প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৯

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৯
তানজিলা খাতুন তানু

আকরাম খাঁন আদৃতকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই আদৃত নিজে থেকেই বলল,
– আপনি আমার বাড়িতে, কোনো প্রয়োজন!
– হ্যাঁ একটা দরকারেই এসেছিলাম। তবে তুমি কি আমাকে চেনো?
প্রশ্নটা আদৃতের কাছে অদ্ভুত লাগল। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– আপনাকে কে না চেনে, আমিও সবার মতোই চিনি। তবে কোথাও না কোথাও একটু বেশিই।
– মানে?
– মাম্মাম তুমি ভেতরে যাও।
– আচ্ছা।

আরু দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আকরাম খাঁন এখনো কিছুই বুঝতে পারেননি।
– আপনি কি দরকারে এসেছেন বলুন।
– আমি অতসীর বিষয়ে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
– কি কথা।
– অতসীর সাথে আদৃতের বিয়ের বিষয়ে।
আদৃত আর ওর মা দুজনেই চমকে উঠল। আদৃত বলল,
– আপনি কি সবকিছু জেনেই বিয়ের কথা বলতে এসেছেন!
– কি সবকিছু?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদৃত বুঝলে আকরাম খাঁন এখনো পর্যন্ত কিছুই জানেনি। তারমানে অতসী ওনাকে কিছুই না জানিয়ে,এইখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু কেন? এখন সত্যিটা জানলে তো একটা খারাপ সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে। আদৃত কোনো কিছুই না ভেবে বলল,
– আমার অতীত।
– না অতসী আমাকে কিছুই বলেনি। শুধুমাত্র তোমাকে বিয়ে করতে চাই এই কথাটা বলেছে। আর আমি আমার মেয়ের ইচ্ছা রাখতেই এইখানে এসেছি।

– এই কাজটাই যদি ৭বছর আগে করতেন তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না।
আদৃত তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে কথাটা বলল। আকরাম খাঁন কিছুই বুঝল না, সবটাই ওনার কাছে এলোমেলো লাগছে।
– কি বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বলো।
– রুহিকে চেনেন?
আবারো রুহি। আকরাম খাঁন বিরক্ত হলেন, সবকিছুতেই কেন যেন বারবার রুহি নামটা চলে আসছে।
– হ্যাঁ, আমার.. (অন্যকিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, অতসী কে কথা দিয়েছে সত্যিটা কাউকে জানতে দেবে না।) আমার বড়ো মেয়ে।
– রুহি আমার স্ত্রী।
আকরাম খাঁন প্রচন্ড পরিমানে চমকে উঠল। রুহির স্বামীর সাথে অতসী বিয়ে করতে চাইছে এইটা মেনে নিতে ওনার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

– রুহি আমার হাত ধরেই ৭বছর আগে চলে এসেছিল, এবং ৫বছর আগে আমাদের সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে মা’রা যায়। এই সত্যিটা জানার পরেও কি আপনি আপনার ছোট মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবেন?
আকরাম খাঁন সোফাতে বসে পড়লেন। অতসী এইভাবে ওনাকে অপদস্থ করবে সেটা কখনোই ভাবতে পারেনি। যেই ছেলেকে ৭বছর আগে প্রত্যাখান করেছিলেন আজ তার কাছেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। অপমানে লজ্জাতে মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে আকরাম খাঁনের।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছে অতসী। ওহ যে এই বাড়িতে আছে সেটা আরু আর আদৃতের মা জানেন, তবে সবকিছুর মাঝে আদৃতের মা কথাটা ভুলেই গেছেন। অতসী দেখতে চেয়েছিল ওর বাবা কি করে, আর তার জন্যই আরুকে তাড়াতাড়ি পড়াতে এসেছিল।

– সরি বাবা। আমি জানি তুমি অপমানিত বোধ করছ, কিন্তু এটার যে অনেক দরকার ছিল। তোমাকে বোঝানোর দরকার ছিল, কাউকে ছোট করলে নিজেকেও ছোট হতে হয়। কাউকে অবহেলা অপমান করলে সেটা একদিন নিজের কাছেও ফিরে আসে। তুমি তোমার জেদ ও টাকার কারনে কিছুটা হলেও অহংকারী হয়ে উঠেছিলে, সেই অহংকার টাকেই আমি শেষ করে দিতে চাই।
আকরাম খাঁনকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে, আদৃত ওনার সামনে বসে বলল,

– আপনাকে বাবা বলার অধিকার আমার আছে কিনা জানি না, তবুও বাবা বলছি। আপনি আমার বাবার বয়সী, আমার গুরুজন। সেইদিন সত্যি আমি আপনার বড়ো মেয়ের যোগ্য ছিলাম না, বাবাকে হারিয়ে আমাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। আমিও বেকার ছিলাম, তবে কয়েকদিন সময় দিলে আমি ঠিকই দাঁড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আপনি আমার সাথে কথা না বলে, শুধুমাত্র আমি বেকার বলে রুহির অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে দিলেন। সেইদিন যদি আপনি বিয়ে ঠিক না করে আমার সাথে একবার কথা বলতেন তাহলে হয়তো এইসব কিছুই হতো না।
আকরাম খাঁন আদৃতের কথাগুলো শুনে নিজের মনেই উপলব্ধি করলেন। হ্যাঁ সেইদিন যদি জেদ দেখিয়ে বিয়েটা ঠিক না করে আদৃতের সাথে দেখা করতেন তাহলে হয়তো এতকিছু ঘটত না।

– রুহি আপনাদের ছেড়ে এসে ভালো ছিল না। একা সময়েই আপনাদের কথা মনে করে কাঁদত। আর আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে গেছে, সফল হবার জন্য যাতে আমাকে নিয়ে আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, গর্ব করে বলতে পারে ভুল মানুষকে বেছে নেয়িন। আমিও প্রতিষ্ঠিত হলাম আর রুহির প্রেগন্যান্ট হবার খবর জানতে পারি। তখন রুহি নিজের মত পাল্টে ফেলে, বেবি হবার পর আপনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে পেয়ে আপনারা কখনোই ওকে ফিরিয়ে দেবেন না এই আশা নিয়ে দিন কাটাতে থাকে। আমাকে সবসময়েই বলত,

– আমাদের বেবি দেখলে বাবা কখনোই আর আমাদের উপরে রাগ করে থাকতে পারবে না দেখবে।
– হুমম তাই যেন হয়।
– জানো আমার না খুব মন খারাপ হয়, প্রতিটা মেয়েই তার প্রথম সন্তানের সময়ে বাবার বাড়িতে থাকে কিন্তু আমি সেটা তো দূর তাদেরকে নিজের পাশেই পাচ্ছি না।
– কেন আমরা কি তোমার দেখাশোনা ঠিক মতো করতে পারছি না।
– আরে না। তোমরা তো আমাকে রাজরানির মতো রেখেছ। মা মিতু তুমি সবাই আমার খুব খেয়াল রাখো। তবুও
– আচ্ছা বাদ দাও মন খারাপ করো না।

– আমরা রুহির খেয়াল রাখলেও ও আপনাদেরকে পাশে চাইত কিন্তু আমি ওকে সেটা দিতে পারিনি। প্রেগন্যান্সির দিন যত বাড়তে লাগল রুহির ছটফটানি ততই বাড়তে লাগল, আপনাদেরকে দেখার জন্য আকুল হয়ে পড়তে লাগল। বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে রেখেছিলাম যে বেবি হবার পর ওকে নিয়ে যাবো কিন্তু তার আগেই রুহি সবকিছু ছেড়ে চলে গেল।
আদৃত নিজের চোখের কোনের পানিটা মুছে নিল। আকরাম খাঁনের চোখেও পানি চিকচিক করছে, রুহি নিজের মেয়ে না হলেও কখনোই ওকে নিজের মেয়ের থেকে কম আদর ভালোবাসায় বড়ো করেননি। কিন্তু নিজের জেদ, অহংকারের বশে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আজকে আদৃতের কথাগুলো ওনার হৃদয়ের অহংকারগুলোও ভেঙে পড়তে লাগল।

– রুহি চলে যাবার পর আমি আর আপনাদের মুখোমুখি হতে পারিনি। একটা ভয়ে, আপনারা যখন জিজ্ঞেস করবেন রুহি কোথায় তখন কি জবাব দেবো। সেই ভয় থেকেই আমি আরুকে আপনাদের থেকে দূরে রেখেছি পারলে আমাকে মাফ করে দেবেন।
– আমার দিদিভাই কে একটাবার ডাকবে।
আদৃতের মা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
– আমি ডাকছি।
উনি চলে যেতেই, আকরাম খান আদৃতের হাতটা ধরে বলল,

– আমাকে মাফ করে দিও আমি নিজের জেদ, অহংকারের বশে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। মাফ করে দিও।
– এইভাবে বলবেন না আপনি আমার গুরুজন। আর ভুল সবাই করে, কিন্তু ভুলটাকে স্বীকার করতে কজন পারে।
আদৃতের কোমল ব্যবহারে আকরাম খাঁন মুগ্ধ হলেন, সত্যি ছেলেটার তুলনা হয় না। এই কয়েকমিনিটেই ওনার মন জয় করে নিয়েছে, এই জন্যই কি ওনার দুই মেয়েই আদৃতের জন্য পাগল। আকরাম খাঁন আফসোস করতে থাকে, সেইদিনের জন্য। যদি একবার আদৃতের সাথে দেখা করতেন তাহলে হয়তো জীবনের ৭টা বছর এইভাবে কা’টত না।
আদৃতের মা আরুকে নিয়ে এসে আকরাম খাঁনের উদ্দেশ্য বললেন,

– আরু দিদিভাই, ওইটা তোমার দাদুভাই হয় যাও ওনার কাছে।
দিদুনের কথা শুনে আরু আদৃতের দিকে তাকাল, আদৃত অনুমতি দিতে আরু এগিয়ে গেল। আকরাম খাঁন আরুকে কোলে তুলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন।
– আমার দিদিভাই।
আনন্দে ওনার চোখে আবারো পানি চলে আসলো। ছোট আরু কিছুই বুঝল না। পিটপিট করে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকল।
সকলেই খুব খুশি, অতসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সবকিছুই ঠিকঠাক হয়েছে।

– তাহলে দাদা আপনি রাতে খেয়ে বাড়ি যাবেন, আমি রান্নার ব্যবস্থা করছি কেমন।
– আরে না আজকে নয় অন্যদিন। আদৃত আমার প্রস্তাবটার কি হবে।
– কি প্রস্তাব।
– অতসীর বিষয়টা?
আদৃত চুপ করে থাকল। আকরাম খাঁন বুঝল আদৃত এখন এই বিষয়ে কথা বলতে পারছে না।
– ওকে আজকে আমি আসছি। পরে কথা হবে। আর আদৃত একদিন তুমি সবাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসো, সবাই খুব খুশি হবে।

– আচ্ছা চেষ্টা করব।
– আসছি।
– চলুন আপনাকে আগিয়ে দিয়ে আসি।
– চলো।
আদৃত আকরাম খাঁনকে নিয়ে এগিয়ে গেল। আকরাম খাঁন গাড়িতে উঠার আগে বলল,
– আদৃত আমি সত্যি সবকিছুর জন্য অনুতপ্ত, পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
– হুমম। বাবা আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
– কি বলো।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৩৮

– বাবা আমি অতসী কে বিয়ে করতে পারব না। আপনি প্লিজ ওর পাগলামীতে সায় দেবেন না।
– কিন্তু কেন?
– আসলে বাবা…
আদৃতের কথা শুনে আকরাম খাঁনের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল।

প্রয়োজনে প্রিয়জন পর্ব ৪০