মেজর পর্ব ৭

মেজর পর্ব ৭
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

আজকের মুশফিক আর প্রথম দিনের মুশফিকের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।এই যে কি অবলীলায় শাড়ি পরার কথা বললো।মিতু ড্যাবড্যাব করে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে আছে।মুশফিক সহযে বলে ফেললেও মিতু সেটা হজম করতে পারছে না।চোখ পিটপিট করে নিজের লজ্জা লুকোতে চায়।কিন্তু চেহারার হাবভাব কি লুকোনো যায়;মিতুর এমন লজ্জা মাখা কাঁচুমাচু চেহারা দেখে মুশফিকের মুখের হাসি চওড়া হয়।আস্তে করে বললো,

“তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?তাহলে থাক পরা লাগবে না।”
মিতু জলদি মাথা নেড়ে বললো,
“না না।পরবো।”
মুশফিক দাম্ভিক হাসি দেয়।
“গুড গার্ল।”
মুশফিক নিজেই শাড়ি পরতে বলেছে সে না পরলে,কথা অমান্য করলে বেয়াদবি হবে।মিতু চায় না মেজরের মনক্ষুন্ন হোক,তার জন্য এতোদূর থেকে ছুটে এসেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিতু মুশফিকের জন্য চা নিয়ে আসে।নিলু বানু এসে মুশফিকের পাশে বসে।
“তা ভাই আমার বইন কি এমন যা,দু কইরা নিলো যে না বইলাই ছুটে আইলা।”
উনার প্রশ্ন শুনে তাদের দুজনের চোখাচোখি হয়।মেজর কেমন সন্ধানী চোখে তাকায়,আসলেই মিতু তাকে যা,দু করেছে তা না হলে এক দিনের ছুটিতে কখনো বাসায় আসেনি অথচ আজকে ছুটে এলো,কেনো?এই মেয়েটার জন্যই তো তাই না।মুশফিকের দিকে তাকিয়ে মিতু ভাবে সে কিভাবে যা,দু করবে এখনো তো ভালো করে কথাই হলো না যা,দুর ম,ন্ত্র দেয়া তো দূরের কথা।

মুশফিক নিলু বানুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দাদি আপনার নাতীন মস্ত বড় যা,দুকর।”
মুশফিকের কথায় নিলু বানু হু হু করে হেসে উঠে বললো,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।ঠিকঠাক যতন নিয়ো ভাই যেনো সামনের মাসেই সুখবর শুনি।”

দাদীর কথা শুনে মুশফিক স্থির চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে।সুখবর পাওয়ার মতো সম্পর্ক আদো তাদের হয়নি,আর কবে হবে তাও ঠিক বলা যাচ্ছে না,বউ যে লাজুক, দেখা যাবে কাছে গেলেই কেঁদে উঠবে।লজ্জায় মিতুর কান দিয়ে ধোয়া বের হয়,কি বলছে এসব!মুশফিকের চোখের দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতরটা হীম হয়ে যায়।হাতের আঙ্গুল খুটে বললো,

“দাদী কি বলো এসব!”
নিলু বানু রসিক মানুষ।উনি বললো,
“তুই কি লজ্জা পাইতেছিস?কিও ভাই লজ্জা টজ্জা কমে নাই ক্যান?”
মুশফিক হাসে,মিতুকে আপাদমস্তক লক্ষ করতে করতে বললো,
“কমে যাবে আস্তে আস্তে।”
মিতু অধৈর্য হয়ে বললো,
“উফ!দাদী তুমি যাও।”
“কেনো?আমি থাকাতে কি তুই লজ্জা পাইতেছিস?”

মুশফিক ঠোঁট টিপে হাসছে।মিতু সেই হাসি লক্ষ করে রুম ছেড়ে তার মায়ের কাছে রান্নাঘরে চলে যায়।জামাই আসার উপলক্ষে মহিমা বেগম হরেক রকমের রান্নার আয়োজন করেছে।মিতু মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
“এতো কিছু রান্না করার কি দরকার আম্মু?”
মহিমা বেগম মেয়ের কথায় ভ্রু কুঁচকায়।এই মেয়ে আসলেই বলদ,নতুন জামাই আসলে কি তাকে এক পদ তরকারী দিয়ে ভাত দেয়া যাবে।উনি বললো,

“নতুন জামাই ।ভালোমতো আদর আপ্যায়ন করা লাগবে।”
“উনি তো এতো খায় না।ডায়েট করে তাই অল্প খায়। ”
“যতোটুকুই খাক,আয়োজন তো করাই লাগবে। ”
“আমি তোমাকে সাহায্য করি?”

“না না। আজকে রান্নাঘরে আসার দরকার নেই,তুই মুশফিকের কাছে যা কিছু লাগবে কিনা দেখ।সন্ধ্যায় নাকি চলে যাবে।একদিনের ছুটিতে এসেছে কোনটা রেখে কোনটা খেতে দেই বলতো।”
মহিমা বেগম আরো নানান কথা বলছেন কিন্তু মিতুর মাথায় একটা কথাই গেথে গেলো’একদিনের জন্য এসেছে ‘সে ধীর পায়ে রুমে ফিরে আসে,সন্ধ্যায় চলে যাবে,এইটুকু সময় দূরে থাকবে কেনো?নিলু বানু আর মুশফিক তখনো কথা বলছে।মুশফিকের দিকে তাকিয়ে মিতুর বুকে অজানা ব্যথারা হু হু করে ডাকে সে বিষন্ন চোখে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরে নিলু বানু চলে যায়।মুশফিক উঠে দরজা আটকে দেয়।মিতু চমকে উঠে বললো,
“কি হলো!দরজা আটকালেন কেনো?”
মুশফিক তীব্রভাবে মিতুর দিকে তাকায়।চোখের ভাষা মিতুর বোধগম্য হয় না কিন্তু পা থেকে মাথা কেঁপে ওঠে।মুশফিক তখন থেকে মিতুর বিষন্ন চেহারাটা লক্ষ করেছে সে বললো,
“দরজা আটকানো স্বামীর দায়িত্ব তাই আটকিয়েছি।”
মিতু হতভম্ব হয়ে বললো,

“এই কথা কে বলেছে আপনাকে?”
“কেউ বলতে হবে কেনো?স্ত্রীর সাথে একান্তে কথা বললে নিশ্চয়ই দরজা খুলে কথা বলা সম্ভব না।”
মিতু মিহিয়ে যায়।কি এমন কথা যা দরজা আটকে বলতে হবে।নাকি তখন দাদীর বলা সুখবরের জন্য এমন করছে;মূহুর্তেই তার গলা শুকিয়ে যায়,ভয়ার্ত চোখে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা বুঝার চেষ্টা করে।
মিতু মুশফিকের মনের কথা বুঝতে পারলো কিনা জানি না কিন্তু ট্রেনিং প্রাপ্ত দক্ষ মুশফিক ঠিকই মিতুর চোখের ভাষা বুঝে নিলো।

“মিতু আমাদের দুজনের সম্মতি ছাড়া কিছুই হবে না। রিলাক্স হও।”
মুশফিক মিতুর মনের ভাব বুঝে ফেলাতে মিতু মাথা নিচু করে টপিক বদলায়।
“আপনি নাকি আজকেই চলে যাবেন?”
মুশফিক ছোট করে বললো,
“হুম।”
“কেনো?”

“আমার তো ছুটি নেই মিতু।কালকে অপারেশন থেকে ফিরার পরে আজকের দিনটা লিভ দেয় বিশ্রামের জন্য।আমি সেই দিনটা তোমাকে দিয়ে দিয়েছি হাসিমুখটা যেনো কাঁদো কাঁদো না হয় এই জন্য।”
প্রচন্ড বাতাসে যেমন গাছ পালা হু হু করে নড়ে উঠে তেমনি সুখের এক ঝংকার তুলা বাতাসে মিতুর সারা শরীর সুখে ভরে যায়।সে মুগ্ধ হয়ে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,

“এতো কষ্ট করে আসার দরকার ছিলো না।”
“না আসলে তো জানতে পারতাম না কেউ একজন আমার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলে।”
“ফোন দিলেই তো কেউ আর কাঁদে না।”
“নেটওয়ার্ক ছিলো না।”

“আমাকে বলে গেলেই তো আর চিন্তা হতো না।”
“আমার জন্য চিন্তা হয়?”
“হওয়ার কথা না?”
“কি জানি।”
“মেজর!আপনার জানার কথা ছিলো।”
মুশফিক মুচকি হাসে।দীপ্তিময় চোখদুটো দিয়ে মিতুকে দেখে যায়।

তখন মহিমা বেগম মিতুকে ডাকলে মিতু চলে যায়।মুশফিক বিছানায় বসার পর এতো ক্লান্ত লাগে যে সে শুয়ে পরে।
কিছুক্ষণ পরে মিতু রুমে এসে দেখে মুশফিক ঘুমিয়ে গিয়েছে।সোজা হয়ে শুয়ে কপালের উপর একটা হাত দিয়ে রেখেছে।মুশফিককে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে খুব ক্লান্ত।মিতুর খুব মায়া হলো ইচ্ছে করলো মুশফিকের কপালে হাত ভুলিয়ে দিতে কিন্তু তাদের সম্পর্কটা যে ওই পর্যায়ে যায়নি।

মিতু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মেজরকে দেখে।জাগ্রত অবস্থায় তো ভালো করে তাকাতেই পারে না।তার কেনো যানি মেজরকে ভয় লাগে, উনি কাছে এলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়,অজানা শিহরনে বুক ধুকপুক করে।মুশফিক ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে মিতু নিঃশব্দে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।গোসল শেষ করে শাড়ি পরতে গিয়ে বিপাকে পরে,বাথরুমে সে কোনোভাবেই পরতে পারবে না।দরজা খুলে দেখে মুশফিক তখনো ঘুমিয়ে আছে।সে আস্তে করে বেরিয়ে আসে।জলদি শাড়ি পরা আরম্ভ করে।একটু পরে পরে মুশফিকের দিকে তাকাচ্ছে জেগে গিয়েছে কিনা।শাড়ি পরা শেষে মিতু চুল শুকায়।হালকা একটু সাজার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

কানে ঝুমকা পরার পরে আয়না দিয়েই দেখে মুশফিক উঠে বসেছে।কিছুক্ষণ পরে তাকিয়ে দেখে শিকারী একজোড়া চোখ তাকে পরখ করে যাচ্ছে।সবুজ শাড়িতে মিতুর পুতুলের মতো লাগছে।মুশফিক এগিয়ে আসে।মিতু বললো,
“পরেছি। ”
মুশফিক তখনো মিতুকে গভীর চোখে দেখে যাচ্ছে।ছোট করে বললো,
“সুন্দর লাগছে।”
“ধন্যবাদ।”

মুশফিকের দৃষ্টি নড়চড় হচ্ছে না।মিতু মিহিয়ে যায়।মুশফিক তেজী চোখে বুকের এফোঁড় ওফোঁড় করে তাকিয়ে থেকে,ঘন গলায় বললো,
“তুমি কি আমাকে মিস করেছো? ”

মিতুর তার বাকচটুলতা হারায়।মুশফিকের দারাজ গলার স্বরে কথা বলার শক্তি ফুরোয়।বুকে পাখি ছটফটিয়ে অজানা ভাষায় তার মনোভাব প্রকাশ করে।মিতুকে চুপ করে থাকতে দেখে মুশফিক এগিয়ে আসে।দূরে দাঁড়ায় অথচ মিতুর গায়ে যেনো আগ্নেয়গিরির লাভা লাগে সে ছটফটিয়ে উঠে।কাঁপা কাঁপা চোখে তাকায়।মুশফিক খুব যত্নে মিতুর কানের ঝুমকায় আলতো ধাক্কা দেয়।মিতু কেঁপে ওঠে।তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে,মুশফিক ফিসফিস করে বললো,
“আমাকে এতো ভয় পাও কেনো মেয়ে? ”

মুশফিকের ফিসফিস করে বলা কথাগুলো যেনো মিতুকে গভীর সমুদ্র থেকে চুবিয়ে তুলে সে মাথা নিচু করে বললো,
“জানি না।”
মুশফিক মিতুর ডাগর আঁখিতে তাকিয়ে বললো,
“তুমি খুব সুন্দর মিতু।”
মিতু থরথর করে কাঁপে।মুশফিক মিতুর গালে হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
“আমি কোনো রা,ক্ষস না যে এভাবে কাঁপতে হবে।ভয় পাচ্ছ কেনো?”
মিতু আস্তে করে বললো,

“এখন থেকে ফোন দিবেন তো?”
মুশফিক মিতুর গাল ঘষে দেয়।গম্ভীর গলায় বললো,
“দেবো।”
মিতু ফিসফিস করে বললো,
“আপনি আমাকে মিস করেন?”
মুশফিকের পুরুষালী ঠোঁটের ভাজে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে উঠে।

“খুব।”
মিতু গাল ফুলিয়ে বললো,
“মিথ্যা কথা।”
“তাই?”
“মিস করলে তো ফোন দিতেন।”
মুশফিক তার আঙ্গুলের ভাজে মিতুর আঙ্গুল জড়িয়ে ধরে বললো,
“মিস করলেই ফোন করে জানাতে হবে? মাঝে মাঝে কিছু কিছু মূহুর্ত একা কাটানোতেও মজা আছে।এই যে আমি তোমাকে মিস করে তোমার কথা অসংখ্য বার ভেবেছি।”

মিতু মুশফিকের দিকে তাকায়।মুশফিক বললো,
“আমি মাঝে মাঝেই অপারেশনে যাই।আমি যেহেতু মেজর তাই আমার উপর দায়িত্ব বেশী।ফোন না দিলে টেনশনের করার দরকার নেই,আমার জন্য কান্নাকাটি করারও কোনো দরকার নেই।আমি আছি,সারাজীবনের জন্য মিতুলের হয়ে।”

মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।মুশফিকের সব কথা তাকে ভিষণ সুখ দেয়।
যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে।মুশফিক সবার থেকে বিদায় নেয়। মিতুর দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
“চলে যাচ্ছি।”

মেজর পর্ব ৬

মিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় এখনি কেঁদে দেবে।মুশফিক দাঁড়ায় না।গম্ভীর মুখে সামনে এগিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরে মিতুর মোবাইলে মেসেজ আসে।
❝অনেককিছু পাওনা রইলো মিতুল,সব শোধে আসলে পূরণ করবো।এবার ভালো ছেলে হয়ে থেকেছি আরেকবার কিন্তু একটুও ভালো থাকবো না।❞

মেজর পর্ব ৮