প্রণয় বিরহ পর্ব ৫

প্রণয় বিরহ পর্ব ৫
অর্ষা আওরাত

শীতের সকাল চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে! সজল দৃষ্টি যতোদূর যায় অতদূরই কেবল কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। পৌষ মাসের শুরু কেবল আর এই মধ্যেই শীতের প্রকোপ বেশ গাঢ় হয়ে ওঠেছে। খুব ভোরে জেগে ওঠা পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে মুখরিতো চারিপাশ। এই শীতের সকালে লেপ মুড়ো দিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছি ঠিক তখনি কারো গরম নিশ্বাস এর উত্তাপ যেনো গায়ে আছড়ে পড়ছে!

প্রথমে ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিই কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন আমার চোখ মুখে ঠান্ডা পানির ছিটা লাগতেই পুরো শরীর যেনো ছ্যাৎ করে ওঠলো! শীতের ঠান্ডা সকালে ঠান্ডা পানি যেনো গায়ের সব গরম ভাব দূর করে দিলো! আর বসে থাকলাম না এবার শোয়া থেকে ধপ করে ওঠে বসলাম! ওঠেই সামনের মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেঁসে যাচ্ছে তা দেখে শরীরের জ্বালা আরো বেড়ে গেলো কয়েক ধাপ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘড়ির কাঁটায় চোখ বোলাতেই দেখতে পেলায় মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে। শীতের সকাল হওয়ায় এখনো রৌদ্র ওঠেনি যার ফলে এখনো বেশ ভোরই বলা যেতে পারে। নিজেকে প্রস্তুত করলাম সামনের বসে থাকা লোকটিকে আচ্ছা মতন বলবো কিন্তু এর আগেই মস্তিষ্কে প্রশ্নের আর্বিভাব ঘটলো এই লোকটি এই সাত সকালবেলা আমার রুমে কি করছে? প্রশ্নের ঝুড়ি মাথায় আসতেই কাল বিলম্ব না করে সেহেরিশ এর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,

–“আপনি এই এতো সকালবেলা আমার রুমে কি করছেন? আমাকে এভাবে ঠান্ডা পানির ছিটা দেওয়ার মানে কি আপনার? কি উদ্দেশ্য এসেছেন এখানে বলুন?”
আমার প্রশ্ন শুনে লোকটি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বললো,

–“তুমি যেরকম ভাবছো মোটেও সেরকম কিছু না! তোমার মনে নেই আজকে ইহাদের জন্য মেয়ে দেখতে যাবার কথা ছিলো? আমি সেই জন্যই এখানে এসেছি। তোমাদের বাড়ির ড্রাইভার অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর ইহাদও নাকি ড্রাইভ করতে পারবে না এতোক্ষণ। আর বাকি যারা আছে মানে তোমার কাকা, বাবারা তাদের বয়স হয়েছে এতো ঘন্টা ড্রাইভিং করতে পারবে না? কালকে তোমার ঝেঠুর সঙ্গে কথা বলছিলাম কথায় কথায় ওনি জানতে পেরে গেছিলো আজকে আমার অফিস ছুটি। তাই আমাকে বললো সকাল সকাল চলে আসতে কারন ইহাত যে ঠিকানা দিয়েছে তা বেশ দূরেই পৌছুতে পৌছুতে তিন চার ঘন্টা লাগবে তাই এখন এতো তাড়াতাড়ি রওনা দেবার জন্য এসেছি। এবার কি বুঝেছো?”

সেহেরিশ এর কথা শুনে এক মুহুর্তের জন্য ইহাদ ভাইয়ার বিয়ের কথা মনে পড়ে গেলো! সঙ্গে সঙ্গেই মনটা একরাশ খারাপ লাগায় ডুব দিলো! বিষন্ন মন নিয়ে সেহেরিশের কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে আছি ঠিক তখনি ওনি বলে ওঠলেন আবার,
–“তোমার মতন বাঁচাল মেয়ে চুপ করে আছে এটাও সম্ভব! আর তুমি জিগেস করলে না যে আমি তোমার রুমে এসেছি কেনো?”

–প্রথম কথা শুনে মন খারাপ জানলা দিয়ে পালিয়ে মনের ভিতর সেহেরিশ এর জন্য এক বালতি রাগের উপদ্রব হলো সারা অঙ্গে! শেষমেশ কিনা আমি বাঁচাল! কথার উত্তর দিবো কিন্তু তখনি দিত্বীয় কথাটি মনে উদয় হলো সত্যিই তো উনি এই সাত সকালবেলা আমার রুমে কি করছেন সেটা তো একবারো জিগেস করা হলো না! দেরি না করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ওনার দিকে,

–“হ্যাঁ আপনি কি করছেন আমার রুমে সেটা বলুন? আমার চোখে মুখে পানির ছিটা দিলেন কেনো?”
–“এই তো বাঁচাল মেয়ের মুখের তালা আবারো খুলেছে দেখছি! এখন আর ওনার মুখ বন্ধ রাখা অসম্ভব ব্যাপার! তাল দিতে হবে দেখছি আবার নয়লে কানে শুনতে পাবো না। শোনো তাহলে তোমার রুমে এসেছি কারন আমি যখন নিচে ড্রয়িং রুমে তোমাদের সবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখনি তোমার আব্বু আমাকে বললো যে “আমার মুর্খ মেয়েটা এখনো গাধার মতন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে তুমি গিয়ে গাধাটাকে যেভাবে পারো একটু ঘুম থেকে জাগ্রত করে নিয়ে আসো।”

ব্যস আমিও বাধ্য ছেলের মতন মুর্খ গাধার মতন ঘুমাচ্ছিলো সেই মেয়েটাকে ডাকতে চলে আসি। এসে দেখি আংকেল বলেছিলো সে মুর্খ আর গাধা কিন্ত আমি এসে দেখি সে আস্ত এক পাগল! হ্যাঁ পাগলের মতনই চুল গুলো খোলা রেখে কিরকম উপুর হয়ে শুয়ে ছিলো! তাই প্রথম আমি চুপ করে ছিলাম যদি পাগল আমাকে কামড়ে দেয়! তারপরই যখন দেরি হয়ে যাচ্ছিলো পানির ছিটা দিয়ে পাগলটিকে সজাগ করার চেষ্টা করলাম এবং তাতে আমি সফলও হয়েছি।”

প্রথমে বাঁচাল তারপর মুর্খ তারপর গাধা শেষমেশ পাগল বলে আখ্যায়িতো করলো আমায়! এ অপমান কিছুতেই মানবার নয়। রাগের চোটে চোখমুখ কুঁচকে চেহারায় রাগী রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলে সেহেরিশ এর দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝে জোরে এক চিৎকার দিয়ে বলে ওঠলাম,
–“আপনি যাবেন এখান থেকে?”

চোখ খুলতেই ব্যস সেহেরিশ গায়েব! যখন আমি রেগে যাই তখনি চিৎকার করা ছাড়া নিজকে শান্ত করতে পারি না! ভালোই হয়েছে সেহেরিশ নিজ থেকে চলে গেছে নয়তো আমাকে মুর্খ,গাধা,বাঁচাল, পাগল বলার মজা আজকে দেখিয়ে দিতাম। কেনো জানি এই বদমাশ ছেলেটা আমার পিছু লাগে সবসময়! আড়মোড়া ভেঙে বিছনা থেকে ওঠে ফ্রেশ হতে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে একটা লাল রঙের থ্রিপিস পড়ে নিচে নেমে আসলাম।

নিচে নামতেই সবাই নাস্তা খাচ্ছে দেখত পেলাম। বৃষ্টি আপু তৈনী হবার জন্য নিজের রুমে গেলো আর বাদ বাকিরা খেয়ে দেয়ে রুমে চলে গেছে। ওই ব্যাটা বদমাইশ সেহেরিশ সোফায় চুপ করে বসে ফোন চালাচ্ছে! এখন কি ভালো মানুষ যেনো ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না আর একটু আগে আমাকে কতোগুলো কথা শুনালো। ওই ব্যাটার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে চুপচাপ নাস্তা খেতে বসলাম।

খাওয়া শেষ করে ওঠতে যাবো তখনি আর্বিভাব ঘটলো ইহাদ ভাইয়ার! হাসোজ্জল মুখ নিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে আসছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছে! শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি গায়ে পরিধান করে তার সঙ্গে হাতে ঘড়ি চু্লগুলো পিছন দিক ফিরে আঁচড়িয়ে রেখেছে। আর তার ফর্সা সুন্দর গঠনের মুখশ্রী তো আছেই। টেবিলে বসে আমি ভাইয়াকে দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি! ধ্যান ভাঙলো যখনি ভাইয়া আমার পাশের চেয়ার বসে তুড়ি মেরে বললেন,

–“আমি জানি আমি সুন্দর কিন্তু এভাবে না তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয় না হলে তোকে ফেলে রেখেই যেতে হবে। আর শোন এই লাল টুকটুকে রঙে জামা পড়বি না সাদা বা কালো রঙের জামা পড়ে তার সাথে ম্যাচিং হিজাব পড়ে আসবি আর বেশি সাজগোজও করবি না কারন ওখানে তোকে কেউ দেখতে যাবে না বুঝেছিস? এখন বুঝে থাকলে যেভাবে বলেছি ঠিক ওইভাবেই সেজে আয়।”

–ভাইয়ার কথায় মনে পড়লো সত্যিই তো তার এই সাজ, সজ্জা সবকিছুইতো অন্য কারো জন্য! সেখানে আমার তাকানো বড্ড বেমানান। কেনো জানি ভাইয়ার এরূপ কথা শুনে আমার নিজের প্রণয়ের বিরহ বেশ ভালো করেই জাগ্রত হলো মনের গহীন কোনে! এখনই ভাইয়ার কথা শুনে যেনো কান্না চলে আসছে আর তখন কি হবে? মন চাচ্ছে ওখানে যাবো না গেলে নিজের প্রিয় মানুষটিকে অন্য কারোর হতে দেখলে যে বড্ড পোড়াবে এই পোড়া মন। কিন্তু আবার কেনো জানি যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে ওই মেয়েটিকে একবার দু-চোখ ভরে দেখার জন্য কি আছে ওর মধ্যে? আর ওখানে না গেলে তো নিজের চোখে সবটা দেখতেও পারবো না তাই যতোই বিরহ বাড়ুক না কেনো সবটা জানার জন্য আমি যাবো।

ভাইয়ার কথা মোতাবেক একটা ধূসর রঙের জামা আর কালো রঙের হিজাব পড়ে তৈরী হয়ে নিচে নেমে আসলাম। সবাই রুমে আছে আরো পাঁচ মিনিটের ভিতরই বেড়িয়ে পড়বে। নিচে সোফায় ইহাদ ভাইয়া আর সেহেরিশ বসে আছে। আমাকে নিচে নামতে দেখে ইহাদ ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো! আমি বুঝলাম না ভাইয়া কেনো এমন করছে? সেহেরিশ ভাইয়া আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারো নিজের ফোনে মনোযোগী হলো! তার এরুপ ব্যবহার দেখে একটু চমকালাম! লোকটা একবারো কিছু জিগেস করলো না?

সারাক্ষণ বকবক করে আর এখন চুপ করে সবটা দেখে যাচ্ছে? ইহাদ ভাইয়া আমার হাত তার হাতে রেখে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম তার স্পর্শ পেতেই এক অদ্ভুত শিহরন বয়ে গেলো সারা শরীর জুড়ে! যতোই হউক তাকে তো আমি ভালোবাসি তার স্পর্শ আমার কাছে বিশেষ! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তবে এটুকু বিশ্বাস আছে তার প্রতি সে আমার কোন অসম্মান করবে না। সব থেকে বড়ো কথা তো সে অন্য কারোর ভালোবাসার মানুষ।

প্রণয় বিরহ পর্ব ৪

কিন্তু আমাকে টেনে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে কে জানে? ভাগ্যিস সবাই নিজের রুমে ছিলো নতুবা দেখলে নানান কথা ওঠতো। শেষমেশ ভাইয়া আমাকে বাড়ি থেকে বের করে পিছন দিকটার বারান্দায় নিয়ে এসে দাঁড় করালো! আমার মনে তখন একটাই প্রশ্ন যে ভাইয়া আমার সঙ্গে দরকার ছাড়া কথা বলে না সে এভাবে টেনে নিয়ে আসলো কেনো আমাকে?

প্রণয় বিরহ পর্ব ৬