প্রণয় বিরহ পর্ব ১০

প্রণয় বিরহ পর্ব ১০
অর্ষা আওরাত

গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বের করে বাইরের বিকেলের স্নিগ্ধ আভা অবলোকন করছি কিয়ৎক্ষন যাবত। কেনো জানি মন থেকে ইহাদ ভাইয়াকে নিজের পাশে দেখতে ইচ্ছে করছে না বিধায়ই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। হাতে ঠান্ডা পানির ছিটা পড়তেই হুশ ফিরে! এতোক্ষণ যাবত বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কোনোকিছুই ভালো করে খেয়াল করিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিলাম কেবল।

পানির ছিটা হাতে পড়তেই বাইরে ভালো করে দেখলাম হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে! বৃষ্টির স্নিগ্ধ পানির ছোঁয়া আমার হাত ছুঁয়ে চোখেমুখেও তার ঠান্ডা পরশ দিয়ে যাচ্ছে! আমি সানন্দে বৃষ্টির পানির সঙ্গে তালি মিলিয়ে যাচ্ছি হঠাৎই ইহাদ ভাইয়ার ধমক শুনে হাত জানলার বাহির থেকে ভেতরে নিয়ে আসলাম। ইহাদ ভাইয়া গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার সঙ্গে যাওয়ার থেকে ঠান্ডা বৃষ্টির পানির ছোঁয়াই উপভোগ করছিলাম বেশ। এখন মাথা নিচু করে বসে আছি ভালো লাগছে না! একটু ঝাকুনি নিয়ে গাড়ি থেমে গেলো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম শপিং মলে এসে পড়েছি। সবার আগেই আমি তড়িঘরি নামি ইহাদ ভাইয়ার পাশ থেকে। গাড়ি থেকে নামতেই মা, কাকীমা, ঝেঠিমারা মিলে এক শাড়ির দোকানে শাড়ি দেখছে আমি আর বৃষ্টি আপু দাঁড়িয়ে রয়েছি কোন দোকানটায় আগে যাবো বলে তখনি দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো একটা দোকানের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা সেহেরিশ নাম মানুষটির দিকে! তাকে দেখতে পেয়েই আমি কিছু বলার আগেই বৃষ্টি আপু তাকে ডাক দিয়ে বলতে লাগলো,

–“সেহেরিশ ভাইয়া আপনি তো একলাই দাঁড়িয়ে আছেন। মা’য়েরা শাড়ি দেখছে চলুন আপনিও আমার আর জুঁইয়ের সাথে মিলে কাপড় পছন্দ করে দিবেন না হয়?”
-“হ্যাঁ তাও ঠিক বলেছো বৃষ্টি। এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে চলো তোমাদের সাথে যাওয়া যাক। মনে হচ্ছে তুমি না ডাকলে আমাকে সারাক্ষণই এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।”

শেষোক্ত বাক্যটির লাইনগুলো যে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না আমার। কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভাবে পাশের দোকানে নিজেদের জন্য কাপড় দেখছি আমি আর বৃষ্টি আপু। হঠাৎই আমার চোখ আটকে যায় একটি কালো রঙের শাড়িতে! অসম্ভব সুন্দর কালো রঙের শাড়িটি পাড়ের দিকটায় সাদা আর লাল রঙের ডিজাইন পুরো শাড়ির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে চারগুন করে! যেই না শাড়িটিকে ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়িয়েছি তখনি ইহাদ ভাইয়া এসে ছো মেরে শাড়িটি নিজের হাতে নিয়ে বললো,

–“আংকেল এই শাড়িটি প্যাকেট করে দিন। এই সুন্দর শাড়িটি অন্য কারোর চেয়ে কেবল আমার বউয়ের গায়েই মানাবে।”
দোকানদার আংকেলও কোনো কথা না বলে ইহাদ ভাইয়াকে শাড়িটি প্যাকেট করে দিয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারলাম না আমার পছন্দ করা শাড়িটিই কেনো নিতে হলো ইহাদ ভাইয়াকে? এটা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার নাকি ওনি ইচ্ছে করে করছে এসব?

কিছুই বুঝতে পারছি না! ওনাকে দেখলে এখন রাগের মাত্রা শরীরে বেশ ভালো করেই উৎপন্ন হয়। তাই বাধ্য হয়ে চললাম অন্য দোকানে বৃষ্টি আপু আর সেহেরিশ ভাইয়াকে রেখে। ইহাদ ভাইয়াও তার কার্য সিদ্ধি করে চলে গেছে! অন্য দোকানে গেছি ঠিকই কিন্তু কোনো শাড়িতেই মন বসছে না!

মন পড়ে আছে সেই কালো রঙের শাড়িটিতে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দোকান ছেড়ে ওঠে যেতেই একটা কালো রঙের লেহেঙ্গা আমার সামনে এনে ধরে সেহেরিশ ভাইয়া! যদিও বা আমি শাড়ি পছন্দ করেছিলাম কিন্তু এই কালো রঙের লেহেঙ্গাটিও চোখ ফেরাতে বাধ্য! কালো রঙের ভিতরে গোল্ডেন কালারের ডিজাইন পুরো লেহেঙ্গা জুরে। কলোর ভিতর গোল্ডেন কালার টা লেহেঙ্গার উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে আরো। সেহেরিশ ভাইয়া বলে ওঠলেন,

–“এই লেহেঙ্গা টা আমি নিজে তোমাকে উপহার দিলাম আশা করি তুমি সেটা গ্রহন করবে জুঁইফুল?”
ভাইয়ার আকুতি ভরা কোমল কন্ঠের কথা ফেরাতে পারলাম না। নিয়ে নিলাম লেহেঙ্গাটি। শাড়িটি নিতে না পারায় যতোটা মন খারাপ ছিলো লেহেঙ্গাটি নেবার পর সেই মন খারাপ এক নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। বৃষ্টি আপুও তার শপিং করা শেষ করে ফেলে।

আমরা তিনজন মিলে মায়েদের কাছে যেতেই দেখতে পেলাম ইহাদ ভাইয়ার হাতে লাল টুকটুকে রঙের একটি বেনারসি! হয়তো প্রিমা আপুর জন্যই পছন্দ করেছে শাড়িটি। আমি নির্বাক হয়ে বসে রয়েছি সেখানে আমার আর কিছু বলার নেই। অবশেষে সবার শপিং করা শেষ হতেই আমি আগেভাগে গিয়ে একদম পিছনের সিট টায় গিয়ে বসি। সবাই যখন বলাবলি করছিলো আমি কোথায়? ত

খনি সেহেরিশ ভাইয়া গাড়িতে আসার সময় বলে দিলো আমি নাকি গাড়িতেই আছি। গাড়িতে বসে রাস্তার দিকে সাজিয়ে রাখা কিছু ফুলের দিকে দৃষ্টি পড়তেই বিমোহিতো দৃষ্টি নিয়ে ফুলগুলো দেখে যাচ্ছি। হঠাৎই গাড়ির স্টার্টের শব্দ শুনে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আগের মতনই সবাই গাড়িতে ওঠে বসেছে শুধু আমার পাশে সেহেরিশ ভাইয়া বসেছে! ইহাদ ভাইয়াই ড্রাইভিং করছে কবে লুকিং গ্লাসে দেখতে পেলাম সে বারবার আড়চোখে আমার আর সেহেরিশ এর দিকে তাকাচ্ছে যা মোটেও আমার দৃষ্টি এড়ালো না! পুরো রাস্তায় আমি আর কোনো কথা বলিনি চুপচাপ ভাবেই ছিলাম সর্বক্ষন! একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেছে আমিও নেমে গেছি বাড়ির দিকে যাবো তখনি সেহেরিশ ভাইয়ার পিছু ডাকে থমকে দাঁড়াই,

–“জুঁইফুল ওই শাড়িটি তোমাকে দিতে পারিনি কিন্তু লেহেঙ্গা টা কিছুটা ওই শাড়ির মতনই তুমি এটা ইহাদের বিয়ের দিন পড়ো?”
–“আপনি না বললেও এই শাড়িটি আমি পড়বো।”
-“আজকে কি সূর্য্য অন্যদিকে ওঠেছে? নাকি আজকের দিনটাই অন্যরকম! না হলে জুঁইফুল এতো তাড়াতাড়ি এতো সহজে সেহেরিশের কথা মেনে নিচ্ছে?”

ওনার কথায় রাগের বদলে আমার হাসি পেয়ে গেলো! আর কোনো কিছু না বলে চলে আসলাম বাড়ির ভেতর। পিছন দিক ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেহেরিশ হাসোজ্জল মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর সেহেরিশ এর ঠিক পিছনে ইহাদ ভাইয়া চোখ মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে! যেনো কোনো কিছু নিয়ে রেগে আছে হয়তো। ওসব দিকে ধ্যান না দিয়ে আমি আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম।

পেটে ক্ষিদের উপদ্রব হতেই ঘুম থেকে ওঠে গেলাম। ক্ষিদে নিবারন করেই রুম এসে বসলাম। মাত্র ঘুম থেকে ওঠায় এখন আর ঘুম আসছে না। চোখ বোলালাম বইয়ের পাতায় কিন্তু তাতেও মন বসছে না! উপায়ন্তর না পেয়ে জানলার পাশ ঘেঁসে বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি হঠাৎই চোখ পড়লো ইহাদ ভাইয়া এতো রাত্রে কারো সাথে কথা বলছে! হ্যাঁ হয়তো সেটা প্রিমা আপু ছাড়া আর কেউ হবে না।

স্মৃতির পাতায় ডুব দিলাম আজ থেকে ঠিক একবছর দু মাস আগে এভাবেই আমার সাথেও গভীর রাত করে কথা বলতেন ইহাদ ভাইয়া! উনি বিদেশে যাবার কয়েকমাস পড় থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ হতো। তখন খুব মিষ্টি করে কথা বলতো তিনি আমার সাথে। খুব বেশিও ফোন দিতো না কাজের চাপে কিন্তু সপ্তাহে একদিন অন্ততো ফোন দিতো। তখন আমাদের কতো কথা বলার থাকতো, কতো ভালো করে কথা বলতো আমার সাথে। মূলত ওনার এই মিষ্টি করে কথা বলা আমার খেয়াল রাখা এসবের জন্যই ওনার প্রতি আকৃষ্ট হই আমি।

কিন্ত যতোদিনে বুঝতে পারি ওনি আমার ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে ঠিক তখন থেকেই ওনার রুড বিহেভিয়ার শুরু হয়! তখন থেকেই আর আমার সাথে কথাও বলেন না। হিসেব করলে আমার সাথে যেদিন থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে ওইদিন থেকেই প্রিমা আপুর সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে! আমার অবচেতন মন প্রিমা আপুর কথা না জেনেই তাকে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে ভালোবেসে যায়। উনি আগে আমার সাথে খুব ভালো করেই কথা বলতেন ঠিক যেরকম সেহেরিশ আমার সাথে বন্ধুর মতন মিশে যায় মাঝে মাঝে ঠিক সেরকম।

প্রণয় বিরহ পর্ব ৯

কিন্তু এখন সবকিছুই অতীত! আগে বুঝতে পারিনি ইহাদ ভাইয়ার হঠাৎ পরিবর্তনের কারন কিন্তু এখন বেশ ভালো করেই বুঝছি প্রিমা আপুই হলো ওনার বদলে যাবার মূল কারন! ওনি কখনো আমাকে ভালোবাসি বলেন নি শুধু খোঁজখবর আর একটু কথা হতো তাই ওনি দেশে আসার পরেও ওনার সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে যাইনি। এসবই এখন স্মৃতির পাতায় বিচরন করছে! থাক না কিছু কারন অজানাই উনি কেনো এমন বদলে গেলো হঠাৎ করে? হয়তো তার ভালোবাসার মানুষ এসে গেছিলো জীবনে খানিকটাই বদলে যাবার কারন! এখন আর সেসব না ভেবে আমি না হয় নবজের মতনই এগিয়ে যাই। ইহাদ ভাইয়া যেমন বিয়ে করে সুখে আছে তেমনি ভাবে না হয় আমিও সুখে থাকি নিজেকে নিয়ে।

প্রণয় বিরহ পর্ব ১১