প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৩

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৩
নিশাত জাহান নিশি

নূর এখনো ননস্টপ হেসেই চলছে! হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা তার। দ্বিধা ভুলে চাঁদ ধীর দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। এক নজরে নূরের দিকে তাকিয়েই রইল! এক অবিচ্ছেদ্য টানেই নূরের মোহভরা হাসিমুখ থেকে কিছুতেই দৃষ্টি সরাতে পারল না সে!

অচিরেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো চাঁদ। হঠকারিতায় মাথা নুইয়ে নিলো! জিভ কেটে নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। মিনমিনে গলায় বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ছিঃ! এসব আমি কী করছিলাম? নূর ভাইয়ার দিকে ওভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়েছিলাম? আমার চিরশত্রুর দিকে ওভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিলাম? ভাগ্যিস, লোকটা কিছু আন্দাজ করে নি! নয়তো আজ আমার খবর ছিল! কী না কী ভাবত আমায় নিয়ে! হয়তো আমাকে নিয়ে মনগড়া অনেক খারাপ ধারণাও পোষণ করত! পরবর্তীতে তা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত।”

নূর হাসি থামালো। চাঁদের কাণ্ডকীর্তি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল! স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তব্ধিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মাহিনের দিকে। অপরদিকে মাহিন নির্বোধ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! ভ্রু যুগল খানিক কুঁচকে জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,
“এখানে কী হচ্ছে একটু বলবি? এই চাঁদ মেয়েটা কে? প্লিজ পরিচয়টা ক্লিয়ার কর।”

নূর গলা ঝাঁড়লো। মাহিনের কাঁধে হাত রেখে অধীর গলায় বলল,,
“আরেহ্ চাঁদকে চিনলি না? চাঁদ হলো আমাদের মেঝো খালামনির ছোটো মেয়ে। যে বি’চ্চু মেয়েটার কথা আম্মু তোকে বার বার ড্রয়িংরুমে বলছিল এই সেই মেয়ে!”

তাৎক্ষণিক চাঁদ ক্ষেপে উঠল! পুচিকে কোলে নিয়ে নূরের দিকে আরও একটু তেড়ে এলো। তটস্থ গলায় বলল,,
“কী বললেন আপনি হ্যাঁ? আমি বি’চ্চু? আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিয়েছিলাম আমি হ্যাঁ? কেন মাহিন ভাইয়ার সামনে আমাকে এভাবে অপদস্ত করছেন? নিজে তো আমাকে সম্মান দিতে পারবেনই না সাথে অন্য কাউকেও সম্মান দিতে দিবেন না? পেয়েছেনটা কী আপনি আমাকে হ্যাঁ?”

পুচি মাত্র ঘুম ভেঙে উঠল। আলসেমি কাটাতে অগত্যাই হাত-পা ছুঁড়ল নূরের মুখের সামনে! জিভ চেটে খর্ব গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল। অমনি নূর ভড়কে উঠল! এক পা দু’পা করে পেছনের দিকে হাঁটা ধরল। ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা চাঁদের দিকে তাক করে কম্পিত গলায় বলল,,

“খবরদার বলছি চাঁদ। আর এক পা ও আমার দিকে এগুবে না। ওয়ার্ণ করছি কিন্তু হ্যাঁ? যদি এর বাইরে যাও না? তবে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে এই বলে দিলাম!”
“কী খারাপটা হবে শুনি? কী করবেন আপনি আমার? শকুনের মতো ওভাবে তাকানো ছাড়া আর কী-ই বা এলেম আছে আপনার?”

নূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! ঝগড়া ভুলে দৌঁড়ে পালালো জায়গা থেকে! যেতে যেতে আক্রোশিত গলায় বলল,,
“জাস্ট একদিন শুধু মারপ্যাচে পাই তোমায়! কী যে একটা সাংঘাতিক অবস্থা করব তোমার যা তুমি ভাবতেও পারছ না! তখন কিন্তু হাজার কান্নাকাটি করেও পাড় পাবে না বলে দিলাম। আমি কিছুতেই তখন ছাড় দিব না তোমায়। কড়া গণ্ডায় প্রতিটা অপদস্তের প্রতিশোধ নিব।”

“আরেহ্ যান যান। খালি মুখে মুখেই বড়ো বড়ো কথা আপনার! ধাঁর ধাঁরি না আমি আপনার এসব আউল ফাউল কথার বুঝলেন? ছ্যাঁকাখোর কোথাকার! আইছে আমারে হুমকি দিতে। ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো!”
নূরের ছায়াটিও আর দেখা গেল না! সোজা রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। অস্থিরমনা হয়ে সারাঘরে পায়চারী করতে লাগল! রাগে গজগজ করে নিজের হাতে নিজেই ঘুঁষি বসাতে লাগল! ঘাড়ের রগ টান টান করে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“শিট। আর পারা যাচ্ছে না ঐ ধূর্ত মেয়েটার সাথে৷ সুযোগ বুঝে ঠিক আমার দুর্বল জায়গাগুলোতেই বার বার আঘাত করছে। সিরিয়াসলি আর সহ্য করা যাচ্ছে না এত অপমান। আমারও সুযোগ বুঝে মেয়েটার দুর্বল জায়গায়গুলোতে আঘাত করতে হবে! চূড়ান্ত একটা শাস্তি দিতে হবে ঐ মেয়েটাকে! তবেই নূরকে ভয় পেতে বাধ্য হবে ঐ বি’চ্চু মেয়েটা। এট অ্যানি কস্ট আমার ভয় মেয়েটার মনে ঢুকাতেই হবে।”

নূরের যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ বিদ্বেষী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চাঁদ পুচিকে কোলে নিয়ে মাহিনের দিকে এগিয়ে এলো। জোরপূর্বক হেসে কিছু বলার পূর্বেই মাহিন নাক সিটকে হাত দ্বারা নাকটা ঢেকে নিলো। চোখের ইশারায় তার সমস্যার কথা বুঝালো! মাহিনের ইশারা বুঝে চাঁদ শুকনো হাসল। তাড়াহুড়ো করে পুচিকে ওড়নার তলায় ঢুকিয়ে নিলো! শুষ্ক গলায় মাহিনকে বলল,,

“এবার আমাকে চিনতে পেরেছেন তো মাহিন ভাই?”
মাহিন ম্লান হাসল৷ নাকে হাত রেখেই অস্পষ্ট গলায় বলল,,
“হ্যাঁ, পেরেছি। আর হ্যাঁ, একটু আগে তোমাকে না চিনেই অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম চাঁদ। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ওকে?”
চাঁদ দাঁত কপাটি দেখিয়ে হাসল৷ সরু দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। স্বস্তিজনক গলায় বলল,,

“আর যাই হোক, আপনি ঐ মাতাল নূরটার মতো হন নি! যথেষ্ট নস্র, ভদ্র এবং নরম মনের হয়েছেন! কী সুন্দর প্রথমে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেও পরে আবার তা স্বীকার করলেন। এমনকি মাইন্ড করতেও বারণ করলেন। সত্যিই আপনার ব্যবহারে আমি খুবই ফুলফিল হয়েছি মাহিন ভাইয়া।”

বেশ সক্রিয় হয়ে মাহিন নাক থেকে হাতটি সরিয়ে নিলো৷ এক ভ্রু উঁচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। তৎপর গলায় শুধালো,,
“হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মাতাল? আমার ভাই মাতাল?”
চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। রাগান্বিত অবস্থায় মাহিনকেও নূরের মতোই ভয়ংকর দেখাচ্ছে! অতিশয় বিপাকে পড়ে চাঁদ মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“আইলা এ তো দেখছি দুইটাই এক পিস! একটাকে মাতাল বলাতে আরেকটা ক্ষেপে গেল? তার মানে আমি এতক্ষণ ধরে যা যা ভাবছিলাম সব ভুল ছিল? মাগো! এ কোন মহা ফ্যাসাদে ফেঁসে গেলাম আমি? এখন কি একেও আমার স্যরি বলতে হবে? যদিও একে স্যরি বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই! তবে নূরের বাচ্চাকে কিছুতেই স্যরি বলা যাবে না! এ হলো আমার জন্মের শত্রু! শত্রুদের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ নয়।”

চাঁদ গলা ঝাঁড়লো। কম্পিত দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। আড়ষ্ট গলায় বলল,,
“স্যরি ভাইয়া। ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো আপনার সামনে আপনার টুইন নূর ভাইয়াকে মাতাল বলব না।”
মাহিন কপাল কুঁচকালো। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মানে? অন্য কারো সামনে নূরকে ঠিকই মাতাল বলবে?”

“না তো ভাইয়া! আমি একথা কখন বললাম? আমি তো কারো সামনেই মাতালকে মাতাল বলব না! শুধু মনে মনেই আত্মার শান্তির জন্য তাকে মাতাল মাতাল বলে জপ করব!”
মাহিন কটমট দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! চাঁদ আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না। রাস্তা মাপতে আরম্ভ করল! মাহিনকে উপেক্ষা করে সামনে পা বাড়িয়ে গলা খাদে এনে বলল,,

“আমি এখন যাচ্ছি মাহিন ভাইয়া! পুচিকে ওর বাড়ি রেখে আসছি। এই রুমের পাশের রুমটাই আপনার বুঝেছেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। সকাল থেকেই হয়তো অনেক ধকল গেছে আপনার উপর।”
এক মুহূর্তের জন্য থামল চাঁদ। পুনরায় লাগামহীন গলায় বলল,,

“বাই দ্যা ওয়ে, নাইস টু মিট ইউ মাহিন ভাই।”
চাঁদ আর ডানে-বায়ে তাকালো না। এক দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মাহিন অট্ট হাসল! মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,,
“নূর ঠিকই বলেছে, এই মেয়ে সত্যিই বিচ্চু!”

হাসতে হাসতে মাহিন তার রুমে প্রবেশ করল। গাঁয়ের ব্লু শার্টটা খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। চাঁদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। ড্রয়িংরুমের পরিবেশ এখন বেশ রমরমা। বাড়ির প্রতিটি সদস্য ড্রয়িংরুমে উপস্থিত। একে-অপরের সাথে নানা ধরনের খোশগল্পে মশগুল। সবার চোখে- মুখে হাসি-খুশি ঠিকরে পড়ছে।

মাহিন এবং সেলিনা চৌধুরীকে পেয়ে সবাই বেশ খুশি। এই মুহুর্তে চাঁদ কাউকে ডিস্টার্ব করতে চাইল না। উপস্থিত সবাইকে উপেক্ষা করে মন্থর পায়ে হেঁটে বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো। অমনি পেছন থেকে রুহির গলার স্বর ভেসে এলো। চাঁদ তৎক্ষনাৎ পিছু ফিরে তাকালো। রুহি দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“কোথায় যাচ্ছ আপু?”
“পাশের বাড়ি যাচ্ছি। পুচিকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিতে।”
“তুমি একাই যাবে?”
“কেন? তুই যাবি?”

“হুম! এখানে খুব বোর লাগছে আপু। একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলে হয়তো ভালো লাগত।”
চাঁদ মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। রুহির কাঁধে হাত রেখে রুহিকে নিয়ে বাড়ির সদর দরজা পাড় হলো। বাড়ির মেইন গেইটের কাছে আসতেই রুহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। সন্দিহান গলায় বলল,,

“আচ্ছা আপু? ইনিই কী সেই সেলিনা চৌধুরী? যার জন্য মেঝো খালামনির সাথে বড়ো খালামনির খুব ঝগড়া হয়েছিল? যার কারণে অনেক বছর আগে বড়ো খালামনির সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল?”
চাঁদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“হ্যাঁ রে! এই সেই সেলিনা চৌধুরী! যার জন্য খালামনির সাথে আম্মুর ঝগড়া হয়েছিল। আম্মুর মুখ থেকে যতটুকু শুনেছি মূলত ঝগড়া হওয়ার কারণ ছিল মাহিন ভাইয়া! আম্মু এবং ছোটো খালামনি চায়নি সেলিনা চৌধুরীর কাছে মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিতে!”

“সিরিয়াসলি আপু? বড়ো খালামনি মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ এরকমই কিছুটা। যদিও এই বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানিনা। তবে সোহা আপু এই বিষয়ে খুব ভালো জানেন।”
“আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপু, বড়ো খালামনি কেন মাহিন ভাইয়াকে দত্তক দিয়েছিল?”

“আমারও খুব জানতে ইচ্ছে হয়। তবে আম্মু এবং আপুর ভয়ে খালামনিকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়ে ওঠে না। আর একটা কথা, তুই কিন্তু ভুলেও আম্মু, আপু কিংবা খালামনিকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবি না।”
“আচ্ছা আপু জিজ্ঞেস করব না। তবে একটা জিনিস ডাউট হচ্ছে আমার!”

“কী?”
“মেঝো খালামনি আসবে তো বিয়েতে? সেলিনা চৌধুরী কিন্তু এখানেই আছেন!”
“আরেহ্ আসবে। আসবে না কেন হ্যাঁ? আর কতকাল এভাবে রাগ-অভিমান পুষিয়ে রাখবে? সবকিছুর-ই একটা তো সীমা থাকে না-কি? এবার আমি কিছুতেই আম্মুকে সেই সীমা অতিক্রম করতে দিব না।”

কথা বলতে বলতে দুজনই পাশের বাড়ির মেইন গেইট অবধি চলে এলো। গেইট ক্রস করে দুজনই দুতলায় ওঠে গেল। চাঁদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফ্ল্যাট নাম্বার দুই এর কলিং বেল চাপল। অমনি পুচি আহ্লাদি হয়ে চাঁদের মুখ চাটতে লাগল। পাশ থেকে রুহি খুব হেসে পুচিকে আদর করতে লাগল। পুচির থাবায় মোলায়েমভাবে চিমটি কাটতে লাগল!

পুচি রেগে বোম হয়ে খড়তড় গলায় ম্যাও বলে ডাকতে লাগল। প্রায় তিন থেকে চারবার কলিংবেল চাপ দেওয়ার পর আকস্মিকভাবেই একজন মাঝবয়সী ছেলে এসে ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে দিলো! চোখ দুটো লাল হয়ে আছে ছেলেটির! দেখেই মনে হচ্ছে নেশাগ্রস্ত। শরীরটাও কেমন ঢুলু ঢুলু করে কাঁপছে ছেলেটির।

নাক ঘঁষে কম্পিত দৃষ্টিতে বার বার চাঁদ এবং রুহির দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটির বর্তমান ভয়ানক অবস্থা দেখে চাঁদ এবং রুহি দুজনই শুকনো ঢোক গিলল। একে-অপরের দিকে ভয়াল দৃষ্টিতে তাকালো। নাক টেনে ছেলেটি চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“কী চাই?”
সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির মুখ থেকে তামাকের বিশ্রী গন্ধ বেরিয়ে এলো! চাঁদ এবং রুহি তৎক্ষনাৎ নাক-মুখ চেপে ধরল। কম্পিত দৃষ্টিতে চাঁদ ছেলেটির দিকে তাকালো। রুহি শুকনো কেশে চাঁদের ঠিক পেছনের দিকটায় লুকালো। রুহির হাত ধরে চাঁদ রুহিকে অভয় দিলো। কাঠ কাঠ গলায় জবাবে ছেলেটিকে বলল,,

“আআআন্টি কোথায়?”
“আন্টি নেই। যা বলার আমাকে বলুন।”
কাঁপা কাঁপা হাতে চাঁদ পুচিকে ছেলেটির দিকে ধরল। ভয়ার্ত গলায় বলল,
“পুচিকে দিতে এসেছি।”

পুচিও কেমন যেনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকালো! মাথাটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে পুচি চাঁদের দিকে মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলেটির কাছে যেতে সে আপত্তি প্রকাশ করল! চাঁদ সচকিত দৃষ্টিতে পুচির দিকে তাকালো। অমনি ছেলেটি চাঁদের হাত থেকে পুচিকে কেড়ে নিলো!

সঙ্গে সঙ্গেই পুচি আর্ত গলায় ম্যাও বলে ডেকে উঠল! চাঁদ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। উদগ্রীব গলায় হা করে কিছু বলার পূর্বেই ছেলেটি মুখের উপর দরজাটি বন্ধ করে দিলো! চাঁদ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। অধৈর্য্য হয়ে দরজায় টোকা মারতে লাগল। উদ্বেগি গলায় বলল,,

“প্লিজ দরজাটা খুলুন। পুচি হয়তো আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে!”
অমনি রুহি চাঁদকে টানতে টানতে নিচ তলায় নেমে এলো। অস্থিরমনা চাঁদের দিকে তাকালো। শঙ্কিত গলায় বলল,,
“আপু প্লিজ চলো এখান থেকে। ছেলেটা খুবই ডেঞ্জারাস। কেমন যেনো গাঁজাখোর টাইপস। ভয়ে আমার শরীরটা কেমন যেনো কাঁপছে আপু!”

“কিন্তু আমার তো পুচিকে নিয়ে অনেক ভয় হচ্ছে রুহি! ছেলেটা পুচির কোনো ক্ষতি করবে না তো? তাছাড়া আন্টি কোথায়? আন্টিকে তো কোথাও দেখলাম না। আচ্ছা? আন্টি ঠিক আছে তো?”
“আপু প্লিজ থামো। চুপচাপ এখান থেকে চলো। আর কখনো তুমি পুচিকে নিতে এই বাড়িতে আসবে না। ছেলেটা কিন্তু ভালো নয় আপু।”

চাঁদকে আর কথা বাড়াতে দিলো না রুহি। প্রতিবার চাঁদের কথায় বেগড়া দিলো। চাঁদকে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ড্রয়িংরুম এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। আড্ডার আসর ভেঙে যে যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে৷ একটু পর টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হবে।

আর সেই কারণেই সোহানী, জায়মা এবং সাবরিনা আবরার ব্যস্ত রান্নাঘরের কাজে। খাবারের রকমারী আইটেম আজ রান্না করেছেন সাবরিনা আবরার। সেই তালিকায় যুক্ত আছে মাহিনের সমস্ত প্রিয় খাবার। রান্নাঘর থেকে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে ড্রয়িংরুমের প্রতিটি আনাচে-কানাচে। খুশি যেনো ধরছে না উনার। ছেলেকে কীভাবে খাইয়ে-দাইয়ে সন্তুষ্ট করবেন সেই চিন্তায় উনি বেখবর!

চাঁদ এবং রুহি ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেই প্রথমে গড়গড় করে দু’গ্লাস পানি খেলো। মাথায় হাত দিয়ে দুজনই সোফায় বসে পড়ল! বলা নেই কোয়া নেই এরমধ্যেই নূর হঠাৎ পেছন থেকে এসে চাঁদের মাথায় সজোরে গাড্ডা মারল! ব্যথায় চাঁদ কুঁকড়ে উঠল। ব্যথাযুক্ত জায়গায় হাত রেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকালো। নূর রক্তিম চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে! বুকে দু’হাত বেঁধে। চাঁদ অবাক হলো। পিটপিটে দৃষ্টিতে নূরের তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো ব্যাপারটা? আপনি হঠাৎ আমার মাথায় গাড্ডা মারলেন কেন?”
তেজের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিলো নূর! বুক থেকে হাত দু’খানা সরিয়ে নিলো। খড়খড়ে গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“আমার বেডে বিড়ালের পশম এলো কোত্থেকে শুনি? আমি যাওয়ার পর বেডটা ক্লিন করো নি তুমি? কাম অন স্পিক আপ।”
চাঁদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“ক্যান ভাই? আমারে কি বাসার কাজের বুয়া পাইছেন? আপনার বেড ক্লিন করব আমি? খেয়ে-দেয়ে আর কোনো কাজ নাই আমার? আপনার বাসায় আমি কাজ করতে আইছি?”
“হ্যাঁ তুমিই করবে। কারণ তোমার কারণেই বিড়ালের পশম আজ আমার বেড অবধি পৌঁছাতে পেরেছে। ইট’স অল অফ ইউর ফল্ট ওকে?”

“পারব না আমি! পা র ব না! শুনতে পেরেছেন আপনি? যান এবার বিদায় হন!
“তুমি পারবে না তোমার ঘাড় পারবে!”
চাঁদের ডান হাত ধরে টান দিলো নূর! সুঠাম হাতে টানতে টানতে চাঁদকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটা বাঁকাতে হয় বুঝছ? আর তুমি সোজা কথার মানুষ না। সবসময়ের ঘাড়ত্যাড়া!”
চাঁদ গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল! আর্ত গলায় বলল,,
“খালামনি দেখে যাওওও। তোমার ছেলে আমার সাথে কী করছে।”

সাবরিনা আবরার দ্রুত পায়ে হেঁটে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। কাপড়ের আঁচলে হাত মুছে উদ্বেগী দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। রুহি হাসতে হাসতে প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে! নূর এক প্রকার টেনে হেছড়ে চাঁদকে তার রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ শত চেষ্টা করেও নূরের হাতটা ছাড়াতে পারছে না! সাবরিনা আবরারও এবার ফিক করে হেসে দিলেন! চাঁদ কান্নাজড়িত দৃষ্টিতে পিছু ফিরে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বলল,,

“খালামনি তুমিও হাসছ? তোমার ছেলেকে কিছু বলবে না?”
চাঁদের কথায় ফোড়ন কাটল নূর। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“কী বলবে হ্যাঁ? মা কী বলবে আমায়? দোষ তো তোমারই ছিল। তুমি কেন আমার বেডটা ক্লিন করে রাখলে না? এই? কেউ তোমাকে বলছিল বিড়াল নিয়ে আমার রুমে যেতে? এবার ভুগো। যেমন কর্ম তেমন ফল ওকে? তোমার কাজ এবার তুমিই করো।”

চাঁদ নাক টেনে কেঁদে উঠল! অসহায় দৃষ্টিতে পিছু ফিরে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো! সাবরিনা আবরার এবার হাসি থামালেন। শান্ত গলায় চাঁদকে লক্ষ্য করে বললেন,,
“যা মা বিছানাটা পরিষ্কার করে আয়! অল্প একটুই তো কাজ। তাছাড়া নূর তো তোর খালাতো ভাই-ই হয় তাই না? বিছানাটা একটু পরিষ্কার করে দিলে কিচ্চু হবে না।”

হাসি চেপে সাবরিনা আবরার জায়গা থেকে প্রস্থান নিলেন। চাঁদ এবার নিরুপায় দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর বাঁকা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ঠোঁটে কোণে লেগে আছে তার রাজ্য জয়ের হাসি! চাঁদকে অপদস্ত করতে পেরে সে মহা খুশি। শার্টের কলারটা পেছনের দিকে হেলিয়ে নূর বেশ ভাব নিলো। এক চোখ টিপে চাঁদের কানে গুঞ্জন তুলে বলল,,

“কী করবে এবার মিস ঝগড়ুটে চাঁদ? আমার কাজ তো এবার তোমাকে করতেই হবে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে না? টিথ ফর টেথ? এই মুহূর্তে প্রবাদ বাক্যটা তোমার সাথে একদম পার্ফেক্টলি ম্যাচ হয়ে যাচ্ছে।”
নূর অট্ট হাসল। পরিস্থিতির চাপে পড়ে চাঁদ বিড়াল হয়ে গেল! নূরের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আক্রোশিত গলায় মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“সুযোগ বুঝে মাতালটা আমার থেকে রিভেঞ্জ নিচ্ছে। ইচ্ছে করে আমাকে হেনস্তা করছে। এবার কী হবে আমার? এই ছেলের বেড ক্লিন করতে হবে আমার? আমি তো নিজের বেডটাই কখনো গুছাই নি। সবসময় কাজ থেকে গাঁ বাঁচিয়ে চলেছি! এখন সেই মহা ঝামেলার কাজ-ই আমাকে করতে হবে?”

মাহিনের রুমে আয়মন এবং সাদমানের আড্ডার আসর জমেছে। তারা তিনজনই একসাথে বসে নানারকম আলাপচারিতায় মগ্ন৷ মাহিন তার বাইরের দেশে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত দুই ফ্রেন্ডের সাথে শেয়ার করছে। আয়মন এবং সাদমান খুব মনযোগ দিয়ে তার সব কথাগুলো শুনছে।

মাঝে মাঝে মেয়েলী বিষয় নিয়ে মাহিনকে ক্ষেপিয়েও দিচ্ছে। বিপরীতে মাহিনও ঠাস ঠাস করে দুজনের গাঁয়ে কিল ঘুঁষি মারছে। তাদের আড্ডাকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্য সোহানী হাতে করে তিন মগ কফি নিয়ে এলো! কফি পেয়ে তারা তিনজনই ব্যাপক খুশি হয়ে গেল। হাসিমুখে সোহানীকে তারা ধন্যবাদ জানালো। বিপরীতে সোহানীও মুচকি হেসে মাহিনকে লক্ষ্য করে বলল,,

“আরও কিছু লাগলে আমাকে বলবে কেমন? আমি এসে দিয়ে যাব।”
মাহিন মৃদু হেসে সোহানীর দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সোহানী হঠাৎ মাথা চুলকে মাহিনকে বলল,,

“আমি না প্রথমে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম তুমি মাহিন না-কি নূর৷ পরে তোমার আচরণ দেখে কনফার্ম হলাম তুমি মাহিন!”
মাহিন খিলখিলিয়ে হেসে বলল,,

“এই তো ব্যাস শুরু আপু। আরও কত কনফিউশনের বাকি আছে! মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানেন? আমাদের দুই ভাইয়ের কপালে বউ জুটবে না! এত কনফিউশন নিয়ে কে আমাদের সাথে থাকতে চাইবে?”
সোহানী ফিক করে হেসে দিলো! সাথে আয়মন এবং সাদমানও। জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো সোহানী। যেতে যেতে পিছু ফিরে বলল,,

“কথাটা কিন্তু মন্দ বলো নি তুমি!”
এরমধ্যেই হঠাৎ সোহানী কারো সাথে ধাক্কা খেলো! হঠকারি দৃষ্টিতে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি দৃষ্টির সীমানায় নীড়কে দেখতে পেল সোহানী। নীড় এক ভ্রু উঁচু করে সোহানীর দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ সোহানী জিভ কেটে গলা খাদে এনে বলল,,

“সরি ভাইয়া। আপনাকে খেয়াল করি নি আমি।”
নীড় ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে দাঁড়ালো৷ সোহানীর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”

সোহানী অবাক হলো। নীড়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কী কথা ভাইয়া?”
“তুমি ঐ সময় যেনো অনুকে নিয়ে কী বলছিলে? অনু এই বিয়েতে রাজি না তাই তো?”

“আমি কিন্তু স্পেসেফিকলি কিছু বলি নি ভাইয়া। জাস্ট ধারণা থেকে সন্দেহ করছিলাম। আর সেই সন্দেহটাই আমি আপনার কাছে ক্লিয়ার করেছিলাম। বাকিটা তো আপনি আর ভাবি জানেন তাই না?”
“এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছিল অনুর সাথে। অনু নিজের মুখেই স্বীকার করেছে সে এই বিয়েতে রাজি। সো এখানে তো আমি সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২২

“সবসময়ই যে কানে শোনা কথা বা নিজ চোখে দেখা কোনো ঘটনা সঠিক হতে পারে তা কিন্তু নয়! হতে পারে আমার দেখার ভুল ছিল কিংবা আপনার শোনার ভুল ছিল! তাই আগে থেকেই হলফ করে কিছু বলা ঠিক না।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৪