প্রণয় বিরহ পর্ব ৯

প্রণয় বিরহ পর্ব ৯
অর্ষা আওরাত

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নয়টার ঘরে ছুঁই ছুঁই। এখনো কোনো গাড়ির দেখা মিলছে না। অগত্যা গাড়ির সন্ধান না পেয়ে হাঁটা ধরলাম আমি আর বৃষ্টি আপু দু’জনে ভর্সিটি যাবার উদ্দেশ্য। আগে আমার কলেজ পড়ে রাস্তায় তারপর আপুর ভার্সিটি। দু’জনের হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে। কিন্তু দশটার ভিতরেই যে করেই হউক পৌছুতে হবে আমাদের। হঠাৎই সামনে সাদা রঙের একটি গাড়ি এসে থামে।

জানলা ভেদ করে ফর্মাল ড্রেস পড়া হাসোজ্জল মানুষটির মুখশ্রী বেশ ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে বাহির থেকে! সেহেরিশ ভাইয়ার ফর্মাল লুক দেখে বুঝতে বাকি রইলো না তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেখে তার গাড়ি থামানোর উদ্দেশ্য ঠিক বোধগম্য হলো না আমার। গাড়ি থেকে নেমে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বলে ওঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“তোমরা ওঠে পড়ো আমার গাড়িতে। আমার অফিস যাবার পথেই তো তোমাদের কলেজ পড়বে আমি না হয় সেখানে নামিয়ে দিবো তোমাদের।”
-সেহেরিশ ভাইয়ার কথা শুনে বৃষ্টি আপু গাড়িতে ওঠে বসলো কিন্তু আমি কাঠ কাঠ গলায় বলে দিলাম,
–“আমি যাবো না আপনার সঙ্গে আপনার গাড়িতে।”

তাদের দু’জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি আমার পিছন পিছন সেহেরিশ ভাইয়াও আসছে। একসময় কাঁধে কারো হাত পড়তেই পিছন ঘুরে তাকাই,
–“আপনি আমার পিছু পিছু এসেছেন কেনো? আপনি কালকে যে আমাকে মিথ্যা বলে পার্কে নিয়ে গেছিলেন সেই কথা কি আমি ভুলে গেছি? আপনার সাথে একটু হেঁসে হেঁসে ফুচকা খেয়েছি বলে ভাববেন না আমি সব ভুলে গেছি।”

আমার কথার পৃষ্ঠে ভাইয়ার চটপটে উত্তর,
–“সেটার কারন তো বললামই জুঁইফুল! আমার একা একা ভালো লাগছিলো না তাই তোমায় সাথে করে নিয়ে গেছিলাম আর তুমি যা সত্যি বললে তো আসতে না তাই একটু আধটু মিথ্যে বলেছি। আর হ্যাঁ ভালো কথা মনে করেছো কালকে তো ফুচকা খেয়েই হনহনিয়ে চলে গিয়েছিলে তা হঠাৎ করে ইহাদের সাথে কথা বলার পর তুমি আমার সাথে ফুচকা খেতে গেলে কেনো? তখন তো বেজায় রেগে ছিলে ফুচকা খাওয়ার তো প্রশ্নই ছিলো না তাহলে?”

সেহরিশ এর কথায় আমার বিষম খাওয়ার অবস্থা প্রায়! এখন তো দেখছি ওনাকে কথা শোনাতে গিয়ে আমি নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলছি! এখন তাকে কি করে বলবো যে ইহাদ ভাইয়ার উপর রাগ করে আমি ফুচকা খেয়েছি!এটা বললে তো আবার তার প্রশ্নের ঝুড়ি শেষ হবে না। উপায়ন্তর না দেখে চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে ওঠে বসলাম। আমাকে আর কিছু জিগেস করার সুযোগ না পেয়ে ওনিও গাড়িতে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্য স্থলে।

বিকেলবেলা শান্ত কিচিরমিচির পাখির আওয়াজ স্নিগ্ধ বিকেল। দুপুরের পরে কলেজ থেকে ফিরে বাড়ি এসে বেশ ভালো করেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে জুঁই। সেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো চোখে মুখে ঠান্ডা পানির ছিটায়! তড়িৎগতিতে জুঁই ঘুম থেকে চোখ কচলাতে কচলাতে ওঠে বসে। সামনেই সেহেরিশকে বসা দেখতে পেয়ে আর বাকি রইলো না তার আরাম এর ঘুম কে হারাম করেছে।

–“সেহেরিশ ভাইয়া আপনি এই সময় আমার ঘুম কেনো ভাঙালেন বলুন তো?”
–“সবাই শপিং এ যাচ্ছে তুমি যাবে না বুঝি? নিচে সবাই রেডি হতে ব্যস্ত আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো তাই তোমাকে ডাকার আদেশ জারি করেছে আমার উপর তোমার পরমানন্দ পিতামনি। আর আমিও আমার সকল কার্য ফেলে রেখে চলিয়া আসিয়াছি তোমার মতো কুম্ভকর্ণকে ডাকার জন্য!”

-শেষোক্ত লাইনগুলি ওনি যে মজা করে বলেছেন তা আসি বেশ বুঝতে পারি। মানুষটা এরকমই সবসময়ই আমার সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। কিন্তু আমার এখন মোটেও ওনার সাথে হাসির মুড নেই।
–“সেহেরিশ ভাইয়া আপনাকে আর কথা বলতে হবে না। আপনি গিয়ে নিচে বসুন আমি রেডি হয়ে আসছি।”
–আমার কথা শুনে ভাইয়া নিচে যাবার জন্য আমার রুম থেকে বেরোচ্ছিলেন তখনি আমার পিছু ডাকে ভাইয়া থমকে দাঁড়ায়।

–“বলে তো দিলেন শপিং এ যাচ্ছে সবাই কিন্তু কিসের শপিং সেটা তো একবারো বললেন না?”
–“আরে বুদ্ধু! কালকে তো ইহাদের গায়ে হলুদ আজকে তার শপিং করতে হবে না? কিছুই কি বুঝতে পারো না নাকি তুমি?”
–ইহাদ ভাইয়ার গায়ে হলুদের শপিং এ যেতে হবে আমাকে! নিজের চোখে দেখতে হবে যাকে ভালোবাসতাম বলে দাবি করেছি একসময় তারই বিয়ের শপিং এ যেতে হবে! কথাগুলো ভাবতেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আর সেখানে গেলে তো নিশ্চয়ই প্রিমা আপু আসবে যা আমার জন্য আরও অসহ্যনীয় হয়ে ওঠবে! সেহেরিশ ভাইয়াকে বলে দিলাম,

–“আপনারা যান। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না আমি যেতে পারবো না। আমি না হয় বাড়িতেই থাকছি।”
আমার কথা শুন তড়িঘড়ি করে সেহেরিশ বলে ওঠলো,
–“মাথা খারাপ তোমার! বাড়িতে কেউ থাকবে না আর তুমি বলছে শরীর ভালো লাগছে না যদি কিছু হয় তো কে দেখবে তোমাকে? ওখানে সবার ভীড়ে থাকলেও কিছু হলে সবাই দেখতে পাবে এখানে একা একা কে দেখবে বলো? তুমি রেডি হয়ে নিচে এসো। দরকার পড়লে আমি ছায়ার মতন মিশে থাকবো তোমার সঙ্গে কোনো বিপদ হবে না।”

মানুষটির সঙ্গে কথায় কোনো কালেই আমি পেরে ওঠতে পারি না। অগত্যা ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিচে নামলাম। ড্রয়িং রুমে সবাই রেডি হয়ে গেছে। সেদিন কার মতন ঘুনাক্ষরেও আমি ইহাদ ভাইয়ার সঙ্গে বসতে চাই না বিধায় সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। কারন ওইদিন ওনার সাথে বসে বেশ আনকমর্ফেটবল লাগছিলো। আর আমি জানি ড্রাইভিং সেহেরিশই করবে সেই জন্যই এসেছেন উনি এই বাড়িতে কিন্তু এখনো ওনি আসছে না কেনো?

গাড়ির জানলা দিয়ে মাথা বের করে দেখতে পেলাম মহাশয় এখানেই আসছে। আসার সময় আমার চোখে চোখ পড়তেই চোখ মেরে দিলো! আমি হতভম্ব হয়ে মাথা গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে নিলাম। ব্যাটা বজ্জাত সারাদিন আমার সাথে ফাজলামো করেও হয় না ওনার আবার চোখ মারছে! সেহেরিশ আর একটু পর আমার পাশে এসে বসে ড্রাইভিং করবে।

কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে ইহাদ ভাইয়া এসে বসে পড়লো! তাকে দেখেই আমার বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে। যে কারনে সামনে এসে বসলাম সেই কারনই আমার পিছু এসে পড়েছে! আমি কিছুতেই বসবো না তার পাশে। তার জন্যই সিট বেল্ট খুলতে যাচ্ছিলাম তখনি তার কাঠ কাঠ উত্তর,
–“জুঁই সেহেরিশ আমার সিটে বসবে। তুই এখানেই বসে থাক। প্রতিবারই ও ড্রাইভিং করে আজকে না হয় একটু বিশ্রাম নিক আমিই ড্রাইভ করি।”

–“বেশ তাহলে না হয় সেহেরিশ ভাইয়া আপনার পাশে আর আমি পিছনে*
আমার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তিনি বলে ওঠলেন,
–“জুঁই তুই এতো কথা না বলে চুপচাপ বসবি?”
ইহাদ ভাইয়ার কথায় গাড়ির বাকিরাও বলতে লাগলো,
–“জুঁই তুই এরকম করছিস কেনো? সত্যিই তো সেহেরিশই প্রতিবার ড্রাইভ করে আজকে না হয় ও একটু বিশ্রাম নিক।”

আমি আর কোনো কিছু বললাম না চুপচাপ ভাবেই বসে রইলাম। পিছন ফিরে দেখলাম বৃষ্টি আপুর সাথে সেহেরিশ ভাইয়া চুপচাপ করে বসে আছে। আমি তার দিকে তাকাতেই তার নিথর দৃষ্টি আমার দৃষ্টিতে আবদ্ধ হলো। হঠাৎই ইহাদ ভাইয়া বলে ওঠলো,
–“জুঁই এদিক সেদিক না তাকিয়ে সামনে তাকা আমি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি। এতো দিকে তাকালে পড়ে দিশেহারা হয়ে যাবি।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ৮

ভাইয়ার কথার উত্তর দিতে মন চাইলো না। চুপচাপ ভাবে বসে রয়েছি। বুঝতে পারছি না ইহাদ ভাইয়ার চিরকাল ড্রাইভিং করতে বিরক্ত লাগে দেখে এসেছি সেই ওনার আজকে হঠাৎ করেই ড্রাইভিং করতে ইচ্ছে হয়ে গেলো? বুঝতে পারলাম না। তবে বিরক্ত লাগছে তার পাশে বসতে। ইদানীং তার সবকিছুই বিরক্ত লাগে আমার কেনো জানি তাকে দেখলেও বিরক্ত এসে ভড় করে! হয়তো সেটাই হওয়া উচিত যতো বিরক্ত লাগা কাজ করবে ততোই ভুলতে পারবো তাকে।

প্রণয় বিরহ পর্ব ১০