প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩২

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩২
নিশাত জাহান নিশি

“এবার তুমি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাবে চাঁদ! নতুন করে আবারও আমার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করবে। আমাকে পেয়ে তুমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে। আমার মায়ায় তুমি এতোটাই মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়বে যে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে তোমার বুকটা লক্ষ্যাধিকবার কেঁপে উঠবে!”

পাশ থেকে মাহিন গলা ঝাড়লো! গরমের তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে গাঁয়ে পরিহিত সাদা রঙের শার্টটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এদিক-ওদিক তাকালো। অসহ্যকর গলায় বলল,,
“এই এবার ফিনিশ হয়েছে তোর হিরোপান্তি? ফর দ্যা গড সেইক গাড়িটা একটু সাইড কর ভাই। গরমে জান বের হয়ে যাচ্ছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সানগ্লাসের উপর থেকে নূর ভ্রু যুগল উঁচিয়ে মাহিনের দিকে তাকালো! কিয়ৎক্ষণ সেই একই নিরক্ষর দৃষ্টিতে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করল। অতঃপর ভাবশূণ্য গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন রে ভাই? তোরও কী আমার মতো প্রেয়সীর ঠোঁটের আইসক্রিম খাওয়ার স্বাদ জেগেছে?”
চোখ দুটো লাল করে মাহিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তেজী গলায় বলল,,

“আজিব! আমার প্রেয়সী আসবে কোত্থেকে হ্যাঁ? প্রেম-ই তো এখনো হয় নি আমার। আর প্রেয়সী তো সেখানে দিবাস্বপ্ন!”
ঝট করে মাহিনের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো নূর। আইসক্রিমটায় পুনরায় বাইট বসালো। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে তৃপ্তির সাথে আইসক্রিমটা গিলে খেলো। কঠিন গলায় বলল,,

“তো কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান না করে চুপচাপ বসে থাক। গাড়িটা এখন সাইড করা যাবেনা। আমার একটু ভুলের জন্য প্রেয়সীর কাছে আমি ধরা খেতে চাইনা!”
“ধরা তো তুই এমনিতেও খাবি ভাই। কারণ, আমাদের গাড়িটা এখন চাঁদদের বাড়িতেই যাবে! আর গাড়িটাকে একবার দেখলেই চাঁদ চোখ বুজে বলতে পারবে গাড়িতে এক্সেক্টলি কে ছিল!”

“বাড়িতে যাওয়ার পর ধরা খেলে আই হেভ নো প্রবলেম। তবে রাস্তার মাঝখানে ধরা পড়লে বহুত সমস্যা রে ভাই। এই মেয়ে যা বিচ্ছু! দেখা গেল রাস্তার মাঝখানেই আমাকে গন ধোলাই দিলো! এর সাথে বিশ্বাস নেই কিন্তু।”
“তার মানে তুই এখন গাড়িটা সাইড করবিনা তাই তো?”

“হ্যাঁ ঠিক তাই। চুপচাপ বসে সিগারেট গিল। আমার চিল মুডটা নষ্ট করিস না ঘ্যান ঘ্যান করে।”
মাহিন ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নিরুপায় হয়ে নূরের কথা মেনে নিলো। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল। লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে জোরে এক টান দিলো সিগারেটটায়। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বিদ্বেষি দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো৷ নূর বাঁকা হাসল! আইসক্রিম খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে শ্লেষাত্নক গলায় মাহিনকে বলল,,

“হাউ স্ট্রেঞ্জ না মাহিন? তোর এই ভাই প্রেয়সীর মুখের আইসক্রিম খাচ্ছে আর তুই তার পাশের সিটে বসে সিগারেট টানছিস! প্রেমে এলার্জি থাকলে এরমই হয় রে ভাই! ঢাকায় তো আর কম মেয়ে দেখাইনি! মনের মতো একটাও প্রেয়সী পেলিনা!”

মাহিন চোয়াল শক্ত করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“ভাট না বকে কুইকলি কারটা ড্রাইভ কর। বাড়ির সবাই হয়তো অলরেডি খালামনির বাড়ি পৌঁছে গেছে। আমরাই পেছনে পড়ে গেলাম।”
নূর কদাচিৎ হাসল। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“কুল ভাই কুল। এতো রাগছিস কেন? আই সোয়ার, এই কুমিল্লাতেই আমি তোর জন্য একটা প্রেয়সীর ব্যবস্থা করে দিব! প্রেয়সীর মুখের আইসক্রিম খেতে আমি তোকে হেল্প করব!”
রাগে বোম হয়ে মাহিন তার হাতে থাকা সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারল! গম্ভীর গলায় বলল,,
“ধ্যাত! তোর সাথে কথা বলাই বেকার!”

চাঁদ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক পর্যায়ে এসে থেমে গেল! চাঁদের পিছু পিছু জায়মা এবং তাশফিয়াও দৌঁড়ে এলো। দুজনই পেরেশান হয়ে চাঁদকে দুপাশ থেকে চেপে ধরল। সমস্বরে বলল,,
“এই তুই ঠিক আছিস তো?”

চাঁদ কুঁজো হয়ে হাঁপাতে লাগল। এক টানে মাথা থেকে সাদা হিজাবটা খুলে নিলো। ঘর্মাক্ত মুখণ্ডলে জায়মা এবং তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ক্লান্ত গলায় বলল,,
“ঠিক আছি। কিন্তু আমার আইসক্রিম?”
জায়মা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। চাঁদ ঠিক আছে শুনে যেনো সে প্রাণ খুঁজে পেল। বুকে হাত রেখে জায়মা শুকনো গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“কী হয়েছিল চাঁদ একটু বলবি? তোর চিৎকার শুনে তো আমরা ভেবেছিলাম তোর আবার খারাপ কিছু হলো নাকি।”
রুদ্ধকর শ্বাস ফেলে চাঁদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কোমরে হাত গুজে নিজেকে স্থির করল। শুষ্ক গলায় বলল,,
“কেউ আমার হাত থেকে আইসক্রিমটা কেড়ে নিয়েছে জায়মা! চোখের পলকেই সবকিছু হয়ে গেল বিশ্বাস কর। লোকটাকে ঠাওর করতে পারিনি আমি। সবকিছু কেমন যেনো ঘোলা ঘোলা লাগছিল আমার।”
তাশফিয়া উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সিরিয়াসলি চাঁদ? দিনে-দুপুরে কেউ এসে তোর হাত থেকে আইসক্রিমটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল আর তুই টের-ই পেলিনা? আর এই যুগে এতো বড়ো কার নিয়ে কে কার আইসক্রিম ছিনতাই করতে আসে ভাই? এর লজিক তো আমি বুঝলাম না।”
চাঁদ হয়রান হয়ে কয়েক দফা শ্বাস ছাড়ল। তৎপর গলায় বলল,,

“জানিনা আমি। কিচ্ছু জানিনা। এই প্রথম কোনো আজব ঘটনা ঘটল আমার সাথে। জানিনা কার শকুনের দৃষ্টি পড়েছে আমার উপরে। যদি একবার ঐ শুকুনকে হাতের কাছে পাইনা? তো আই সোয়ের একে আমি ডা’ণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করব!”
জায়মা শান্ত ভঙ্গিতে চাঁদের কাঁধে হাত রাখল। চাঁদকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ভাবছাড়া গলায় বলল,,

“আচ্ছা বাদ দে এসব। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফিরে চল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে অলরেডি। বাড়ি ফিরতে আর একটু দেরি হলেই দেখবি আয়মন ছুটে আসবে। আর তখন আমাদের একশটা জবাবদিহি করতে হবে।”
তাশফিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাঁদ এবং জায়মার দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা তোদের এই আয়মন ভাইয়াটা কে রে? যখনই শুনি তখনই ঐ আয়মন ভাইয়া। এই আয়মনটা কে?”
অমনি আয়মনের আবির্ভাব ঘটল চাঁদ, জায়মা এবং তাশফিয়ার সম্মুখে! বাড়ি ফিরতে তাদের দুজনের দেরি হচ্ছিল দেখে আয়মন বাইক নিয়ে হন্ন হয়ে ছুটে এসেছে তাদের খোঁজে! চাঁদ এবং জায়মাকে একত্রে দেখামাত্রই আয়মন বাইক থেকে নেমে এলো। রক্তিম চক্ষুজোড়া নিয়ে চাঁদ এবং জায়মার মুখোমুখি দাঁড়ালো। কঠিন গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“ঘড়িতে কয়টা বাজছে হ্যাঁ? কী করছিলি তোরা এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”
প্রবল ভয়ের বশবর্তী হয়ে চাঁদ এবং জায়মা মাথা নুইয়ে নিলো। প্রত্যত্তুরে কী বলবে তাই ভাবছিল। তবে চাঁদ এখনই আয়মনকে ঐ ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে চাইছেনা। আরেকটু সয়ে রয়ে জানাতে চাইছে। অপরদিকে, তাশফিয়া গরম চোখে আয়মনের দিকে তাকাচ্ছে! আক্রোশিত ভাব নিয়ে কোমরে হাত গুজে আয়মনকে দেখছে। পরক্ষণেই আয়মনকে উদ্দেশ্য করে তাশফিয়া তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই আপনি সেই ছেলেটা না? যে ছেলেটা ঐদিন আমাকে দেখে বাজে গানটা গাইছিলেন?”
তাৎক্ষণিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে আয়মন তাশফিয়ার দিকে তাকালো। অমনি আয়মনের রক্তিম চক্ষুজোড়া আরও টগবগে রক্তিম হয়ে উঠল! মাথায় তার অঢেল রাগ চেপে বসল। সেইদিনের সেই চড়ের আওয়াজটা তার কানে সূক্ষ্মভাবে বাজতে লাগল! অবিলম্বেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আয়মনের। চড়ের প্রতিশোধ নিতে সে মরিয়া হয়ে উঠল। রাগান্বিত ভাব নিয়ে তাশফিয়ার মুখেমুখি দাঁড়ালো। কড়া গলায় বলল,,

“ইউ ইডিয়ট গার্ল। আজ তো আপনার ছাড় নেই আমার হাত থেকে! এতোদিন ধরে অনেক খুঁজেছি আপনাকে কিন্তু পাইনি। আজ যখন আপনাকে হাতের কাছে পেয়েছি সেই সুযোগ আমি কিছুতেই হাতছাড়া করবনা।”
অনর্গল কথাগুলো বলে আয়মন যেই না হাত উঠিয়ে তাশফিয়ার গালে চড় বসাতে যাবে অমনি উত্তেজিত হয়ে চাঁদ এবং জায়মা আয়মনের হাত টেনে ধরল! বিস্ফোরিত গলায় সমস্বরে বলল,,

“আরেহ্ ভাইয়া থামো। কী করছ কী তুমি?”
তাশফিয়া ভয়ে এতক্ষণে হাত দ্বারা চোখ-মুখ ঢেকে নিয়েছিল! হঠাৎয়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যাওয়ায় তাশফিয়া বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই পর্যায়ে এসে চাঁদ এবং জায়মার অভয় পেয়ে তাশফিয়া মুখ থেকে হাতটা সরালো। পিটপিটে চোখে আয়মনের দিকে তাকালো। চাঁদ এবং জায়মা আয়মনকে ঠেলতে ঠেলতে পেছনের দিকে নিয়ে এলো। তবুও যেনো আয়নকে সামলানো যাচ্ছেনা! গরম চোখে তাশফিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় চাঁদ এবং জায়মাকে বলছে,,

“এই আমাকে ছাড় তোরা। তোরা জানিস না এই মেয়েটা আমার সাথে ঐদিন কী করেছে।”
চাঁদ হাঁপিয়ে ওঠা গলায় আয়মনকে বলল,,
“কী করেছে ভাইয়া?”
“চড় মেরেছিল ঐদিন এই মেয়েটা আমাকে!”

চাঁদ এবং জায়মা থম মেরে গেল! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। তারা দুজন যেনো বিশ্বাসই করতে পারছেনা তাশফিয়া এই কাজটা করেছে! তাশফিয়া শুকনো মুখে চাঁদ এবং জায়মার দিকে তাকালো। ভয়ে খানিক ঘাবড়ে উঠল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আমি কী করব বল? তোদের এই ভাইয়াটাই তো ঐদিন আমাকে দেখে বাজে গানটা গাইছিল। তাই আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দিয়েছি।”
আয়মন এতক্ষণে চাঁদ এবং জায়মার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে রুদ্রাক্ষের ন্যায় গরম হয়ে তেড়ে এলো তাশফিয়ার দিকে! শার্টের কলার ঝেড়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“হ্যালো এক্সকিউজ মি। ঐদিন ইচ্ছেপূর্বকভাবে আমরা আপনাকে দেখে গানটা গাই নি ওকে? বন্ধুরা মিলে এয়ারফোনে গান শুনছিলাম। আর তখনই আমাদের সামনে আপনার উদয় ঘটল। কিছু না বুঝে, শুনেই ঠাস করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। তাছাড়া ঐদিন নূরের মুখ থেকে গানটা জোরে বের হয়েছিল। আমার মুখ থেকে নয়। সেক্ষেত্রে দোষ যদি হতো তবে নূরের হতো আমার নয়। চড়টাও নূরের গাঁয়ে পড়ত আমার গালে নয়। অন্যায় করেছিল একজন আর আপনি তার শাস্তি দিয়েছিলেন অন্যজনকে৷ এখন এর ফল তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে!”

আয়মন আবারও গরম হয়ে হাত উঠিয়ে তাশফিয়ার দিকে তেড়ে আসতেই চাঁদ এবং জায়মা দুইদিক থেকে আয়মনকে চেপে ধরল। চাঁদ মৃদু আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত তাশফিয়াকে বলল,,
“এই তাশফিয়া তুই এখন পালা এখান থেকে। আগামী পরীক্ষায় আমাদের দেখা হচ্ছে ওকে?”

আল্লাহ্’র নাম জপ করতে করতে তাশফিয়া জান নিয়ে জায়গা থেকে পালালো! পিছু ঘুরে আর একবারও তাকালো না। এখান থেকে পালিয়ে গেলেই সে যেনো এখন জানে বাঁচে! কিছুদূর যেতেই তাশফিয়া রিকশা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আয়মন নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে উঠল। চাঁদ এবং জায়মাকে গাঁ থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তেজস্ক্রিয় গলায় বলল,,
“এই তোরা আমাকে ছাড় বলছি। আজ এই মেয়েটাকে আমি কিছুতেই ছাড়বনা। আমার হাত থেকে এই মেয়ের আজ নিস্তার নেই।”

জায়মা তিক্ততা প্রকাশ করল। বিরক্তিমাখা গলায় বলল,,
“ভাইয়া প্লিজ থামো। তাশফিয়া আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। তুমি আমাদের সামনে ওর সাথে এমন আক্রমনাত্নক ব্যবহার করতে পারোনা। তাকে ইনসাল্ট করতে পারোনা।”
চাঁদও জায়মার কথায় সহমত পোষণ করল। আয়মনকে চেপে ধরে উঁচু গলায় বলল,,

“হ্যাঁ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও তুমি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। দোষ হলে এখানে সম্পূর্ণ দোষ ঐ নূরের বাচ্চার হয়েছে! পারলে ঐ বজ্জাত নূরকে ধরো তুমি। তাকে মা’রধর করো! কারণ, সে তোমাকে ইচ্ছেপ্রণোদিতভাবে ফাঁসিয়েছে! অযথা তুমি আমার ফ্রেন্ডের পিছনে লেগেছ কেন হ্যাঁ?”

আয়মন এবার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। ছোটোছুটি থামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। শান্ত গলায় চাঁদকে শুধালো,,
“তার মানে তুই বলছিস এখানে সম্পূর্ণ দোষ নূরের ছিল?”
“হ্যাঁ নূরের-ই তো ছিল! নূর কেন তাশফিয়াকে দেখে এতো জোরে গানটা টান দিতে গেল হ্যাঁ? আর পরে কেন ব্যাপারটা ক্লিয়ার করল না? নূরের তো রাইট ছিল ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল করার।”

আয়মন ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা ভাবল। মনে মনে যোগ-বিয়োগ কষিয়ে চাঁদের কথার সত্যতা বিচার করল। পরক্ষণে-ই আবার আয়মন উত্তেজিত হয়ে উঠল। তটস্থ গলায় বলল,,
“আর একবার ঐ নূরের বাচ্চাকে সামনে পেয়ে নিই! শালাকেও যদি আমি মেয়েদের হাতের চড় না খাওয়াই তো আমার নামও আয়মন নয়!”

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই চাঁদ, জায়মা এবং আয়মন তাদের বাড়ি ফিরে এলো। আয়মন তার বাইকটা বাড়ির আঙিনায় পার্ক করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। চাঁদ এবং জায়মা দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। দুজনই বেশ ক্লান্ত এবং অবসন্ন। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে দুজনেরই। তাছাড়া আজ একের পর এক যে অভাবনীয় ঘটনাগুলো ঘটল তার জাল থেকে যেনো তারা কেউ-ই বের হতে পারছেনা।

চাঁদকে টপকে জায়মা আগে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। কারণ জায়মাকে এখন সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠতে হবে। কারণ, তিনতলাটা হলো জায়মাদের। দুতলা চাঁদদের এবং একতলাটা আয়মনদের। আয়মনের বাবার সাথে জায়মার বাবার খুব ভালো সম্পর্ক। তাই তারা একসাথেই জায়গা জমি ক্রয় করে এই তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িটা বানায়।

এর সুবাদে চাঁদের মা এবং জায়মার মা দুই বোন মিলে একই বাড়িতে থাকতে পারে। এক সাথেই থাকা-খাওয়া করতে পারে।
জায়মাকে অনুসরণ করে চাঁদ সদর দরজার কাছে আসতেই হঠাৎ চোখ পড়ল পার্কিং এরিয়ায় পার্ক করে রাখা সাদা মাইক্রোকারটির দিকে! মুহূর্তের মধ্যেই কপাল কুঁচকে নিলো চাঁদ। পিছনে থাকা আয়মনকে লক্ষ্য করে বলল,,

“কী ব্যাপার ভাইয়া? আমাদের বাড়িতে কি আজ গেস্ট এসেছে?”
প্যান্টের পকেটে চাবিটা ঢুকিয়ে নিলো আয়মন। ভাবলেশ গলায় বলল,,
“আমি কী করে জানব? আমিও তো মাত্র বাড়িতে এলাম। হয়তো আব্বুর বন্ধু-টন্ধু এসেছে।”

অমনি আয়মনের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল বাড়ির পেছনের ফাঁকা গ্রাউন্ডে। যে গ্রাউন্ডটার ঝোপঝাড় কেঁটে আয়মন মাত্র একমাস আগেই একটা ক্রিকেট খেলার মাঠ বানিয়েছিল। এলাকায় খোলা কোনো মাঠ নেই বিধায় খেলাধূলা করতে তাদের অনেক অসুবিধা হয়। সেই অসুবিধা দূর করার জন্যই মূলত আয়মনের এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া।

এখন খেলাধূলার পাশাপাশি এই মাঠটিতে বসে ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে নিরিবিলি আড্ডাও দেওয়া যায়। বাড়ির কোনো ছোটো খাটো অনুষ্ঠানও এই জায়গাটিতে অনায়াসে করা যায়। সচকিত দৃষ্টিতে আয়মন ক্রিকেট খেলতে থাকা নূর, মাহিন, সাব্বিরের পাড়ার কয়েকটা ফ্রেন্ড সার্কেলের দিকে তাকালো! নূর ব্যাটিং করছে এবং মাহিন বলিং করছে।

মাত্র লম্বা একটা চার মেরে নূর এবং সাব্বির দৌঁড়ে তাদের জায়গা পরিবর্তন করল। চার মারার খুশিতে নূর লাফ ঝাপ মারতে লাগল। আয়মনের বিস্ময়াত্নক দৃষ্টি এখনো স্থির নূরের দিকে। বিস্ময়জনক দৃষ্টতে আয়মনকে দেখে চাঁদ ভ্রু কুঁচকালো। দ্বিধায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“হোয়াইট’স হ্যাপেনিং ভাইয়া? তুমি এভাবে মাঠের দিকে কী দেখছ? তোমার ফ্রেন্ডসরা কী খেলতে চলে এসেছে?”
ঘোর কাটিয়ে আয়মন এবার প্রফুল্ল হাসল। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে লাফাতে শুরু করল। উত্তেজিত গলায় বলল,,
“ইয়েয়েয়েস! নূর এবং মাহিন এসে গেছে!”

আয়মন আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না। এক ছুটে বাড়ির পেছনের গ্রাউন্ডে চলে গেল। খুশিতে নাচতে নাচতে নূর এবং মাহিনকে লক্ষ্য করে উল্লাসিত গলায় বলল,,
“আজ তো আমাদের ইদ লেগে গেল ইয়ার!”

আয়মনকে দেখামাত্র নূর এবং মাহিন হেসে উঠল। ব্যাট বল রেখে দুজনই আয়মনের কাছে দৌঁড়ে এলো। নূর কদাচিৎ হেসে ব্যগ্র গলায় বলল,,
“হ্যাঁ মামা। আজ তো তোর চড় খাওয়ারও ছয়মাস পূরণ হয়ে গেল!”

উচ্ছ্বাস ভুলে আয়মন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো! আয়মনের মুখভঙ্গি দেখে নূর হু হা করে হেসে উঠল। নূরের এই গাঁ জ্বলা হাসি দেখে রাগে আয়মনের গাঁ রি রি করে উঠল! পুরনো ঘাঁ তার তাজা হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত করে কিছু বলার পূর্বেই মাহিন আয়মনের কাঁধে হাত রেখে প্রসঙ্গ পাল্টানোর পায়তারা করল। খিটখিটে মেজাজে বলল,,

“কেয়া ইয়ার? এতমাস পর আমাদের দেখা হলো আর তোরা কী চড় থাপ্পড় নিয়ে পড়ে গেছিস।”
মাহিনের কথায় আয়মন মুড অন করে নিলো। চড়ের প্রসঙ্গ ভুলে আবেগে ঘনীভূত হয়ে তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে ধরল। লাফিয়ে লাফিয়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল! মনে হলো যেনো কতবছর পর তাদের একসাথে দেখা। কত আবেগ, কত ভালোবাসা, কত অপেক্ষা নিয়ে আবারও তাদের একসাথে হওয়া। বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই যেনো এমন হাজার হাজার মিশ্র অনুভূতির সংমিশ্রণ। বন্ধুত্ব মানেই হলো- “একটি আত্মা, দুটি জান।”

নূরের নামটা শোনামাত্রই চাঁদ কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে গেল! চোখ দুটো তার অদ্ভুত নেশায় চঞ্চলা হয়ে উঠল। সেই চঞ্চলা চোখকে চাঁদ আর বাঁধ সেঁধে রাখতে পারলনা! দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে এক চোখা দৃষ্টিতে পেছনের খালি গ্রাউন্ডে উঁকি মারল! দূর থেকে হাসোজ্জল অবস্থায় নূরকে দেখামাত্রই তাৎক্ষণিক চাঁদ চোখজোড়া বুজে নিলো! শুকনো ঢোক গিলে জায়গা থেকে সরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়ালো। বুকটা তার অসম্ভবভাবে কাঁপতে আরম্ভ করল। কম্পিত বুকে সে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় বলল,,

“সত্যিই কি ঐ মাতালটা এসেছে?”
চোখজোড়া খুলে চাঁদ পুনরায় এক চোখে বাড়ির পেছনের গ্রাউন্ডে তাকালো। অমনি তার দৃষ্টির সামনে থেকে নূর উধাও হয়ে গেল! চাঁদ তাজ্জব বনে গেল। চোখ কচলে আবারও পূর্ণদৃষ্টিতে গ্রাউন্ডে তাকালো। এবারও নূরকে কোথাও দেখতে পেলনা! চাঁদ এবার উদ্বেগী হয়ে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে বলল,,

“মাতালটা গেল কই? একটু আগে তো এখানে-ই ছিল!”
উদগ্রীব হয়ে চাঁদ দেয়ালের পাশ থেকে সরে আসতেই হঠাৎ তার কণর্কুহরে কারো উত্তপ্ত নিশ্বাসের অনুভূতি পেল! থতমত খেয়ে উঠল চাঁদ! শীঘ্রই বুকে থুঃথুঃ ছিটিয়ে চোখ বুজে নিলো। ভয়ার্ত গলায় বলল,,

“মাগো! কে আবার আমার কানে এমন উত্তপ্ত হাওয়া দিলো? এই বাড়িতে আবার ভূত-প্রেতের আছড় হলো না তো?”
চাঁদের কাণ্ডকীর্ত দেখে নূর হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিলনা! তবে এই মুহূর্তে তার হাসতে বড্ড ইচ্ছে করছে। তবে এখনই হেসে দিলে চলবেনা! চাঁদকে আরও কাছ থেকে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হবে! চোখের তৃষ্ণা তার মিটিয়ে নিতে হবে। চাঁদের নিশ্বাসে আরও গাঢ়ভাবে মিশতে হবে। চাঁদের নেশায় মত্ত হয়ে উঠল নূর। একটু একটু করে চাঁদের কানের লতিতে জোরদার ভাবে মুখ ঠেঁকালো। নেশা ভরা গলায় বলল,,

“আমি এখানে।”
চাঁদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নূরের গলার স্বর শুনে চোখজোড়া খুলে নিলো। মাথাটা বাঁ পাশে ঘুরালো। অমনি তার দৃষ্টির সীমানায় শরীরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূরকে দেখতে পেল! কানের লতি থেকে নূর মুখটা সরিয়ে বাঁকা চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো। বেখায়ালী দৃষ্টিতে চাঁদের বুকের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ইউ আর লুকিং সো হ’ট!”
চাঁদ বিষম খেলো! কম্পিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। হিজাব দ্বারা বুকটা ভালোভাবে ঢেকে নিলো। নিজেকে ঠিকঠাক করে চাঁদ এবার উজবুক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের অবস্থা দেখে নূর ফিক করে হেসে দিলো। কাঁধটা বাঁ দিকে খানিক বাঁকা করে আসক্ত গলায় বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩১

“এভাবে ফ্যাল ফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিও না প্লিজ! ভুলভাল কিছু ঘটে গেলে কিন্তু তখন আমায় খুঁজে পাবেনা! তোমাকে বদনাম করে আমি নিরুদ্দেশ হবো। যেনো তোমার খুঁজে আমি নই…তবে তুমি আমার খুঁজে দিশেহারা হয়ে ওঠো!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৩