প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৮

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৮
তানিশা সুলতানা

ভিড় জমেছে প্রচুর। মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না মেয়েটার কাছে। কাদামাটি থেকে তুলেও আনছে না। বড় রাস্তায় জিপ গাড়ি নিয়ে ঢুকতেই পেছন থেকে অন্য গাড়ি ধাক্কা মারে অভির গাড়িটিকে। আল্লাহ সহায় ছিলো বিধায় গাড়ি থেকে ঠিক সময়ে বের হতে পেরেছিলো অভি।

হাতে সামান্য ব্যাথা পেয়েছে। বড় রাস্তা হতে পায়ে হেঁটে কাঁচা রাস্তায় নামতেই চোখে পড়ে এই দৃশ্য। শতশত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মনে সন্দেহ জাগে অভির। এগিয়ে যায় ভিড়ের কাছে। এবং ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে। উলঙ্গ অবস্থায় নিথর দেহখানা পড়ে থাকতে দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় দেহ খানার দিকে। নিজের পরনের শার্ট খুলে তা দ্বারা দেহটাকে পেঁচিয়ে কোলে করে তুলে এনে রাস্তায় রাখে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঠান্ডা হয়ে গেছে, একদম নেতিয়ে পড়েছে। নিঃপাপ মুখ খানা। বড্ড চেনা চেনা লগছে এই মুখটা। কোথাও একটা দেখেছে। বাচ্চা মেয়েটা। এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়ে নারীর রূপধারণ করেনি তার ছোট্ট শরীরটা। আকর্ষনী নয়। তবুও কিছু পুরুষ লোভ সামলাতে পারলো না।

মেয়েটার সাড়া গায়ে আঁচড়ের চিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে আছে পা জুড়ে। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।
“মেয়েটা এতোখন বেঁচে ছিলো। তাকে কেনো হাসপাতালে নিয়ে যান নি?
শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে মানুষদের দিকে। মধ্য বয়স্ক একটা লোক জবাব দেয়
” নষ্ট মাইয়া। এরে ডাক্তার দেখাইয়া বাঁচানোর মানে সমাজের দুর্নাম। এই কলঙ্কিনী মাইয়ারে দিয়া বাপ মায় কি করতো? এর থিকা ভালো হইছে মইরা গেছে।

স্তব্ধ হয়ে কিছু খন লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে অভি। নিজের মেয়ের এমন অবস্থা হলে সে কি এই কথা বলতে পারতো?
“একটা প্রাণের থেকে দুর্নামটা বড় হয়ে গেলো? মেয়েটার এখানে কি দোষ?
আরেকটা লোক বলে ওঠে
” মাইয়াডারে তো আর বাড়ি থিকা তুইলা আইনা ভোগ করা হয় নাই। মাইয়া মানুষের পড়ালেখা করনের কি দরকার?

বাড়ি থিকা বাইর হইবো কেন?
এই মাইয়ারে সারাক্ষণ টইটই করতে দেখা যায় এদিক ওদিক। ভালোই হইছে।
প্রতিবাদ করার মতো অনেক কথা থাকলেও অভি চুপ করে যায়। শক্ত মনের অভি মনে মনে নেতিয়ে পড়ে। তার বোনটাও তো স্কুলে যায়। আর পূর্ণতা সেও তো স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরবে।

পূর্ণতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ইফতির দিকে। অভি ফিরবে না? মনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করলেও বাইরে নিজেকে শক্ত রাখে পূর্ণতা।
“আমার উনি ফিরবে। আমার কাছে তাকে ফিরতেই হবে। কখনো আবোলতাবোল কথা বলবেন না আপনি বলে দিলাম।

ইফতি জবাব দেয় না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে পূর্ণতার মুখের দিকে। মনের কি জোর মেয়েটার। কতোটা নিশ্চিত সে। মাত্র দুই দিনেই এতো ভালোবাসা? মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েও নিজেকে বেশ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালায় ইফতি।
প্রসঙ্গ পাল্টে বলে ওঠে
” আমি বলতে চাচ্ছিলাম ভাই কাজে গেছে। আজকে নাও ফিরতে পারে। তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।
মন খারাপ হয় পূর্ণতা। মানুষটা বলে গিয়েছিলো আজকে সে পূর্ণতাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যাবে। অথচ আজকে ফিরবেই না?

ইফতি বুঝে ফেলে। বয়সের তুলনায় পূর্ণতা একটু বেশিই বুদ্ধিমতি। ভুংভাং করে তাকে নেওয়া যাবে না। তাই সরাসরি বলে
“তোমার বোন আর বেঁচে নেই। তাকে শেষবার দেখতে চাইলে আমার সাথে চলো৷
কিছু খন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পূর্ণতা।

মনে পড়ে পাখির সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো। প্রচন্ড চঞ্চল মেয়ে ছিলো পাখি। সারাক্ষণ দৌড়া দৌড়ি করাই ছিলো তার স্বভাব। এর থেকে আম চুরি করতো, ওর গাছ থেকে লিচু। এর জন্য মা ই রও খেতো প্রচুর। তেরো বছরের পাখিকেও ওরা বাঁচতে দিলো না? ওদের এতোই চাহিদা নারীর শরীরের? দশ মিনিট মজা করার জন্য ওরা মেয়েদের জীবনের পরোয়াও করে না?

আল্লাহ ওদের বিচার করবে না? শাস্তি দিবে না?
সালাম এর বাড়ির উঠোনে খাটিয়াতে পাখিকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। গোছল করানো হয়েছে কিছু খন আগেই। বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। সকলেই শেষ বার দেখতে এসেছে পাখিকে। কেউ কেউ দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে তো কেউ কেউ উপহাস করছে।

চিৎকার করে কাঁদছে সেলিনা। সালাম কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।
ইফতির সাথে জিপ গাড়িতে করে এসেছে পূর্ণতা। সারা রাস্তা একটুও কাঁদে নি সে। চুপচাপ বসে ছিলো। বাড়ির উঠোনে গাড়ি থামতেই নেমে যায় পূর্ণতা। ছোট ছোট পা ফেলে পাখির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁটু মুরে বসে পড়ে খাটিয়ার পাশে।

দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখতে থাকে গোলগাল মুখখানা।
এই উঠোনে দু বোন কতো খুনশুটি করেছে। খেলেছে কতো। সেই বোনটা আর কখনো খেলবে না। বুনু বলে ডাকবে না। আম চুরি করে এনে বলবে না “বুনু মালিক বোকা। আমাকে ধরতে পারে নি”
এখন আর কারোর হাসির ঝলকে বাড়িটা মুখরিত হবে না।

“আমার কলিজা যারা খালি করলো তাদের কলিজায় আগুন লাগিয়ে দিবো আমি।
বিরবির করে বলে পূর্ণতা। চোখ ভর্তি পানি তার। হাত এগিয়ে দেয় পাখির মুখটা ছুঁয়ে দেখার জন্য অভি বাঁধা দেয়।
পূর্ণতা অভির দিকে তাকায় এক পলক।
” ছুঁয়ে দিও না পূর্ণতা। দোয়া করো বোনের জন্য।

অভির হাত জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে পূর্ণতা। এতোখন আটকে রাখা কান্না যেনো উগড়ে দিচ্ছে। পূর্ণতার চিৎকারে আশেপাশের সকলের আঁখিতে পানি জমে।
“যে সমাজে নারীরা নিরাপদ নয়। সেই সমাজ থেকে নারী নামক অভিশাপকে উগড়ে ফেলা হোক”

পূর্ণতাকে চিনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে অভির। পাখিকে কবর দেওয়ার পরে পূর্ণতাকে বলেছিলো “বাবা মায়ের সাথে থাকো দুদিন”
পূর্ণতা জবাব না দিয়ে নিজে একা একাই জিপ গাড়িতে গিয়ে বসেছে। অভিও আর কিছু না বলে নিয়েই ফিরেছে পূর্ণতাকে।
বাড়ির গেইটে জিপ গাড়ি থামতেই। পূর্ণতা ইফতির দিকে তাকিয়ে বলে
“যা করবেন ভেবে চিন্তে করবেন। পূর্ণতা ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না”

শুকনো ঢোক গিলে ইফতি। জবাব দেয় না। অভি কিছু বুঝতে পারে না। আর বোঝার চেষ্টাও করে না।
জমিদার বাড়ির বৈঠক খানায় পা রাখতেই আরও একটা দৃশ্য চোখে পড়ে। জমিদারের ছোট ছেলে মনির পূর্ণতার বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছেে। রিমা আঁচলে মুখ ঢেকে এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনির সিনা টান করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার হাত ধরে৷
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পূর্ণতা।
মমতার কথা কানে আসে

“বিয়ে করেছো ভালো কথা। বাচ্চা যেনো না হয়। কয়েকদিন বাড়িতে রেখে দিয়ে এসো অতিথি আপ্যায়নে। সামনে সপ্তাহে বিদেশি খদ্দের আসবে। একেই উপস্থাপন করা যাবে তাদের সামনে।
মনির বাধ্য ছেলের মতো মাথা নারায়। পূর্ণতা হাত মুষ্টিবন্ধ করে ফেলে।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৭

ইশান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার মুখের দিকে। চোখ দুটো বোধহয় তার ছলছল করছে৷ নজর এড়ায় না পূর্ণতার।
এগিয়ে যেতে নেয় পূর্ণতা। মিষ্টি জাপ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে৷ এগোতে দেয় না।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৯