প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২০

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২০
নিশাত জাহান নিশি

“কী হলো আপু? কিছুই তো বুঝলাম না। ডাকতে এসেছি আমরা। মাঝখানে থেকে উনি কোথা থেকে এলো?”
বাঁ হাতের আঙুল দ্বারা সোহানী হালকা করে চাঁদের ডান হাতে চিমটি কাটল! পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“চুপ কর। যা হচ্ছে তা হতে দে। উনাদের বাড়ির মেয়ে, তাই উনারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। এখানে আমাদের কোনো ইচ্ছে বা অনিচ্ছের কিছু থাকতে পারে না।”
বিপরীতে চাঁদ মুখটা বাঁকালো! সোহানীর কাছে প্রশ্রয় না পেয়ে জায়মার কাছে গেল। সন্দিহান গলায় জায়মার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই জায়মা শোন? তোরও কী কিছু ডাউট হচ্ছে?”
জায়মাও সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। সহমত পোষণ করে বলল,,
“ডাউট তো হচ্ছেই! শ্বশুড়বাড়ির লোকজনদের দেখার পরেও হবু বউ দরজা বন্ধ করে বসে আছে৷ এখন আবার আমরা ভাবিকে সেঁধে ডাকতে এলাম সেখানেও বাঁধা। ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে না?”

চাঁদ মাথা দুলালো৷ বিষয়টাকে শতভাগ আমলে নিলো। ক্ষণিকের মধ্যেই নিজেকে উদ্যোগী করে তুলল! জায়মাকে ঠেলে চাঁদ মেয়েটির কিঞ্চিৎ পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। জিজ্ঞাসু গলায় হা করে কিছু শোধাবার পূর্বেই মেয়েটি অনুর রুমের দরজায় সশব্দে টোকা মারল। ব্যাপক ভয়ার্ত হয়ে নড়বড়ে গলায় বলল,,
“অনু আপু শুনছ? দরজাটা খোলো। তোমার ননদরা তোমাকে দেখতে এসেছে।”

দরজার ঐ প্রান্ত থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া-ই ঘটল না! মেয়েটি উদগ্রীব হয়ে অনবরত দরজায় টোকা মারতে লাগল। চাঁদ, সোহানী, জায়মা এবং নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি ভ্রু যুগল কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে একে-অপরের মুখ দেখাদেখি করছে। তারা রীতিমতো অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কিছু বুঝে উঠতে না পারায় নির্বোধের মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে মেয়েটি অজানা কিছু ভয়ে ক্রমান্বয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে! তৎপর গলায় দরজায় টোকা মেরে বলছে,,

“আপু প্লিজ দরজাটা খোলো৷ তোমার ননদরা অনেকক্ষণ যাবত তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ দরজাটা খুলে বের হয়ে এসো।”
সোহানী এবার মুখ খুলল। মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ গলায় বলল,,
“কোনো সমস্যা? ভাবি ঠিক আছে তো?”

মেয়েটি শুকনো মুখে সোহানীর দিকে তাকালো! জোরপূর্বক হেসে আড়ষ্ট গলায় বলল,,
“না আপু৷ কোনো সমস্যা নেই। আপু ঠিকই আছে। এই তো এক্ষণি আপু দরজা খুলে দিবে। হয়তোবা ওয়াশরুমে গেছে তাই আমাদের গলার আওয়াজ শুনতে পারছে না! তাই দরজা খুলতেও কিছুটা দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আরেকটু ওয়েট করুন আপু প্লিজ।”

সোহানী স্মিত হাসল। প্রত্যত্তুর করার পূর্বেই চাঁদ এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসু গলায় মেয়েটিকে বলল,,
“আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন আপু? গলাটাও কেমন শুকিয়ে আসছে। আমরা তো এখানে আপনাকে জেল ফাঁসি দিতে আসি নি! শুধু ভাবিকে দেখতে এসেছি! সো এখানে তো আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

মেয়েটি শুকনো ঢোক গিলল৷ ইতস্তত গলায় হা করে কিছু বলতে গেল অমনি রুমের দরজা খুলে অনু বের হয়ে এলো! বিক্ষিপ্ত অবস্থায় মাথা নুঁইয়ে দাঁড়ালো সে! কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মেয়েটি তড়িঘড়ি করে অনুকে নিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে গেল! তড়িৎ বেগে দু’হাত দ্বারা অনুর কান্নাসিক্ত মুখমণ্ডল মুছে দিলো! মুখটা উপরে তুলে জোরপূর্বক হেসে অনুকে বলল,,

“আপু দেখো তোমার ননদরা এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে। আর তুমি কিনা এতক্ষণ ওয়াশরুমে বসেছিলে? তাদের এতক্ষণ ওয়েট করালে?”
নিরুত্তর রইল অনু। আবারও মাথাটা নুইয়ে নিলো। চাঁদ, সোহানী, নাদিয়া, সাদিয়া, জায়মা এবং রুহি ধীর পায়ে হেঁটে রুমের ভেতর প্রবেশ করল। তারা প্রত্যেকে অনুর পাশে এসে দাঁড়ালো। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে অনুর কান্নাসিক্ত মুখমণ্ডলে তাকালো। সোহানী উদ্বেগি গলায় অনুকে শুধালো,,

“ভাবি? আপনি কেঁদেছেন? চোখ-মুখ এমন ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”
তৎক্ষনাৎ অনু এবং পাশের মেয়েটি হকচকিয়ে উঠল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে অনুর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“শান্ত হও আপু। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো। তাদের কিন্তু কিছুতেই আঁচ করতে দেওয়া যাবে না তুমি এই বিয়েতে রাজি নও!”
অনু মাথা দুলালো। মেয়েটির কথা মেনে নিলো। নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করল। নিথর চোখে সোহানীর দিকে তাকালো। আচমকা জোরপূর্বক হেসে বলল,,

“আসলে মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যাব তো তাই খুব কান্না পাচ্ছিল!”
সোহানী শুকনো হাসল। আকস্মিকভাবে অনুর ডান হাতটা মোলায়েমভাবে আঁকড়ে ধরল! শান্তনার স্বরে বলল,,
“কাঁদবেন না ভাবি। নীড় ভাইয়ার পরিবারও আপনাকে নিজের পরিবারের মতোই খুব যত্নে-আদরে-ভালোবেসে আগলে রাখবে। সত্যি বলছি তাদের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে আর দুটো হয় না!

খুব ভাগ্য করে আপনি তাদের মতো একটি পরিবারকে নিজের পরিবার হিসেবে পেতে চলছেন। ভাববেন না নিজের খালাতো ভাই বা খালামনি বলে তাদের তারিফ করছি। বাস্তবতার দিকে থেকে হলেও বলছি তারা সত্যিই খুব ভালো মনের মানুষ।”

অনু তব্ধ শ্বাস ছাড়ল। অবিলম্বেই মাথা নুইয়ে নিলো। সোহানী পুরোপুরি অনুর কথা বিশ্বাস করে নিলেও চাঁদ এবং জায়মা অনুর একটি কথাও বিশ্বাস করল না! দুজনই দুজনের মধ্যে শলা পরামর্শ করল। চাঁদ মিনমিনিয়ে জায়মাকে বলল,,
“এই জায়মা? ভাবির একটা কথাও কী তোর বিশ্বাস হলো? কেমন যুক্তিহীন মনে হচ্ছে না? মুখ দেখেই সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে না?”

জায়মাও চাঁদের কথায় সহমত হলো। ফিসফিসিয়ে বলল,,
“আমার তো প্রথম থেকেই ভাবিকে সন্দেহ হচ্ছে রে চাঁদ। পাশের ঐ মেয়েটিকেও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।”
চাঁদ উপরের ঠোঁট কামড়ে ভাবুক হয়ে উঠল। মনে মনে কিছু একটা যোগ-বিয়োগ করতে লাগল। ক্ষণিকের মধ্যেই কিছু একটা ভেবে-চিন্তে সে ব্যস্ত গলায় জায়মাকে বলল,,

“তোরা এখানেই থাক। আমি একটু আসছি।”
হম্বিতম্বি হয়ে চাঁদ জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। অমনি পেছন থেকে নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি মিলে চাঁদকে ডাকল! প্রফুল্লিত গলায় সমস্বরে বলল,,
“এই চাঁদ আপু। একটু দাঁড়াও তো।”

চাঁদ কৌতূহলী হয়ে পেছন ফিরে তাকালো। নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি উৎফুল্লিত হয়ে চাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালো। রুহি খুশিতে উত্তেজিত হয়ে সেল্ফি ক্যামেরাটা তাদের মুখের সামনে ধরল। হাসি হাসি মুখে বলল,,
“চলো আমরা একটা সেল্ফি তুলি৷ আসার পর থেকে চাঁদ আপুর সাথে একটাও সেল্ফি তোলা হয়নি।”
চাঁদ ব্যস্ত হয়ে উঠল। তাড়াহুড়ো গলায় বলল,,

“উফফ তাড়াতাড়ি তোল।”
চাঁদ মুচকি হাসল। বাকি সবাইও চাঁদের সাথে মুচকি হেসে বিভিন্নভাবে পোঁচ নিলো৷ হাতে গোনা দু থেকে তিনটি ছবি তোলার পর চাঁদ এক ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে সোহানী অবাক হলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জায়মাকে লক্ষ্য করে বলল,,

“চাঁদ কোথায় গেল রে?”
জায়মা গলা খাঁদে এনে বলল,,
“জানি না তো আপু৷ আমাকে তো কিছু বলে যায় নি।”

সোহানী আর এই বিষয়ে মাথা ঘামালো না। অনুকে নিয়ে খুশি মনে বেডের উপর বসল। জায়মাও একযোগ হয়ে সোহানীর পাশে এসে বসল৷ অনুর কাজিন ইলমা এখনও অনুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে! ইশারায় তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। সোহানী বিষয়টি বেশ আঁচ করতে পারছে।

তবে তা প্রকাশ করছে না! জায়মা কিছুক্ষণ পর পর ইলমার দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের দৃষ্টি মিলে যেতেই ইলমা জোরপূর্বক হেসে দিচ্ছে! জায়মাও হাসিমুখে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি রুমের অন্যপাশে নিজেদের মধ্যে হাসি, ঠাট্টা এবং আড্ডায় মশগুল। সেল্ফি তোলা যেন তাদের কিছুতেই ক্ষান্ত হচ্ছে না।

দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদ ড্রয়িংরুমে এলো। মাথা নুইয়ে সাবরিনা আবরারের ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালো। আড়চোখে সামনের সোফায় বসে থাকা নূরের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি দেখতে পেল নূর হিংস্র বাঘের মতো চোয়াল শক্ত করে চাঁদের দিকে শিকারীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। মাথা চুলকে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“এই ছেলে তো দেখছি এখনও আমার উপর রেগে আছে! সামনে পেলে তো আস্ত চিবিয়ে খাবে। কী করতে আসলাম আমি এখানে হ্যাঁ? এই ছেলের শিকারী রূপ দেখতে?”
এরমধ্যেই অনুর মা মিসেস মাহফুজা বেগম অধীর দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালেন। ভয়ার্ত গলায় চাঁদকে শুধালেন,,
“অনুর সাথে কথা হয়েছে চাঁদ?”

চাঁদের ধ্যান ভাঙল। পূর্ণদৃষ্টিতে মাহফুজা বেগমের দিকে তাকালো৷ জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“কথা হয়েছে আন্টি।”
“তোমার বাকি বোনরা কোথায়?”
“উপরেই আছে আন্টি। ভাবির সাথে কথা বলছে।”

মাহফুজা বেগম কেমন যেন দুঃশ্চিতাগ্রস্ত হয়ে উঠলেন! কাপড়ের আঁচল দ্বারা মুখ মুছতে লাগলেন। বারংবার চোখের পলক ফেলে দুতলায় অনুর রুমের দরজার দিকে ব্যস্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। সাবরিনা আবরার কিছুটা সন্দিহান হয়ে উঠলেন! ভ্রু যুগল কুঁচকে মাহফুজা বেগমকে লক্ষ্য করে বললেন,,

“কী হয়েছে বেয়ান? আপনাকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে!”
মাহফুজা বেগম পরিস্থিতি এড়িয়ে গেলেন! প্রসঙ্গ পাল্টাতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। তৎপর গলায় বললেন,,
“বেয়ান আসেন আমরা দুপুরের খাবারটা সেরে নিই! বেলা তো গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি সবাইকে ডেকে দিচ্ছি কেমন? খাবার দাবারের পর না হয় ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।”

মাহফুজা বেগম বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। হন্তদন্ত হয়ে দু’তলার দিকে রওনা হলেন। উপস্থিত সবাই অবাক হলো। বিশেষ করে সাবরিনা আবরার বিস্মিত দৃষ্টিতে মাহফুজা বেগমের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছেন। চাঁদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ইশারায় আয়মনকে ডাকল। ইশারা বুঝে আয়মন জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। কুজো হয়ে নূরের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“চাঁদ ডাকছে বাইরে আয়।”
নূর নাকোচ করল। খড়খড়ে গলায় বলল,
“তোকে ডেকেছে তুই যা। আমাকে আবার এর মধ্যে জড়াচ্ছিস কেন?”
“আরে ব্যাটা এত রাগ দেখালে চলবে? এখানে বসে বসে বোর হওয়ার চেয়ে বরং ভালো আমরা বাইরে যাই। চাঁদ কী বলছে শুনে আসি।”

নূর তবুও রাজি হতে চাইল না। আয়মন জোর করে নূর এবং সাদমানকেও নিয়ে চাঁদকে অনুসরণ করে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সোজা বাইরে চলে এলো। পিছু ঘুরে চাঁদ তৎপর দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। ভুলেও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নূরের দিকে তাকালো না! তবে পাশ থেকে নূরের ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তার কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। এই বুঝি নূর এক্ষণি চাঁদের টু’টি চেপে ধরল!

আয়মন চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,
“কী রে? ডেকেছিলি কেন?”
চাঁদ গলা খাঁকালো। ধীর গলায় আয়মনকে বলল,,
“ভাবির ভাব-ভঙ্গি আমার সুবিধার লাগছে না ভাইয়া!”

আয়মন প্রত্যত্তুর করার পূর্বেই নূর চাঁদের দিকে তেড়ে এলো। কপালের ভাজে তিক্তার ছাপ ফুটিয়ে তটস্থ গলায় শুধালো,,
“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?”
চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। না চাইতেও নিরুপায় হয়ে নূরের দিকে তাকালো। ভয়াল গলায় বলল,,
“এই বাড়িতে আসার পর থেকেই ভাবিকে কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে!”
নূর বিষয়টাকে বেশ সিরিয়াসভাবে নিলো! চাঁদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তৎপর গলায় বলল,,
“মানে? খুলে বলো।”

চাঁদ অভয় পেল। আড়ষ্টতা ভুলে বিরামহীন গলায় বলল,,
“আসলে আমরা যখন ভাবিকে দেখতে উপরে গেলাম না? তখন অনেক ডাকাডাকির পরেও ভাবি রুমের দরজাটা খুলছিলেন না। রুমের ভেতর থেকে কোনো জবাবও দিচ্ছিলেন না।

এরপর যেন কোথা থেকে ভাবির কাজিন ছুটে এলেন! এসেই ভাবিকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। মেয়েটাও কেমন যেন ঘাবড়ে ছিল। ভয়ে গলা কাঁপছিল তার। হাত-পাও কাঁপছিল। অনেক ডাকাডাকির পর বাধ্য হয়ে ভাবি দরজা খুলে বাইরে আসেন। বাইরে আসার পরও দেখছিলাম ভাবি কাঁদছিল!”
নূর সন্দিহান হয়ে উঠল। ব্যস্ত গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“ওয়েট ওয়েট। ভাবি কাঁদছিল?”
“হ্যাঁ! এজন্যই তো আমার এত বেশি সন্দেহ হচ্ছে।”
সাদমান মাঝখান থেকে বেগড়া দিলো! চাঁদের সন্দেহকে আমলে না নিয়ে ছাড়া গলায় বলল,,

“তোমার হয়তো বুঝতে ভুল হচ্ছে চাঁদ। বিয়ের আগে এমনিতেও মেয়েরা খুব নার্ভাস থাকে। সেই নার্ভাসনেস থেকেই হয়তো কাঁদছিল বা অস্বাভাবিক আচরণ করছিল! হতেই পারে এসব। ইট’স নরমাল।”
নূর ক্ষেপে গেল। সাদমানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
“তুই কীভাবে এত শিওর হচ্ছিস হ্যাঁ?”
সাদমান শান্ত গলায় বলল,,

“শিওর হচ্ছি কারণ, আমার বড় আপুও বিয়ের আগে খুব নার্ভাস ছিল! শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের সাথে মিশতে চাইত না, কথা বলতে চাইত না, তাদের যথেষ্ট এড়িয়ে চলত, সারাক্ষণ কান্নাকাটি করত। এর মানে এই নয় যে তোরা যা সন্দেহ করছিস তা ঠিক। বা আমার আপুর অন্য কোনো সিরিয়াস কেইস ছিল। মূলত এক বাড়ি ছেড়ে আরেক বাড়ি চলে যাবে। নতুন সব মানুষদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। এসব দুঃশ্চিন্তা থেকেও কান্নাকাটি করতে পারে। তোরা চাইলে বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে পারিস।”

নূর রক্তিম চোখে চাঁদের দিকে তাকালো! হিংস্র গলায় বলল,,
“এই তোমার কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আন্দাজে মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করো কেন?”
চাঁদ এবার রেগে গেল। নূরের দিকে এগিয়ে এসে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“আমি যা রিয়েলাইজ করেছি তাই বলেছি। এখন যদি এই ব্যাপারগুলো আপনাদের স্বাভাবিক মনে হয় তো এখানে সত্যিই আমার কিছু বলার নেই।”

চাঁদ হনহনিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। সাদমান ব্যথীত হলো! চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলল,,
“ধ্যাত। আমার জন্যই চাঁদ রেগে গেল!”
নূর এক ভ্রু উঁচু করে সাদমানের দিকে তাকালো। সন্দেহজনক গলায় বলল,,
“তোর হাব ভাব কিন্তু সুবিধার লাগছে না। এত দরদ কেন তোর চাঁদের প্রতি হ্যাঁ?”
সাদমান মৃদু হাসল! মাথা নুইয়ে পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। আবিষ্ট গলায় বলল,,

“কুচ কুচ হোতা তে!”
ঘটনার আকস্মিকতায় নূর হা করে সাদমানের দিকে তাকিয়ে রইল! আয়মন সাদমানের দিকে তেড়ে এলো। রাগান্বিত গলায় বলল,,
“এই তুই কি সত্যিই আমার বোনের উপর লাইন মারছিস?”
সাদমান মাথা তুলে আয়মনের দিকে তাকালো। জড়তা ভুলে ক্ষীণ গলায় বলল,,
“ক্ষতি কী? ভালো লাগতেই পারে।”

নূর কদাচিৎ হাসল। সাদমানের মুখের কথা টেনে নিলো! শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,
“কোনো প্যারা নেই মামা। লাইন মারো ঠিক আছে? দু’দিন পরেই বুঝবা ঐ মেয়ে কী জিনিস! আর তখন বুঝবা জীবনে সবচেয়ে বড় ভুলটা তুমি কী করছ!”
নূর অট্ট হেসে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। আয়মন ক্রোধভরা দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সাদমান নির্বোধ গলায় আয়মনকে শুধালো,,

“কী বলে গেল নূর? দুদিন পর মজা বুঝব মানে?”
আয়মন ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। সাদমানের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উঁচু গলায় বলল,,
“শালা! আমার বোনের থেকে দূরে দূরে থাকবি। আমি চাই না চাঁদ কোনো প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াক। আর আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তো ভুলেও না।”

সাদমান বাঁকা হাসল! আয়মনের সামনে থেকে দৌঁড়ে পালালো। যেতে যেতে বলল,,
“শালা হবি তুই আমার। আমি তো হবো তোর দুলাভাই! চাঁদকে তো আমার চাই-ই চাই!”
আয়মন পাশবিক রূপ ধারণ করল। মৃদু আওয়াজ করে বলল,,

“সাদমানের বাচ্চা! এদিকে আয়। দেখাচ্ছি তোকে মজা!”
কে শুনে কার কথা? সাদমান এক দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। পরিশেষে আয়মনও সাদমানের পিছু নিলো। রাগ ঠাণ্ডা করে সবার সাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসল!

মাহফুজা বেগম এতক্ষণে অনুর রুমে থেকে সোহানী, জায়মা, নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহিকে নিয়ে খাবার টেবিলে চলে এলেন! একপ্রকার জোর করেই তাদের খাবার টেবিলে আনা। এই পুরো বিষয়টাতে সোহানী খুবই হতবাক। তার পাশাপাশি ক্রমাগত সন্দেহপ্রবণও হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে সোহানী এই বাড়িতে চুপ করে থাকলেও বাড়ি ফিরে এই বিষয়ে নীড়ের সাথে কথা বলবে বলে ভেবে রেখেছে! এবার শুধু পরিস্থিতি সামলে বাড়ি ফেরার পালা।

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য তার প্রখর উত্তপ্ততা ধরণীর বুকে বিলিয়ে এই সময়টাতে এসে প্রায় নির্জীব হয়ে পড়েছে। কোথাও একরত্তি রোদের তেজও অবশিষ্ট নেই। সূর্যের মৃদু আলো বিরাজ করছে সর্বত্র জুড়ে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সূর্যের লালরঙা মুগ্ধতা।

মাঝে মাঝে আবার দক্ষিনা বাতাস এসে শরীর-মন ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের পদচারণ ক্রমাগত বেড়ে চলছে। ক্লান্তি ভুলে আবারও সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে আবার চায়ের আড্ডায় নিজেদের পরিপূর্ণভাবে মাতিয়ে রেখেছে।

নীড়ের পরিবার কিছুক্ষণ আগে মাত্র নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। এসেই সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে যে যার রুমে শুয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সোহানীর চোখেই ক্লান্তি নেই। আছে শুধু কিছু অপ্রকাশ্য সন্দেহের জাল। সেই জাল ছেদ করে কখন সোহানী সব সন্দেহের ইতি টানবে সেই আশাতেই আছে প্রায়।

নীড় একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছে। মাহিনকে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করবে বলেই অফিসের সব কাজ ফেলে তাকে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে আসা! সোহানী ওঁৎ পেতে বসে আছে কখন নীড় ফ্রেশ হয়ে একটু রিলাক্স মোডে বসবে আর সোহানী সুযোগ বুঝেই নীড়ের সাথে খোলসা করে কথা বলবে। তীব্র ছটফটানি নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো সোহানী।

মনোস্থির করে নীড়ের রুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। ধীর পায়ে হেঁটে নীড়ের রুমের সামনে পৌঁছাতেই দেখল নীড় ফ্রেশ হয়ে মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। দেখতে ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত দেখাচ্ছে। সুযোগ বুঝে সোহানী তড়িৎ বেগে নীড়ের রুমে ঢুকে পড়ল! নীড় খানিক হকচকিয়ে উঠল। মুখ থেকে টাওয়ালটা সরিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় শুধালো,,

“কী ব্যাপার সোহানী? তুমি হঠাৎ?”
সোহানী ম্লান হাসল। ইতস্তত গলায় বলল,,
“কিছু না ভাইয়া। রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলে যাই!”
নীড় স্মিত হাসল। সোহানীর দিকে খানিক এগিয়ে এলো। বুকের উপর দু’হাত গুজে বলল,,

“ওহ্ আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার? বলো? কী বলবে?”
সোহানী শুকনো ঢোক গিলল। কীভাবে কী শুরু করবে তাই ভেবেই ভয়ে মরছিল। কিয়ৎক্ষণ মনে মনে প্রায় অনেক কিছু ভাবল সোহানী। নিজেকে খানিক ধাতস্থ করে সোহানী এবার নীড়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“ভাবির সাথে কথা হয়েছে?”

নীড় মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। বিষণ্ণ গলায় বলল,,
“এখনও হয় নি। আসলে সময়ই খুঁজে পাই নি।”
“ভাবি কল করে নি?”
“না! অনু আমার সাথে খুব কমই কথা বলে।”
“কারণ জানতে চান নি কখনো?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ১৯

“কারণ আবার কী থাকতে পারে? হয়তো জড়তা কাজ করে তাই তেমন কথা বলতে চায় না!”
“এতটাই শিওর আপনি? নিজের মন যা বলবে তাই? কখনো কিছু খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না?”
নীড় কপাল কুঁচকালো। তৎপর দৃষ্টিতে সোহানীর বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো। সন্দিহান গলায় বলল,,
“কী হয়েছে সোহানী? ঐ বাড়িতে সব ঠিকঠাক আছে তো? তোমাকে দেখতে একটু বেশিই সিরিয়াস দেখাচ্ছে।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২১