প্রণয় বিরহ পর্ব ৮

প্রণয় বিরহ পর্ব ৮
অর্ষা আওরাত

সকালবেলা ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোনের আওয়াজ শুনে! একের পর এক ফোন বেজেই যাচ্ছে আমার সেদিকে হুশ নেই। মেসেজের টোন কানে আসতেই স্ক্রিন জুড়ে সেহেরিশ নামক মানুষটির মেসেজ গোটা অক্ষরে ভেসে ওঠলো! অগত্যা ওঠে গেলাম বিছানা ছেড়ে তার দেওয়া ঠিকানা অনুসারে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। বসন্তের প্রথম দিনের ছোঁয়ায় মেতে ওঠেছে চারদিক।

কর্নকুহুরে কেবল একটি গানই বেজে যাচ্ছে “বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে।” সত্যিই যেদিকেই তাকাচ্ছি চারদিক শুধু লাল, নীল, হলুদ নানান রঙের রকমারি ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে। বেশিরভাগ কাপলরা’ই হলুদ বা একে অপরের সাথে ম্যাচিং করে শাড়ি পড়ে আছে।ফুলের সাজে নিজেদের সজ্জিত করে রেখেছে। হাতেও ভালোবাসার প্রতীক চিহ্ন হিসাবে রয়েছে লাল গোলাপ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাখিগুলো এখনো কিচিরমিচির করে ডেকে যাচ্ছে হয়তো তাদের মনেও বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। এইভালোবাসা দিবসে আমাকে এভাবে এখানে দাঁড় করানোর কি মানে আদৌ সেটার কিঞ্চিৎ পরিমানও বুঝতে পারছি না আমি। অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর সাইডে রাখা এক বেঞ্চিতে বসে পড়ি আমি। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে চোখ আটকে গেলো দু’জন মানুষের দিকে যাদের একে অপরের হাতে ভালোবাসার চিহ্ন হিসাবে লাল গোলাপ রয়েছে!

সেই মানুষ দু’টো আর কেউ নয় তারা হলো প্রিমা আর ইহাদ ভাইয়া! প্রিমা আপু তার এক হাত দ্বারা ইহাদ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে আর ইহাদ ভাইয়াও প্রিমা আপুর সঙ্গে হেঁসে হেঁসে কথা বলে যাচ্ছে! প্রিমা আপু হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে মাথায় আবার ফুলের মালা হাতেও ফুলের সাজ! আর কোনো পার্ক খুঁজে পেলো না তারা এখানেই আসতে হলো?

এখন আমারই চোখের সামনে তাদের প্রণয়ের মুহুর্ত ঘটবে যা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া একটু অস্বস্তিকর বটে! সব ঠিক থাকলে হয়তো আমিই থাকতাম আজকের দিনটায় প্রিমা আপুর বদলে ইহাদে ভাইয়ার সাথে! কিন্তু যা হবার নয় তা তো মেনে নিয়েছি তবুও কেনো তারা দু’জন সবসময়ই আমার চোখের আশেপাশে থাকে! তাদের দু’জনকে একসাথে দেখলে যে আমার দহন শুরু হয় মনের ভেতর এখনো! যতোই বলি ইহাদে ভাইয়াকে ভালোবাসি না ভুলে যাবো তাকে কিন্তু এতো সহজেও পুরো দেড় বছরের স্মৃতি ভোলা যায় না! আর অপেক্ষা না বাড়িতে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ হাঁটতেই পিছন দিক থেকে কারো হাতের স্পর্শ আমার হাতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম! মানুষটি আমার হাত ধরে আমাকে আবারো সেই বেঞ্চিতে নিয়ে বসালো। আমার দিক ফিরে বসে মুখের হাসির রেখা টেনে বললো,

–“চলে যাচ্ছিলে আমাকে একলা ফেলে? আরো একটু অপেক্ষা করা কি যেতো না জুঁইফুল?”
কেনো জানি সেই মুহুর্তে ওনার কথায় বেশ রাগ হলো মনের ভেতর! রাগান্বিত স্বরেই বলে ফেললাম,
–“আপনি কে? আপনার জন্য আমি অপেক্ষা করতে যাবো বলুন?”
আমার কথা বোধহয় সেহেরিশ ভাইয়ার পছন্দ হলো না তাই তো মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে বিষন্নতা এসে ভর করেছে। তিনি বলেন,

–“হ্যাঁ তাও ঠিকই বলেছো তুমি। যাই হোক একবারো ওতো বললে না আমাকে কেমন লাগছে?”
সেহেরিশ এর কথা শুনে জুঁইয়ের মনে পড়লো সত্যিই তো মানুষটিকে সাদা পাঞ্জাবী আর হাতে সাদা গোলাপ নিয়ে অপূর্ব সুন্দর লাগছে! এর আগে কখনো সাদা রঙের পাঞ্জাবী পড়েনি বিধায় আজকে এই শুভ্র রঙে তাকে এতোটা মোহনীয় লাগছে বোধহয়! অপর দিকে জুঁইও সেহেরিশের কথায় সাদা রঙের একটি শাড়ি পড়েছে যার পাড়ে হলুদ রঙের একটু ডিজাইন আছে আর মাথায় চুলগুলো খোঁপা করে তার সাথে সাদা রঙের বেলী ফুলের মালা গুঁজে দিয়েছে। এই সাজেই জুঁইকে অপরুপ লাগছে সেহেরিশ এর কাছে। সেহেরিশ মুগ্ধ হয়ে জুঁইকে দেখতে লাগলো এর আগে কখনো জুঁইকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখেনি তাই আজকে এতোটা রূপবতী লাগছে আজকে! সেহেরিশ এর ধ্যান ভাঙে জুঁইয়ের কথা বলার শব্দে। জুঁই বলে ওঠলো,

–“আপনি যে সকাল বেলা আমাকে মেসেজ দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি এখানে আসার জন্য কোনো দরকার আছে। তা কি দরকার এখন বলুন?”
সেহেরিশ এবার বিষম খেয়ে ওঠলো! সে কি করে বলবে জুঁইকে কোনো কারন ছাড়াই অযথা এখানে ডেকেছে জুঁইকে!

–“কোনো দরকার নেই বুঝলে! আজকে তো ভালোবাসা দিবস তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু ঘুরাঘুরি করি। তুমিও সিঙ্গেল আমিও সিঙ্গেল বেশ জমেছে না বলো? তাইতো ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু ঘোরা যাক। আর তুমি যা মেয়ে তোমাকে এমনি বললে তো আর আসতে না তাই বাধ্য হয়েই মিথ্যা কথা বলে এনেছি।”

এবার আর সহ্য হলো না আমার! আমি আসতাম নাকি না আসবো তার জন্য আমাকে মিথ্যা বলার কোনো দরকারই ছিলো না! আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো সত্যিই কোনো জরুরি দরকার হবে তাই ওনি এভাবে ডেকেছেন আর আমি এসেছি। কিন্তু এসে যখন দেখছি পুরোটাই মিথ্যা তাহলে আর এখানে থাকার কোনো মানে হয় না! সেহেরিশ এর কথা বলা শেষ হতেই আমি চলে গেলাম সেখান থেকে। পিছন থেকে সেহেরিশ ডাকছে আমাকে আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছি। হঠাৎই আমার সামনে ইহাদ ভাইয়া আর প্রিমা আপু এসে দাঁড়িয়েছে! তাদের দেখে আমার পা চলা বন্ধ করে দিলো।

–“জুঁই মানলাম আমি মিথ্যা বলেছি কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে রাগ করে আমাকে এখানে একা ফেলে রেখে যেও না?”
সেহেরিশ ভাইয়ার গলা শুনে পিছন দিকে তাকাইতেই দেখতে পেলাম বেচারা কেমন কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে! আমি কিছু বলবো তার আগেই ইহাদ ভাইয়া বলে ওঠলো,

–“ওহ্ তাহলে সেহেরিশকে নিয়ে তুইই পার্কে ঘুরতে এসেছিস বল? দু’দিনের ভিতরই তোর সব ভালোবাসা উড়ে গেলো দেখছি! কি বলেছিলি সেদিন সবটাই তো আমার এখনো মনে আছে। সব শেষ এতো তাড়াতাড়ি বল?”
ইহাদ ভাইয়ার কথায় রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো! আমি কি করবো না করবো সব কি তাকে বলে করবো নাকি? যেদিন ভালোবাসার দাবি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন তো দিব্যি তার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিয়েছে আমিও নিজ থেকেই সরে এসেছি তাহলে এখন এসব প্রশ্ন অযথাই! আগেরবারও এসব বলেছে এবার আর সহ্য করা যাচ্ছে না! উনার ধারনা নিয়ে উনি থাকুক।

–“আপনি যেমন কোথায় যান, কোথায় কি করেন, কাকে ভালোবাসেন,কার সাথে কি করবেন সেগুলো যেমন আমাকে বলে করেন না তেমনি আমিও নিশ্চয়ই আপনাকে বলে সবকিছু করবো না এটাই স্বাভাবিক নয় কি ইহাদ ভাইয়া?”

আমার প্রশ্নের উত্তর শুনে ভাইয়া থমতম খেয়ে গেলো তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে! হয়তো তার কথার পৃষ্ঠে আমার এরকম জবাব আশা করেনি হয়তো। কিন্তু এখন আর আমার কোনো কিছু যায় আসে না ইহাদ ভাইয়া আমার সম্পর্কে কি ভাবলো না ভাবলো! হয়তো যায় আসতো যদি উনি আমাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু না আমাদের মধ্যে কোনো ভালোবাসা আছে আর না অন্য কোনো কিছু। ভালোবাসাটা শুধু আমার দিক দিয়ে একতরফাভাবেই!
–“হ্যাঁ তাও ঠিক বলেছিস।”

কথাটি শেষ হতেই আমার কর্নকুহুরের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ওঠলো,
-” তবে অবাক হয়েছি কারন যে দু’দিন আগেও আমাকে ভালোবাসি বলছিলো তার দু’দিনই এতো পরিবর্তন কীভাবে?”

শেষোক্ত কথাটি আমার কানের কাছে এসে বললো যাতে প্রিমা শুনতে না পায়। কিন্তু আমিও বেশ জোরেই বললাম,
–“পরিবর্তন তো আপনারও হয়েছে বাংলাদেশে এসে! আগে কিরকম ব্যবহার করতেন আমার সঙ্গে আর এখন কিরকম ব্যাবহার করেন সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আপনার কর্মকান্ডে আর কথাবার্তায়!”
ভাইয়া আরেক দফা চমকে গেলো! সে কথাটি আমার কানের কাছে এসে বলেছে আর আমি সবার সামনে! কিন্তু তাতে আমার কোনো কিছু যায় আসে না তাতে। আমি সেহেরিশ ভাইয়াকে বলে ওঠলাম,

–“পাশেই ফুচকার দোকান আছে চলুন সেখানে গিয়ে ফুচকা খাই? আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার পেট ক্ষিদে পেয়ে গেছে চলুন?”
–“মানে! হ্যাঁ ঠিঠিকআছে চলো্।”

ওনার কথা বলার ধরন দেখে আমার রাগের ভিতরও হাসি চলে আসছে! কেমন তুতলিয়ে কথা বলছে। এটাই স্বাভাবিক যেখানে আমি রেগে চলে যেতে চাইছিলাম সেখানে ওনাকে ফুচকা খাওয়ার কথা বলছি এতে অবাক হওয়ারই কথা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমি চলে গেলাম ফুচকার দোকানে আর আমার পিছু পিছু সেহেরিশ ভাইয়াও চলে এসেছে! ফুচকা খেতে খেতে কানে বাজলো প্রিমা আপুর বলা কথা,

–“ওর সাথে কি তোমার কোনো কিছু হয়েছে ইহাদ?”
ইহাদ ভাইয়ার চটপটে উত্তর,
–“না তেমন কিছু হয়নি। ও এইরকমই থাকে সবসময়।”

আর কিছু শুনতে পেলাম না ওরা একটু দূরে যেই বেঞ্চে আমরা বসেছিলাম সেদিকে গিয়ে বসলো। কথা শুনতে না পেলেও কি করছে সেটা বেশ ভালো করেই এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎই ফুচকায় কাঁচা মরিচ কামড়ে পরতেই ঝালে মুখ গরম হয়ে যাচ্ছে! পানি খোঁজার আগেই সেহেরিশ ভাইয়া পানির বোতল সামনে এগিয়ে দিলো! পানি খেয়ে ঝাল নিবারন করতেই দেখলাম তার ফুচকার প্লেট এখনো ভর্তি হয়ে আছে! মানে সে এখনো একটাও ফুচকা খায়নি আর আমার ফুচকা প্রায় শেষের পথে!

প্রণয় বিরহ পর্ব ৭

–“আপনি ফুচকা খাচ্ছেন না কেনো?”
–“আমি ফুচকা খাই না মানে খাই না।”
বুঝে গেলাম তার কথার ধরন! সঙ্গে সঙ্গে প্লেট থেকে একটি ফুচকা নিয়ে তার মুখের মধ্যে পুরে দিলাম! তিনি ফুচকা মুখে নিয়েই বসে আছে হতভম্ব হয়ে! তার এরুপ ক্যাবলা মার্কা চেহারা দেখে আমার হাসি থামছেই না!
অন্য দিকে ইহাদ তুখোড় দৃষ্টি নিয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে! তার অগ্নি দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে প্রচুর রেগে আছে!

প্রণয় বিরহ পর্ব ৯