প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২২

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২২
নিশাত জাহান নিশি

অন্যদিকে নীড় এবং সাব্বির রেডি হয়ে বাড়ির মেইন গেইটে নূর এবং আয়মনের জন্য অপেক্ষা করছে। ভাড়া করা মাইক্রো নিয়ে তারা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

ভর সন্ধ্যা। রজনীর প্রথম ভাগ শুরু হয়েছে মাত্র। অন্তরিক্ষে সূর্যের রক্তিম আভা মিলিয়ে বিদঘুটে কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে বিস্তীর্ণ ভূ-মণ্ডল। মৃদুমন্দ বাতাসে আচ্ছন্ন বৃক্ষরাজি। পাখির কলতান মিইয়ে নির্বাক ধরণী। পূর্ব আকাশে কিঞ্চিৎ জায়গা জুড়ে চন্দ্রকরের বুৎপত্তি!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেই উপলক্ষে যেনো কান্তিমান আকাশের সৌন্দর্য দ্বিগুন, তিনগুন, চারগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে! শর্বরে নিমগ্ন ভূ-খণ্ড যেনো ক্রমশ ক্ষীণ আলোর দিশা খুঁজে পাচ্ছে! আবির মাখানো চন্দ্রকরের আলোয় নবচিত্তে মেতে উঠছে ধরা! মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে দিক থেকে বিদিক।

চারপাশ আলোকিত সেই বিভোর সৌন্দর্যকে কোনো উপমা দ্বারা ব্যক্ত করার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না নূর! কেবলই মগ্ন দৃষ্টিতে এক ধ্যানে চেয়ে আছে শোভন আকাশের পানে! টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে হাতে ভাড়ের চা নিয়ে তার যেনো মনগড়া হরেক রকম জল্পনা কল্পনা! মন খারাপের নানান বিজ্ঞাপন!

নূরের পাশেই বসে আছে আয়মন এবং সাদমান। দুজনই চায়ের ভাড়ে চুমুক দিয়ে শরীরকে নানানভাবে হেলিয়ে দুলিয়ে এয়ারফোনে গান শুনছে! কর্কশ গলায় আবার সেই গানের লিরিক্স ধরে টান দিচ্ছে! তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপে নূর বড্ড বিরক্ত হচ্ছে। নাক-মুখ কুঁচকে তিক্ততা প্রকাশ করছে।

এই মুহূর্তে গানে বুদ হয়ে থাকা দুই কুখ্যাত গায়ককে পিটিয়ে তক্তা বানাতে ইচ্ছে করছে তার! তবে মন-মানসিকতা খারাপ থাকার দরুন কোনোকিছুতেই মন বসছে না তার। নীরবে নিভৃতে নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে নানা শ্রেণির লোকজন যাতায়াত করছে।

ছেলে, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠরা আবার তাদের পাশে বসে ভাড়ে চা খাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে পারিবারিক, সাংসারিক, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করছে। এসব দিকে আয়মন এবং সাদমানের। তারা দুজনই গানের নেশায় বিভোর।

এরমধ্যেই আয়মন হঠাৎ প্রচলিত একটি হিন্দি গান ধরে জোরে টান দিলো! গানটা খুব প্রিয় হওয়ায় নূরও এবার নিস্তব্ধতা ভেঙে আয়মনের সাথে তাল মিলিয়ে শুষ্ক গলায় বলল, “তু চিজ বারি হে মাস্ত মাস্ত, তু চিজ বারি হে মাস্ত!”

আয়মন অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল। শুধু গানের সাথে লিপ সিং করছিল। যাকে বলে গুনগুন করে গান গাওয়া। তবে নূর গানের এই লাইনটা প্রায় দু থেকে তিনবার জোরে জোরে গেয়েছিল! কেউ ভাবতেই পারেনি এরমধ্যেই হঠাৎ করে কোমল হাতের চড় এসে আয়মনের গালে পড়বে!

কেউ আক্রমনাত্নক হয়ে তেড়ে আসবে তাদের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আয়মন ভড়কে উঠল! চোখ তুলে চড় মারা মেয়েটির দিকে তাকালো। নূর বেকুব হয়ে মুখ চেপে মেয়েটির দিকে অধীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! রাগে ফোঁস ফোঁস করে মেয়েটি আয়মনের দিকে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

মনে হলো যেনো এক্ষণি আয়মনকে আস্ত চিবিয়ে খেতে পারবে মেয়েটি! নূর এবং সাদমান আর এক মুহূর্তও ব্যয় করল না। অতিশয় বিপাকে পড়ে দুজনই চোরের মতো জায়গা থেকে ওঠে দৌঁড়ে পালালো! ডানে-বায়ে তাকিয়ে আয়মন হতাশ হলো। মনে মনে নূর এবং সাদমানকে গালি গালাজ করতে লাগল!

সবার জীবনেই এমন কিছু হারামী বন্ধু আছে যারা বিপদে পড়লে বন্ধুকে রেখেই দৌঁড়ে পালায়! আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা নেয়। বিপদ উদ্ধার হলেই চারিপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরে। বিভিন্নভাবে তাকে ক্ষেপানোর জন্য প্রস্তুত থাকে! নূর এবং সাদমানও সেই হারামী বন্ধুদের দলেই অন্তর্ভুক্ত হলো!

রোষ সংবরণ করে আয়মন নিরুপায় দৃষ্টিতে মেয়েটির তাকালো! অবুঝের মতো ভান ধরল। মেয়েটি রাগে নাক ঘঁষল। আয়মনের দিকে আক্রোশিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,
“রাস্তাঘাটে সুন্দুরী মেয়ে দেখলেই মুখ থেকে আজেবাজে গান বের হয়ে আসে না? তাদের টিজ করতে মজা লাগে?”
আয়মন ভোলা ভালা দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকালো! নির্বাক গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী? আমি আপনাকে টিজ করেছি?”
“হ্যাঁ করেছেন। আলবাদ করেছেন! আমাকে উদ্দেশ্য করেই আপনি বিশ্রী গানটা গাইছিলেন!”
আয়মন এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠল! তড়িৎ বেগে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। নির্ভীক গলায় মেয়েটিকে বলল,,

“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে বুঝেছেন? আমি জাস্ট এয়ারফোনে গান শুনছিলাম। আর মনে মনে গানটা গুনগুন করে গাইছিলাম। এরমধ্যে যদি আপনি হঠাৎ ছুটে এসে আমার গালে চড় বসিয়ে দিন এখানে আমার কী দোষ হ্যাঁ?”
মেয়েটি ধমকের স্বরে পুনরায় বলল,,

“মনে মনে গুনগুন করছিলেন হ্যাঁ? নাকি জোরে জোরে গানটা গাইছিলেন? আমি সব শুনেছি বুঝেছেন? আপনি যে আমাকে দেখেই জোরে জোরে গানটা গাইছিলেন আমি বেশ বুঝতে পেরেছি!”
আয়মন অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। রুক্ষ গলায় বলল,,

“আরেহ্! কখন থেকে কী যা তা বলছেন? আমি আপনাকে দেখে জোরে জোরে গানটা গাইতে যাব কেন হ্যাঁ? আমি তো জাস্ট লিপ সিং করছিলাম। জোরে জোরে তো গানটা গাইছিল আমার বন্ধু নূর!”

“ঢপবাজি করবেন না আমার সাথে, একদম না। আমি আপনাকেই জোরে জোরে গানটা গাইতে শুনেছি! রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, না? কখন তাদের টিজ করবেন সেই ধান্দায় থাকেন? অসভ্য, বেহায়া, নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার! বাড়িতে নিশ্চয়ই মা-বোন নেই? তাই এই বেহায়াপনা দশা আপনার। খবরদার বলছি নেক্সট টাইম থেকে যেনো আপনাকে কোথাও না দেখি যে রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করছেন। সাবধান করে গেলাম কিন্তু! পরেরবার আর সাবধান করব না। সোজা পুলিশে দিয়ে দিব!”

তুখার রাগ নিয়ে মেয়েটি আয়মনের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো! আয়মন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মেয়েটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল! সে যেনো বিশাল এক ঘোরে ডুবে আছে! ঘোর কাটিয়ে কিছুতেই বর্তমানে ফিরতে পারছে না সে। কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে আয়মনের নাজেহাল অবস্থা দেখে নূর এবং সাদমান হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে!

দুজনই বেশ ভালোই মজা নিচ্ছে। হাসাহাসির পর্ব শেষ হতেই দুই কালপ্রিট মন্থর পায়ে হেঁটে আয়মনের দিকে এগিয়ে এলো! তন্মধ্যেই আয়মন মেয়েটির যাওয়ার পথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অগ্রে তাকালো। নূর এবং সাদমানের দাঁত কেলানো হাসি দেখামাত্রই আয়মনের মাথায় রক্ত ওঠে গেল! রক্তিম দু’চোখে আয়মন নূর এবং সাদমানের দিকে তাকালো। ভাড়ের চা’টা বেঞ্চির উপর রাখল। কিছু বলার বা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল। এরমধ্যেই নূর হঠাৎ সাদমানের কাঁধে হাত রেখে শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“কী খবর মামা? কেমন লাগল মেয়েদের নরম হাতের চড়?”
আয়মন এবার কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ল! কটমট দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। শার্টের হাতা ফোল্ড করে নূরের দিকে তেড়ে এসে বলল,,

“শালা হারামী! আমারে ফাঁসাইয়া এখন আমার খবর নিতে আসছস তাই না? বোকার হদ্দ পাইছস আমারে? দাঁড়া আজ তোর একদিন কী আমার একদিন!”
নূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! দৌঁড়ে জায়গা থেকে পালালো। যেতে যেতে বলল,,
“যাই বলছ মামা, মেয়েটা কিন্তু জুস!”

নূরের পিছু নিলো আয়মন। কড়া গলায় বলল,,
“জুস হলে গিলে খা। যত ইচ্ছা তত খা। জাস্ট একবার তোকে হাতের কাছে পেয়ে নিই নূর! চড়ের প্রতিশোধ তো আমি কড়ায় গণ্ডায় শোধ করব-ই করব।”
“চড়ে খেয়েছিস ভালো কথা! মেয়ের নাম্বারটা কালেক্ট করতে পারলি না? লাইন টাইন মারতি একটু। আর কতকাল সিংগেল থাকবি বল?”

“মিংগেল হইয়া তোর মতো ছ্যাঁকা খাওনের ইচ্ছা নাই আমার!”
“ছ্যাঁকা আমি খাই নাই মামা! ছ্যাঁকা তো খাইছে রোজ! নূরকে হারাইছে সে! বুঝতে পারছস? নূরকে হারাইছে! নূরের মতো বিশাল মনের একটা ছেলেটাকে হারাইছে।”

দুজনই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে উঠল! ক্লান্ত হয়ে দুজনই এয়ারপোর্টের প্রবেশ দ্বারে এসে থামল। তাদের পিছু পিছু সাদমানও দৌঁড়ে এলো। অমনি তিনজনের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল এয়ারপোর্টের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা মাহিন, সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীর দিকে! তাদের এগিয়ে আনার জন্য এয়ারপোর্টের লটে দাঁড়িয়ে আছে নীড় এবং সাব্বির। নীড়কে দেখামাত্রই তারা তিনজন হাসিমুখে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। নূর খুশিতে হেসে উঠল। আয়মন এবং সাদমানকে লক্ষ্য করে বলল,,

“ভেতরে চল। মাহিন এসেছে!”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না নূর! আয়মন এবং সাদমানকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এয়ারপোর্টের ভেতর প্রবেশ করল। মাহিন বেশ আনন্দঘন হয়ে সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীকে রেখে দৌঁড়ে এলো নীড়ের দিকে। আষ্টেপৃষ্টে নীড়কে জড়িয়ে ধরে প্রফুল্লিত গলায় বলল,,
“কেমন আছো ভাইয়া?”

নীড় খুশিতে প্রায় আত্মহারা! ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে উদ্বেলিত গলায় বলল,,
“ভালো আছি মাহিন। তুই কেমন আছিস?”
“আমি তো খুব বেশি ভালো আছি ভাইয়া! এতো গুলো বছর পর আমার পরিবারের লোকজনদের সাথে আমার দেখা হচ্ছে। আর আমি ভালো থাকব না বলো?”

“জানিস? মা-বাবা খুব খুশি হবে তোকে পেয়ে। বাড়িতে এতক্ষণে এলাহি কাণ্ড বেঁধে আছে তোকে ঘিরে। তারা হয়তো মরিয়া হয়ে উঠেছে কখন তোকে কাছে পাবে!”
“আমিও ভীষণ উত্তেজিত ভাইয়া। মা-বাবকে কাছে পাওয়ার জন্য! সবাইকে কাছ থেকে দেখার জন্য।”

মৃদু হেসে নীড় মাহিনকে তার বুক থেকে উঠিয়ে নিলো। দিশেহারা হয়ে মাহিনের কপালে চুমু খেল! মাহিনকে পাশ কাটিয়ে নীড় এবার সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। প্রফুল্ল গলায় দুজনকে সালাম জানিয়ে বলল,,
“কেমন আছেন আঙ্কেল-আন্টি?”

দুজনই মিষ্টি হেসে নীড়ের দিকে তাকালো। নীড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সমস্বরে বলল,,
“আমরা ভালো আছি বাবা৷ তুমি কেমন আছো?”
“আপনাদের দোয়ায় আমিও ভালো আছি। বাড়িতে মা-বাবা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কখন আপনারা মাহিনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছাবেন সেই দুঃশ্চিতায় অস্থির হয়ে উঠছেন!”
সেলিনা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন! ক্ষীণ গলায় বললেন,,

“আমরা যতোই করি না কেন বাবা, মা-বাবার টান কিন্তু আলাদাই হয়! মাহিন এত বছর ধরে আমাদের সাথে আছে তবুও আজও অবধি তার মা-বাবার জায়গাটা আমরা দখল করতে পারলাম না! ছেলে শুধু নিজের মা-বাবাকেই কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে! উত্তেজনায় ছেলেটা দু’রাত ধরে ঘুমায় নি জানো? কখন দেশে ফিরবে সেই চিন্তায় ছিল!”
নীড় মলিন হাসল! সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল,,

“আপনার ধারণা হয়তো ভুলও হতে পারে আন্টি! মাহিন শুধু নিজের বাবা-মাকে নয় আপনাদেরও ভালোবাসে। আপনারা কাছে থাকেন বলে হয়তো টের পান না, তবে দূরে গেলে ঠিকই টের পাবেন। তখন মাহিন আপনাদেরও কাছে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে!”

আফতাব চৌধুরী কথায় ফোড়ন কাটলেন। নীড়কে লক্ষ্য করে বললেন,,
“আমিও সেলিনাকে তাই বলি। দূরত্বে গুরুত্ব বাড়ে। আমরা যখন মাহিনের থেকে দূরে যাব তখন মাহিন আমাদেরও গুরুত্ব বুঝবে।”
নীড় সায় জানালো। মৃদু হেসে বলল,,

“জি আঙ্কেল আপনি ঠিক বলেছেন!”
তাদের তিনজনেরই দৃষ্টি পড়ল অট্ট হাসিতে ফেটে পড়া মাহিন এবং নূরের দিকে। দুজনই দুজনের কাঁধে হাত রেখে হাসতে হাসতে কাহিল। মূলত তাদের হাসির কারণ হচ্ছে আয়মনের একটু আগের চড় খাওয়ার মর্মান্তিক কাহিনী! দূর থেকে বুঝাই যাচ্ছে না কে মাহিন আর কে নূর!

দুজনই পড়েছে নীল শার্ট তার উপর দুজনই টুইন! নিজে থেকে তারা পরিচয় না দিলে কেউ তাদের চিনতে পারবে না এটা শিওর। আয়মন এবং সাদমান বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে অনেক আগেই! নূর এবং মাহিনকে আলাদা করতে পারছে না তারা! নতুন করে আবার বিভ্রান্ত হয়ে উঠল সেলিনা চৌধুরী, আফতাব চৌধুরী এবং নীড়ও!

সেই বিভ্রান্তি নিয়েই তাদের গাড়িতে ওঠে বসা! বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। গাড়িতে বসেছে নীড়, মাহিন, নূর, সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী। বাসে করে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে আয়মন, সাদমান এবং সাব্বির। সারা পথ জুড়ে ননস্টপ কথা বলে গেছে নূর এবং মাহিন! যতো রাজ্যের জমানো কথা আছে সব তারা গাড়িতে বসেই সেরে নিচ্ছে।

সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী তাদের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নীড় পিছু ফিরে ব্যাক সিটে তাকালো। নূর এবং মাহিনের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন ছুড়ল,,
“এই তোদের মধ্যে নূর কে?”
নূর হাত তুলল! আচ্ছন্ন গলায় বলল,,
“আমি ভাইয়া। কেন?”

“তুই গাড়ি থেকে নাম! সি.এখন.জি বা রিকশা করে বাড়ি ফির। তোদের দুজনকে একসাথে দেখলে বাড়ির সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যাবে! তাই আমি চাই না মাহিনের আগমন বিভ্রান্তি দিয়ে হোক।”
নূর গম্ভীর মুখে নীড়ের দিকে তাকালো। মাহিন রাশভারী গলায় নীড়কে লক্ষ্য করে বলল,,

“থাক না ভাইয়া। আমি এবং নূর একসাথেই যাই প্লিজ।”
নীড় দ্বিমত পোষণ করল। নমনীয় গলায় বলল,,
“বাড়ি পৌঁছে তো আবার এক হবি-ই। এখন নূরকে যেতে দে। ভাইয়া যা বলছি তাই শোন।”

নূর রাগে গজগজ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল! সি.এখন.জিতে ওঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,,
“গাড়ি থেকে নামানোর হলে আগেই নামিয়ে দিতো। আয়মন আর সাদমানের সাথে এক বাসে করে বাড়ি ফিরে যেতাম। অযথা রাস্তার মাঝখানে এনে আমাকে অপদস্ত করল!”

ঘড়িতে রাত প্রায় নয়টা চলমান। মাহিনকে নিয়ে বাড়ির ড্রয়িংরুমে খুশির স্রোত বহমান। সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরার মাহিনকে পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়ছে। পারছেনা তারা মাহিনকে বুকে পুড়ে নিতে। মাহিনও তাদের পেয়ে ভীষণ খুশি। কিছুক্ষণ পর পর মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরছে।

পুরো বাড়িতে খুশির রোল পড়ে গেছে। সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরীও মাহিনকে ঘিরে বসে আছে। সাবরিনা আবরার এক এক করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাহিনের। ড্রয়িংরুমে সবার উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও চাঁদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেই চাঁদ ঘুমিয়ে পড়েছে! পুচিকে বুকে নিয়েই ঘুমাচ্ছে সে। নূর একটু আগেই বাসে করে বাড়ি ফিরেছে। আয়মন, সাদমান এবং সাব্বিরের সাথে ড্রয়িংরুমে এসে জয়েন করেছে। সবার মধ্যখানে নূর চাঁদকে দেখতে না পেয়ে জায়মার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“জায়মা। চাঁদ কোথায়?”
জায়মা অবাক হলো। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,,
“ওমা! এ তো দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম!’
গলা ঝাঁকালো জায়মা। ক্ষীণ গলায় বলল,,
” চাঁদ তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া।”

“আচ্ছা ঐ আপদটা কি এখনো আছে না গেছে?”
“কোন আপদ ভাইয়া?”
“ঐ যে বিড়ালছানাটা!”
“ওহ্ পুচি? পুচি তো এখনো চাঁদের সাথেই আছে ভাইয়া!”

নূর শুকনো ঢোক গিলল! পাশ কাটিয়ে মাহিনের পাশে এসে বসল। মাহিনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,
“আচ্ছা তোর ও তো বিড়ালে এলার্জি আছে তাই না?”
মাহিন ভ্রু কুঁচকালো! সহমত পোষণ করে বলল,,
“নেই মানে? সাংঘাতিক এলার্জি আছে।”
মাহিন খানিক নড়ে-চড়ে বসল। নূরের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,
“আচ্ছা নূর, আমার বেডরুমটা কোনদিকে? একটু ফ্রেশ হতে হবে।”

নূর বাঁকা হাসল! মনে মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,,
“এই সুযোগ মাহিনকে অপদস্ত করার! শুধু আমিই এলার্জির প্রবলেমে ভুগব কেন? তুইও ভোগ!”
নূর গলা ঝাঁকালো। ধীর গলায় বলল,,
“দুতলায় ওঠে ডান পাশের রুমটাই তোর।”

মাহিন ওঠে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবার থেকে পারমিশন নিয়ে উপরে ওঠে গেল। নূরের কথামতো দুতলার ডান পাশের রুমে প্রবেশ করা মাত্রই মাহিন আচম্বিতে কারো সাথে ধাক্কা খেলো! উদগ্রীব দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল চাঁদ কটমট দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকিয়ে আছে! মাহিন ভড়কালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“কে আপনি?”
চাঁদ মুখটা হা করে মাহিনের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় বলল,,
“এ্যাঁ?”
“আরে এ্যাঁ আবার কী? আপনি আমার রুমে কী করছেন হুম?”
“মাথা কি সত্যি সত্যিই গেছে আপনার? আমাকে চিনতে পারছেন না আপনি?”

“আরে আশ্চর্য তো! আমার মাথা যাবে কেন? আর আপনি কে? কাকেই বা চিনতে পারছি না আমি?”
চাঁদ কোমরে হাত রাখল। খড়তড় দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,
“আজও আবার নেশা-ভান করেছেন হ্যাঁ? মাতলামি করছেন আমার সাথে?”

মাহিন তেজী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“ভালোয় ভালোয় জিজ্ঞেস করছি কে তুমি বলো?”
চাঁদ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কোনো কথা না বাড়িয়ে সে বিছানা থেকে ঘুমন্ত পুচিকে কোলে তুলে নিয়ে এলো! মাহিনকে নূর ভেবে ভয় দেখানোর জন্য মাহিনের মুখের সামনে পুচিকে ধরল। বাঁকা হেসে বলল,,

“এবার অটোমেটিকলি আপনার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসবে! মনে করে দেখুন কে আমি!”
অমনি মাহিন হাত দ্বারা নাক-মুখ চেপে ধরল। প্রকাণ্ড চক্ষুজোড়ায় ঘোর আতঙ্ক নিয়ে জোরে চিৎকার করে বলল,,
“মামামামা। আমার এলার্জি।”

পেছন থেকে অট্ট হাসির আওয়াজ ভেসে এলো! নূর হাসতে হাসতে মাহিনের পাশে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে নমনীয় স্বরে বলল,,
“থ্যাংকস চাঁদ! আমার মনের আশা পূরণ করার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে নূর এবং মাহিনের দিকে তাকালো! বারংবার চোখ ঘুরিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“মাহিন ভাইয়া কখন এলো?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২১

নূর এখনো ননস্টপ হেসে চলছে! হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা তার। দ্বিধা ভুলে চাঁদ ধীর দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এক নজরে নূরের দিকে তাকিয়েই রইল! এক অবিচ্ছেদ্য টানেই নূরের মোহভরা হাসিমুখ থেকে কিছুতেই দৃষ্টি সরাতে পারল না সে!

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৩