প্রণয় বিরহ পর্ব ১৩

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৩
অর্ষা আওরাত

সকাল থেকেই বিয়ের বাড়ির আমেজে ছেয়ে গেছে পুরো বাড়ি! আত্নীয় স্বজনে ভড়ে গেছে চারিদিক। পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষে গিজগিজ করছে। লাল, নীল হরেক রকম আলোকসজ্জা তো আছেই তার সঙ্গে আজকে যুক্ত হয়েছে উচ্চ স্বরে গান বাজানো! নানান রকমের খাবারের গন্ধে মৌ মৌ করছে পুরো বাড়ি। সকাল থেকেই সকলের ব্যস্ততা! কানে আজানের ধ্বনি আসতেই সকলে মিলে তাড়াহুড়ো দিতে লাগলো নামাজ পড়ার জন্য।

নামাজ পড়া শেষ করেই রওনা দেওয়া হবে প্রিমা আপুদের বাড়িতে বিয়ের জন্য। কালকে রাত্রে বেলা সেহেরিশ ভাইয়া এই বাড়িতেই রয়ে গেছিলো সকাল বেলা আংকেল, আন্টি, আর সেহেরিশ ভাইয়ার ছোটো বোন লতা সবাই মিলে চলে এসেছে। নামাজ শেষে সবাই ড্রয়িং রুমে একত্রিতো হয়েছে বিয়ে বাড়িতে যাবার জন্য। প্রথমে যাবো না বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু পরে ভাবলাম যে আমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছে তার জন্য কষ্ট পেয়ে আমি নিজের আনন্দ নষ্ট করবো কেনো?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমিও রেডি হয়ে গেলাম সেহেরিশ এর দেওয়া কালো রঙের নজরকাঁড়া লেহেঙ্গাটি গায়ে পরিধান করে। চুলগুলো খোলা রেখে সামনের দিকে এনে ছেড়ে দিয়েছি কানের পাশে কালো সাদা রঙের দু’টো গোলাপ গুঁজে দিয়েছি। হাত ভর্তি কালো চুড়ি গলায় কালো রঙের ম্যাচ করা গয়না। আর মুখেও মেক-আপ করেছি তবে সেটা হালকা করে ঠোঁটে লিপস্টিক আর কপালে টিপ ব্যস এই! চোখে কাজল দিলে লেপ্টে যায় তাই কাজল দেওয়া থেকে বিরতো রেখেছি। আমি রেডি এখন পুরোপুরি ভাবে। বৃষ্টি আপুর রুমে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে বৃষ্টি আপুর রুমের আগে ইহাদ ভাইয়ার রুম পড়ে। আসি বৃষ্টি আপুর রুমে যাবো ঠিক তখনি ওনার আগমন ঘটে! চোখে চোখ পড়ে যায় তার সঙ্গে। কিন্তু আমি সেটা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম তখনি ভাইয়ার ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকাই,

–“এই কালো রঙের লেহেঙ্গাটায় তো তোকে বেশ মানিয়েছে জুঁই! খুব সুন্দর লাগছে তোকে।”
আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম,
–“হ্যাঁ সুন্দর তো লাগবেই কারন যখন ঠিক কালো রঙের একটি শাড়ি আমি নিতে গেছিলাম তখনি কেউ সেটা ছো মেরে নিয়ে নেয়। কিন্তু সেহেরিশ ভাইয়া আমাকে এই লেহেঙ্গাটি পছন্দ করে কিনে দেয়। তিনি যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি তার পছন্দসই ও অসাধারন! তাই তো এই লেহেঙ্গায় আমাকে এতো মানিয়েছে কারন লেহেঙ্গাটিতো সেহেরিশ ভাইয়া পছন্দ করেছে!”

আমার কথা বোধহয় ইহাদ ভাইয়ার পছন্দ হয়নি তাই কোনো কিছু না বলেই চলে গেলো! ভাইয়া যাবার পরই আমি বৃষ্টি আপুর রুমে যাই আপুকে ডাকতে। আপুও বেশ সুন্দর করে সেজেছে। আপু লাল রঙের টুকটুকে শাড়ি পড়েছে চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে আর মুখে একটু ভারি মেক-আপ করেছে! সব মিলিয়ে আপুকেও বেশ সুন্দরী লাগছে!
–“জুঁই তোকেও তো সুন্দর লাগছে বেশ! বলতে হবে সেহেরিশ এর পছন্দ আছে বল? লেহেঙ্গা টি বেশ নজরকাঁড়া!”
–“তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে আপু। এবার চলো নিচে যাওয়া যাক? সবাই অপেক্ষা করছে।”

–“তুই সত্যিই ইহাদ ভাইয়ার বিয়েটা নিজের মন থেকে মেনে নিতে পারছিস জুঁই? তোর কষ্ট হচ্ছে না? কেউ না জানুক আমি তো জানি যে তুই ইহাদ ভাইয়াকে কতোটা ভালোবাসিস।”
আপুর কথায় পা জোড়া থমকে দাঁড়ায়! খানিকক্ষণের জন্য বুকে কম্পন অনুভুত হলো! কিন্তু সকল অনুভুতি বির্সজন দিয়ে কাঠ গলায় আপুকে বলে দিলাম,

–“ভালোবাসিস না আপু ভালোবাসতাম একসময়! তবে সেটা অতীত এখন বর্তমান আর এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে ইহাদ ভাইয়া প্রিমা আপুকে ভালোবাসেন এবং খানিকক্ষন পর তাদের বিয়ে। আর সর্বপ্রথম হলো যে আমাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না তার কাছে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করার চেয়ে না তাকে জীবন থেকে সম্পুর্ন মুছে যাওয়াই ভালো।”

আপুর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম হয়তো আপু বুঝতে পারছে না! আপুকে তো সবটা বলাও হয়নি। তাই আপুকে বোঝাতে বললাম,
–“আপু তোমাকে কিছু কথা বলা বাকি রয়ে গেছে সেগুলো পরে বলি? এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে যে নিচে চলো তাড়াতাড়ি ঝেঠু ডাকবে এবার?”

আপুও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গে নিচে চলে গেলো! নিচে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সবার মাঝেও আমার চোখ গিয়ে থমকায় একজন সুর্দশন যুবকের দিকে যার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ছে! বেহায়া দৃষ্টি কেবল তার দিকেই যাচ্ছে বারংবার। মানুষটিকে সবসময়ই দেখে এসেছি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবীই পড়ে কিন্তু আজকে কালো রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে! তার ফর্সা গায়ের রঙে কালো রঙের পাঞ্জাবীটি ফুটে ওঠেছে বেশ ভালো করেই! খুব আকৃষ্ট করছে আমার চোখগুলো তার দিকে বারংবার! ধ্যান ভাঙলো আপুর ডাকে

–“জুঁই তাড়াতাড়ি গাড়িতে চল নাহলে তোকে ফেলে রেখেই চলে যাবো?”
আপুর কথায় জলদি করেই গাড়ির কাছে যেতেই দেখলাম বেশ অনেকগুলো গাড়িই দাঁড়িয়ে আছে বরযাত্রী হিসাবে যাওয়ার জন্য। ইহাদ ভাইয়া গাড়িতে ওঠেই আমার দিকে চেয়ে বলে ওঠলো,
–“জুঁই তুই বৃষ্টির সাথে এই গাড়িতেই ওঠ। আজকে ড্রাইভার ড্রাইভ করবে।”
ভাইয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে ওঠলাম,

-“বৃষ্টি আপু চাইলে যেতে পারে কিন্তু সেহেরিশ ভাইয়া ওই গাড়িতে ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে যাবে আমরা না হয় ওই গাড়িতে যাবো। আপনি এই ফুলে সজ্জিত গাড়িতেই যান।”
আমার কথায় বোধহয় বেশ অপমানিতো বোধ করলো ইহাদ ভাইয়া! যা তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভালো করে! কিন্তু আমি সেদিক পাত্তা না দিয়ে সেহেরিশ ভাইয়া যেই গাড়ি ড্রাইভ করবে সেই গাড়িতেই ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে ওঠে বসলাম আগেভাগে! সবাই একে একে গাড়িতে ওঠার পর সেহেরিশ ভাইয়া ও গাড়িতে ওঠেই আমার দিকে তার মুচকি হাসি প্রদর্শন করেই মনোযোগী হলেন গাড়ির ড্রাইভিং-এ।

কিছুক্ষণের ভিতরেই আমরা প্রিমা আপুদের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। ভিতরে ঢুকতে বেশ ভালো ভাবেই আদর আপ্যায়ন করে ভেতরে ঢোকালো আমাদের। আমি বউ দেখতে বউয়ের রুমে গেলাম। প্রিমা আপুর গায়ে লাল টুকটুকে বেনারসি গায়ের ভারি ভারি গয়না। মুখভর্তি ভারী মেক-আপ। অসম্ভব সুন্দর লাগছে আপুকে। যে রুমে বউ আছে ওই রুমের দরজার পাশে একটি ছেলেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এ-তো সেই ছেলে তানভীর!

যাকে সেদিন বাস স্টপে প্রিমা আপুর সাথে দেখেছিলাম সেদিন যদি ভুল করে বাসায় ফোনটা ফেলে না আসতাম তাহলে আজকে এই ছেলের মজা বুঝিয়ে দিতাম! হঠাৎই লক্ষ্য করলাম এই ছেলে প্রিমা আপুর দিকে তাকিয়ে ফ্লাইং কিস দিচ্ছে! এ তো দেখছি মহা পাঁজি ছেলে! ইহাদ ভাইয়া তো খুব বুক উঁচু করে বলে প্রিমা আপু তাকে খুব ভালোবাসে এই ভালোবাসার নমুনা? প্রিমা আপু ইহাদ ভাইয়াকে যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে এই ছেলেকে ওইদিন জড়িয়ে ধরেছিলো কেনো?

আর এই ছেলেই বা প্রিমা আপুকে ফ্লাইং কিস দিচ্ছে কেনো? সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ পেলাম না আর। কাজী রুমের ভিতর এসে তাড়া দিতে লাগলো বিয়ের জন্য ঘর খালি করে দিতে। ভীড় কমে গেলো আস্তে আস্তে। প্রিমা আপু রুম ছেড়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলো আমাদের সেখানে এক পাশে রঙিন পর্দার মতন টাঙানো আছে। মূলত পর্দার এক পাশে বউ সেজে আছে প্রিমা আপু আর আরেক পাশে বর সেজে আছে ইহাদ ভাইয়া!

এবার আর দেরি না করে কাজী এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলো। যখন ইহাদ ভাইয়াকে কবুল বলতে বললো ভাইয়া কি রকম দৃষ্টি মেলে যেনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিছু সময়ের জন্য! তখন না চাইতেও আমার কেনো জানি মনের অন্তঃপুরে জ্বালা ধরতে শুরু করলো! কানে পরপর তিনটি বাক্য পোঁছতেই বুঝতে পারলাম বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে!

কেনো জানি মুখের হাসি টুকু তখন মুখ থেকে বিলীন হয়ে গেলো! বাকি সময়টুকু খুশি থাকলেও এই সময়টায় এসে একটু খারাপ লাগছে! ধর্মমতে বিয়ে সেড়ে এবার আইনিমতে সই সাবদ করছে দু পক্ষ মিলে! সবশেষে এবার ইহাদ ভাইয়া আর প্রিমা আপু দু’জনে এখন নব বিবাহিতো দম্পতি! তাদের দু’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে! কষ্ট হচ্ছে খুব! আসার সময় তো নিজেকে বুঝিয়ে এসেছিলাম আমি আনন্দ করবো কিন্তু এখন যে আনন্দের বদলে মনের অন্দরমহলের কষ্টগুলো কান্না পাকিয়ে আসতে চাইছে ভেতর থেকে! নিজেকে শক্ত করলাম হাজার কষ্ট হলেও আমি কাঁদবো না! কান্না চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম আগের ন্যায়! হঠাৎই আমার সামনে টিস্যুর প্যাকেট এনে ধরলো সেহেরিশ!

–“জুঁইফুল কষ্ট পেলে কষ্ট লুকোতে হলে এই রুমালের বোধহয় খুব প্রয়োজন পড়ে একসময়। নাও এটা নিজের কাছে রাখো। এটা তোমার এখন না হলেও প্রয়োজন ঠিকই হবে আজকে। আর এতো সুন্দর করে সেজেছো তোমার বিরহে বিলীন হয়ে এই সাজ নষ্ট না করার অনুরোধ রইলো।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ১২

মানুষটা বরাবরই এইরকম। না বলতেও কীরকম ভাবে বুঝে গেলো এখন আমার কান্না গড়িয়ে পড়লেও মুছতে একটি রুমাল প্রয়োজন হবে? কিন্তু ওনি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে? না হলে এই রুমাল, বিরহের কথা এসব কেনো বললো? হয়তো বুঝেছে কিছু আবার হয়তো বুঝেনি।

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৪