প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৪

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৪
নিশাত জাহান নিশি

“সবসময়ই যে কানে শোনা কথা বা নিজ চোখে দেখা কোনো ঘটনা সঠিক হতে পারে তা কিন্তু নয়! হতে পারে আমার দেখার ভুল ছিল কিংবা আপনার শোনার ভুল ছিল! তাই আগে থেকেই হলফ করে কিছু বলা ঠিক না।”
উদগ্রীবতায় নীড় ভ্রু যুগল কুঁচকালো! গভীর দুঃশ্চিতায় ডুবে গেল। অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি নিজ কানে যা শুনেছি সব মিথ্যে ছিল?”
সোহানী রুক্ষ হাসলো! রহস্যময়ী গলায় বলল,,
“হতে পারে! আবার নাও হতে পারে!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নীড়কে ঘোর বিপাকে ফেলে সোহানী ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! পিছু ফিরে নীড় সন্দিহান দৃষ্টিতে সোহানীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মনে মনে আওড়ে বলল,,
“কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে এসব সোহানী? সত্যিই কি আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে? এই বিষয়ে কি আমার অনুর সাথে বসে খোলাখুলি কথা বলা উচিৎ?”

সোহানীর যাওয়ার পথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নীড়। কপালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো! হারিয়ে যাওয়া মনোবল আবারও দৃঢ় করল। কপাল থেকে হাত সরিয়ে ফুসফুসে দম সঞ্চার করল। পরিস্থিতি শতভাগ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল! ম্লান হেসে মাহিনের রুমে প্রবেশ করল!

অমনি মাহিন, সাদমান ও আয়মন ফাজলামি ভুলে নিজেদের জায়গায় স্থির হয়ে বসল। জোরপূর্বক হাসি টেনে নীড়ের দিকে তাকালো। এই সময়টাতে নীড়কে তারা একদমই প্রত্যাশা করে নি! তাদের হঠকারি ভাব-ভঙ্গি দেখে নীড় তা বেশ আঁচ করতে পারল। তাই পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য নীড় প্রাণবন্ত হেসে মাহিনের পাশে বসল! মাহিনের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসু গলায় সবাইকে লক্ষ্য করে বলল,,

“কী রে? কী করছিস তিন ব্যাটেলিয়ান মিলে?”
মাহিন স্মিত হাসল। জবাবে বলল,,
“এই তো ভাইয়া আড্ডা দিচ্ছিলাম।”
নীড় মৃদু হেসে সাদমানের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তে এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কী সাদমান? সামান্তা এখনো তোকে ডিস্টার্ব করে?”

সাদমান লজ্জামাখা হাসি দিলো! মাথা নুইয়ে পেছনের চুলগুলো টেনে ধরল। স্বস্তিজনক গলায় বলল,,
“না ভাইয়া। কবেই ডিস্টার্ব করা ছেড়ে দিয়েছে!”
“কেন? পাত্তা দিস না বলে?”
“হ্যাঁ! কিছুটা এরকমই।”

নীড় অট্ট হেসে আয়মনের দিকে তাকালো। দুষ্টুমির স্বরে বলল,,
“কী আয়মন? চড়ের দাগটা এখনো গালে লেগে আছে?”
চোখে-মুখে বিস্ময়াত্নক ছাপ ফুটিয়ে আয়মন তাড়াহুড়ো করে চড়ে খাওয়া গালে হাত রাখল! চোখ জোড়া প্রকাণ্ড করে নীড়ের দিকে তাকালো। বিরামহীন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“তুমি জানলে কী করে ভাইয়া, আমি চড় খেয়েছিলাম?”

পাশ থেকে মাহিন ব্যগ্র হাসল! ইশারায় আয়মনকে ব্যঙ্গ করতে লাগল! বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না মাহিন-ই নীড়ের কানে এই লজ্জাষ্কর বিষয়টা ঢুকিয়েছে। কটমট দৃষ্টিতে আয়মন মাহিনের দিকে তাকালো! মাহিন মুখ ভেংচাতে লাগল! আয়মনকে পঁচাতে পেরে সে মহা খুশি!

সাদমান মুখ চেপে হাসতে ব্যস্ত৷ মনে মনে মাহিনকে হাজারটা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল! আয়মনের বর্তমান অবস্থা ভয়ার্ত বাঘের ন্যায়। দুই বন্ধুকেই আঁচড়ে ফেলার মোডে আছে সে! আয়মনের আক্রমনাত্নক রূপ দেখে নীড় গলা খাঁকালো৷ হাসি থামিয়ে আয়মনের দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“নূর বলল মেয়েটা দেখতে না-কি জুস ছিল?”
আয়মন মাথা নুঁইয়ে দাঁতে দাঁত চাপল! মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“শালা! সবগুলা-ই হারামির দল। দুইভাই মিলে আমার ইজ্জতের দফা-রফা করে দিলো! বড়ো ভাইয়ের কাছে আমার বেঁচে যাওয়া মান-সম্মানের ফালুদা বানিয়ে ছাড়ল।

ছিঃ আয়মন! শেইম অন ইউ! তবে আমিও কিন্তু কম যাই না। যার জন্য আমাকে এত ইনসাল্টেড হতে হলো না? দ্বিতীয়বার যদি তার সাথে দেখা হয় না? কী যে একটা খারাপ অবস্থা করব আমি ঐ মেয়েটার, যা ঐ মেয়েটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছে না!”

জল্পনা-কল্পনা ভুলে আয়মন গলা ঝাড়লো। মাথা নুইয়ে রেখেই চোয়াল শক্ত করে বলল,,
“হ্যাঁ করলার জুস ছিল!”

উপস্থিত সবাই হু হা শব্দে হেসে দিলো! আয়মন ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে লাগল! চড়ের আওয়াজটা প্রখরভাবে তার কানে বাজতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই সে প্রতিজ্ঞা করে নিলো ঐ মেয়েকে সামনে পেলে চড়ের সাংঘাতিক একটা প্রতিশোধ নেওয়ার! সাদমান পাশ থেকে নানাভাবে আয়মনকে খোঁচাতে লাগল। ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল। রাগী আয়মনের আরও উস্কিয়ে দিতে লাগল। আয়মন পাশ থেকে সাদমানের কানে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“খুব মজা নিচ্ছিস না? নে। সময় পরে আমারও আসবে। সেদিন কিন্তু আমি চুপ করে থাকব না! আমার বোনকে লাইন মারার শাস্তি তোকে নিজ হাতে দিব!”
“তোর বোনকে পাওয়ার জন্য আমি হাজার শাস্তি পেতেও রাজি! ইউ নো হোয়াট? ইট’স হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভ!”

সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নূর! শার্টের কলার পেছনের দিকে এলিয়ে সোফার পেছনের গদিতে হেলান দিয়ে সে রাজার হালে বসে তাজা আপেলে বাইট বসাচ্ছে! পৈশাচিক খুশিতে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। কারণ সামনেই তার চিরশত্রু চাঁদ ইনিয়ে বিনিয়ে নাক ফুলিয়ে বিছানা ঝাঁড়ছে!

কিয়ৎক্ষণ পর পর নূরের দিকে ঝাঁঝালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে! বিপরীতে নূরও তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। হাতা ফোল্ড করে চাঁদকে ভয় দেখাচ্ছে। চোখের ইশারায় বলছে তাড়াতাড়ি বিছানাটা ঝেড়ে দিতে। নয়তো চোখ উপড়ে ফেলবে! দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাঁদ নাকি কান্না করে কাজে মনোঃসংযোগ করল।

মনে মনে নূরের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল! শলা ঝাড়ু দিয়ে কোনোরকম চাঁদ বিছানাটা ঝাড়ল। এইদিকে এক ঝাড় তো ঐদিকে এক ঝাড় এমন করে মোট তিন থেকে চারটে ঝাড় দিয়ে বিছানাটা মোটামুটি ঝেড়ে দিলো চাঁদ। কাজ শেষে হাত থেকে শলা ঝাড়ুটা মেঝেতে ছুড়ে মারল! রাগী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“হয়েছে? আপনার মনস্কামনা পূরণ হয়েছে আপনার? এবার আমি যেতে পারি?”
নূরের সম্মতির অপেক্ষা করল না চাঁদ। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! রুমের দরজা বরাবর পৌঁছাতেই নূর তড়িৎ বেগে সোফা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। হাতের আপেলটা ডেস্কের উপর রেখে তটস্থ গলায় চাঁদকে লক্ষ্য করে বলল,,
“হেই ওয়েট অ্যা সেকেন্ড। আমার পারমিশন ছাড়া কোথায় যাচ্ছ তুমি হ্যাঁ?”

চাঁদ পিছু ঘুরল। কোমড়ে হাত গুজে লোহিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো৷ তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“আর কী করানোর বাকি আছে হ্যাঁ?”
“চেইক করে দেখতে হবে না আদৌ কাজের কাজ কিছু হয়েছে কি-না? তোমার আনারি হাতের কাজ যে কতোটা ফলপ্রসূ একবার তো তা চেইক করে দেখা উচিৎ না-কি? জাস্ট অ্যা মিনিট ওকে? এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে? এমন তো নয় যে তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!”

নূরের একটা কথাও চাঁদের পছন্দ হলো না। রাগে ফোঁস করে ক্ষোভ প্রকাশ করল। উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে নূরের দিকে তেড়ে এলো। ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা নূরের মুখের সামনে ধরল। তেজী গলায় বলল,,
“আমি কী আপনার মতো ইডিয়ট যে আমার বয়ফ্রেন্ড থাকবে? বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড তাদের-ই থাকে যাদের মাথামোটা হয়!”
নূর অট্ট হাসল! হাসতে হাসতে সোফার উপর বসে পড়ল! পেটে হাত রেখে শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,

“বিড়াল যখন মাছের নাগাল না পায় না? তখন ঠিক তোমার মতই নিজেকে খুব চালাক ভাবে! বয়ফ্রেন্ড পাবে তুমি কোত্থেকে শুনি? তোমার মতো একটা ইমম্যাচিউরড মেয়ের সাথে কেউ প্রেম করবে? তুমি কোন দিক থেকে পার্ফেক্ট হ্যাঁ?”
একটা কথাও চাঁদ আমলে নিলো না! মনোক্ষুণ্ণ না করে উল্টে বিদ্বেষি গলায় বলল,,

“আমি পার্ফেক্ট না তা আমি বেশ ভালোভাবেই জানি। আপনার বলে বলে বেড়াতে হবে না। বয়ফ্রেন্ড থাকলেই সবাই চালাক হয় না ওকে? বয়ফ্রেন্ড না থাকাটাই হলো আসল বুদ্ধিমানের কাজ! তাছাড়া আমি চাইলে-ই এই মুহূর্তে যে কাউকে বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারি! তবে বানাব না! কেন বলুন তো? কারণ আমি অন্য একটা ছেলের জন্য নিজেকে কষ্ট দিতে পারব না। আমার পরিবারকে কষ্ট দিতে পারব না। তার জন্য কেঁদে কেটে নিজের ক্ষতি করতে পারব না। পরিবার যার সাথে বিয়ে ঠিক করবে আমি ঠিক তাকেই বিয়ে করব। আপনার মতো কখনো তাদের মনোক্ষুণ্ণ করব না।”

চাঁদের কথাগুলো নূরের একটুও ভালো লাগল না! তাই সে মুখমণ্ডলে রাগী ছাপ ফুটিয়ে তুলল। জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো। চাঁদকে উপেক্ষা করে বিছানার মুখোমুখি দাঁড়ালো। কুজো হয়ে বিছানায় হাত রেখে দেখল কিছু কিছু জায়গায় এখনো বিড়ালের পশম লেগে আছে! চোয়াল শক্ত করল নূর। পিছু ফিরে রক্তিম দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এই তাহলে তোমার বেড ক্লিনিংয়ের নমুনা? এভাবে ক্লিন করতে বলেছিলাম আমি তোমাকে?”
চাঁদ মুখ ভেংচালো। বুকে দু’হাত গুজে ভাবলেশ গলায় বলল,,
“আমি যতটুকু পারি ততটুকুই করেছি। এরচেয়ে বেশি আমার দ্বারা হবে না।”

অগ্নিশর্মা হয়ে নূর চাঁদের দিকে তেড়ে এলো! চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,
“কী বললে তুমি? কাজটা তুমি করতে পারবেনা?”
পা দু’টো উপরে তুলে চাঁদ নূরের দিকে খানিক উঁকি দিয়ে দাঁড়ালো! নূরের মুখের সামনে আঙুল ঠেকিয়ে একগুয়ে গলায় বলল,,

“না পারবনা! শুনতে পেরেছেন এবার?”
নূর থমকালো! অজ্ঞাতবশত চাঁদের দীপ্তিময় মুখমণ্ডলে মোহময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! দুজন দুজনের এতোটাই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে চাঁদের নাক-মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটা তপ্ত শ্বাস নূরের মুখমণ্ডলে ঠিকরে পড়ছে! নূর যেনো ক্রমশ বেখবর হয়ে উঠছে! চাঁদের সুনয়না চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর চলতে থাকা ধুকপুক শব্দে ক্রমাগত নাজেহাল হয়ে উঠছে।

এর আগে নূর কখনো চাঁদকে এতোটা কাছ থেকে উপলব্ধি করেনি। না তারা দুজন কখনো এতোটা কাছাকাছি এসেছে। আজ না চাইতে-ই নূর চাঁদের এতোটা কাছাকাছি চলে এলো! তাই অবিলম্বেই চাঁদের দিকে নূরের নজর পড়তে বাধ্য হলো! নূরের সম্মোহন দৃষ্টি দেখে চাঁদ ভ্রু কুঁচকালো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“এমা। এর আবার কী হলো? এ আবার স্টেচু ফেস্টেচু হয়ে গেল না তো?

পা জোড়া চাঁদ নিচে নামালো। নূরের ধ্যান ভাঙানোর জন্য নূরের মুখের সামনে তুড়ি মারল! অধীর গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“এই আপনি ঠিক আছেন তো? এমন স্টেচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি কি মুভ বলব?”
নূরের ধ্যান ভাঙল! সঙ্গে সঙ্গেই সে পিছু ঘুরে দাঁড়ালো! একটু আগের করা হঠকারিতার জন্য কপাল চাপড়ালো। মনে মনে আওড়ে বলল,,

“শীট! কী করছিলাম এসব আমি? ঐ পাগল মেয়েটার দিকে ঐভাবে রাস্কেলের মতো তাকিয়েছিলাম? হ্যাংলার মতো তাকে দেখছিলাম? ছিঃ নূর শেইম অন ইউ। টোটালি হেইট মাই মাইন্ড!”
চাঁদ বাঁকা হাসল! সুযোগ বুঝে দৌঁড়ে রুম থেকে পালানোর চিন্তা করল! যেই ভাবনা সেই কাজ। চাঁদ পিছু ঘুরে পালাতেই নূর পেছন থেকে চাঁদের হাতটা সজোরে টেনে ধরল! ঘাবড়ে যাওয়া চাঁদকে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। চোয়াল শক্ত করে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমার কাজ না হওয়া অবধি কোথাও যাওয়ার রাইট নেই তোমার! আরও একবার সুযোগ দিচ্ছি আমি। বেডটা ভালো করে ক্লিন করে দাও। আমার বেডে যেনো একটাও পশম না থাকে। ফ্লোরেও যেনো পশমের কোনো চিহ্নও না থাকে। লেটস স্টার্ট দ্যা ওয়ার্ক নাও।”

চাঁদ ঠোঁট উল্টালো। ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর আরও রাগী রূপ ধারণ করল। কিছুতেই চাঁদের অসহায়ত্বকে প্রশ্রয় দিলো না। চাঁদ ভেজা বিড়ালের ন্যায় মাথা নুইয়ে নিলো। নিরুপায় হয়ে নূরের শর্ত মেনে নিলো! বিছানার চাদরটা উঠিয়ে চাদরটা ভালো করে ঝেড়ে আবারও বিছানায় বিছিয়ে দিলো।

নূরের ভয়ে ফ্লোরও ঝাড়ু দিতে বাধ্য হলো! মনে মনে পণ করে নিলো পরেরবার নূরকে সুযোগে পেলে-ই গাঁধার মতো খাটিয়ে ছাড়বে সে! তক্কে তক্কে সেই সুযোগের অপেক্ষা করবে। চাঁদের বর্তমান নাজেহাল অবস্থা দেখে নূর মনে মনে বেজায় খুশি! সোফার উপর পা তুলে বসে সে চাঁদের জেদ ভঙুর হওয়াকে বেশ আনন্দের সাথে উপভোগ করবে। ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে তুলছে। একটু একটু করে তার ইগো সেটিজফাইড হচ্ছে!

পরের দিন।
সকাল প্রায় আটটার কাছাকাছি। সূর্যের আবির মাখা রোদের ঝাঁজ সরাসরি এসে পড়ল চাঁদের মুখমণ্ডলে। থাই খোলা ছিল বিধায় সূর্যের আলো কোনো বাঁধা-বিপত্তি ছাড়া-ই চাঁদের চোখে-মুখে ঠিকরে পড়ছিল। একটু একটু করে ঘুমের রেশ কেটে আসছিল চাঁদের। পিটপিট চাহনিতে চোখ মেলছিল সে।

তবে রোদের তীব্র প্রকোপে সম্পূর্ণ চোখ মেলার জোঁ ছিল না তার। সম্পূর্ণ চোখ মেলতেই হঠাৎ তেজস্বী রোদ তার চোখ দুটো ভৎস করে দিচ্ছিল! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ চোখ বুজে নিলো। নাক-মুখ খিঁচে ডান হাতটা মুখের উপর চেপে ধরল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে অন্যপাশে কাত হয়ে শুলো। চোখ বুজেই বড়ো করে একটা হামি তুলে বিড়বিড় করে বলল,,
“জায়মা শোন? কয়টা বাজে রে?”

পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না! তব্ধতায় প্রায় অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর চাঁদ অর্ধদৃষ্টিতে পাশে তাকালো। জায়মাকে পাশে দেখতে পেল না। ধপ করে চাঁদ শোয়া থেকে ওঠে বসল। সারাঘরে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করেও কাউকে কোথাও খুঁজে পেল না। উত্তেজিত দৃষ্টিতে চাঁদ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল আটটা পনেরো মিনিট বাজছে ঘড়িতে! আর এক মুহূর্তও ব্যয় করল না চাঁদ। তাড়াহুড়ো করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,,

“ইশশ। আটটা বেগে গেল! সবাই হয়তো আমাকে ছাড়াই ব্রেকফাস্ট করে ফেলছে।”
তড়িঘড়ি করে কিছুক্ষণের মধ্যে-ই চাঁদ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। মুখটা ভালো করে না মুছেই সে ভেজাক্ত মুখমণ্ডলে ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা হলো। রুম থেকে বের হতেই প্রথমে সে সাদমানের মুখোমুখি হয়ে গেল! মাথা উঁচিয়ে চাঁদকে এক পলক দেখামাত্রই সাদমান মৃদু হাসল। মাথা চুলকে উদ্বেলিত গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“ইশশ। মেঘ না চাইতে-ই জল! তাহলে ভাগ্য এবার আমার অনুকূলেই আছে! সকাল থেকেই ভাবছিলাম তাকে একটা নজর দেখব। তাকে দেখেই দিনটা শুরু করব!”
সাদমানের মৌনতা দেখে চাঁদ ভ্রু যুগল উঁচু করল। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কী ভাবছেন সাদমান ভাই?”

চাঁদের কোনো কথাই সাদমানের কানে গেল না! নিজ থেকেই ঘোর কাটিয়ে ওঠে সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,,
“হায়।”
বিনিময়ে চাঁদ সৌজন্যের হাসি হাসল! নির্বোধ গলায় বলল,,

“হায়।”
“কেমন আছো?”
চাঁদ মুখটা চুপসে নিলো! গম্ভীর গলায় বলল,,
“ভালো নেই!”
সাদমান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল! উত্তেজিত গলায় বলল,,
“কেন? কী হয়েছে?”

“নূর! আপনার ফ্রেন্ড নূর। কাল রাতে আমাকে দিয়ে গাঁধার মতো খাঁটিয়েছে! মাজা কোমড় সব ভেঙে গেল আমার! তাই একটু অসুস্থবোধ করছি!”
“কখন হলো এসব? আমরা তো কিছু টের-ই পেলাম না।”

“টের পাবেন কোথা থেকে শুনি? আপনারা কেউ আমার খোঁজ রাখেন?”
সাদমান উৎসাহিত হয়ে উঠল! সম্মোহনী গলায় বলল,,
“তুমি কী সত্যিই চাও আমি তোমার খোঁজ রাখি?”
চাঁদ শুকনো হাসল। গলা খাদে এনে বলল,,

“আরেহ্ না ভাইয়া। আমি তো জাস্ট কথার কথা বলছিলাম। আপনার ফ্রেন্ড নূর আছে না? তাকে আমার মোটেও পছন্দ না! এক নম্বরের বদের হাড্ডি সে! সবসময় আমাকে জ্বালায় জানেন? খালাতো ভাই হয়েও কখনো আমার খোঁজ রাখে না! আর সেই জায়গা থেকে তো আপনি হলেন বহু দূরের সম্পর্কের। আপনি আমার খোঁজ কেন রাখবেন হুম?”

অমনি ড্রয়িংরুম থেকে সোহানীর উঁচু গলার স্বর ভেসে এলো দুতলায়। চাঁদ এবং সাদমানকে ডেকে সে ব্যস্ত গলায় বলল,,
“এই চাঁদ সাদমান নিচে নেমে এসো। ব্রেকফাস্ট রেডি।”
দুজনই সোহানীর দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সাদমানকে উপেক্ষা করে চাঁদ প্রথমে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। পেছন থেকে সাদমানকে মৃদু আওয়াজে ডেকে বলল,,

“ভাইয়া আসুন।”
সাদমান স্মিত হাসল। পেছনের চুলগুলো টেনে মনে মনে আওড়ে বলল,,
“ইশশ। কবে যে চাঁদ আমার চোখের ভাষা বুঝবে! পাগলীটা হয়তো বুঝতেও পারছে না তার জন্যই, তার কারণেই আমার দিন-রাত এই বাড়িতে পড়ে থাকা!”

ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সবাই উপস্থিত। শোরগোলে আচ্ছন্ন পরিবেশ। সবাই যে যার মতো করে হাসি-ঠাট্টা করছে খাবার টেবিলে। মাহিন, সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী থেকে শুরু করে বাড়ির সবাই আছে এখানে। তবে হাবিব আবরার এইমাত্র খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে একটু সাইডে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

নীড়ের শ্বশুড় বাড়ি থেকে কল এসেছে মাত্র! প্রয়োজনীয় কল হবে বিধায় উনি হৈ-হট্টগোল থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছেন! সোহানী, সাবরিনা আবরার এবং বাড়ির নতুন কাজের মহিলা সবার প্লেটে প্লেটে পরোটা এবং ওমলেট সার্ভ করে দিচ্ছে। মাহিন আসার পর থেকেই বায়না ধরেছে সকালের ব্রেকফাস্টে সে পরোটা আর ওমলেট খাবে! ছেলের আবদার ফেলতে পারেন নি সাবরিনা আবরার। তাই বিরিয়ানির আইটেম বাদ রেখে উনি পরোটা আর ওমলেট-ই করলেন সবার জন্য।

সবার মধ্যে নীড় বেশ তাড়ায় আছে অফিসে যাওয়ার জন্য। অন্যদিকে শতভাগ উদগ্রীবতাও কাজ করছে তার মধ্যে। ঐ বাড়ি থেকে কী খবর আসবে তা জানার জন্য ব্যাকুল সে। চাঁদ তাড়ায় আছে নূরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করার জন্য! এদিকে নূর চোখ তুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে না পর্যন্ত! খুব মনযোগ দিয়ে কেবল কফি খেয়ে চলছে। মাঝেমধ্যে মাহিন এবং আয়মনের কথায় ম্লান হাসছে। এরমধ্যেই হঠাৎ হাবিব আবরার হন্তদন্ত হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এলেন! নীড়কে লক্ষ্য করে তৎপর গলায় বললেন,,

“এই নীড় শোন? তোর হবু শ্বশুড় চাইছে আগামী দুদিনের মধ্যেই তোদের বিয়ের শুভ কাজটা সেরে ফেলতে। এখন তুই কী চাস?”
নীড়সহ উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হলো! তব্ধিত দৃষ্টিতে হাবিব আবরারের দিকে তাকালো। সাবরিনা আবরার উত্তেজিত হয়ে হাবিব আবরারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তিক্তময় গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“এসব তুমি কী বলছ নীড়ের বাবা? দুইদিনের মধ্যে কীভাবে সম্ভব বিয়ের কাজ সেরে ফেলা?”
“আমি কীভাবে বলব সাবরিনা? উনারা জোর করে উনাদের ইচ্ছাগুলো আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন! আমাকে কিছু বলার সুযোগ-ই দিলেন না।”
নীড় তাজ্জব ভঙ্গিতে এখনো বসে আছে। মুখ দিয়ে রা টি কাটছে না পর্যন্ত৷ নূর কফি খাওয়া ভুলে তেজী দৃষ্টিতে হাবিব আবরারের দিকে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“এখনও তো বিয়ের কার্ডও ছাপানো হয়নি বাবা। দুইদিনের মধ্যে কীভাবে সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলা? আমাদের অনেক আত্নীয়-স্বজনও এখনো ভালো করে আসেনি। কোন যুক্তিতে তারা এই প্রস্তাবটা রাখল? কমনসেন্স বলতে কিছুই কি নেই?”
নীড় এবার মৌনতা ভাঙল। খাবার টেবিল ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। খড়খড়ে গলায় বলল,,

“কীসের এতো তাড়া তাদের হ্যাঁ? কীসের এতো তাড়া? মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে! অফিস থেকে আমার এখনো ছুটিও নেওয়া হয়নি। সবাই জানে আরও এক সপ্তাহ পর আমার বিয়ে!”
মাহিনও টেবিল ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। হাবিব আবরারকে লক্ষ্য করে শান্ত গলায় বলল,,

“আমার মনে হয় বাবা তাদের সাথে বসে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ। এভাবে তো হুটহাট করে বিয়ের ডেইট পাল্টানো যায় না। সবকিছুরই তো একটা ভালো খারাপ দিক আছে।”
হাবিব আবরার ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। তটস্থ গলায় বললেন,,
“তারা তো আমার কোনো কথাই শুনছে না মাহিন। বলছে তাদের ছেলে নাকি দুইদিন পর কানাডায় চলে যাবে। এটলিস্ট বোনের বিয়েটা দেখে যেতে চায়।”

সেলিনা চৌধুরী এবার হাবিব আবরারের মুখের কথা টেনে নিলেন। নমনীয় গলায় হাবিব আবরারকে বুঝিয়ে বললেন,,
“দেখেন ভাই। তাদের সমস্যা আছে বিধায়-ই তারা বাধ্য হয়ে বিয়ের ডেইটটা সামনে এনেছেন! আমার মনে হয় এই বিষয়টা একটু ভেবে দেখা উচিৎ আপনাদের। সুবিধা-অসুবিধা তো সবার-ই থাকতে পারে তাই না? তেমনি কম্প্রোমাইজ করার ক্ষমতাও সবার মধ্যে থাকতে হবে।”

সোহানী মনে মনে হাসল! নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল,,
“এসব কিছু-ই না আন্টি! আসল কারণ তো হলো খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই মেয়েকে নীড় ভাইয়া ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া!”
চাঁদ গলা ঝাড়লো। জায়মার কানে ফিসফিস করে বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৩

“আমি বলেছিলাম না? ভাবির মধ্যে কোনো একটা ঘাপলা আছে? দেখলি তো কীভাবে মিলে গেল? নিশ্চয়ই বিয়ের ডেইট এগিয়ে দেওয়ার পেছনে গভীর কোনো কারণ আছে! যা আমি বা আমরা আঁচ করতে পারছি।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৫