প্রেমময় বিষ পর্ব ১০

প্রেমময় বিষ পর্ব ১০
মাহিমা রেহমান

‘টায়রার ডাকে নিজ লজ্জা’হীন আঁখি দুটোকে সামলে নিয়ে টায়রার পানে তাকাল বেলা।টায়রা আপন চিত্তে ব্যক্ত করতে লাগল,
— তুই এমন ‘হা’ করে কি দেখছিস?
বেলা নিজ মনে বিড়বিড় করতে লাগল,

— তোকে কি করে বলি?আমার দুই চোখ দিয়ে তোর ভাইকেই গিলে যাচ্ছি।
টায়রা বেলাকে পুনরায় ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,
— কোথায় হারিয়ে গেলি আবার?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কোথাও না । আচ্ছা শোন আজকে যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে, মনে হয় না আজ আর স্কুলে যেতে পারব। চল কিছু একটা বাহানা দিয়ে বাড়িতে থেকে যাই।নয়তো এই বৃষ্টিতেই পাঠিয়ে দিবে।
— ঠিক বলেছিস। চল গিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করি।
— আচ্ছা চল।এটা বেশ হবে।

টায়রা আর বেলা নিজ নিজ মায়ের সমীপে গিয়ে নানা কৌশলে তাদের অন্তঃকরণ গলাবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।অতঃপর ফলাফল শূন্যে গিয়ে দাঁড়ায়। অজ্ঞতা রায়াযের নাস্তা শেষ হতেই তার সহিত স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় দুজন।তবে যাওয়ার আগে মায়েদের শর্ত দিয়ে যায়,,তারা টিফিনের পর আর ক্লাস করতে ইচ্ছুক নয়।তাদের মায়েরা তাদের এই সিদ্ধান্তে সায় জানিয়ে রায়াযকে বুঝিয়ে দেয় যেন, প্রিন্সিপালের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দেয়।

রায়ায সায় জানিয়ে দুজনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে পুনরায় বাসায় ফিরে আসে।আজকে সে আর ভার্সিটি যাবে না।
রায়াযের যাওয়ার পানে আঁখি মেলে একধ্যানে তাকিয়ে রয় বেলা।রায়াযের এমন নিশ্চুপ ভাব যেন কারো হজম হচ্ছে না। কারো কণ্ঠ শ্রবনপথে পৌঁছতেই ঈষৎ চ’মকে ফিরে তাকায় টায়রার পানে বেলা,, টায়রা বলে উঠে,

— দেখলি তো বেলা ভাইয়া কেমন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে।সকাল থেকে লক্ষ্য করছি।
বেলা আঁখি পল্লব ঝাপটে উত্তর দেয়,
— আমিও।আচ্ছা চল ক্লাস শুরু হলো বৈকি।

ক্লাসে বসে আশার সাথে ফিসফিসিয়ে বকবক করে চলছে বেলা, থামার নাম-গন্ধ নেই।বেলা আশাকে নিজ অন্তঃকরণের দুঃখ ভাগ করতে বলে উঠে,
— জানিস তো আশা আজ রায়ায ভাইয়াকে কালো পাঞ্জাবিতে কি সুদর্শন লাগছিল।ইচ্ছে করছিল একদম খেয়ে নেই মিল্কশেকের মত। আশা’রে ভাইয়া আমাকে কবে বুঝবে’রে।কবে আমার ভালোবাসা স্বীকার করবে?

— নো চিন্তা, নো ফিকার। এই আশা আছে না? এমনি এমনি কি চার চারটা বয়ফ্রে’ন্ড সামলাই নাকি?তোর সমস্যা আজকেই শেষ করে দেব। শোন আজকে কিন্তু ভ্যালেন্টাইন।যা করার আজকেই করতে হবে।
বেলা আশায় কথায় নেত্র বড় বড় করে হতভম্ব হয়ে রইল কিছুক্ষন।পূনরায় আশায় গুতো খেয়ে হুশ ফিরে এলে কথায় মনোযোগ দেয়।

— আমি কি কি বলেছি বুঝেছিস তো বেলা?
— ইশরে! আমার শুনেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছেরে আশা।
— রাখ তোর লজ্জা। পুরুষ মানুষ এসবেই গ’লে পানি পানি হয়ে যায়।দেখবি রায়ায ভাইয়া ও তোকে মেনে নিবে আশা করা যায়।আমি যেভাবে যেভাবে বলেছি ঠিক সেভাবে সেভাবেই করবি কিন্তু! কেমন?
বেলা ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানায়।পূনরায় ব্যক্ত করে,

— কিন্তু রায়ায ভাইতো অনেক লম্বা আর আমি লিলিপু’ট!
— তো কি হয়েছে? দরকার পড়লে দশ ইঞ্চির হিল পরবি বুঝেছিস।
বেলা পুনরায় সায় জানিয়ে ক্লাসে মনোনিবেশ করে।

আজ যেন বেলার মন খারা’পের দিন।বাড়ি ফিরে নিজ রুমে শুয়ে আছে বেলা।বৃষ্টি যেন কমতেই নারাজ।এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভার গিয়ে বেলা আর টায়রাকে নিয়ে এসেছে।আজকে ফুপিরা চলে যাবে ভেবেই আঁখি জলে ভরে উঠছে বেলার।পলক ঝাপটে উঠে দাঁড়ায় বেলা, উদ্যত হয় কিয়ারার রুমের উদ্দেশ্যে।
আপন চিত্তে কিয়ারা কিছু একটা নিয়ে ভাবনায় বিভোর।বেলা ক্ষীণ পায়ে কিয়ারার সন্নিধ্যে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে পড়ে। বেলাকে দেখে কিয়ারা ব্যথিত চিত্তে উঠে বসে।বেলা কিয়ারার ব্যথিত মনোভাব বুঝতে পেরে বেলা বলে উঠে,

— আপু আজকে থেকে যাও’না।দেখো বৃষ্টি এখনও থাকেনি।
— আচ্ছা দাড়া মাকে দেখি মানানো যায় কিনা?

বৃষ্টির কারণে আজকে আদিবরা থেকে যায়।মন্থরবেগে সাঁঝ এসে হানা দেয় আকাশের বুকে। ক্ষণকাল পূর্বে বৃষ্টি থেমে গেছে, কিছু সময় পূর্বেই ডেলিভারি ম্যান এসে বেলার প্রয়োজনীয় সকল জিনিপত্র ডেলিভারি দিয়ে যায়। অজ্ঞতা বেলা লেগে পরে কাজে। আশার বলা কথার প্রেক্ষিতে সকল কিছু রেডি করে নেয়। বৃষ্টির কারণে আপাদত ছাদে যেতে কেউ ইচ্ছুক নয়। ফলস্বরূপ এটাই যেন বেলার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।এখন শুধু রাত হওয়ার পালা।

রাত এখন বারোটা বেজে বিশ মিনিট।সহসা রায়াযের ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে।রায়ায কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে মোবাইল হাতে নেয়।ম্যাসেজ খানা দেখে রায়াযের ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল। আপন চিত্তে বিড়বিড় করে উঠল,
— চাচিমা! এতো রাতে ম্যাসেজ দিয়ে ছাদে যেতে বলছে?

রায়ায আপন চিত্তে ভাবনায় বিভোর হয়ে ব্যগ্র পা বাড়ায় ছাদের দিকে।ছাদে এসে রায়াযের চক্ষু ললাটে ওঠার উপক্রম।ছাদের সর্বদিক গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সজ্জিত তার সহিত ক্যান্ডেল ও রয়েছে চারিপাশে ছড়িয়ে।এসব দৃষ্টিপাত হতেই রায়ায ইষৎ চমকে উঠল।সহসা পৃষ্ঠদেশ দিক হতে কেউ তার পাঞ্জাবি খামচে ধরে পশ্চাৎদিকে ঘুরিয়ে নিল।

রায়াযকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে অগন্তুক তার ওষ্ঠে নিজ ওষ্ঠ স্পর্শ করল। দীর্ঘ্ হতে দীর্ঘ হলো সে স্পর্শ,,, যেই রায়ায বুঝতে পারল ঠিক কি হচ্ছে? সহসা নিজ কায়া থেকে সেই নারী মূর্তির বদনখানি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বেলা শঙ্কিত আঁখি মেলে যেই রায়াযের পানে তাকাল,, অকস্মাৎ বেলাকে দেখে রায়ায কিঞ্চিৎ চমকে উঠে নিজ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দৃঢ়চিত্তে নিশ্বাস নিতে লাগল।রায়ায অগ্নিমূর্তি ধারণ করে সুদৃঢ় কণ্ঠে বেলার পানে প্রশ্ন করে উঠল,

— তুই! তুই এখানে এত রাতে কি করছিস? আর কিছুক্ষন আগে কি করতে চাইছিলি এটা?
রায়াযের রক্তবর্ণ আঁখি দেখে বেলার অন্তঃকরণ ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠল।পরন্ত সে হেরে না গিয়ে রায়াযের সমীপে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল,, অতঃপর নিজ আঁখি পল্লব বন্ধ করে আপন গহীন চিত্তে লুকিয়ে রাখা বাক্য ব্যক্ত করে উঠল,

— ভাইয়া আমি সত্যি আপনাকে অনেক ভালোবাসি,,আমার ভালোবাস গ্রহণ করে নিন! আমি সবসময় আপনাকে ভালোবেসে যাব ভাইয়া।
সহসা কপোল জুড়ে এক ভয়ংকর থাপ্পড়ের আভাস পেল বেলা। যায় দারুণ ছিটকে গিয়ে পড়ল একদম ছাদের মেঝেতে।থাপ্পড় এতটাই জোরালো ছিল যে বেলার ওষ্ঠের কার্নিশ বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ল।সহসা নিজের কেশের ফাঁকে রায়াযের বলিষ্ঠ হাত প্রবেশ করতে দেখে শঙ্কিত নয়নে রায়াযের পানে তাকায় বেলা।রায়ায খুব দৃঢ়ভাবে বেলার চুলের মুঠি চেপে ধরে নিচ থেকে টেনে তুলে ভয়ংকর চিৎকার করে বলে উঠে,

— তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই!তাছাড়া তোর সাহস কি করে হলো আমাকে কিস করার?(চিৎকার করে কথাগুলো বলে উঠে রায়ায) তাছাড়া কাল না তোর আরেক নাগরকে দেখলাম প্রপোজ করেছিলি? এখন আবার আমার কাছে এসেছিস? চরিত্রেহীন মেয়ে! আজ তোর একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়ব।

নিজ বাক্য ব্যক্ত করেই রায়ায বেলাকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেল।বেলা সমানতালে কেঁদেই চলছে।বেলার চক্ষুর জল যেন আজ রায়াযের পাথর সমতুল্য অন্তঃকরণ গলাতে অক্ষম।সহসা রায়ায চিৎকার করে বাড়ির সকলকে ডাকতে লাগল। মধ্যপ্রহরে এমন চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাড়ির সকলে হতভম্ব হয়ে ছুটে এলো ড্রইংরুমে।বেলাকে এমন মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সকলে আঁতকে উঠলেন।মেয়েকে এমন বিধ্বস্থ অবস্থায় দেখে দৌড়ে মেয়েকে নিজ বক্ষে টেনে নিলেন রুমি বেগম। রাজিয়া বেগম নিজ ছেলের সন্নিধ্যে এসে শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস কিরে উঠলেন,

— কি হয়েছে রায়ায? তুই এই মাঝরাতে এমন চিৎকার করছিস কেন? আর বেলার কি হয়েছে? ও এমন মেঝেতে বিধ্বস্থ অবস্থায় কেন পড়ে আছে?
মায়ের কথা কর্ণপাত হতেই রায়ায হুংকার ছাড়ল,
— কি করেছে? এই মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো? চরিত্রহীন মেয়ে একটা!
ছেলের এহেন কথা শুনে রাজিয়া বেগম এবার রেগে গিয়ে বলে উঠলেন,

— এসব তুই কি বলছিস রায়ায ?
পুনরায় রায়ায হুংকার ছেড়ে বলে উঠল,
— এখনই এই মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করো।একে দেখে আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে।এই মেয়েকে যত পার আমার থেকে দূরে রেখ।
কথাটা বলেই গটগট পায়ে রায়ায নিজ রুমে চলে গেল।
আকস্মিক রুমি বেগম নিজ মেয়ের কপোলে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিল।রুমি বেগমের এহেন কাজে রাজিয়া বেগম নিজ বোন সমতুল্য জা’য়ের নিকট এসে জা’কে শাসিয়ে উঠলেন,

— কি করছিস কি ছোট? ওকে কেনো মারছিস?
–, কারণ আমি জানি এই মেয়েই সকল গন্ডগোলের মূল্।নিশ্চয়ই এই মেয়ে কিছু একটা করেছে যায় দারুণ রায়ায এতটা রেগে গেছে।তাই সবার ভালোর জন্য এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা আমি করেই ছাড়ব।
কথাটা বলেই রুমি বেগম নিজ মেয়ের বাহু শুক্ত হাতে পাকরাও করে মেয়ের রুমের উদ্দ্যেশে প্রস্থান করলেন।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। বাহির থেকে সকলে বারংবার দরজায় করাঘাত করে যাচ্ছে সমান তালে। ভিতর হতে ভেসে আসছে বেলার কান্নার আওয়াজ।

ক্ষণকাল পর রুমি বেগম মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে এলেন।সকলে দৌড়ে উনার সন্নিধ্যে এগিয়ে গেলাম।উনি সকলকে থামিয়ে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— বেলা এখন ঘুমাচ্ছে। বাকি কথা পড়ে হবে।এখন সবাইকে যার যার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া উচিত।রাত প্রায় শেষ হতে চলল।

প্রেমময় বিষ পর্ব ৯

অজ্ঞতা সকলে যার যার রুমে চলে গেলেও কিয়ারা বোনের পাশে থাকতে চাইলে রুমি বেগম বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন নিজ রুমে।
এতক্ষন সকলের সাথে আদিব ও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। যাওয়ার আগে একপলক বেলার কক্ষের পানে আঁখি মেলে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ছেড়ে পুনরায় চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজ রুমের উদ্যেশে অগ্রসর হয়।

প্রেমময় বিষ পর্ব ১১