প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৫

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৫
নিশাত জাহান নিশি

“আমি বলেছিলাম না? ভাবির মধ্যে কোনো একটা ঘাপলা আছে? দেখলি তো কীভাবে মিলে গেল? নিশ্চয়ই বিয়ের ডেইট এগিয়ে দেওয়ার পেছনে গভীর কোনো কারণ আছে! যা আমি বা আমরা আঁচ করতে পারছি।”
জায়মা ভাবুক হয়ে উঠল। চিন্তিত হয়ে চাঁদের কানে মিনমিনিয়ে বলল,,

“কারণটা এক্সয়েক্টলি কী হতে পারে চাঁদ? ভাবির কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”
“উউউম শিওর না! তবে থাকতেও পারে।”
“হ্যাঁ। হাব-ভাব দেখে-ই বুঝা গেছে। আর এখনকার যুগে এটা কমন!”
“কেন রে? তোরও কি বয়ফ্রেন্ড আছে? তলে তলে সিএনজি চালাচ্ছিস?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ধ্যাত। কী যে বলিস না এসব! আমার যদি বয়ফ্রেন্ড থাকত না তবে সবার আগে তুই-ই জানতিস। আমি তো জাস্ট প্রেজেন্ট সিচুয়েশনটা তোকে বললাম। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সবারই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড থাকে!”
“আমার কেন বয়ফ্রেন্ড নাই রে জাম্বু? তোর কি মনে হয় না আমার একটা বয়ফ্রেন্ড প্রয়োজন?”
“থাপ্পড় খাবি? চুপ করে বসে থাক। কখনো এসব রিলেশানে যাওয়ার কথা ভাববিও না।”

চাঁদ অট্ট হাসল! ঠাট্টসূচক গলায় বলল,,
“আরে গাঁধি আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম। আমার এতো শখ নেই কারো সাথে সম্পর্কে যাওয়ার।”
এরমধ্যেই হাবিব আবরার গলা ঝাঁকালেন। উদ্বিগ্নমনা হয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। গড়গড় করে এক গ্লাস পানি খেলেন। সবার দিকে একবার শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সবদিক ভেবে চিন্তে স্থির গলায় বললেন,,

“দেখো। সেলিনা ভাবি ঠিক-ই বলেছেন! সবার-ই সুবিধা-অসুবিধা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের সবার-ই উচিৎ কম্প্রোইজ করা। অনুর ভাই-ই তো হলো একজন। তারও তো শখ থাকতে পারে বড়ো বোনের বিয়ে দেখে যাওয়ার? আমরা যদি বিয়ের এলাহি আয়োজনটা এখন না করে কিছুমাস পরে করি তবে এখানে সবার-ই সুবিধা হবে!

এখন কোনোরকম বিয়েটা হয়ে যাক। অনুর ভাই যখন ছয়-সাত মাস পরে আবারও দেশে ফিরে আসবে তখন না হয় বড়ো করে বিয়ের আয়োজন করা হবে! তখন আমাদের বাজেটও বাড়বে। ধুমধাম করে আবারও তাদের বিয়ে হবে।”
সবাই বিষয়টা মনযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। নীড় নিজেও বিষয়টা নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবল। একে-অপরের সাথে পরামর্শ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই হাবিব আবরারের সিদ্ধান্তে একমত হলো! সাবরিনা আবরার মৃদু হেসে হাবিব আবরারের পাশে দাঁড়ালেন। হাবিব আবরারের কাঁধে হাত রেখে সহমত পোষণ করে বললেন,,

“তুমি ঠিক-ই বলেছ নীড়ের বাবা! আপাতত বিয়েটা ঘরোয়াভাবেই হয়ে যাক। আত্মীয়-স্বজনদের এখন দাওয়াত না করাই ভালো। পরবর্তীতে আবার যখন বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হবে তখন না হয় সব আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে একসাথে আবারও বিয়েটা হবে!”

হাবিব আবরার তৎপর দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালেন। অস্থির গলায় বললেন,,
“সামিয়া? সায়মা? ওরা আসবেনা?”
সাবরিনা আবরার বিমূর্ষ ভঙ্গিতে মাথাটা নুইয়ে নিলেন! এর উত্তর ঠিক উনার জানা নেই! পাশ থেকে সোহানী কথা টেনে নিলো। শুষ্ক হেসে হাবিব আবরারকে অভয় দিয়ে বলল,,

“আসবে আঙ্কেল। আম্মু এবং খালামনিকে আমি আগামীকালের মধ্যেই আসতে বলে দিব! সাথে আব্বু আর ছোটো আঙ্কেল তো আছেই। আপনি এই বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব।”
হাবিব আবরার স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন। ম্লান হেসে সোহানীর দিকে তাকালেন। ধীর গলায় বললেন,,

“এতো বছরের জমতে থাকা রাগ-অভিমান ভুলে যেনো তারা আমার ছেলের বিয়েতে আসে। এই প্রত্যাশা তাদের থেকে।”
সেলিনা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন! মাথা নুইয়ে অপরাধী গলায় বললেন,,
“আসলে এসবের জন্য আমি-ই দায়ী! আজ আমার জন্যই আপনাদের মধ্যে এতো দ্বন্ধ, এতো কলহ, এতো দূরত্ব, এতো মান-অভিমান। কেন যে আমি সেদিন সিদ্ধান্তটা নিতে গেলাম!”

মাহিন বিমূর্ষ হয়ে মাথা নুইয়ে নিলো! বিমূঢ় গলায় সেলিনা চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বলল,,
“থাক না আন্টি! এসব কথা এখন থাক প্লিজ। এই মুহূর্তে আমি এসব মনে করতে চাইনা। দিনটা খারাপ করতে চাইনা!”
মাহিনের ভেতরের কষ্টটা বুঝতে পারলেন সাবরিনা আবরার! নাক টেনে কেঁদে উনি মাহিনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মাহিনের মাথায় দীর্ঘ এক চুমু খেয়ে কান্নাজড়িত গলায় বললেন,,

“ঠিক আছে বাবা। এসব আর মনে করতে হবেনা তোর। আমরা আর কখনো তোর সামনে এই প্রসঙ্গে কোনো কথা তুলব না! আমরা এখন নীড়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলব কেমন? তুই আর মন খারাপ করিস না।”
এরমধ্যেই নীড় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে তার সেলফোনটি বের করল। অধীর গলায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
“তাহলে আমি এখন বসকে কল করে সবটা জানিয়ে দিচ্ছি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছি। যদিও এখন এক সপ্তাহের বেশি ছুটি নিতে পারবনা!”

হাবিব আবরার সহমত পোষণ করলেন। জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। ব্যগ্র গলায় বললেন,,
“আচ্ছা নে। সাতদিন-ই বা কম কীসে? আমি বরং বিয়ের শপিং করার জন্য মেয়েদের শপিংমলে পাঠিয়ে দিই। আর ছেলেদের ডেকোরেটিংয়ের কাজে লাগিয়ে দিই। সময় হাতে নেই একদম। যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে।”

যেই ভাবা সেই কাজ। অফিসের বসকে কল দিয়ে নীড় সাতদিনের জায়গায় দশদিনের ছুটি নিলো! সকালের নাশতাটা কোনো রকমে সেরে বাড়ির মেয়েরা শপিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। তবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে তারা অনুর পছন্দ অপছন্দ সব জেনেই শপিংয়ে বের হলো।

সবার পছন্দ তো সমান নাও হতে পারে। তাই আগে থেকেই সবকিছু জেনে যাওয়া ভালো। তাদের সাথে মুরুব্বি হিসেবে সেলিনা চৌধুরী এবং আফতাব চৌধুরী আছেন। যদিও মেয়েরা কেউ শপিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না! কারণ তারা এই বিয়েটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা! খারাপ কিছুর ইঙ্গিত করছে সবাই। যা কাউকে তারা মুখ ফুটে ব্যক্ত করতে পারছেনা। বিশেষ করে সোহানী। ভেতরে ভেতরে সে কিছু প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় গুমরে মরছে!

বাড়ির ছেলে ফেলেরা বাড়ির ডেকোরেশনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল! হলুদের অনুষ্ঠান আগামীকাল-ই ডিসাইড করা হলো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তারা বাড়ির ড্রয়িংরুমটা অনুষ্ঠানের উপযোগী করে তুলছিল। কল করে নূর একজন ভালো ডেকোরেটর ম্যানেজার নিয়ে এলো। যার ডেকোরেটিংয়ে হলুদের মহল সাজানো হবে।

বাড়ির ছেলেরা সবদিক থেকে ডেকোরেটিং ম্যানেজারকে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরার হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেন। কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করবেন তার একটি নির্দিষ্ট হিসাব মেলাতে চাইছেন। তাদের হিসাবগুলো ঠিক জায়গায় বরাদ্দ হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য পাশে নীড়ও রয়েছে।

বাড়িতে কাজের হৈ-হট্টগোল লেগে গেছে। কোন কাজটা ছেড়ে কোন কাজটা আগে করবে সে নিয়ে সবার মধ্যে তুমুল ব্যস্ততার ঝড়। এই মুহূর্তে দম ফালানোরও জোঁ নেই কারোর। কীভাবে অনুষ্ঠানটাকে সুন্দরভাবে প্রেজন্ট করা যাবে সে নিয়েই অস্থির সবাই।

আজ নীড়ের হলুদ সন্ধ্যা! হলুদ শেরওয়ানিতে নীড়কে রূপকথার রাজকুমারদের মতো কম সুন্দর দেখাচ্ছে না! আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নীড় আজ নিজেকে দেখছে। ব্যস্ততা কাটিয়ে প্রায় অনেকমাস পর নিজেকে এতো নিঁখুতভাবে দেখা তার। উৎফুল্ল হাসিতে তার ঠোঁটের কোণ ছেঁয়ে আছে। অনুকে সে মন-প্রাণ থেকে বিয়ে করতে চাইছে।

নীড়ের পাশেই হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে তার ভাই-রা দাঁড়িয়ে আছে। সবার ঠোঁটের কোণেই খুশির হাসি। নীড়কে খুশি দেখে তারা নিজেরাও বেশ খুশি। হলুদ পাঞ্জাবিতে নূর, মাহিন, আয়মন, সাদমান এবং সাব্বিরকেও নীড়ের চেয়ে কম সুন্দর দেখাচ্ছে না! তবে ছেলেরা সবাই হলুদ পাঞ্জাবি পড়লেও মাহিন পড়েছে বাসন্তী কালার পাঞ্জাবি! তার প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো নূরের সাথে নিজেকে গুলিয়ে না ফেলা! সবাই যেনো তাদের দুই ভাইকে সহজেই চিনতে পারে সেজন্যই এই ট্রিক কাজে লাগানো।

হলুদের স্টেজ এখন রেডি প্রায়। ড্রয়িংরুম জুড়ে রকমারি মরিচা বাতির সমাহার। সিঁড়ির প্রতিটি সাইড ঘেঁষে তাজা গোলাপ এবং লাল, নীল রঙের মরিচা বাতি জ্বলছে। হাজার হাজার সুগন্ধি ফুলের সমারোহে ম ম করছে হলুদের স্টেজ। এতো কম সময়ের মধ্যে যে পুরো ড্রয়িংরুমটা এতো জাঁকজমকভাবে সাজানো হবে তা ভাবতে পারেনি বাড়ির কেউ!

ডেকোরেটর ম্যানেজার যথেষ্ট অভিজ্ঞশীল ব্যক্তি ছিলেন বলেই সব সম্ভব হয়েছে! এর জন্য বাড়ির সবাই উনার কাছে কৃতজ্ঞ।

বাড়ির সব মেয়েরা ব্যস্ত ভারী মেকাপে! বিশেষ করে চাঁদ! সোহানীর আনা সমস্ত মেকাপ চাঁদ নিজের মুখেই ঘঁষে মেজে এপ্লাই করছে! সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে মেকাপ করছে। জায়মা, নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি তার দিকে নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাঁদের কাণ্ডকীর্তি তাদের মাথায় ঢুকছে না। এইদিকে তারা হালকা সাজে তঅনেক আগে থেকেই রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তারা এখন ব্যাকুল হয়ে চাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের তিনজনের ড্যাব ড্যাব চাহনি দেখে চাঁদ মুখে ফাউন্ডেশন মেখে তাদের ব্যঙ্গ করে বলল,,

“দেখবি আজ স্টেজে সবার দৃষ্টি শুধু আমার দিকেই থাকবে! সবাই বলবে ওমা এতো দেখছি বিশ্বের সেরা সুন্দুরী এসে হাজির! তোরা তো একটাও নিঁখুতভাবে সাজতে পারিস না। কীসব মাথা মুন্ডু সাজিস! আমাকে দেখ? আমি কীভাবে সাজছি। বিয়ের অনুষ্ঠানে এভাবে সাজতে হয় বুঝলি? ভারী মেকাপ করে।”

জায়মা খিলখিল করে হেসে দিলো। হলুদ শাড়ির কুঁচি ধরে বিদ্রুপাত্নক গলায় বলল,,
“হ্যাঁ সাজ। ভালো করে সাজতে থাক। পরে না আবার তোর মুখের অবস্থা কিরিম আপার মতো হয়ে যায় দেখিস!”
“বুঝি তো তোদের হিংসে হয়! আমি একটু সুন্দর করে সাজলেই তোদের হিংসে হয়। যা যা নিচে যা। তোদের জন্য আমার মেকাপ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আধা ঘণ্টা পরে আমি নিচে আসছি। তখন সবাই তাক লেগে থাকবি। আর আমাকে দেখে দেখে আফসোস করবি!”

জায়মা মুখ চেপে হাসল। ভাবলেস গলায় বলল,,
“ওকে। দেখা যাবে কে বা কারা তখন আফসোস করে! যাই হোক আমরা যাচ্ছি। তুইও চলে আয়, সাজ হলে।”
নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহিকে সাথে নিয়ে জায়মা রুম থেকে প্রস্থান নিলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে চাঁদ তাদের লক্ষ্য করছিল। ভেংচি কেটে তাদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বলল,,

“আইছে আমারে কিরিম আপা কইতে! আমি যে ইউটিউব ঘেঁটে বড়ো বড়ো মেকাপ আর্টিস্টদের টিউটোরিয়াল দেখে এতো হাইলি মেকাপ করা শিখেছি এটা তো ওরা জানে না! জানলে আর ওসব বলত না। যাই হোক বাবা, আমি এখন মন দিয়ে সাজি। জীবনে প্রথমবার নিজে নিজে সাজার একটু সুযোগ পেলাম! প্রতিবার তো সোহানী আপু-ই কোনোরকম মেকাপ ছাড়া আমাকে সাজিয়ে দেয়। তখন আমাকে দেখতে একটুও ভালো লাগে না! গ্রামের চাচাতো, খালাতো, মামাতো বোনদের মতো লাগে!”

ইতোমধ্যেই হাতে করে পাঁচ কার্টুন মিষ্টি নিয়ে নূর হম্বিতম্বি হয়ে চাঁদের রুমে প্রবেশ করল। চাঁদ মুখে মেকাপ করতে এতোটাই ব্যস্ত যে এদিক-ওদিক তাকানোর সময়টা পর্যন্ত পেল না! গভীর মনযোগ দিয়ে সে তার কাজ করছে। এই সময়ে যেনো এদিক-বেদিক তাকানো তার মানা!

এইদিকে নূর মিষ্টির কার্টুনগুলো বেডের উপর রেখে বেশ হাঁপিয়ে উঠল। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছল। সামনের অগোছালো চুলগুলো হালকা টেনে ধরল। ক্লান্তভরা শ্বাস ছেড়ে সে সামনে তাকাতেই হঠাৎ আঁতকে উঠল! জায়গা থেকে দু’কদম পিছিয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে আয়নায় চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। হঠকারিতায় মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“এই? এসব কী সেজেছ তুমি?”
ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদের হাত থেকে মেকাপের ফোমটা নিচে পড়ে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদ পিছু ফিরে তাকালো। নূরকে দেখামাত্রই তার গা-পিত্তি জ্বলে গেল! চাঁদকে সরাসরি দেখামাত্রই নূরের চক্ষুজোড়া চড়কগাছে পরিণত হলো! মুখ হাত রেখে সে অস্পষ্ট গলায় বলল,,

“ভূভূভূতত!”
চাঁদ এবার শঙ্কিত হয়ে উঠল! ধপ করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুঁচি টেনে ধরে দৌঁড়ে নূরের পিছনে এসে দাঁড়ালো! নিজেকে নূরের পিছনে আড়াল করে নূরের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল! ভয়াল গলায় বলল,,
“কোকোকোথায় ভূত?”

নূর তাজ্জব বনে গেল! পিছু ঘুরে অবুঝ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তুমি ভূত না?”
চাঁদ এবার বুঝতে পারল নূর কাকে ভূত বলতে চেয়েছে! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত করে নূরের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“কী বললেন আপনি? আমি ভূত?”
নূর তেজী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ক্ষিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“ভূত নয়তো কী? মুখে এসব কী মেখেছ হ্যাঁ? আটা ময়দা সুজি! এসবের কারণেই তো তোমার আসল মুখটা বুঝা যাচ্ছে না।”

নূরের পাঞ্জাবিটা আরও শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল চাঁদ! নূরের প্রতি জমা সমস্ত ক্ষোভ সে নূরের পাঞ্জাবির উপর ঝাড়ল। রাগে ফোঁস ফোঁস করে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“মেকাপ সম্পর্কে কী বুঝেন আপনি হ্যাঁ? এসব আটা ময়দা সুজি? আটার দাম জানেন আপনি কত? এই যে মুখে এই মেকাপগুলো মেখেছি না? এই মেকাপগুলোর দাম শুনলে তো আপনার মাথা-ই ঘুরে যাবে! চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে। ২০ কেজি আটা ময়দা কেনা যাবে এই মেকাপ দিয়ে বুঝতে পেরেছেন?”

পাঞ্জাবি থেকে চাঁদের হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিলো নূর। চোখ লাল করে কর্কশ গলায় বলল,,
“এতো কিছু শুনতে চাইনা আমি ওকে? মুখটা এক্ষণি ভালো করে ধুঁয়ে এসো! আজিব চিড়িয়া লাগছে তোমাকে! এই মেকাপ নিয়ে একদম নিচে যাওয়া যাবেনা। নিচে নীড় ভাইয়ার অনেক ফ্রেন্ড সার্কেল এবং কলিগরা আছে। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে তাদের সামনে আমাদের পরিবারের ফেইস লস হবে।”

“আরে ধূর! কখন থেকে কী যা তা বলছেন? আমি তো মেকাপটা এখনো ভালোভাবে মুখে ব্লেন্ড-ই করিনি। তাই এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। যখন মেকাপটা খুব ভালোভাবে মুখে মিশে যাবে না? তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নূরকে উপেক্ষা করে চাঁদ আবারও ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল। ফোমটা হাতে তুলে নিয়ে আয়না দেখে মুখটা ভালোভাবে ব্লেন্ড করতে লাগল। নূর রূদ্রাক্ষের দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“যদি তোমার কারণে আমার পরিবারের ফেইস লস হয়না? তো আই টোল্ড ইউ চাঁদ তখন কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়বনা আমি। জাস্ট মাইন্ড ইট ওকে?”
“এত রাগ দেখাবেন না তো! সবসময় শুধু রাগ আর রাগ। কিছুক্ষণ পর যখন আমাকে দেখবেন না? তখন তাক লেগে যাবেন! মনে মনে বলবেন, আরেহ্ বাহ্ এ আবার কে? এ কী সত্যিই আমাদের চাঁদ না-কি? আকাশের চাঁদ আবার জমিনে খঁসে পড়ল না তো?”

নূর ফিক করে হেসে দিলো। শ্লেষাত্মক গলায় বলল,,
“নিজের ঢোল নিজে একটু কম পেটাও বুঝছ? আসছে নিজেকে আকাশের চাঁদের সাথে তুলনা করতে! তোমাকে না তখন? বটগাছে ভর করা পেত্নীদের মতো লাগবে! আ’ম ডেম শিওর!”
হাসতে হাসতে নূর রুম থেকে প্রস্থান নিতেই চাঁদ পেছন থেকে নূরকে ডাকল। চোখের উপর আই শেডো লাগাতে লাগতে ব্যস্ত গলায় বলল,,

“আজ আপনি যাই বলুন না কেন আমি কোনো রিয়েক্ট করবনা! এই খুশির দিনে চিরশত্রুদের সাথেও মুখ লাগাতে নেই! তবে আজ একটা সত্যি কথা বলতে চাই। হলুদ পাঞ্জাবিটায় না? আপনাকে সত্যিই দারুন মানিয়েছে! মুগ্ধ হওয়ার মতো সুন্দর লাগছে!”

নূর থমকালো! পিছু ঘুরে চাঁদের দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চাঁদ ব্যস্ত চোখের উপরে আই শেডো লাগানোর পর চোখের নিচে হালকা করে কাজল পড়তে। আনমনেই নূর বুকের উপর দু’হাত গুজে ম্লান হাসল। চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে আবিষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল! আচম্বিতেই চাঁদ পিছু ঘুরে স্মিত হেসে নূরের দিকে তাকালো। মাথাটা ডান পাশে ঈষৎ বাঁকিয়ে বার বার চোখের পলক ফেলে নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কাজলটা কি ঠিক হয়েছে?”
বুকের পাঁজর থেকে হাত গুটিয়ে নিলো নূর। চাঁদের থেকেও অবিলম্বে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাথা চুলকে পেছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। গলা খাদে এনে বলল,,

“আই থিংক কাজলটা আরও একটু গাঢ় হবে!”
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না নূর! তড়িৎ বেগে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ ঠোঁট উল্টালো। নির্বোধ গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৪

“আরও গাঢ় করে পড়তে হবে? কিন্তু আমি তো গাঢ় করে কাজল পড়তে পারিনা! তবে কি আজ গুমরা মুখোটার কথা রাখা হবেনা আমার?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৬