প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৭

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৭
লেখিকাঃ মাহযাবীন

“মামনী কেনো সময় নিচ্ছে? কেনো কিছু দিন পর আমাকে ফিরতে বললো?আমাকে মিস করে না সে?মিস করলে তো ঐদিনই আমাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতো তাই না?”
উদ্বিগ্ন কন্ঠে উক্ত প্রশ্ন ছুড়লো মিয়ামি।আর্শের কন্ঠ শীতল। সে শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-মা আর আর্শির ভেতর খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, টপ সিক্রেট রেসিপিতে।আমার আর বাবার তো ঘ্রাণ অব্দি পাওয়া বারণ।তাদের ভাষ্য মতে আমি আর বাবা পেট-পাতলা তাই।বুঝলে?

ঠোঁটে হাসি ফুটলো মিয়ামির।নেতিয়ে পরা মন সতেজ হলো তার।উত্তেজিতও হলো খানিক।সে উচ্চ শব্দে প্রশ্ন করে উঠলো,
-মামনী আর আশু(আর্শি) আমার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করতেছে?
উত্তরে নিরব হাসলো আর্শ।মিয়ামি না দেখেও সে নিরব হাসি অনুভব করলো।বুঝলো আর্শের সম্মতি।মনে খুশির জোয়ার এলো তার।জোরে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে সে বলে উঠলো,
-আমার ছেলে কতো লাকি দেখছো?এত্তোগুলা ভালোবাসা পাবে সে পৃথিবীতে এসে।
-সবথেকে বেশি ভালোবাসা পাবে তার বাবার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-এহ্ খবরদার, যদি আমার থেকে বেশি ওকে ভালোবাসছো তো তোমার খবর করে ছাড়বো।হুহ্!
উক্ত বাক্য কানে আসতেই শব্দ করে হেসে উঠলো আর্শ।হাসতে হাসতেই বলে উঠলো,
-হিংসুটে একটা!নিজের বাচ্চাটাকে অন্তত রক্ষা দেও।
-নাহ।নো রক্ষা।আমার জামাইর ভালোবাসা ওর সাথে ভাগ করবো কেন?ও কী ভবিষ্যতে ওর বউর ভালোবাসা আমার সাথে ভাগ করবে?
আবারও হেসে উঠলো আর্শ।আর্শের হাসির শব্দ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শুনলো মিয়ামি।কয়েক প্রহর কাটিয়ে দিলো এভাবে।অতঃপর সে বলে উঠলো,

-জানো আমি কত্তো চাইছিলাম আমাদের একটা মেয়ে হোক।যাতে ওকে আমি আমার মনের মতো সাজায়ে-গুছায়ে রাখতে পারি।কিন্তু তা আর হলো না।ছেলেদের কী আর সাজানো যায়?
-আর আমি মন থেকে চাচ্ছিলাম আমাদের একটা ছেলে হোক।সে একদম তার বাবার মতো হোক।তার বাবা যেমন তার মাকে এক বুক ভালোবাসায় আগলে রাখে সেভাবেই সেও আগলে রাখুক।যদি কখনো আমি না থাকি তখন আমাদের ছেলে আমার শূন্যতা পূরণ করুক,তার মাকে খুব যত্নে রাখুক যেভাবে তার বাবা রাখে।

-যদি কখনো তুমি না থাকো তাহলে মিয়ামিও থাকবে না।আর্শ ছাড়া মিয়ামি ব্যাটারি ছাড়া রিমোট এর মতো।ব্যাটারি ছাড়া রিমোট চলে? সো কারেক্ট করে বলো যে, আমি এন্ড আমার ছেলে দু’জনে মিলে প্রিয় মানুষগুলোকে আগলে রাখবো।
স্নান হাসলো আর্শ।আকাশের চকচকে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো,

-জন্ম-মৃত্যু মানুষের হাতে নেই মিয়ু।কোনো নিশ্চয়তা নেই আমরা আর এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকতে পারবো কিনা।মৃত্যু তো হুট করেই এসে হাজির হয়।মানুষের চলে যেতেই হয়।কারণ তারা মাটির তৈরি, মাটিতেই মিশে যেতে হবে।যার মৃত্যু আসে সে তো যেতে বাধ্য কিন্তু মৃত্যুর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তার প্রিয় মানুষ গুলোর।তারা হয়তো মৃত্যু কামনা করে কিন্তু মৃত্যু তো নির্ধারিত সময়ের এক সেকেন্ডও আগে আসবে না।তাই দুঃখু বুকে পুষে বেঁচে থাকতেই হয় মানুষদের।অপেক্ষা করতে হয় মৃত্যুর।আর মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে এক সময় তারা আবারও বাঁচতে শিখে যায়।
কথাগুলো বলে থামে আর্শ।ফোনের ওপাশের মানুষটা নিরব নিস্তব্ধ।আর্শ বুঝলো ওপাশে শ্রাবণ ধারা বইছে।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আর্শ। বলে উঠলো,

-যদি আমি কখনো না থাকি তবুও তুমি বাঁচবে মিয়ু।খবরদার আবেগে ভেসে বাচ্চামি করবে না।আমি না থাকলেও আমার অংশ তো থাকবে তোমার কাছে থাকবে না?ওকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে থাকবে তুমি।দেখবে আমার ছেলে তার মাকে তার বাবার থেকেও কয়েকশত গুণ বেশি ভালোবাসবে।
কানতে কানতে এবার হেঁচকি উঠে গেলো মিয়ামির।থেমে থেমে প্রশ্ন করে উঠলো,
-তুমি ২-৩ দিন ধরে এমন সব কথা কেনো বলতেছো আর্শ?কেনো থাকবা না তুমি?তোমাকে ছাড়া আমি শ্বাস নিতে পারবো না একটুও পারবো না।

এতোটুকু বলে আবারও কাদতে আরম্ভ করলো মিয়ামি।শব্দ করেই কাঁদছে সে।
এক ফোটা অশ্রু আর্শের চোখের কোণ বেয়েও গড়িয়ে পড়লো।ছেলেটা হাতের উল্টো পাশ দিয়ে তা মুছে নিলো।মনে মনে বলে উঠলো,
“তোমাকে একা ফেলে আমিও যেতে চাই না মিয়ু।একটুও চাই না।আমার সন্তান বাবা নামক ছায়া ছাড়া বড় হোক তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে চাই না।কিন্তু কেনো যেনো মন কু’ডাক ডাকছে।কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরে রেখেছে আমায়।প্রতি মুহুর্ত ভয় হচ্ছে আমার, ভয় হচ্ছে তোমাদের একা ফেলে চলে যেতে হবে না তো আমার?”

অনেকদিন পর সেদিন একটুখানি কথা হয়েছিলো আর্শির বিহানের সাথে।অল্প একটু কথা বলেই আবারও ঝগড়া হয় তাদের, আবারও কথা বন্ধ। আর্শি যতই চেষ্টা করুক ঝগড়া না করার তবুও তা হয়ই।সময়ের সাথে একটা বিষয় খুব করে অনুভব করছে আর্শি।তা হলো,

একটা সম্পর্ক সুন্দর রাখার জন্য সম্পর্কে আবদ্ধ দুটো মানুষের উভয়েরই সমান পরিমাণ চেষ্টা করতে হয়।এই সম্পর্ক নামক গাছটা ভীষণ অভিমানী হয়।সে চায় উভয়ের থেকেই সমপরিমাণ যত্ন পেতে।কিন্তু যখন এক তরফ থেকে যত্নে ত্রুটি হয় তখন অপর তরফ থেকে যতই যত্ন করা হোক না কেনো গাছ আর সতেজ থাকতে চায় না।সে অভিমানে, দুঃখে নুইয়ে পড়তে থাকে।তারপর ধীরে ধীরে একসময় সে মরে যায়।এতো স্বার্থপর কেনো হয় এই সম্পর্ক নামক নাজুক গাছ টা?কেনো সে এক তরফের অবহেলা পেয়ে মরতে রাজি কিন্তু অপর তরফের মানুষটার হাজার চেষ্টা, অসংখ্য যত্ন,অসীম ভালোবাসা দেখেও বাঁচতে পারে না?কেনো নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর হয় ঐ তরফের ব্যক্তিটির উপর?কেনো এতো চেষ্টার পরেও অসফল হয় তারা?

প্রশ্ন গুলো মনে মনে আওড়ানোর মাঝেই হুট করে ধ্যান ভাঙলো আর্শির।কোচিং ক্লাস শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।সে এক বই খুলে চুপচাপ তাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো।হটাৎ বইয়ের উপর একটা কাগজ পড়তে দেখে চমকালো সে।তাকালো আশপাশে।নাহ তার পাশে তো কেউ বসেনি।তাহলে জানালা দিয়ে কেউ দিয়েছে?ভাবতেই জানালার দিকে চাইলো আর্শি। নাহ কেউ নেই।
খুঁজায় ব্যর্থ হয়ে কাগজখানা হাতে তুলে তাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আর্শি।তাতে লেখা,

“আই অ্যাম স্যরি মিস.ব্লাইন্ড।রেইলি স্যরি।”
এবার আর্শি বুঝলো এটা কে দিয়েছে।সে নিঃশব্দে কাগজটা মুচড়িয়ে জানালা হতে বাইরে ফেলে দিলো।দূর থেকে কেউ একজন দেখলো তা।নিরাশ মনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
এমন সময়ই উপস্থিত হলো নিশি।আর্শিকে দেখে দ্রুত পদে তার কাছে ছুটে এলো।পাশ থেকে আর্শিকে ঝাপটে ধরে বলে উঠলো,

“দোস্ত মাফ করে দে না?প্লিজজজজজজ”
আর্শি নিশির বাহুবন্ধন হতে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে উঠলো,
-যা না তোর এহসানের কাছে যা।তার সাথে হাসিঠাট্টা কর,যা।
এবার আর্শিকে ছাড়লো নিশি।একরাশ অস্বস্তি, লজ্জাভাব নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে নিম্ন স্বরে সে বলে উঠলো,
-দোস্ত আই থিংক আই লাইক হিম।
আর্শি তাকালো নিশির দিকে।রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,
-তা আগেই বুঝছি।এতো ঘটা করে বলার কিছু নেই।
-কেমনে বুঝলি?

-ব্যাটার সামনে যে একদম মিস.পার্ফেক্ট হয়ে যাস, নির্লজ্জের মতো তাকায়ে থাকিস তাতেই বুঝা যায়।
-ওহ শিট দোস্ত! তাহলে কী এহসানও বুঝে গেছে? ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা!
নিশির কথায় হেসে ফেললো আর্শি।আরো ক’খানা কথা শুনিয়ে মেয়েটাকে চেতানোর প্রস্তুতিও নিয়ে নিলো সে মনে মনে।
বন্ধুত্ব এমনই।এখানে ‘রাগ’ নামক অনুভূতিটা খুবই ক্ষণ স্থায়ী।
এক ক্লাস শেষ। ৫ মিনিটের ব্রেক।অতঃপর আইসিটি ক্লাস শুরু হবে।আর্শি ব্যাগ রেডি করে বেরোলো।তার পিছু পিছু নিশিও বেরোলো।পেছন থেকে প্রশ্ন করে উঠলো,

-তুই সত্যিই আজ থেকে আর আইসিটি ক্লাস করবি না?
-নাহ।
-দোস্ত ক্ষতি তো তোরই হবে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ সাথে তোদেরও ক্ষতি হলো।এখন থেকে আর দু’জনে মিলে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে পারবি নাহ।
-উফ,বললাম তো স্যরি। আর হবে না।

-দেখ নিশ,জোর করিস নাহ।আমার ইচ্ছা হলে পরে আবার ক্লাস করা স্টার্ট করবোনে।বাট এখন নাহ।
উত্তরে আর কিছু বললো না নিশি।নিশির নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো আর্শি।নিশিও ক্লাসে ফিরে যেতে অগ্রসর হলো।তবে মাঝ রাস্তায় আবার থামতে হলো তাকে।এহসান তাকে প্রশ্ন করে উঠলো,
-নিশি?কী ব্যাপার আর্শি চলে গেলো দেখলাম?

-জ্বি।আসলে সেদিনের ঘটনায় ও অনেক বেশিই রেগে গেছে।এখন বলতেছে আইসিটি ক্লাস আর করবে না।
নিশির উত্তর কানে আসতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এহসানের।কী এমন করেছে সে?একটু মজাই তো?তাতে এতো রাগ?স্যরি বলার পরও কেন এতো রেগে থাকতে হবে?
নাহ, বিষয়টিকে এভাবে চলতে দিবে না সে।সীমালঙ্ঘন করতে হলেও করবে সে।মেয়েটা অল্প সময়েই এভাবে তার হৃদমাঝারে জায়গা বানালো কেন?এর শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে।

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৬

[বিড়ালের আচর খেয়ে এখন হসপিটালে দৌড়ানো লাগতেছে ভ্যাকসিনের জন্য 🙂
শুভ পহেলা ফাল্গুন প্রিয় পাঠক মহল ♥️]

প্রণয় আসক্তি সিজন ২ পর্ব ১৮