প্রণয় বিরহ পর্ব ৪

প্রণয় বিরহ পর্ব ৪
অর্ষা আওরাত

ঝেঠিমার কথা শুনে কোনো কিছু না ভেবেই চলে গেলাম বাড়ির পিছন দিকটার দিকে! বাড়ির পিছনে পুকুরঘাটের সিঁড়িতে বসে আছি পা গুলো পানিতে ভিজিয়ে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রয়েছি পুকুরের সচ্ছ পানির দিকে। পুকুর ঘাটের পাশে ছোটো বড়ো গাছের পাতাগুলো বাতাসে হালকা দুলে ওঠছে। শরীর জুড়ে শীতল বাতাস দোলা দিয়ে গেলো। ছোটোবেলা থেকেই এই পুকুরের জায়গাটিই আমার ভীষন পছন্দের।

যখন আমার মন খারাপ হয় বেশি তখন এই পুকুরঘাট আমার সঙ্গী হয়। আজ একসাথে এতোকিছু ঘটেছে তাই মন খারাপের পাল্লাটা বড্ড বেশিই ওজনদায়ক হয়ে ওঠছে তাই এখানে এসে বসা। কেনো জানি পা গুলো পানিতে ভিজিয়ে বসে থাকতে তখন বড্ড ভাল্লাগে। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পুকুরের সচ্ছ পানির দিকে। পানিগুলো বেশ কিছুক্ষণ পরপর ঢেউ খেলে যাচ্ছে। হাঁসেরা সাতার কাটছে পরম আনন্দে এই সবকিছুর ভিতরেও নিজেকে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে ফেলেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইহাদ ভাইয়ার বিয়ে হবে অন্য কারো সঙ্গে তাও আবার আমারই চোখের সামনে ঘটবে পুরো বিষয় ভাবলেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠছে বারংবার! হৃদয় বলছে ইহাদ ভাইয়া আমার মস্তিষ্ক বলছে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তাকে ছেড়ে আসাই উত্তম! কিন্তু বেহায়া মন বারংবার ইহাদ ভাইয়ার কথাই মনে আনে। দেড় বছর ধরে ভালোবেসে গেছি আমি ইহাদ ভাইয়াকে কিন্তু আজ নিয়তির নিয়মে তাকে ভুলতে হবে। আমার ভালোবাসাটা একপাক্ষিক ভালোবাসা ছিলো তাইতো পরিনতি পেলো না!

সব কথা ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো! কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই মনে উদয় হলো আমার পিছন পিছন নিশ্চয়ই বৃষ্টি আপু এসেছে। বৃষ্টি আপু মনে করে কাঁধে থাকা হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় পুরে পিছন দিক ফিরে তাকাতেই অপর ব্যাক্তির হাতগুলো নিজের হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিলাম! এই লোকটিকে মোটেও আশা করিনি এখানে এই অবস্থায় দেখবো! তাকে দেখে বিরক্ত ধরে গেলো মনের ভিতর! নাক মুখ কুঁচকে তিক্ত স্বরে কিছু বলবো এর আগেই তিনি বলে ওঠলেন,

–“আমাকে কিছু বলবে তার আগে নিজে ভালো করে শোনো, এই অবেলায় এখানে পুকুর ঘাটে বসে আছো কেনো তুমি? শীতের মাস তো শুরু হয়ে গেছে এর ভিতর খালি গায়ে শীতল বাতাসে বসে কি এমন ধ্যান করছো? বাসায় গিয়ে পড়তে পারো না? সন্ধ্যা নামবে একটু পর এখানে বসে কি ভুত ধরার ইচ্ছে কষছো নাকি মনের ভিতর?”

–ব্যস শুরু হয়ে গেলো ওনার বকবক! এই জন্যই লোকটিকে দেখলে আমার গা পিত্তি জ্বলে যায় একেবারে! যখনি দেখবে তখনিই এক গাদা প্রশ্ন আর জ্ঞান এর ভাণ্ডার শুরু হয়ে যাবে ওনার। এই জন্যই এই লোকটাকে মোটেও পছন্দ নয় আমার। এই জ্ঞানী মহাশয় হলেন আমার আব্বুর বন্ধুর ছেলে। ওনার নাম হলো জাওয়াদ সেহেরিশ। বর্তমানে ওনার সাথে আমার যখনি দেখা হয় তখনি ওনি আমাকে তার জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান দান করতে প্রস্তুত থাকে সর্বদা যা প্রচন্ড বিরক্তিকর আমার ক্ষেত্রে! ওনার কথার পৃষ্ঠে জবাব দিতে মুখে বিরক্তিকর ভাবটা বেশ গাঢ় করেই বলে ওঠলাম,

–“হ্যাঁ আমি এখানে ভুত ধরতেই আছি এবার আপনার সেটা না দেখলেও চলবে। আপনি আপনার কাজ করুন মনোযোগ দিয়ে এখন এখান থেকে যাবেন?”
আমার কথাটি মহাশয়ের পছন্দ হলো না সেটা তার মুখশ্রী দেখেই বুঝতে পারলাম! তার বিরক্তি বাড়াতে আরো রেগে বললাম,
–“আপনি চলে যাবেন? নাকি আমি যাবো জাওয়াদ ভাই? আপনার এসব জ্ঞানের কথা বলেছি তো আমার ভাল্লাগে না।”

এবার মহাশয় দাঁড়ানো থেকে আমার সঙ্গে পুকুরের আরেকটি সিঁড়িতে বসে পড়লেন! আয়েশি ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন,
–“মুর্খদের জ্ঞান দিতে আমার বেশ ভালোই লাগে বুঝেছো জুঁই? তাই তোমাকে দিয়ে সেটা মাঝে মাঝে প্রয়োগ করি।”

কথাটির মানে বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো যখনি বুঝলাম উত্তর দিতে যাবো তখনি দেখি বেটা গায়েব! মানে উনি আমাকে মুর্খ বলে গেলেন আর আমি কিছু বলতে পারলাম না ভেবে রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে! ওনাকে দু চার কথা না শোনালে শান্তি পাবো না মনের ভিতর! বাড়ির ভেতর ছুট লাগালাম উদ্দেশ্য একটাই ওনাকে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিবো! ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মা টিভি দেখছে মা’কে সুজন ভাইয়ের কথা জিগেস করতেই মা এক কথায় উত্তর দিয়ে দিলো সে অনেক্ষন আগেই চলে গিয়েছে!

এবার সবটা পরিষ্কার হলো আমার সামনে ওনি বাড়ি থেকে যাবার পথেই আমাকে তার জ্ঞান শোনাতে এসেছিলেন! এখন পারলাম না কিন্তু সময় বুঝে এর সঠিক প্রয়োগ আমিও করবো বলে মনে মনে ঠিক করে নিলাম। হঠাৎই মনে হলো আমিতো ইহাদ ভাইয়ার ঘটনা মনে করে পুকুর ঘাটে মন খারাপ করে বসেছিলাম এই জ্ঞান এর ভাণ্ডার লোকের সাথে কথা বলতে বলতে আমার তো ইহাদ ভাইয়ার কথা মাথায়ই ছিলো না এতোক্ষণ! সত্যি লোকটা এসে আমার ভালোই হলো একপ্রকার। ইহাদ ভাইয়ার ভাবনা থেকে তো বেরোতে পারলাম। এই জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য কিন্তু আমাকে যে মুর্খ বলেছে সেটাও আমার বেশ ভালো করেই মনে আছে তাই ধন্যবাদ ক্যান্সেল করে দিলাম! কানে আজানের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতেই মাথায় ঘোমটা খানি ভালো মতন টেনে দিয়ে ওজু করার উদ্দেশ্য চলে গেলাম নিজ রুমে।

রাত্রেবেলা জানলার পাশ ঘেঁসে বসে বসে নীল জোৎসা ভরা আকাশ দেখতে ব্যস্ত আমি। গোটা আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারাদের মেলা বসেছে যেনো। তাদের আলোকসজ্জায় গোটা আকাশ সজ্জিত হয়ে ওঠেছে। বড়ো থালার মতন সচ্ছ চাঁদ মামা ওঠেছে আকাশ জুড়ে! যার কিরন ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা ধরনীর বুকে ফলস্বরূপ রাতের ঘুটঘুটে ভাব কমে গিয়ে চন্দ্রের আলোয় আলোকিতো হয়ে আছে ধরনীর বুক।

ঝি ঝি পোকাগুলো ডেকে জানান দিচ্ছে তারাও এখনো ঘুমায়নি আমার মতন। অন্যদিন হলে এই ঝি ঝি পোকার আওয়াজ বন্ধ করতে দরজা জানলা সব বন্ধ করে দিতাম কিন্তু আজকে কেনো জানি ঝি ঝি পোকার আওয়াজ ও শুনতে ভালো লাগছে। পড়ার টেবিলে বসেছিলাম কিন্তু সারাদিনের তিক্ত স্মৃতি মনে পড়তেই বইয়ের পৃষ্ঠায় মনোযোগ স্থাপন করতে পারলাম না যার ফলস্বরূপ এখন বসে বসে বাইরে চন্দ্রবিলাস করতে ব্যস্ত আমি। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ন’টার ঘরে এসে পৌছুলো। দরজায় কড়াঘাত শুনতে পেলাম দরজা খুলতেই বৃষ্টি আপু এসে বললো,

–“তুই রুমে বসে বসে কি করছিস এখনো? ওদিকে যে নিচে সবাই সব কথা বলে ফেলছে। যদি শুনতে চাস তো নিচে আয় তাড়াতাড়ি।”
আপুর কথার মাথা মুন্ডু কিছুই না বুঝে স্থির হয়ে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। একটু আগেই সবাই খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছিলো তাহলে এখন কি এমন কথা বাকি রয়ে গেলো যে এখনি সবাই নিচে কথার আসর জমিয়েছে? আর না ভেবে এবার নিচে গেলাম কি হয়েছে জানার জন্য। নিচে সবাই রয়েছে আমার বাবা, মা, কাকু, কাকী, ঝেঠা, ঝেঠিমা আর ইহাদ ভাইয়াও রয়েছে। সবার দৃষ্টি আড়াল করে আড়চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম অদ্ভুত ঘোর লাগানো মানুষটির দিকে। হঠাৎই চোখ চোখ পড়তেই দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে ফেললাম। বড়ো ঝেঠু ইহাদ ভাইয়াকে বলতে লাগলো,

–“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো কি জন্য এখানে ডাকা হয়েছে তোমাকে?”
–“জ্বি আব্বু আমি বুঝেছি। বিকেলে মা বলেছিলো তোমরা এই বিষয়ে কথা বলতে পারো আজকে।”
মুখে গম্ভীর ভাব স্থির রেখে ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে ওঠলো,
–“তুমি তোমার কাজের জন্য বাহিরে চলে যাবে আসতে আসতে দেরি হবে। তাই আমরা চাচ্ছিলাম দশ বারো দিনে ভিতর তোমার বিয়েটা সম্পন্ন করে ফেলতে। এখন তুমি বলো তোমার কি কোনো পছন্দ আছে? নাকি আমরা মেয়ে দেখবো।”

ঝেঠুর কথা শুনে বুঝতে বাকি রইলো না এখন ইহাদ ভাইয়া তার ভালোবাসার মানুষের কথা জানাবে। আর তারপরে হয়তো তাদের বিয়েও ঠিক হয়ে যাবে। আমার ভাবনার মাঝেই ভাইয়া বলে ওঠলো,
–“জ্বি আমার পছন্দ আছে! আমি ভালোবাসি একজনকে এবং তাকেই বিয়ে করতে চাই।”
–“তুমি একজনকে ভালোবাসো সে সম্পর্কে কি তোমার পরিবারের কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি?”

ঝেঠুর কথা শুনো ইহাদ ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠলো,
–“আমি মা’কে বলেছিলাম মা জানে সবটা।”
ভাইয়ার বলা কথা শুনে প্রত্যেক এর দৃষ্টি চলে গেলো ঝেঠিমার দিকে। ঝেঠিমা চুপচাপ ভাবে আগের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না ঝেঠিমাকে। বাড়ির কর্তা হলো ঝেঠু ঝেঠু যখন কিছু বলেনি তাই কেউ আর কিছু বলেনি। ঝেঠু ইহাদ ভাইয়াকে বললো,

–“তাহলে এখন সবটা আমাদেরকে খুলে বলবে কি? না হলে তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিভাবে আগাবো?”
ঝেঠুর কথা শুনে ভাইয়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠলো। হাসোজ্জল মুখে বলতে লাগলো,
–“আব্বু মেয়েটির নাম প্রিমা ও এই বছরই অর্নাস ফাইনাল দিবে। ওর সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ হয় তারপরেই আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে ওঠে। আট মাসের মতন আমরা এক সঙ্গে আছি এখন আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই।”

প্রণয় বিরহ পর্ব ৩

–“ঠিকআছে তাহলে ওর বাড়ির ঠিকানা দাও আমরা বাড়ির সবাই মিলে কালকে মেয়েকে দেখে আসবো যদি সব ঠিক থাকে তাহলে কিছুদিনের ভিতরেই তোমাদের বিয়ে ঠিক হবে।”
ভাইয়া ঝেঠুকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে হাসোজ্জল মুখ নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। হয়তো এখনি প্রিমাকে ফোন করে সবটা বলবে। এখন তাদের বিয়েও হবে আমার সামনে সেটা আমাকে নিজের চোখেও দেখতে হবে সবটা! বিরহ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে কমার বদলে! তবুও সবটা নিরবে সয়ে যাবো।

প্রণয় বিরহ পর্ব ৫