প্রণয় বিরহ পর্ব ১৪

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৪
অর্ষা আওরাত

পৃথিবীর সবচেয়ে করুন মুহুর্তের মধ্যে একটি হলো একজন কন্যাগ্রস্থ পিতার কাছে তার কন্যার বিদায় মুহুর্ত! সেই সময় হাজারো সুখকর স্মৃতি এসে মনে দোলা দেয় তখন কিন্তু সেই স্মৃতি, আনন্দ,শৈশবকাল সব ছেড়ে বিদায় নিতে হয় এক সময়। বিয়ের পর সমস্ত নিয়ম কানুন সবকিছু মেনে নিয়ে এখন বিদায়ের মুহুর্ত চলে এসেছে! পরিবেশ ভারী হয়ে গিয়েছে আপনজনের কান্নার আওয়াজে! সবার চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ মেয়েটি চলে যাবে বলে।

প্রিমা আপুর মা আচলে মুখ গুঁজে কেঁদে যাচ্ছে সমানতালে! বাকি আত্নীয় স্বজন সবার চোখে মুখেই বিদায়ে বিষাদের সুর লক্ষ্যনীয়। কিন্তু যাকে ঘিরে এতোকিছু তার চোখে মুখে কেনো জানি আমি কান্নার কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বিদায় দিতে দিতে গাড়ীর কাছে এসে পড়েছে সবাই তবুও প্রিমা আপু মাথা নিচু করে রেখে গাড়িতে ওঠে গেলো! অবাক করা ব্যাপার হলো একবারের জন্যও তার চোখে মুখে কান্নার আভাস হিসাবে পানির রেখা দেখলাম না! ব্যাপারটা বেশ খটকার লাগলো আমার কাছে কিন্তু তা প্রকাশ না করে নিজের মনেই রেখে দিলাম। আগের ন্যায় সেহেরিশ ভাইয়ার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। সেহেরিশ গাড়ি চালাচ্ছে আমি এই ফাঁকে জিগেস করলাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“আচ্ছা আপনি তখন কি করে বুঝলেন রুমালটা আমার সেই মুহুর্তই প্রয়জোন ছিলো?”
আমার কথায় সেহেরিশ বলে ওঠলো,
–“বেশ দিন হয়েছি তোমাকে চিনি তাই তোমার কখন কি প্রয়োজন হতে পারে সেটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারি জুঁইফুল।”

সেহেরিশ ভাইয়ার কথা শুনে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ভাবে গাড়িতে সারা রাস্তা পার করে দিলাম। অতঃপর বাসায় আসতেই সারাদিনের ক্লান্তি জেঁকে ধরলো গোটা শরীর জুড়ে! সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায় তবুও একটু বিশ্রাম নিলে চলছে না আমার। ওয়াশরুম থেকে ভারী লেহেঙ্গা খুলে ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়! কিছুক্ষণ পর কানে আজানের সুমিষ্ট ধ্বনি ভেসে আসতেই তড়িঘড়ি করে ওঠে দাঁড়ালাম। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় আটটা বেজে গেছে।

রুম থেকে ওঠে নিচে গেলাম নিচে যেতেই দেখতে পেলাম প্রিমা আপুকে আগের মতনই সাজ সজ্জায় রেখে সোফায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশেপাশে চোখ বোলালাম কিন্তু বউয়ের পাশে তো দূর ঘরের কোথাও ইহাদ ভাইয়াকে দেখতে পেলাম না! একে একে প্রায় সবাই এসে প্রিমা আপুর মুখ মানে নতুন বউ দেখে যাচ্ছে! প্রিমা আপুর চোখমুখ কুঁচকে আছে বিরক্তিতে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আমি। ঝেঠিমা রান্নাঘর থেকে তার সকল কাযকর্ম সেড়ে এসে তার পুত্রবধূকে পরম যত্নে রুমে নিয়ে গেলেন। আমিও গেলাম পিছু পিছু। রুমে যেতেই ঝেঠিমা বলে ওঠলেন,

–“প্রিমা এই গোলাপি রঙের শাড়িটা নাও তোমার গা থেকে ওসব ভারী ভারী সাজ সজ্জা সব খুলে ফেলো। নিশ্চয়ই খুব অস্বস্তিতে ছিলে এখন। এই ভারী জামাকাপড় খুলে এই পাতলা শাড়ীটা পড়ে নাও দেখবে ভালো লাগবে।”
প্রিমা আপু ঝেঠিমার কাছ থেকে শাড়িটি নিয়ে আবারো ঝেঠিমার হাতেই দিয়ে বললো,
–“আন্টি আমি এসব শাড়ি ফাড়ি পরতে পারবো না বুঝলেন! এতোক্ষণ ধরে পড়েছিলাম কারন আমা মা কাকিমা তারা বলেছিলেন এই বিয়ের দিন একদিনই শাড়ি পড়তে হয়। আর বিয়ে যেহেতু শেষ তাই এই শাড়ি পড়ে থাকার কোনো মানেই হয় না! আপনারা সবাই রুম থেকে বেরো হোন লাগেজে আমার জামাকাপড় আছে আমি ওগুলোই পড়ে নিবো।”

প্রিমা আপুর কথা শুনে উপস্থিত সবাই বিষম খাবে এরুপ অবস্থা! একে তো নতুন বউ তার শাশুড়ী মাকে মা না বলে আন্টি বলছে তারপর আবার মুখের উপর বলে দিলো শাড়ি পড়তে পারবে না! এটা সত্যিই অভাবনীয়! আমার মা কিছু বলার উদ্দেশ্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো তখনি ঝেঠিমা বলে ওঠলো,

–“তুই চুপ করে থাক! একটা কথাও বলার দরকার নেই। ইহাদ আমাদের কথা শুনে নি। সে নিজে যখন প্রিমাকে ভালোবেসে এনেছে তাহলে তার দায় অনেকাংশই ইহাদের। এখন কথা না বাড়িয়ে নিচে চল। ও ওর মতন থাকুক। এখন আর কেউ নতুন বউকে দেখতে আসবে না। তুই একটু পর এসে ওকে খাবার দিয়ে যাস।”

ঝেঠিমার কথা শুনে মা বা কেউ কোনো কথা না বলে সবাই যে যার মতন করে নিচে চলে গেলো। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম প্রিমা আপুর ঘরে। প্রিমা আপু দেখলাস তার সুটকেস থেকে জিন্স প্যান্ট আর একটি টির্শাট বের করছে! নিশ্চয়ই এখন এগুলো পড়বে। এই প্রথম কোনো নতুন বউ তার বাসর ঘরে শার্ট আর প্যান্ট পড়ে অপেক্ষা করবে ভাবতেই আমার কেমন হাসি পাচ্ছে! হাসি চেপে রেখেই চলে গেলাম নিচে ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িংরুমে কেউ কিছু বলছে না যে যার মতন বসে রয়েছে। বৃষ্টি আপুকে দেখতে পেয়েই আমি আড়ালে টেনে এনে জিগেস করতে লাগলাম,

–“আপু সেহেরিশ ভাইয়া কোথায় গো? অনেকক্ষন হলো তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আর আন্টি বা লতা কেউই তো নেই দেখছি।”
–“দেখবি কি করে তারা তো সবাইই চলে গিয়েছে।”
-আপুর কথা শুনে আমি বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠলাম,
-“কেনো? কখন? কি করে গেলো?”

–“তুই যখন ঘুমাচ্ছিলিস তখনি চলে গিয়েছে তারা সবাই। আবার কালকে ইহাদের রিসিপশনে আসবে। কিন্তু তুই সেহেরিশ ভাইয়ার খবর জানার জন্য এতো উতলা হয়ে পড়ছিস কেনো ইদানীং?”
-“ধুর! তুমিও না কিসব বলো। আমি তো এমনি তাদের দেখতে পাচ্ছিলাম ন বলে জিগেস করতে এসেছি আর তুমি কিনা কিসব ভাবছো আমার সম্পর্কে।”
আমার কথা শুনে বৃষ্টি আপু বললো,

-“আচ্ছা শোন বাদ দে এগুলো। তুই বিয়ে বাড়িতে যাবার সময় না আমাকে বলছিলি ইহাদ ভাইয়াকে নিয়ে তোর অনেকগুলো কথা আছে যা আমি জানি না চল এখনি বলে ফেল সেগুলো?”
–“আরে আপু এখন অনেক মানুষ আছে দেখছো না? তার চেয়ে বরং শোনো খাওয়া দাওয়া সেড়ে ছাঁদে এসো তখন তো সবাইই ঘুমিয়ে পড়বে। আর বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ছাঁদেও আলো আছে তখন না হয় শোনো সব কথা তুমি?”
–“আচ্ছা ঠিকআছে।”

আকাশ জুড়ে তাঁরার মেলা বসেছে আজকে। গোটা আকাশ জুড়ে যেখানেই তাকাচ্ছি সেখানেই খালি তারা! চাঁদটাও বেশ বড়ো লাগছে আজকে অন্য দিনের তুলনায়। চাঁদের অপরূপ কিরন ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। আমি ছাঁদের এক কোনে একটি চেয়ারে বসে সবটা অবলোকন করে যাচ্ছি। আজকে রাত্রিটা খুবই সুন্দর। হয়তো আজকে দু’জন ভালোবাসার মানুষ এক হতে চলেছে। আর একজন তার ভালোবাসা ভুলতে মন প্রান দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইহাদ ভাইয়ার বলা কথা গুলো সবকিছুই বৃষ্টি আপুকে বললাম একটু আগে। সবশুনে আপু চুপ করেই রইলো। আমি কিছু বলবো এর আগেই আপু তার মৌনতা কাটিয়ে বললো,

–“সবটাই একটা ভুল বুঝাবুঝির স্বীকার জুঁই! এখানে ইহাদ ভাইয়া যদি সেদিন তোকে ভুল না বুঝতো তাহলে হয়তো সত্যিই আজকে প্রিমার জায়গায় তুইই থাকতি। সবটা শুনে আমার কেমন মাথা চক্কর কাটছে রে। ইশশ একটা ভুলের জন্য তোদের কতো সুন্দর একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল! কিন্তু তুই তো ইহাদ ভাইয়াকে ভালোবাসতিস আর তিনি না হয় তোকে ভালোবাসেনি তোর প্রতি ভালোলাগা কাজ করতো তার। তাহলে তুই কেনো সবটা বোঝালি না তাকে?”

–“আপু দেখো উনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আর উনার ধারনা ভাঙার আগেই প্রিমা আপু এসে পড়েছে তার জীবনে! তাই তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে সুখে থাকুক। তোমার অজানা ছিলো এখন তুমি জানলে আর কথা বাড়িও না আপু। এসব কথা যতোই বলবে ততই তিক্ত স্মৃতি মনে পড়বে আমার।”

আপুকে কোনো কিছু বলতে না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলাম। এই মুহুর্তে ইহাদ ভাইয়া আর প্রিমা আপু একান্তে নিজেদের সময় কাটাচ্ছে আর আমি কিনা আমাদের না হওয়া একটা সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিলাম! এটা ভাবতেই নিজের উপর কেমন ঘৃনা লাগছে। আমি যথারীতি আগের মতন ইহাদ ভাইয়ার চিন্তা মাথা থেকে দূর করে শুয়ে পড়লাম। পাশের রুমে দু’জন মানুষ রয়েছে তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা নিয়ে আর আমি না নয় বিরহে বিলীন না হয়ে এবার একটু নিজের মতন করে থাকলাম। হবে না তো কোনো ক্ষতি যদি তার কথা না ভাবি।

বন্ধুদের সাথে আড্ডা সেড়ে বাসায় আসতে একটু দেরি হয় ইহাদের। বাড়িতে এসে খাওয়া দাওয়ার পর আবারো বেরিয়ে গেছিলো এখন ফিরে এসেছে। রুমে এসেই প্রিমাকে দেখতে পেলো শার্ট, প্যান্ট পড়া অবস্থায় ঘুমাচ্ছে! ইহাদের কেমন জানি লাগলো বিষয়টি। অন্য মেয়ে হলে শাড়ী গয়না পড়ে নতুন বউ সেজে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতো আর এখানে প্রিমা ওয়ের্স্টান ড্রেস পড়ে ঘুমাচ্ছে! ইহাদ গিয়ে প্রিমাকে ডাকতে লাগলো,
–“প্রিমা, ওঠো আমি এসেছি তো। তুমি কি এখনো ঘুমাবে নাকি ওঠবে? আজকে এই রাত্রে তুমি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবে নাকি?”

ইহাদের গলা শুনে ঘুম ঘুম কন্ঠস্বরেই প্রিমা বললো,
–“তুমি এসেছো যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ো আমার পাশে।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৩

প্রিমার কথা শুনে ইহাদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো! আজ তাদের বাসর রাত আর আজকে কিনা প্রিমা ঘুমুতে বলছে কোনো হেলদোল নেই প্রিমার মাঝে ভাবতেই এবার রাগ লাগছে ইহাদের! কিন্তু পর মুহুর্তে প্রিমার দিকে তাকিয়ে দেখলো কেমন আরাম করে ঘুমাচ্ছে! হয়তো সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এখন আর জেগে থাকতে পারেনি। নিজ মনে এটাই ধারনা করে প্রিমার পাশে প্রিমাকে জড়িয়ে ধরেই রাত্রি পার করলো দু’জন।

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৫