্শ বসে খবরের কাগজে চোখ বুলচ্ছে।আবার ফাঁকে ফাঁকে মিয়ামির দিকে তাকাচ্ছে।কয়েকবার চোখাচোখিও হলো তাদের দু’জনার।পুনরায় দৃষ্টি সরিয়ে যে যার কাজে ব্যস্তও হয়েছিলো তারা।কিন্তু এখন আর ভাল্লাগছে না মিয়ামির।১ ঘন্টা বসে থেকে কোমড় ধরেছে তার।কই আগে তো একটানা ২-৩ ঘন্টাও এ টেবিলে বসে পড়ায় কাটিয়ে দিতো সে।তখন তো এমন কোমড় ব্যথা হতো না।তাহলে এখন কেনো এ ব্যথা?এটাও কী প্রেগ্ন্যাসির জন্য?

বুঝলো না মিয়ামি।তবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না তার দ্বারা।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।আর্শ ব্রু কুঁচকে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেই যাবে তার আগেই সে বলে উঠলো,

-কোমড়ে ব্যথা হচ্ছে অনেক।আর বসতে পারবো না।
আর্শ উত্তরে কিছু বললো না।কুঁচকে রাখা ব্রু স্বাভাবিক করে সে উঠে কক্ষ ত্যাগ করলো।
কোথায় গেলো ছেলেটা?ভাবে একবার মিয়ামি।কিন্তু ক্লান্তিতে বিছানায় বসে পড়লো সে।ইচ্ছে হলো না উঠে কোথাও যেতে।আজকাল কেনো যে এতো ক্লান্ত লাগে তার?বিরক্ত সে নিজের এসবে।

খুব একটা দেরি হলো না আর্শের।কয়েক মিনিটের মাঝেই হাতে এক গ্লাস জাফরান মেশানো দুধ নিয়ে হাজির হলো সে।মিয়ামির দিকে এ গ্লাস এগিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় খেতে বললো সে।
জাফরান মেশানো ঘন খাঁটি গরুর দুধ বেশ লাগে মিয়ামির।তাই বাহানা না করে গ্লাস হাতে নিলো সে।আর্শ বসলো মিয়ামির কাছে।দুধ পান শেষ হবার পর গ্লাস টেবিলে রাখলো আর্শ।মিয়ামি কিছুক্ষণ আর্শের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে উঠলো,

-প্রতিদিন সকালে এক্সার্সাইজ করো ঠিকমতো?
-হু।
-মেডিটেশন?
-হু।
-নিজেকে ব্যস্ত রাখা,চিন্তামুক্ত রাখা আর খুশি রাখা তোমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ বুঝো?
-হু।
-সেসব দিকে খেয়াল রাখতেছো?
-কী মনে হয় দেখে?
-কই আর দেখি?দেখার সুযোগ পাই?
-এইযে এখন দেখতেছো।
-কী?

এ প্রশ্নে ঠোঁটটা খানিক প্রশস্ত হলো আর্শের।মিয়ামির থেকে নিজের দূরত্ব কমালো অনেকটা।হাত রাখলো মেয়েটার গালে।নাকে নাক ঘষে নিম্ন স্বরে বলে উঠলো,
-নিজের সবটুকু দুঃখ,দুশ্চিন্তা ভুলে মনটাকে প্রশান্তি দেওয়ার জন্যেই তো ছুটে আসি নিজের ঘুমের কাছে।

-ঘুম?
-হু,তুমি আমার ঘুম মিয়ু।তুমি আমার প্রশান্তিময় ঘুম।
উক্ত বাক্য খানা বলে মিয়ামির কপালে কপাল ঠেকায় আর্শ।মিয়ামিও মুগ্ধ হৃদয়ে বুঁজে নেয় নিজের আঁখিদ্বয়।আর্শ নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,

-তুমি ঘুম হয়ে এসো মেয়ে,রোজরাতে আমার ক্লান্ত দু’নয়নের স্বস্তি হয়ে এসো।
উত্তরে কিছু বলতে পারলো না মিয়ামি।অতি আবেগ তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।সে কাছে টেনে নিলো নিজের পুরুষটাকে।চুমু এঁকে দিলো আর্শের দু’চোখে।প্রেমের মাদকতা বৃদ্ধি পেলো যেনো।আর্শের চোখে প্রকাশ পেলো তীব্র ঘোর।বিছানায় আলতো করে সে শুইয়ে দিলো মিয়ামিকে।

নিজেও তার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে মাথা রাখলো মেয়েটার পেটে।ক’সেকেন্ডের মাঝেই সেথায় গভীর এক চুমু এঁকে দিলো আর্শ।কেঁপে উঠলো মিয়ামি।শক্ত করে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো আর্শের কাঁধ ও চুল।আর্শ একের পর এক ছোট চুমু বসাতে বসাতে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলো।মুখ ডুবালো মেয়েটার গলায়।ছোট্ট ছোট্ট চুমুর বর্ষণ থামে ক’সেকেন্ডের মাঝে।ঘোর লাগা চোখে ছেলেটা একবার তাকায় নিজের স্ত্রীর মুখ পানে।মিয়ামি চোখ বুঁজে রেখেছে।এ মুখপানে তাকিয়ে আর্শ পাড় করে দেয় কয়েক প্রহর অতঃপর মেয়েটার গলায় মুখ গুঁজে বুঁজে নেয় নিজের চোখজোড়া।

সানিয়া বেগম ও আরহান সাহেবের দিন যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়।শেষে কিনা তাদের ছেলে এমন একটা বাজে কাজে জড়িয়ে গেলো?বিষয়টা মানতে পারছেন না তারা নাকি মানতে চাইছেনই না।আর্শ সত্যিই এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে তো?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সানিয়া বেগম।ভিজে চোখ আঁচলে মুছে নেন তিনি।মনে মনেই বলে ওঠেন,

“ইয়া আল্লাহ, আমার ছেলের সহায় হোন”
দোয়া শেষ হতে না হতেই স্বামীর ডাক শুনতে পান সানিয়া বেগম।দ্রুত গতিতে অগ্রসর হোন তিনি নিজের কক্ষের দিকে।
কক্ষে সানিয়া বেগম প্রবেশ করতেই আরহান সাহেব জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-তোমার গুণধর ছেলে কোথায়?
-অফিসের জন্য তো বেরোলো সকালে।
-ওহ,মিয়ামির কল দিয়েছিলো একটু আগে।

-তাই নাকি!আমি তো ওর জন্যই রান্নায় ব্যস্ত।ভাবছিলাম বিকেলে যেয়ে ওর জন্য ওর পছন্দের সব খাবারগুলো দিয়ে আসবো।
-ভালো ভেবেছো।মেয়ে তো তোমার অভিমান করে বসে আছে।তুমি নাকি খোঁজ-খবর নেও না।

বলে মৃদু হাসলেন আরহান সাহেব।সানিয়া বেগম আর হাসলেন না।বলে উঠলেন,
-মনে যে ঝড় চলছে তা-ই তো সামলে উঠতে পারছি না।ওর খবর কী করে নেবো?
হাসি মলিন হলো আরহান সাহেবের।একটি দীর্ঘশ্বাস তিনিও গোপন করলেন।বলে উঠলেন,

-মিয়ু জোর দিয়ে বলেছে,আর্শকে একদম একা না রাখতে।সকালে ওর শারীরিক ব্যায়াম,মেডিটেশন ঠিকঠাক করছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে।ছেলেটা যত টেনশন ফ্রী, হাসিখুশি থাকবে ততই ঐ ড্রাগস থেকে ও দ্রুত বের হয়ে আসতে পারবে।
-দেখেছেন আমরা স্ত্রীরা সংসার থেকে দূরে থাকলেও আমাদের মন আমাদের স্বামী,সংসারের সাথে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থাকে?মেয়েটা নিজে শারীরিক ভাবে ঠিক নেই তাও নিজের বাপের বাড়ি বসে শশুর বাড়িতে খবর পাঠাচ্ছে তার স্বামীর যত্ন নেওয়ার জন্য।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১১

কথাগুলো হাসতে হাসতে বললেন সানিয়া বেগম।মুগ্ধতার হাসি ফুটে উঠেছে আরহান সাহেবের ঠোঁটেও।স্ত্রীকে নিজের বুকে টেনে নিলেন তিনি।মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে উঠলেন,
-শীগ্রই ইন শাহ আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে সানিয়া।আমাদের আর্শ সুস্থ হয়ে যাবে,মিয়ামি ফিরে আসবে সেই সাথে আমাদের ছোট্ট আর্শও।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৩