প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৬

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৬
নিশাত জাহান নিশি

“আরও গাঢ় করে পড়তে হবে? কিন্তু আমি তো গাঢ় করে কাজল পড়তে পারিনা! তবে কি আজ গোমড়া মুখোটার কথা রাখা হবেনা আমার?”

দোটানায় জর্জরিত চাঁদ! দারুন হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন। বহু জল্পনা-কল্পনার সমাপ্তি টেনে চাঁদ আয়নার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নির্বিঘ্নে কাজলটা হাতে তুলে নিলো। নিজের উপর শতভাগ আত্নবিশ্বাস রেখে খুব সতর্কতার সহিত চোখের কার্ণিশ ঘেঁষে দেওয়া কাজলটা আরও গাঢ় করতে লাগল! মনে মনে আওড়ে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“নূর ভাইয়া যেহেতু বলেছে কাজলটা আরও গাঢ় করতে হবে, তার মানে গাঢ়-ই করতে হবে! সচারচর ছেলেরা তো মেয়েদের সাজ-গোজের বিষয়ে তেমন বুঝে না। সেই কুঁড়ে অভিজ্ঞতা থেকেই যেহেতু বলেছে কাজলটা আরও গাঢ় করতে তার মানে কাজলটা আরও গাঢ় করলেই আমাকে ভালো লাগবে!”

সেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে চাঁদ কাজলটা খুবই গাঢ় এবং নিঁখুতভাবে চোখে লাগাল! কাজ শেষ হতেই আয়নার দিকে তাকিয়ে ব্যাপক চমকে ওঠে মুখটা হা করল! অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,
“ওহ্ মাই গড! আমি এতো সুন্দর করে কাজলও পড়তে পারি?”

সম্বিত ফিরে পেতেই চাঁদ মৃদু হেসে মুখটা হাত দিয়ে লজ্জায় ঢেকে নিলো! আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে মিনমিনে গলায় বলল,,
“ইশশশ! আজ তো আমি ছেলেদের পটিয়ে-ই ছাড়ব! একটু পর তো নীড় ভাইয়ার শ্বশুড় বাড়িও যেতে হবে। তখন তো ছেলেদের লাইন পড়ে যাবে এই অপ্সরি চাঁদের পিছনে! মাতাল নূর তো বলেছিল আমি নাকি পার্ফেক্ট নই৷ কোনো ছেলে-ই নাকি আমাকে পছন্দ করবে না! আজ তার প্রমাণ আমি দেখিয়ে-ই ছাড়ব! আর সেই দৃশ্য নূর চোখের সামনে সব দেখবে আর নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানাবে!”

প্রচণ্ড জেদের বশবর্তী হয়ে চাঁদ মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। ভাবলেশ ভঙ্গিতে চোখের পাপড়িতে আইলেস পড়ে ঠোঁটে টকটকে লাল-খয়েরি রঙের লিপস্টিক পড়ল। ঘন কালো রেশমি চুলগুলো সাইড সিঁথি করে দু’পাশে ছেড়ে দিলো। কপালের মাঝ বরাবর বড়ো এক লাল টিপ পড়ল। ব্লাইজের লাল রঙের সাথে মেচিং করেই লাল টিপটা পড়া!

দু’হাতেই ডজন ডজন হলুদ এবং লাল রঙের মিশ্রণে রেশমি চুড়ি পড়ল। বাঁ হাতের মধ্যমা আঙুলে হলুদ পাথরের একটি মাঝারি আংটি এবং তর্জনী আঙুলে লাল রঙের একটি বড়ো আংটি! আয়নায় শেষবারের মতো নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চাঁদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।

পিছু ঘুরে শাড়ির আঁচলটা ভালোভাবে বাঁ হাতে টেনে ধরল। আঁচলের সম্পূর্ণ অংশটা বাঁ হাতে ছেড়ে চাঁদ আনমনা হয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হলো। অমনি খেলো সাদমানের সাথে এক জোরচে ধাক্কা!

সাদমান মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে চাঁদের মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে! অবিলম্বেই হাত থেকে তার গিফটের বড়ো প্যাকেটটি মাটিতে খসে পড়ল! সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ অস্থির হয়ে মুখে হাত দিয়ে পড়ে যাওয়া গিফটের প্যাকেটটির দিকে তাকালো। অধীর গলায় বলল,,

“হায় আল্লাহ্! গিফটটা তো পড়ে গেল সাদমান ভাই।”
দিন-দুনিয়া ভুলে সাদমান পলকহীন দৃষ্টিতে কেবল চাঁদকেই দেখছে! আশেপাশে কী ঘটছে না ঘটছে কিছুর-ই খেয়াল নেই তার। এই মুহূর্তে যেনো তার জান যাই যাই করছে! চাঁদ ব্যস্ত গিফটের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করতে!

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও সাদমানের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখে চাঁদ শাড়ির কুঁচি সামলে তড়িঘড়ি করে খানিক কুজো হয়ে নিচে উঁকি দিলো। গিফটটের প্যাকেটটা হাতে তুলে সটান হয়ে আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল। প্যাকেটটা সাদমানের দিকে এগিয়ে ইতস্তত গলায় বলল,,

“ভাইয়া ধরুন গিফটটা।”
সাদমানের ধ্যান ভাঙল! মাথা ঝাঁকিয়ে সে চাঁদের থেকে বেখেয়ালি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। চাঁদ যেনো তার দৃষ্টির পরিমাপ বুঝতে না পারে সেজন্য তড়িঘড়ি করে গিফটের প্যাকেটটার দিকে তাকালো। চাঁদ জোরপূর্বক হাসল। নিচু গলায় বলল,,
“সরি ভাইয়া। আমি আসলে খেয়াল করিনি৷ আমিও রুম থেকে বের হচ্ছিলাম আর আপনিও সামনে চলে এলেন! তাই বাই মিস্টেকে ঘটনাটা ঘটে গেছে।”

সাদমান তাড়াহুড়ো করে চাঁদের হাত থেকে গিফটের প্যাকেটটা হাত বাড়িয়ে নিলো। মাথা নুঁইয়ে ছোটো আওয়াজে বলল,,
“ইট’স ওকে।”
সাদমান প্রস্থান নিলো! চাঁদের সামনে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে হয়তো এক্ষণি তার হার্ট ফেল হবে! চাঁদ নির্বোধ দৃষ্টিতে সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কপাল কুঁচকে বলল,,

“সাদমান ভাইয়ার আবার কী হলো?”
দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাঁদ তার গন্তব্যপথে তাকালো। সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নামতেই সে লজ্জার মুখে পড়ে গেল! কারণ ড্রয়িংরুম জুড়ে কেবলই নীড়ের ফ্রেন্ডসার্কেল এবং কলিগদের আস্তানা! সবাই আড়চোখে চাঁদকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে! কানে ফুসুর ফুসুর করে কী সব যেন বলছে! চাঁদ অস্থির দৃষ্টিতে জায়মা, সাদিয়া, নাদিয়া এবং রুহিকে খুঁজে চলছে।

এই মুহূর্তে তাদের খুঁজে পেলে হয়তো তার লজ্জাবোধটা একটু কাটবে। ইতোমধ্যেই হঠাৎ চাঁদের নজর পড়ল ড্রয়িংরুমের বাঁ পাশে। তৎক্ষনাৎ চাঁদের চক্ষুজোড়া আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠল! কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই চাঁদ শাড়ি সামলে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল ড্রয়িংরুমের বাঁ পাশে। সবার মাঝখান থেকে সে খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে সামিয়া আহমেদকে জড়িয়ে ধরল! উৎফুল্লিত গলায় বলল,,

“কেমন আছো মা?”
সামিয়া আহমেদ মৃদু হাসলেন। চাঁদকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললেন,,
“ভালো আছি মা। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো আছি মা। কখন এলে তুমি হ্যাঁ? আমার সাথে আগে কেন দেখা করলে না?”

“জায়মা বলছিল তুই নাকি রেডি হচ্ছিস? তাই তোকে ডিস্টার্ব করিনি মা।”
সামিয়া আহমেদের বুক থেকে চাঁদ মাথা তুলল। আহ্লাদি গলায় বলল,,
“বাবা আসেনি মা?”

মমতায় সিক্ত হয়ে সামিয়া আহমেদ চাঁদের মাথায় পর পর দুটো চুমু খেলেন। জবাবে বললেন,,
“এসেছে তো। তোর বাবা, ছোটো আঙ্কেল, তোর মামা সবাই এসেছে।”
“কোথায় ওরা?”
“তোর বড়ো আঙ্কেলের সাথে বাইরে বসে কথা বলছে।”
“আমি যাই ওদের কাছে?”

“আগে তো একটু নজর টিকা পড়িয়ে দিই আমার মেয়েটাকে! কী সুন্দরটাই না লাগছে আমার চাঁদ মা কে!”
চাঁদ লজ্জায় রঙিন হয়ে উঠল। মাথা নুঁইয়ে কানের পেছনে চুলগুলো গুজে বলল,,
“সত্যি বলছ মা?”
“মায়েরা কখনো মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে মিথ্যে বলতে পারে?”

চোখে থেকে আঙুলে কাজল তুলে সামিয়া আহমেদ চাঁদের কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন! নজর কাটাতে বললেন,,
“কারো নজন যেনো না পড়ে আমার মেয়ের উপর।”

মৃদু হেসে চাঁদ এক এক করে তার ছোটো খালামনি এবং মামানীকে জড়িয়ে ধরে তাদের সাথে কৌশল বিনিময় করল। বাড়ির সবাইকে কাছে পেয়ে চাঁদ যেনো খুশিতে আত্মহারা! সাবরিনা আবরার তার ছোটো বোনদের কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন। ক্ষণে ক্ষণে মিনমিনিয়ে কাঁদতে লাগলেন!

বারবার তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন! অতীতের সব ভুলে আবারও সবাই এক হয়ে গেলেন। তবে সেলিনা চৌধুরী তাদের সবার থেকে দূরে দূরে থাকছেন! এক অদৃশ্য অভিমানেই উনি কারো সাথে মিশতে চাইছেন না!

সবার মাঝখান থেকে জায়মা চাঁদকে ড্রয়িংরুমের এক কোণায় টেনে নিয়ে এলো। ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে চাঁদের বিস্তীর্ণ মুখমণ্ডলে তাকালো। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,
“তুই কী সত্যিই নিজে নিজে সেজেছিস চাঁদ?”
চাঁদ বেশ ভাব নিলো! চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো পিঠের দিকে ছুড়ে মারল। বাঁ হাতের তর্জনী আঙুল দ্বারা নাক ঘঁষে বলল,,

“উহ্হ্হ্ তোকে কেন বলব?”
জায়মাকে উপেক্ষা করে চাঁদ বাইরে তার বাবা এবং মামার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো! জায়মার পিছু ডাক সে একদণ্ডের জন্যেও কানে তুলল না। দ্রুত পায়ে হেঁটে নীড়ের গেস্টদের পাশ কাটিয়ে সে সদর দরজার কাছে পৌঁছাতেই হঠাৎ নূরের মুখোমুখি হয়ে গেল! ইয়া বড়ো এক স্পিকার হাতে নিয়ে নূর হলুদের স্টেজের উদ্দেশ্যে হেঁটে আসছিল। এরমধ্যেই আকস্মিক চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল!

কাজের অস্থিরতা ভুলে নূর মোহময় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! কাজল কালো সুনিপুণ দু’চোখের দিকে তাকিয়ে যেনো সে হারিয়ে ফেলা নিজেকে বারবার খুঁজে পাচ্ছিল! বুকের বাঁ পাশে প্রতিধ্বনিত হওয়া ঢিপঢিপ শব্দটা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল! ইদানিং চাঁদকে দেখলেই নূরের বুকের ভেতর কিছু অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়।

সেই ব্যাকুল করা অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় না দিলে কেমন যেনো তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দম বন্ধকর এক গুমুটে অনুভূতি লাগে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বেপরোয়া অনুভূতিগুলোকে তার প্রশ্রয় দেওয়া!
নূরের উদাসীন চাহনি দেখে চাঁদ বাঁকা হাসল! গলা খাঁকিয়ে নূরকে লক্ষ্য করে বলল,,

“কী যেনো বলেছিলেন ঐ সময়? আমাকে আজব চিড়িয়া দেখাবে তাই তো? আমার জন্য নীড়ের ভাইয়ার গেস্টদের সামনে আপনাদের ফেইস লস হবে?”
তড়িৎ বেগে নূর চাঁদের তৃষ্ণার্ত মুখশ্রী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো! এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল। ফুসফুসে দম সঞ্চার করে ধীর গলায় বলল,,

“সামনে থেকে সরো। তোমার সাথে আজাইরা প্যাচাল পারার সময় নেই আমার!”
নূরের একটি কথাও চাঁদ আমলে নিলো না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে উল্টে ঝগড়ুটে গলায় বলল,,

“এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী দেখছেন হ্যাঁ? আমার দিকে তাকান। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন৷ দেখুন, আজ আমাকে কতোটা সুন্দর লাগছে! ছেলেরা কীভাবে আজ চাঁদের পেছনে ঘুরে জাস্ট দেখতে থাকুন।”
দৃষ্টি ঘুরিয়ে নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। আচমকা মুখটা উল্টে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,,

“ওয়াক! কেমন যেনো বমি বমি ভাব হচ্ছে! তোমাকে দেখার পর থেকেই শরীরটা আরও বেশি করে গোলাচ্ছে!”
চাঁদ আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠল! কোমড়ে হাত গুজে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,
“কী বললেন আপনি? আমাকে দেখে আপনার বমি বমি ভাব হচ্ছে? না-কি সকালে কিছু উল্টো পাল্টা খেয়েছেন বলে শরীর গোলাচ্ছে?”

নূর আবারও বমি করার ভাব করে বলল,,
“আরেহ্ না! তোমাকে দেখার পর থেকেই গাঁ-টা কেমন যেনো গোলাচ্ছে!”
“ধূর আপনার সাথে কথা বাড়ানো-ই পাপ! আপনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগল কী লাগল না এসব আমার দেখার বিষয় নয়। অন্য ছেলেদের চোখে আমাকে কতোটা সুন্দর লাগল এটাই দেখার বিষয়!”
দুষ্টুমি ভুলে নূর রাগী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। খড়খড়ে গলায় বলল,,

“তার মানে ছেলেদের চোখে নিজেকে সুন্দর প্রমাণ করার জন্য তুমি এভাবে সেজেছ? নিজের জন্য সাজো নি?”
“আরেহ্ ধ্যাত! এটা তো আপনার সাথে করা আমার চ্যালেঞ্জ! ঐদিন বলেছিলেন না? আমাকে নাকি কোনো ছেলেই পছন্দ করবে না? কেউ আমার সাথে প্রেমও করবে না? আজ তার প্রমাণ আপনি স্বয়ং চোখে দেখবেন! চাঁদ চাইলে কী কী করতে পারে জাস্ট দেখতে থাকুন।”

মুখটা বাঁকা করে চাঁদ নূরের সামনে থেকে প্রস্থান নিলো। নূর মাথাটা পেছন দিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে চাঁদের দিকে অস্থির গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“এই কোথায় যাচ্ছ?”
কোমড়টা হেলিয়ে দুলিয়ে চাঁদ হাঁটছিল! পেছনে না তাকিয়েই সে নূরকে লক্ষ্য করে বলল,,
“ছেলে পটাতে!”
নূর চোয়াল শক্ত করল! রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
“চূড়ান্ত অসভ্য একটা মেয়ে! ইডিয়ট, ননসেন্স রাবিশ।”

স্পিকারটা নিয়ে নূর হলুদের স্টেজের এক কোণায় রাখল। চেয়ার টেনে স্পিকারটার পাশে বসল। ফোনের লাইনটা স্পিকারে কানেক্ট করে স্লো মোশনে মিউজিক ছেড়ে দিলো। রাগে গজগজ করে সে সদর দরজার দিকে তাকাতে লাগল। চাঁদকে এই মুহূর্তে তার কেন জানিনা খু’ন করতে ইচ্ছে করছে! অকারণে তার রাগ হচ্ছে। খুব বেশি অভিমান হচ্ছে। চাঁদকে সত্যিই মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করছে! এরমধ্যেই হঠাৎ আয়মন এসে পেছন থেকে নূরের কাঁধে হাত রাখল। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বলল,,

“কী রে? এখানে বসে কী করছিস? ভাবির বাড়ি যাবি না?”
নূর রেগে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,
“রাখ তোর ভাবির বাড়ি! ঐদিকে যে তোর বোন ছেলে পটানোর ধান্দায় আছে খবর রাখিস এসবের?”
আয়মন কপাল কুঁচকালো। নির্বোধ গলায় বলল,,

“মানে?”
“মানে আবার কী? চাঁদকে দেখিস নি কীরকম মাঞ্জা মেরে সেজেছে? উদ্ভটভাবে সেজে আবার বলছে ছেলে পটাবে!”
আয়মনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পেছন থেকে সাদমান এসে নূরের মুখের কথা টেনে নিলো! বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বেহাল গলায় বলল,,

“মে তো লুট গেয়া ইয়ার! পটানোর আগেই আমি পটে গেছি!”
নূর অস্থির হয়ে উঠল! সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী?”
সাদমান সম্মোহনের গলায় বলল,,

“সত্যি বলছি রে ভাই। তাকে দেখে আমার হঠাৎ পালস রেট বেড়ে গেছে! অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি কিছুতেই যেনো পালস কমছে না! আমি এখন কী করব রে ভাই? একটা পথ দেখা প্লিজ।”
আয়মন বিরক্তবোধ করল। কপাল চাপড়ে বলল,,

“ধূর বা*! আমি এখান থেকে রাস্তা মাপি। দুই পাগলের কারখানা বসেছে এখানে! যতো ইচ্ছা ততো বকতে থাক!”
আয়মন প্রস্থান নিলো। নূর গটগট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল। আচমকাই সিগারেটটা সাদমানের হাতে ধরিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“এটা টান ভালো লাগবে! যতসব আউল ফাউল কথা!”
নূর প্রস্থান নিলো। চাঁদকে হন্ন হয়ে খুঁজতে লাগল। চাঁদের ছেলে পটানো আজ সে ঘুচাবে! দ্রুত পায়ে হেঁটে নূর সদর দরজা পাড় হতেই নীড় পেছন থেকে নূরকে ডাকল। উঁচু গলায় বলল,,

“এই নূর শোন? এক্ষণি একবার অনুদের বাড়ি যেতে হবে তোদের। পান, সুপারি মিষ্টি, সাথে করে বড়ো একটা বোয়াল মাছ নিয়ে যেতে হবে। আর শোন? বাড়ির সব মেয়েদেরও সাথে নিয়ে যাস।”
নূর বিব্রতবোধ করল। পিছু ঘুরে নীড়ের দিকে আপত্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দ্বিমত পোষণ করে বলল,,
“প্লিজ ভাইয়া মেয়েদের নিয়ে না যাই? এদের নিলেই আলাদা ঝামেলা। কখন কোন দিক থেকে ছেলেটা ওদের পটিয়ে ফেলে!”

পেছন থেকে জায়মা, নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহি নূরের কথা টেনে নিলো। নাকি কান্না করে নীড়ের হাত চেপে ধরল। আবদানসূচক গলায় বলল,,
“না ভাইয়া আমরা সবাই যাব প্লিজ।”

ইতোমধ্যেই সোহানী এসে তাদের পেছনে দাঁড়ালো! হলুদের সাজে সোহানীও বেশ জাঁকজমকভাবেই সেজেছে। হলুদ শাড়ি এবং হালকা সাজে অপরূপা লাগছে সোহানীকে! চার বোনের পাশে দাঁড়িয়ে সোহানী মৃদু হেসে তাদের অভয় দিয়ে বলল,,
“যাবি যাবি। আমরা সবাই যাব। নূরের একার কথা হবে না-কি হ্যাঁ?”

ক্ষুব্ধ হয়ে নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। বাড়ির এক কোণায় দাঁড়িয়ে এক প্রকার পেরেশান হয়ে সিগারেট ফুঁকতে লাগল। চাঁদের প্রতি জন্মানো কিউরিসিটি কমাতে লাগল! মনে মনে রোজকে ভাবতে লাগল! চাঁদের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে চাইল না। অবাধ্য অনুভূতি থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চাইল। নেশায় বিভোর হয়ে উঠল।

নীড় পিছু ঘুরে সোহানীর দিকে তাকালো। এক প্রকার অদ্ভুত দৃষ্টিতেই নীড় সোহানীর দিকে তাকালো। সোহানী কপাল কুঁচকালো। এক ভ্রু উঁচু করে বলল,,
“কী?”
নীড় মাথা দুলালো। ম্লান হেসে বলল,,
“কিছু না!”

তড়িঘড়ি করে জায়গা থেকে প্রস্থান নিতেই নীড় হঠাৎ মাহিনের মুখোমুখি হয়ে গেল। মাহিনকে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ব্যস্ত গলায় বলল,,
“সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠে যা। আর এক্ষণি ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হ। ওখান থেকে ফিরলেই আমাদের এখানে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সো ঐখানের কাজ সেরে যত দ্রুত সম্ভব এই বাড়িতে ফিরে আসবি। কথাটা মাথায় রাখিস।”
মাহিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। দায়িত্ব নিয়ে বলল,,

“ওকে ভাইয়া। ইউ জাস্ট ডোন্ট ওরি। সব কাজ ঠিকভাবেই হবে।”
আয়মন, সাদমান, মাহিন এবং সাব্বির নিজ দায়িত্বে পান, মিষ্টি এবং মাছ নিয়ে গাড়িতে এক এক করে সব সাজিয়ে রাখল। মেয়েদেরকে আস্তে ধীরে গাড়িতে উঠতে বলল। সোহানী হন্ন হয়ে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। তবে বাড়ির কোথাও চাঁদের দেখা মিলল না!

আয়মনের কানে কথাটা যেতেই আয়মন উদগ্রীব হয়ে উঠল। তন্ন তন্ন করে বাড়ির আঙ্গিনায় হাজার খুঁজেও চাঁদকে কোথায় দেখতে পেল না! উদ্বিগ্ন হয়ে সে এক দৌঁড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় আড্ডা দিতে থাকা নূরের বাবা, মেঝো আঙ্কেল, ছোটো আঙ্কেল এবং নূরের মামার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পেরেশানি গলায় বলল,,

“চাঁদকে তোমরা কেউ দেখছ?”
সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদের বাবা ঘাবড়ে উঠলেন। তৎপর গলায় বললেন,,
“হ্যাঁ দেখেছিলাম তো। এইমাত্র আমাদের সবার সাথে দেখা করে গেল।”
“তাহলে এখন কোথায় গেল? পুরো বাড়ি চুষেও তো চাঁদকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৫

চাঁদের নিঁখোজ হওয়ার খবরটা পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়ল! সবাই অস্থির হয়ে চাঁদকে খুঁজতে লাগল। সামিয়া আহমেদের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সবার চোখে-মুখে এখন ব্যাপক দুঃশ্চিতার ছাপ। সবার সাথে সাথে নূরও বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল। চাঁদকে ঘিরে খারাপ কিছুর আভাস পেতে লাগল!

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ২৭