প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১৭

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১৭
নিশাত জাহান নিশি

“এবার তুমি কী করবে চাঁদ? ঐ আপদটাকে তো এবার তোমার বিদায় করতেই হবে। বুঝতে পারি নি সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে উঠা-টা আমার লাকি চান্স হয়ে দাঁড়াবে!”

চাঁদ পিছু ফিরল। ভয়াল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এই মুহূর্তে নূরকে দেখে তার জল্লাদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না! চাঁদের হাত খসে এতক্ষণে বিড়ালছানাটি সিঁড়িতে ধপাস করে পড়ে গেল! নূরের হাতের হেঁচকা টানে সেই অনেকক্ষণ আগেই চাঁদের শক্ত হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যার কারণে বিড়ালটি আকস্মিক ভাবেই সিঁড়িতে ছিটকে পড়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো বিড়ালটি ব্যথা পেয়েও কোনো রূপ আর্তনাদ করল না। এমনকি জায়গা থেকেও একরত্তি নড়ল না! কোমড়ে ভর করে শান্ত রূপে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়িতে। লেজ নেড়ে নেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে।

গোল গোল নীল চোখে আবিষ্ট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে! ধীর গলায় ম্যাও ম্যাও বলে ডাকছে। সাথে জিভ চেটে ক্ষুধামন্দা প্রকাশ করছে। সহসা চাঁদের দৃষ্টি পড়ল বিড়ালটির দিকে। নিতান্তই মায়ার আবেশে চাঁদের চোখের কোণে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল! নূরের হাতটি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে চাঁদ তড়িৎ বেগে পুচিকে কোলে তুলে নিলো।

আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না সে। এক ছুটে জায়গা পরিত্যাগ করল! পিছু ফিরে নূরের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পুচিকে বুকের সাথে চেপে ধরল। মাথা নাড়িয়ে নূরকে না বুঝালো। মহিলাটির ভয়ে চাঁদ মুখ খুলার সাহসটাও পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না। ভেতরের কামনা প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করছে। নূর কোনোদিকেই ভ্রুক্ষেপ করল না। কটমট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। খড়খড়ে গলায় বলল,,

“থামো বলছি চাঁদ।”
নূরের কথা চাঁদ কানে তুলল না! এক ছুটে নিজের রুমে ঢুকে পড়ল। ঠাস করে রুমের দরজাটি ভেতর থেকে লক করে দিলো। বিশৃঙ্খলভাবে কয়েকদফা শ্বাস ফেলে পুচিকে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে সে পুচিকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল! নাকে মুখে কাঁথা টেনে পুচিকে বুকের মাঝে চেপে ধরল। কম্পিত গলায় অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,,

“আমি তোকে কোথাও যেতে দিব না পুচি। পৃথিবী ওলোট পালোট হয়ে গেলেও না! ঐ নূরের বাচ্চা গভীর ষড়যন্ত্র করলেও না!”

পুচিও চাঁদের বুকের সাথে একাত্নভাবে মিশে গেল। জিভ বের করে চাঁদের ওড়না চাটতে লাগল! পায়ের নখ দ্বারা চাঁদকে খোঁচাতে লাগল। প্রকাশ করতে চাইল তার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। চাঁদ নিরুপায় দৃষ্টিতে পুচির দিকে তাকালো। গলা খাদে এনে বলল,,

“আর একটু ওয়েট কর পুচি। মহিলাটি এখান থেকে বিদায় হলেই আমি তোকে অনেক অনেক খাবার দিব। তুই যতো খাবার চাইবি সব ধরনের খাবার তোকে দিব। তবুও তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও যাস না পুচি প্লিজ!”

এরমধ্যেই দরজায় খটখট আওয়াজ হলো! নূর একনাগাড়ে দরজায় টোকা মারতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদ বিষম খেয়ে উঠল। পুচিকে আঁকড়ে ধরে শঙ্কিত দৃষ্টিতে কাঁথা ভেদ করে দরজার দিকে তাকালো। নূর প্রতিশোধপরায়ন হয়ে হিংস্র গলায় বলল,

“চাঁদ দরজাটা খোলো বলছি। মহিলাটিকে তার বিড়ালটি ফেরত দাও। বিশ্বাস না হলে দেখে যাও মহিলাটি কীভাবে বিড়ালটির জন্য কাঁদছে। বিড়ালটির মা ও বিড়ালটির জন্য কাঁদছে। এভাবে নির্দয়ের মতো মায়ের থেকে বাচ্চাকে আলাদা করতে নেই চাঁদ। এত বড় একটা মেয়ে হয়ে অবুঝের মতো কাজ করো না প্লিজ!”

চাঁদের বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না নূর নাটক করে এই সমস্ত কথাগুলো বলছে। মন থেকে সে এই নীতি কথাগুলো মোটেও বলছে না। চাঁদ বিভৎস হয়ে উঠল। একরোখা গলায় চিৎকার করে বলল,,
“আপনি যতোই আমার থেকে পুচিকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন নূর ভাইয়া। আমি কখন-ই আপনার সেই চেষ্টাকে সফল হতে দিব না। পুচিকে আমি কোথাও যেতে দিব না। পুচি আমার সাথেই থাকবে। আমার সাথে থাকতেই পুচি কমফোর্টেবল ফিল করে।”

নূর এতক্ষণে মহিলাটিকে বলে দিয়েছে পুচি এই বাড়িতেই আছে! আর পুচি এখন চাঁদের সাথে চাঁদের রুমেই রয়েছে! নূরের কথা বিশ্বাস করে মহিলাটি চরম আশাবাদী হয়ে সোহানীকে ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। নূরকে ফলো করতে করতে চাঁদের রুমের অবধি চলে এসেছে। মহিলাটির সাথে সোহানী এবং সাবরিনা আবরারও উপরে ওঠে এলেন। এসেই দেখলেন মহিলাটি নূরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যথীত গলায় চাঁদকে ডেকে বলছে,,

“আমি তোমাকে চিনি না মা। তবুও বলছি আমার সুমুকে ফিরিয়ে দাও। সুমুর মা সুমুকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুমু খুব ছোটো তো। তাই তাকে ধরে বেঁধে রাখা যায় না। হুটহাট করে মা’কে রেখেই একা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। প্লিজ মা তুমি সুমুকে তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দাও।”

সবার হাঁক ডাকে পাশে গভীর ঘুমে ডুবে থাকা নাদিয়া, সাদিয়া, জায়মা এবং রুহি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। উঠেই তারা দেখল চাঁদ পুচিকে বুকের সাথে মিশিয়ে চোখের জল ছেড়ে কাঁদছে! তারা চারজনই অবাক হলো। শোয়া থেকে ওঠে চাঁদের পাশে বসল। ঘুম জড়িত গলায় নাদিয়া চাঁদের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

“তুমি কাঁদছ আপু?”
চাঁদ কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“দেখ না নাদিয়া, নূর ভাইয়া কত খারাপ একটা লোক! আমার থেকে প্রতিশোধ নিবে বলে ঐ মহিলাকে আমার পেছনে লাগিয়ে দিয়েছে। এখন মহিলা এসেছে আমার কাছ থেকে পুচিকে কেড়ে নেওয়ার জন্য! পুচিকে তো আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি বল? কীভাবে তাকে যেতে দিই?”

তারা চারজনই ব্যথীত হলো। তবে এই অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারা কার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে তাই বুঝতে পারছে না। চাঁদের যেমন একদিনেই পুচির প্রতি এত টান, এত ভালোবাসা, এত মায়া কাজ করছে তেমনি তো ঐ মহিলাটিরও! এমনকি পুচির মায়েরও!

তাঁরা তো অনেকগুলো মাস ধরে পুচিকে দেখছে। পুচিকে লালন পালন করে আসছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে চাঁদের চেয়ে তাদের বেশি আঘাত হওয়াটাই স্বাভাবিক! এরমধ্যেই নূরের গলার স্বর আবারও ভেসে এলো! নূর আক্রমনাত্নক গলায় সাবরিনা আবরারকে বলল,,

“মা। চাঁদকে বলো বিড়ালছানাটিকে নিয়ে এক্ষণি রুম থেকে বের হয়ে আসতে। এভাবে একজন ভদ্র মহিলাকে হেনস্তা করার কোনো মানে হয়? আন্টি নিতান্ত ভালো মানুষ বলেই চাঁদের সাথে এখনো ভালো ব্যবহার করছে। আন্টির জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে চাঁদকে চোর বলে সাবস্ত করত! তাছাড়া বিড়ালটির মাও হয়তো বিড়ালটির জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি না?”

সাবরিনা আবরার চুপ করে রইলেন। মাথা নুইয়ে পরোক্ষভাবে অসম্মতি জানালেন। মহিলাটি এবার কাকুতি মিনতি করে সাবরিনা আবরারকে বললেন,,
“প্লিজ আপা কিছু একটা করুন। সুমুর মায়ের অবস্থা খুব-ই খারাপ। আপনিও তো একজন মা। আপনার সন্তানকে যদি কেউ অগত্যা বুক থেকে কেড়ে নেয় তখন আপনার কষ্ট হবে না বলুন?”

তৎক্ষণাৎ সাবরিনা আবরারের বুকটা কেঁপে উঠল! উনি এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। চাঁদের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় না দিয়ে উনি এবার চাঁদের রুমের দরজায় টোকা মারলেন। নিরুপায় গলায় বললেন,,
“চাঁদ মা দরজাটা খোল।

পুচির মা সত্যিই পুচির জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে। সামিয়ার বুক থেকে তোকে কেড়ে নিলে সামিয়ার যেমন কষ্ট হবে? ঠিক তেমনি পুচির মায়ের বুক থেকে পুচিকে কেড়ে নিলেও পুচির মায়েরও ঠিক তেমনই কষ্ট হবে।”
চাঁদ এবার বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। চোখের জল মুছে পুচিকে জায়মার কাঁথার তলায় লুকিয়ে রাখল! ধীর গলায় জায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“চুপ। বলবি না পুচি এখানে আছে! আমি মহিলাটির সাথে কথা বলে আসছি।”
জায়মা নির্বোধের মতো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। চাঁদ আশ্বস্ত হলো। দৌঁড়ে গিয়ে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। অমনি নূর ট্যারা চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো! দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্যভাবেই চাঁদকে এক চোখ টিপে দিলো! বাঁকা হেসে আঙুল দিয়ে চাঁদের কপালে শ্যুট করেছে বুঝালো! বাম হাতের তর্জনী এবং মধ্যমা আঙুলে ফুঁ দিয়ে সে ইশারায় বলল,,

“নূরের পেছনে লাগার ফল বুঝলে তো? ইউ আর টোটালি ফিনিশড চাঁদ!”
চাঁদ চোয়াল শক্ত করে নূরের দিকে তাকালো। গরম চোখে তাকিয়ে বিরোধীতার ইঙ্গিত করল। এর ফাঁকেই মহিলাটি চাঁদের রুমে ঢুকে পড়ল! হন্ন হয়ে রুমের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিছানার দিকে তাকালো। নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং জায়মার দিকে তাকিয়ে পেরেশানি গলায় মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“আমার সুমু কোথায়?”
নূরের থেকে লোহিত দৃষ্টি সরিয়ে চাঁদ হন্তদন্ত হয়ে মহিলাটির দিকে রুখে এলো। তোতলামো গলায় বলল,,
“সুসুসুমু নেনেই!”

নাদিয়া, সাদিয়া, জায়মা এবং রুহিও চাঁদকে অনুসরণ করে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। চাঁদ তাদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। ইশারায় বুঝালো ভালো করেছিস। এরমধ্যেই ঘটে গেল আরেক কাণ্ড! পুচি কাঁথার ভেতর থেকে গভীর আওয়াজে ডেকে বলল,,
“ম্যাও!”

ধরা পড়ে গেল সবাই! চাঁদ মুখে হাত দিয়ে চোখ জোড়া প্রকাণ্ড করে কাঁথার দিকে তাকালো। পুচি এতক্ষণে কাঁথার ভেতর থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে এলো! মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ম্যাও করে উঠল। নাদিয়া, সাদিয়া, জায়মা এবং রুহি লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। মহিলাটি প্রাণোচ্ছ্বল হাসল! খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে পুচিকে কোলে তুলে নিলো। চুমো খেতে খেতে বলল,,
“আমার সুমু সোনা। তোমাকে মা কত খুঁজেছি বলো? মাকে এভাবে কষ্ট দিতে হয় বুঝি?”

নূর হাসতে হাসতে প্রায় বাঁকা হয়ে যাচ্ছে! পেটে হাত রেখে সে দেয়ালের সাথে মিশে যাচ্ছে। চাঁদ রাগে ফুসফুস করে নাক ফুলিয়ে নূরের হাসি দেখছে। পারছে না সে নূরকে এক্ষণি গলা টি’পে ধরতে! সোহানীও এবার নূরের সাথে তাল মিলালো! মুখ চেপে মিটিমিটি হেসে উঠল।

সাবরিনা আবরার ব্যথীত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালেন। চাঁদের কষ্টটা উনি বুঝতে পারছেন। কারণ, বিড়াল প্রাণীর প্রতি উনারও চাঁদের মতো বেশ ঝোঁক! চাঁদ এবার ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো! মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ভগ্ন গলায় বলল,,

“আন্টি প্লিজ পুচিকে আপনি নিয়ে যাবেন না। পুচিকে আমার কাছেই রেখে যান। সত্যি বলছি আমি পুচিকে খুব যত্নে রাখব, খুব আদরে রাখব। ওর কোনো অনাদর হতে দিব না।”
পুচি মহিলাটির বুকের সাথে মিশে আছে। ক্ষণে ক্ষণে মহিলাটির মুখ, গলা, ঘাড় চেটে দিচ্ছে! আহ্লাদে প্রায় আটখানা। মহিলাটি চাঁদের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকালো। নরম গলায় বলল,,

“সম্ভব না মা! সুমুর মা সুমুকে ছাড়া থাকতে পারে না। তবে তুমি এক কাজ করতে পারো, প্রতিদিন একবার, দুবার করে সুমুকে যেয়ে দেখে আসতে পারো! ওকে আদর করে আসতে পারো। আমি একটুও রাগ করব না।”
চাঁদ মাথা নুইয়ে নিলো। মহিলার দেওয়া প্রস্তাব চাঁদের পছন্দ হলো না। সাবরিনা আবরার চাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। চাঁদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বললেন,,

“রাজি হয়ে যা মা। একেবারে না দেখার থেকে তো দিনে দু, একবার দেখে আসা ভালো।”
চাঁদ এবার বেদনাহত দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো। পরক্ষণে মাথা নুইয়ে মহিলাটিকে বলল,,
“আচ্ছা ঠিক আছে। পুচিকে আপনি নিয়ে যান। আমার যখনি পুচিকে দেখতে ইচ্ছে করবে তখনি কিন্তু আমি আপনার বাড়িতে চলে যাব!”

মহিলাটি মৃদু হাসল। নমনীয় গলায় বলল,,
“ঠিক আছে মা। এখানে আমার আর কোনো আপত্তি নেই।”

পুচিকে নিয়ে মহিলাটি প্রস্থান নিলো। পুচি মায়াময় দৃষ্টিতে একবার পিছু ফিরে তাকালো! চাঁদের দিকে তাকিয়ে ম্যাও করে ডেকে উঠল। চাঁদ অশ্রুসিক্ত চোখে পুচির দিকে তাকালো। পরক্ষণে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। চোখের জল ছেড়ে সে দুহাতে ভর দিয়ে বিছানার উপর বসে পড়ল।

অশ্রুসিক্ত চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে এখনও হাসতে থাকা নূরের দিকে তাকালো। নূর এবার হাসি থামাতে বাধ্য হলো! চাঁদের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এই পর্যায়ে এসে নূর বুঝতে পারল চাঁদ সত্যিই খুব আঘাত পেয়েছে। নূরের মনে আকস্মিক মায়াবোধ জন্ম নিলো! ধীর পায়ে হেঁটে সে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। মর্মার্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“সিরিয়াসলি? তুমি সত্যিই ঐ আপদটার জন্য কাঁদছ?”
চাঁদ নাক টেনে কেঁদে নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জবাবে চুপ থাকল। নূর হুট করে আবারও অট্ট হেসে উঠল! শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“এই প্রথম দেখলাম কোনো প্রাণীর জন্য কাউকে এভাবে কাঁদতে! তাও আবার এত বড় একটা মেয়ে। এমন ছিঁচকাদুনি হলে না? কপালে বর জুটবে না এই বলে দিলাম!”

নূর হাসতে হাসতে জায়গা পরিত্যাগ করল। সাবরিনা আবরারের কটমট দৃষ্টিও নূরের হাসিকে থামাতে পারল না! চাঁদ একদম চুপ হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় শুয়ে পড়ল! কাঁথা দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নিলো। উদ্বিগ্ন হয়ে নাদিয়া, সাদিয়া, জায়মা, রুহি এবং সোহানী চাঁদকে ডাকতে নিলেই সাবরিনা আবরার তাদের চারজনকে থামিয়ে দিলেন। মন্থর গলায় বললেন,,

“থাক। চাঁদকে এখন আর ডাকিস না। বেচারি খুব কষ্ট পেয়েছে। ওকে একটু নিজের মত থাকতে দে এখন। তোরা সবাই নিচে চলে আয়। ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গেছে। একটু পরে আবার নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যেতে হবে। হাতে একদম সময় নেই।”

চাঁদ নাক টেনে কেঁদে ভেতরের কষ্ট বাইরে প্রকাশ করছিল। সবাই মাথা নুইয়ে ব্যথীত মনে এক এক করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। রুমের পরিবেশ শান্ত হয়ে উঠতেই চাঁদ কাঁথার তলা থেকে মুখ বের করল! নাক টিপে নাকের জল বের করল। নূরের প্রতি মনে ক্ষোভ জমিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,,

“একদম ঠিক হয়েছে রোজ আপু ঐ বদ’মাইশ ছেলেটাকে ছেড়ে চলে গেছে! এর মত দজ্জাল টাইপ ছেলে আমি পৃথিবীতে আর দুটো দেখি নি। মন থেকে অভিশাপ দিলাম আমি! ঐ অসভ্য ছেলের কপালে যেন বউ না জুটে! আর জুটলেও যেন একটা বিচ্চু মেয়ে ঐ দজ্জাল ছেলেটার বউ হয়ে আসে! সংসার জীবনে যেন একরত্তিও শান্তি না পায় ঐ নূর। বিচ্চু বউটা যেন উনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একদম ছাড়খাড় করে দেয়!”

সকাল প্রায় এগারোটা বাজতে চলল ঘড়িতে। নাশতা খেয়ে বাড়ির সব মেয়েরা রেডি নীড়ের হবু শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার জন্য। নীড় সকাল নয়টা নাগাদ নাশতা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। এই কয়েকদিন যাবত অফিসের কাজ সামলাতে সামলাতে নীড়ের একদম হুশ নেই। দম ফালানোর সময়টাও পর্যন্ত এই মুহূর্তে তার নেই।

ইদানিং তো বাড়ির কোনো খবরা-খবরই রাখতে পারছে না সে! ব্যস্ততা তাকে এতটাই ঘিরে ধরেছে। নিজের হবু বউয়ের সাথেও দু’দন্ড কথা বলার সময় নেই তার! তার হবু বউয়ের তরফ থেকেও ইচ্ছাকৃত কোনো ফোন কলস আসে না! তবে এই দিকে নীড়েরও কোনো অভিযোগ নেই!

ব্যস্ততা কাটিয়ে যদি নীড় কল করতে পারে তবেই তার হবু বউ কল তুলে তার সাথে হালকা দু, একটা কথা বলে! এক্ষেত্রে নীড় নিজেকেই সম্পূর্ণরূপে দোষী ভাবে। কারণ, সময়ের অভাবে সে-ই তার হবু বউয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না, দেখা করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। আর মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই একটু লজ্জাশীল হয়। হবু বরের সাথে স্ব-ইচ্ছায় তাদের কথা বলতে বা দেখা করতে জড়তা কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক!

অন্যদিকে আয়মন এবং সাদমান একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে নূরের যন্ত্রণায় তাদের ঘুম হয়নি সম্পূর্ণ! সারারাত নূর পাগলের মতো চিৎকার চ্যাঁচামেচি করেছে! স্মোকিং করেছে, রাতভর বাঁচালের মতো কথা বলে গেছে। নিজের দুঃখ, কষ্টগুলো আয়মন এবং সাদমানের সাথে শেয়ার করেছে।

তারাও নীরব দর্শকের মতো নূরের বকবকানি শুনে গেছে! নূরের অনর্থক পাগলামি সহ্য করেছে৷ ভোর হতেই তাদের চোখে ঘুম লেগেছিল। সেই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে তাদের সকাল দশটা বেজে গেছে! তাই সকালে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই তারা জানতে পারে নি৷ সকালের নাশতা সেরেই তারা নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছে।

এইদিকে নূর ব্রেকফাস্টে কেবলমাত্র এক কাপ হট কফি খেয়েছে। এর বেশি কিছু মুখে রুচে নি। চাঁদ ঘুমে বুদ হয়ে আছে! সকালের নাশতাটাও এখনো পর্যন্ত করে নি সে। সাবরিনা আবরার বেশ ফিটফাট হয়ে রেডি হয়ে হন্তদন্ত হয়ে নূরের রুমে প্রবেশ করলেন। নূর রেডি হয়ে মাত্র রুম থেকে বের হচ্ছিল।

এর মধ্যেই সাবরিনা আবরারকে সাথে দেখা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই সে মাথা উঁচিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অন্যদিকর উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে সাবরিনা আবরার নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালেন! তটস্থ গলায় বললেন,,
“চাঁদ এখনও পর্যন্ত রুম থেকে বের হয় নি৷ তোর উপর রাগ করে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তোর করণীয় কী বল?”

নূর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলো। শার্টের কলার ঝেড়ে বলল,,
“এখানে আমার কী করণীয় থাকতে পারে মা?”
“আলবাদ তোর করণীয় আছে। এক্ষণি তোর চাঁদের রাগ ভাঙাতে হবে! রেডি করিয়ে তাকে নিয়ে নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যেতে হবে। চাঁদ না গেলে কিন্তু আমি কোনো ভাবেই নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যাব না এই বলে দিলাম!”

নূর এবার ফেঁসে গেল মহা ফ্যাসাদে! গলার স্বর সে খাদে এনে বলল,,
“এখন ঐ বিচ্চু মেয়েটাকে আমার মানাতে হবে মা?”
“হ্যাঁ হবে! এক্ষণি যা বলছি। চাঁদকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার রাগ ভাঙিয়ে আমাদের সাথে নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজি করাবি! যা এক্ষণি।”

নূর রাগে ফোঁস করে উঠল! সাবরিনা আবরারের শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো। নিরুপায় হয়ে সাবরিনা আবরারের ধারালো দৃষ্টি থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। জেদ দেখিয়ে চাঁদের রুমের দিকে রওনা হলো! চাঁদের রুমের সামনে এসেই নূর সজোরে এক লাথ মারল রুমের দরজায়! অমনি চাঁদ হকচকিয়ে ঘুম ভেঙে ওঠে বসল! বুকে এক গাঁধা থু থু ছিটিয়ে ভয়াল দৃষ্টিতে রুমের দরজায় তাকালো। রাগান্বিত অবস্থায় নূরকে দেখামাত্রই সে বিষম খেলো। শুকনো গলায় বলল,,

“আপনি? আপনি এখানে?”
নূর দাঁতে দাঁত চেপে শার্টের হাতা জোড়া ফোল্ড করল। দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে চাঁদের বিছানার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তেজী গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১৬

“কী ব্যাপার? এখনও ঘুমিয়ে আছো কেন? সকাল কয়টা বাজছে এখন হ্যাঁ? তোমার জন্য কী আমরা নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে বসে থাকব? নীড় ভাইয়ার শ্বশুড় বাড়ি যাব না?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১৮