প্রণয় বিরহ পর্ব ৭

প্রণয় বিরহ পর্ব ৭
অর্ষা আওরাত

সকালের স্নিগ্ধ আভা বদলে গিয়ে দুপুর রোদ্রের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ধরনীতে রোদ্রের উত্তাপ বেশ প্রখর ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে। উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে সবকিছু। রৌদ্রের তাপ এতোটাই কঠোর হয়ে ওঠেছে পাঁচ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয় পড়ছে! খোলা মাঠের উপর দিয়ে কতোগুলো কাক কা কা করে ডাকতে ডাকতে গাছের ডালে গিয়ে বসলো হয়তো তাদের কাছেও রৌদ্রেরঝাঁজ গায়ে লাগছে!

প্রিমা আপুদের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে আর মাঝপথেই গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে যার দরুন আমি ইহাদ ভাইয়া আর সেহেরিশ ভাইয়া, বৃষ্টি আপু এই রৌদ্রময় দুপুরে খোলা মাঠের নিচে দাঁড়িয়ে আছি! বাকি সবাইরা গাড়ি পেয়ে বাড়ির দিকে চলে গেছে। গাড়িতে সবার জায়গা হয়নি। সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ হবার কারনে আমরা যে ক’জন ছোটো ছিলাম তারা অপেক্ষা করে আছি অন্য গাড়ির জন্য।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেহেরিশ ভাইয়া গাড়ি ঠিক করার চেষ্টায় মত্ত আর ইহাদ ভাইয়া সেই মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে আছে। আমি আর বৃষ্টি আপু তাকিয়ে আছি দূরের গাছের নিচে দাঁড়ানো লাল রঙের শার্ট পরিহিত এক সুর্দশন যুবকের দিকে! যুবকটির চোখে কালো রঙের ফ্রেমের মোটা চশমা পড়নে লাল শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। তারও নজর যে এদিকে সেটা আমার আর বৃষ্টি আপু আমাদেরও বুঝতে বেগ পেতে হলো না। ছেলেটি আর কেউ নয় ছেলেটি হলো আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। আমাদের বাড়ি থেকে যেতে মাত্র আধা ঘণ্টা লাগে। তার নাম হলো নয়ন।

বর্তমানে পড়ালেখার শেষ পর্যায়ে আছেন হয়তো কিছুদিনের ভিতরেই চাকরিতে জয়েন করবে। সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি আমি আর বৃষ্টি আপু যখনি তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বা কলেজে যাবার সময় তার সাথে দেখা হতো তখনি ব্যাটার নজর আমাদের দিকে এসে ভর করতো! সেই নজর যে কেবল বৃষ্টি আপুর জন্য সেটা আমিও বেশ ভালো করেই বুঝি। তবে আপু বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকে।

এখানে এসেছে কি উদ্দেশ্য সেটা বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ সময় এভাবে থাকবার পর ছেলেটি পকেট থেকে ফোনটি কানে নিতেই তারপরই সে জায়গা থেকে চলে গেলো দ্রুত গতিতে! হয়তো কোনো ডাক পড়েছে ইমার্জেন্সি ভাবে। নয়ন ভাইয়া চলে যেতেই খেয়াল করলাম বৃষ্টি আপুর চোখে মুখে মন খারাপের ছায়া এসে ভর করেছে! আমারো আর হিসেব মিলাতে গন্ডগোল হলো না! ব্যস দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেলো! আমার ভাবনার মাঝেই ডাক পড়লো সেহেরিশ ভাইয়ার।

–“গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে তোমরা আর বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে এসে বসো বাড়িতে যেতে হবে।”
সেহেরিশ ভাইয়ার ডাক শুনে গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। এবার আর ইহাদ ভাইয়ার পাশে না বসে তড়িঘড়ি করে সামনে সেহেরিশ ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসলাম আর বৃষ্টি আপু বসেছে ইহাদ ভাইয়ার পাশে। সবাই চুপচাপ ভাবেই গাড়িতে বসে রয়েছে আর গাড়ি চলছে নিজের আপন মনে। খানিক্ষন প্রহর অতিবাহিত হবার পরেই আমরা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম।

ঝেঠুর কথায় সেহেরিশ ভাইয়াও এসেছে আমাদের বাড়িতে। সবাই ভেতরে বিশ্রাম নিচ্ছে আমার মা আর কাকী মিলে রান্নাঘরে হয়তো রান্না করছে আর বাকি সবাই রুমে। বাড়িতে আসতেই ইহাদ ভাইয়া নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো যেটা নিচে বসে থেকেও দেখতে বেগ পেতে হলো না আমার! সেহেরিশ ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে এসে সোফায় বসে রয়েছেন ঝেঠুর জন্য। আমিও ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

আধা ঘন্টার ভিতরে আবারো নিচে নেমে আসলাম। খুব ক্ষিদে পেয়েছে তাই। এসেই দেখতে পেলাম মা’য়েরা এখনো রান্নাঘরে আছেন আর সেহেরিশ ভাইয়া এখনো সোফায় বসে আছে! আমি সেহেরিশ ভাইয়াকে কিছু বলার উদ্দেশ্য পা বাড়িয়ে ছিলাম ওমনি স্লিপ খেয়ে সোজা সেহেরিশ ভাইয়ার কোলের উপর গিয়ে বসে পড়ি! লজ্জায় তো আমার মাথা কাটা যাচ্ছে সমানতালে! তড়িঘড়ি করে ওঠতে গিয়েই ফ্লোরে পা পড়তেই আবারো গিয়ে পড়লাম তার উপর! এবার সে দাঁড়িয়ে ছিলো আর আমি পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম তখনি আমার কোমড় আঁকড়ে ধরে আমাকে পরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচান। ওঠতে যাবো ঠিক তখনি ইহাদ ভাইয়ার গলার স্বর শুনতে পেলাম,

–“জুঁই একটু লজ্জা শরম তো রাখবি নাকি বল? এটা ড্রয়িং রুম বেডরুম নয়। এখানে এসব করছিস কেনো? বাড়িতে গুরুজনেরা রয়েছে সেটা ভুলে যাস না।”
ভাইয়ার কথা শুনে বুঝতে বাকি রইলো না ভাইয়া কোন দিক মিন করে আমাকে কথা গুলো বলছে। ভাইয়ার ভূল ভাঙাতে তড়িঘড়ি করে সেভাবে থেকেই বলে ওঠলাম,

–“আপনি যা ভাবছেন আপনার ধারনা একেবারেই ভুল। সবসময়ই যা চোখে দেখা হয় সেটা সত্যি হয় না।”
–“কি সত্যি আর কি মিথ্যা সেটা এখনো নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি! তুই তো এখনো ওর ক্লোজ হয়েই দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিস। আর কিছুদিন আগে যে আমাকে কি বলেছিলি সেটাও মনে আছে আমার! কোথায় গেলো তোর সেই দেড়বছরের*

ইহাদ ভাইয়া আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে চাইছিলো যেটা আমি বলেছিলাম তাকে কিন্তু অর্ধেক বলে আর বলেনি। ভাইয়ার কথায় এবার আমার হুশ ফিরে! সেহেরিশ ভাইয়া আমাকে সাবধানে নামিয়ে দেয় সোফায়। আমাদের কথার আওয়াজ শুনে রান্নাঘর থেকে মা চলে আসে।
–“কি হয়েছে রে? কি নিয়ে তোরা এতো কথা বলছিস।”

মায়ের কথা শুনে আমার মনে ভয়ের আংশকা বেড়ে গেলো! ইহাদ ভাইয়া যেমন উল্টো ভেবেছে তেমনটি যদি মা’কে বলে তাহলে তো আমি শেষ! আমার ভাবনার মাঝেই ইহাদ ভাইয়া আমাকে ভুল প্রমানিত করে বলে ওঠলো,
–“ও কিছু না কাকীমা। আমরা এমনিই কথা বলছিলাম তুমি তোমার কাজ করো গিয়ে।”

ইহাদ ভাইয়া আর আমাদের কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারো উপরে চলে গেলো! আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম ফ্লোরে তেল পড়ে ছিলো বিধায় আমি দু’বার পড়ে গেছিলাম আর ভাইয়া আমার সম্পর্কে উল্টো পাল্টা ভাবছিলো! সেহেরিশ ভাইয়াকে বলে ওঠলাম,

–“আপনাকে কে বলেছিলো এখানে বসতে? আপনার জন্যই তো ইহাদ ভাইয়া আমাকে ভুল বুঝে চলে গেলো!”
–“আশ্চর্য! আমি না থাকলে যে তুমি পড়ে ব্যাথা পেতে সেটা? বরং তোমার আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিলো।”
–“ব্যাথা পেলে পেতাম কিন্তু ইহাদ ভাইয়া তো আর আমাকে এভাবে ভুল বুঝতো না।”
–” তোমার আঘাত পাওয়ার চেয়ে ইহাদের ভুল বোঝা ওটা বেশি তোমার কাছে?”
–“হ্যাঁ ওটাই বেশি কারন আমি যে এখনো*

চুপ করে গেলাম কি বলতে যাচ্ছিলাম ভেবেই নিজে নিজেকে পিটাতে ইচ্ছে করছে! এখনি মুখ ফসকে সবটা বলে দিতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই ঝেঠুর আগমন ঘটলো নিচে! ঝেঠুকে দেখে সেহেরিশও চুপ করে বসে রইলো। ঝেঠু জরুরি কথা বলবে বলে সবাইকে ডেকে নিচে নিয়ে এসে। এক এক করে সবাই নিচে এসে পড়লে ঝেঠু গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে,

–“মেয়েটিকে মানে প্রিমাকে তো তোমরা সকলেই দেখলে তোমাদের কি মনে হয় ও ইহাদের এবং এই বাড়ির বউ হওয়ার উপযুক্ত?”
ঝেঠুর কথায় ইহাদ ভাইয়ার চোখে মুখে ভয়ের রেশ দেখা গেলো! ভয় পাচ্ছে যদি প্রিমাকে না মেনে নেয়। ঝেঠিমা বলে ওঠলো,

–“মেয়েটির কথা বার্তা ঠিকআছে কিন্তু ওসব ছেঁড়া প্যান্ট, শার্ট ওগুলো পড়া আমার মোটেও সুবিধার লাগেনি! আর ওর বাবা মা তাদের ব্যবহারও ভালোই লেগেছে আমার।”
ঝেঠিমার কথা শুনে ঝেঠু বাকি সবার উদ্দেশ্য বলে ওঠলো,
–“তোমাদের আর কারোর কিছু বলার আছে?”

বাড়ির আর বাকি সবাই তাল মিলালো একই সুরে মেয়েটির জামাকাপড় পড়ার ধরন ভালো ঠেকেনি তাদের কাছে। সবার কথা শুনে ইহাদ ভাইয়া এবার তড়িঘড়ি করে বলে ওঠলেন,
–“ও কিছু না মা। বিয়ের আগে সবাই একটু ওরকম থাকে বিয়ের পর ও একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখো। আর ওর পোশাক নিয়েই তো প্রবলেম আর তো কোনো কিছু নিয়ে কোনো প্রবলেম নেই। তোমরা এসব নিয়ে চিন্তা করো না। প্রিমাকে আমি ঠিক করে নিবো বিয়ের পর। তোমরা শুধু প্রিমাকে আমার থেকে দূর করে দিও না। আমি যে ওকে বড্ড ভালোবাসি।”

ইহাদ ভাইয়ার আকুতি ভড়া কণ্ঠের কথা শুনে ঝেঠু বলে ওঠলো,
–“বেশ কারোর যখন প্রিমাকে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই আর তুমি নিজেও যখন তাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছো তাহলে সেখানে আর আমরা কেউই তোমাকে বারন করবো না। এবার সামনের শুক্রবারেই তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে যদি প্রিমাদের পরিবার থেকে কোনো আপত্তি না থাকে।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ৬

ঝেঠুর কথায় বাড়ির সকলের মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠেছে! সবথেকে বেশি খুশি তো ইহাদ ভাইয়া হয়েছে যেটা তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে! আর ওদিকে আমার মনে বারংবার মনে হচ্ছে আর মাত্র চারদিন পরেই ইহাদ ভাইয়ার সংসারে আগমন ঘটবে অন্য কোনো নতুন নারীর! যার সাথে সংসার পাতবে ইহাদ ভাইয়া এবং সেই দৃশ্য আমাকে দেখতেও হবে স্ব চক্ষে! ভাবতেই কেনো জানি এখনো বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনূভুত হয়! হয়তো এটাই ছিলো আমার জন্য প্রণয়ের সুখে সুখী না হয়ে বিরহে বিলীন হওয়া!

প্রণয় বিরহ পর্ব ৮