প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৮

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৮
নিশাত জাহান নিশি

“কী রে মা? কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?”
অশ্রুসজল লোহিত দুই নেত্রজোড়ায় তাশফিয়া তার মা জেসমিন হকের দিকে তাকালো। তার মায়ের চোখে প্রখর উদ্বিগ্নতা দেখে তার কান্নার মাত্রা যেনো বেগতিক বেড়ে গেল! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। ভেতরের নিগূঢ় ব্যথাটা কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাইল। মেয়ের এই বিমূর্ষ অবস্থা দেখে জেসমিন হক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। হুড়মুড় করে তিনি শোয়া থেকে ওঠে এলেন। মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার কান্নারত মুখমণ্ডলের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে উঁকি দিলেন। মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“কী হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
দুঃখ নিবারণ না করতে পেরে তাশফিয়া এবার ডুকরে তুলে কেঁদে দিলো। আগপাছ না ভেবে তার মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরল। হেচকি তুলে কেঁদে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, আমি যা করেছি মস্ত বড়ো অন্যায় করেছি। অতিরিক্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছি! কিন্তু এর শাস্তি যে আমাকে এতোটা তীব্রভাবে পেতে হবে বুঝতে পারিনি মা।”
“আমি তো তোর কথার সারমর্ম কিছুই বুঝতে পারছিনা মা। একটু স্পষ্ট করে বলবি?”

অঝোরে কেঁদে তাশফিয়া তার মা’কে ঘটনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তারিত খুলে বলল। নিজের দোষটাও সে বিনা সংকোচে স্বীকার করল। তিথীর অহেতুক চড় মারার বিষয়টাও খোলাখুলিভাবে বলল। কোনো কথাই সে গোচর করলনা। চাঁদের দুই ভাইয়ের সাথে যে তারা দু’বোন অন্যায় করে এসেছে তার প্রতিটা স্বীকারোক্তি সে খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরল। সব শুনে জেসমিন হক মেয়ের ভুলটাই ধরলেন! তবে এই মুহূর্তে মেয়েকে শাসনের স্বরে কিছু বলতে চাইলেননা। ঠাণ্ডা মাথায় মেয়েকে বুঝাতে তিনি নমনীয় গলায় বললেন,,

“সাহস ভালো মা। তবে অতিরিক্ত সাহস ভালো না। তুমি ঐ ছেলেটার সাথে খুব অন্যায় করেছ। তার গাঁয়ে হাত তুলে তুমি ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় করেছ! না বুঝেই তাকে অন্যায়ভাবে ইনসাল্ট করেছ। ভাগ্যিস ছেলেটা ভালো ছিল! নয়তো অন্য সব খারাপ ছেলেরা হলে ওখানেই তোমার কোনো ক্ষতি করে দিত।

ছেলেরা এমনিতেও খুব রাগী মেজাজের হয় মা। তাদের মধ্যে হিংস্রতা কাজ করে বেশি। তারা স্বভাবতই শোধ নিতে উদ্দত থাকে। সেই শোধের বশবর্তী হয়ে-ই ছেলেটা আজ তোমাকে সামনে পেয়ে শোধ নিতে চেয়েছিল। তুমি চাইলে ভালো করে সরি টরি বলে কিন্তু এই ফাড়া থেকে বের হয়ে আসতে পারতে।

তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলে পরিস্থিতি সামলে আসতে পারতে। তুমি জানো মা? নম্রতা কত বড় অস্ত্র নিজেকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করার জন্য? তুমি যে কাজটা উগ্রতা দেখিয়ে হাসিল করতে না পারবে সে কাজটা তুমি নম্র ব্যবহার দিয়ে হাসিল করতে পারবে। কিন্তু না! তা না করে তুমি উল্টে ছেলেটাকে উস্কে দিয়ে এলে? তিথীকে দিয়ে তার ভাইকে চড় খাওয়ালে?”

“তুমি ভুল বুঝছ মা। আমি তিথীকে বলিনি চাঁদের কাজিনের গাঁয়ে হাত তুলতে। তিথী নিজে থেকেই চাঁদের কাজিনের গাঁয়ে হাত তুলেছিল। কারণ আয়মন ভাইয়া আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছিল মা। চড় মারবে বলে আমার দিকে তেড়ে আসছিল। ভয়ে আমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল মা। হাত-পা কাঁপছিল। যা তিথী সামনে থেকে সহ্য করতে পারছিলনা। তাই সে আগেপাছের কোনো কথা না শুনেই অজান্তে মাহিন ভাইয়ার গাঁয়ে হাত উঠিয়ে ছিল।”

জেসমিন হক চিন্তিত শ্বাস ছাড়লেন। বেশ অনেকক্ষণ যাবত তিনি বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন। বেদ-বিচার করে তিনি একটা সিদ্ধান্তে এলেন। বিবেচক গলায় বললেন,,

“আচ্ছা যা হয়েছে ভুলে যাও মা। চাঁদ এবং জায়মা তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বলেই তো তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? কোনো ব্যাপার না মা। সকাল হতেই আমরা চাঁদের বাড়ি যাব! তবে কিন্তু একটা শর্ত আছে। চাঁদের কাজিনদের কাছে তোমাকে এবং তিথীকে ক্ষমা চাইতে হবে! আমি মনে করি দুজনের কাছে ক্ষমা চাইলেই চাঁদ এবং জায়মা তোমাকে ক্ষমা করে দিবে! আবারও তোমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আগের মতো প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠবে।”

তাশফিয়া মাথা উঁচিয়ে তার মায়ের দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে তুলল। উদ্যমী গলায় বলল,,
“যে করেই হোক মা। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দিবনা। তুমি যদি বলো আয়মন ভাইয়ার পা ধরে ক্ষমা চাইতে, আমি চাইব মা! প্রয়োজনে মাহিন ভাইয়ার পা ধরেও ক্ষমা চাইব! চাঁদ জায়মা থেকে শুরু করে সবার কাছে ক্ষমা চাইব! তবুও আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অক্ষুণ্ণ রাখব মা।”

জেসমিন হক আদুরে হয়ে তাশফিয়ার কপালে চুমু খেলেন। আহ্লাদি গলায় বললেন,,
“এইতো আমার লক্ষি মা। মায়ের সব কথা শুনে আমার বাচ্চাটা।”
মায়ের আদর পেয়ে তাশফিয়া মৃদু হাসল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠল। বিষন্নতা ভুলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। মেয়েকে হাসি-খুশি দেখে জেসমিন হক স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন। পুনরায় তাশফিয়ার মাথায় হাত বুলালেন৷ ব্যস্ত গলায় বললেন,,

“অনেক রাত হয়েছে মা। এবার ঘুমুতে চলো। পড়ার চাপ বেশি থাকলে ভোরেও ওঠে পড়া যাবে মা। এত রাত জেগে পড়লে তোমার মাথাব্যথা করবে। তোমার কষ্ট দেখলে আমারও খুব কষ্ট হবে মা। এখন ওঠে পড়ো কেমন?”
তাশফিয়া মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। পড়ার টেবিল ছেড়ে ওঠে বাধ্য গলায় বলল,,
“ঠিক আছে মা চলো।”

দুই মা-মেয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে গলাগলি করে শুয়ে পড়ল। ঘুমে বুদ হয়ে তাশফিয়া চক্ষুজোড়া অচিরেই বুজে নিলো। ক্লান্ত চোখ তার স্বস্তি খুঁজে পেল। কান্নার পর এমনিতেও ঘুম ভালো হয়! এক অদৃশ্য যোগসূত্র আছে উভয়ের মধ্যে। নির্ঘুম দু’চোখে জেসমিন হক উনার একমাত্র মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন৷

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনি ব্যথীত মনে তাশফিয়ার বাবাকে স্মরণ করছেন! বাপ ম’রা মেয়ে তাশফিয়া! তার জন্মের পাঁচবছরের মাথায় এসে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মা’রা যান! তখন থেকেই মেয়েকে তিনি একা হাতে মানুষ করে আসছেন। মেয়ের কোনো চাহিদা, শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে-অনিচ্ছে কোনো কিছুরই ঘাটতি রাখছেননা।

মেয়েকে বাবার অভাব অনুভব করতে দিচ্ছেননা। মেয়ে যখন যা চাইছেন তখন তাই মেয়ের চোখের সামনে এনে হাজির করছেন। ছোটো খাটো একটা বীমা কোম্পানিতে চাকরী করেন তিনি। মাসিক বেতন বারো হাজারের উর্ধ্বে নয়। একটা সংসার স্বচ্ছলভাবে চলতে গেলে বারো হাজার টাকা কিছুইনা।

চোখে লাগার মতোও না৷ তিথীর বাবা আছেন বলেই মাসে মাসে তাশফিয়ার পড়ার খরচটা খব স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যায়। তাছাড়াও জেসমিন হককে সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়েও হেল্প করেন তিথীর বাবা! তিথীর বাবা এমদাদ খান হলেন তাশফিয়ার মায়ের দুঃসম্পর্কের ফুফাতো ভাই৷ নিঃসন্দেহে এমদাদ খান একজন ভালো মানুষ বলেই দুঃসম্পর্কের মামাতো বোনকে এতগুলো বছর ধরে সাহায্য করে আসছেন। ভবিষ্যতেও করবেন বলে প্রত্যাশা রাখেন।

ভোরের আস্তরণ কেটে অন্তরিক্ষে সূর্যের প্রাদুর্ভাব ঘটল। প্রকৃতির সমস্ত শীতলতা মিইয়ে ভ্যাপসা গরমের রূপ নিলো। ধরিত্রী কোলাহলমুক্ত থেকে কোলাহলপূর্ণ হলো। যান্ত্রিকতা বাড়তে লাগল, হাঁক-ডাক বাড়তে লাগল, ব্যস্ততা বাড়তে লাগল। দিনটা নতুনভাবে শুরু হলেও পুরনো সব নিয়মে বাঁধা পড়ল সর্বস্তরের মানুষ।

তেমনিভাবে বাঁধা পড়ল চাঁদের পরিবারের প্রতিটি মানুষ। সকাল আটটা বাজতেই ঘুম থেকে ওঠে নাশতার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সামিয়া আহমেদ। উনার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছেন সাবরিনা আবরার। যে করেই হোক সকাল নয়টার মধ্যেই ডাইনিং টেবিলে সবার জন্য খাবার সাজিয়ে দিতে হবে। সোহানী এবং নীড় সারারাত খুনশুটি করে ঘুমিয়েছে প্রায় ভোরের দিকে! তুমুল ঝগড়াও হয়েছিল দু’জনের মধ্যে।

নীড়ের হাজারটা বকাবকি শুনে সোহানী শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিল নীড়কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে। দুজনই এখন একে-অপরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।

চাঁদ এবং জায়মা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। ভোর চারটা পর্যন্ত তারা দুজন খুব মনোযোগ সহকারে পড়েছে। পড়ার চাপে তারা ঘুম-নিদ্রা সব ভুলতে বসেছিল প্রায়। তবে শরীর ঠিক রাখার জন্য ভোর চারটার পর বাধ্য হয়ে তাদের চোখ লাগাতে হয়েছিল। পরীক্ষার আগে নিজেদের শরীর খারাপ করতে চায়না তারা।

এতে আমও যাবে ছালও যাবে। এখন আবার সকাল আটটা বাজতেই ঘুম থেকে ওঠে তারা ফ্রেশ হয়ে জলদি জলদি পড়ার টেবিলে বসে পড়ল। ঘুমের তাড়নায় তারা দুজন-ই চোখ টেনে মেলতে পারছেনা। এতে করে পড়াশোনায়ও ব্যাঘাত ঘটছে। এই মুহূর্তে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের অভাব খুব অনুভব করছে তারা! গরম গরম চা খেলে হয়তো এক্ষণি চোখ থেকে ঘুমের ভাবটা হুড়মুড়িয়ে পালিয়ে যেত। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে চাঁদ বাধ্য হয়ে পড়ার টেবিল ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। ঘুম জড়ানো গলায় জায়মাকে বলল,,

“না আর সম্ভব হচ্ছেনা। গরম চা এবার খেতেই হবে। তুই বরং পড় জায়মা আমি চা নিয়ে আসছি।”
ঘুমসিক্ত চোখে জায়মা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। মাতালদের মতো কেবল হেলছে ঢুলছে সে। ধীর পায়ে হেঁটে চাঁদ রুম থেকে প্রস্থান নিলো। আলুথালু পায়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। রান্নাঘরে প্রবেশ করে সে প্রথমেই সামিয়া আহমেদকে রাগতা দিয়ে বলল এক্ষণি চা করে দিতে। তিনি গরম প্যানে মাত্র পরোটা সেঁকছিলেন। বেশ ব্যস্ত গলায় চাঁদকে বললেন,,

“আচ্ছা আমি চা করছি। তুই আগে নূর, মাহিন আর আয়মনকে ডেকে আয়। ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়ে গেছে। এদের একজনও এখনও এলো না। না জানি আমার ছেলে তিনটে ক্ষিধায় তাড়নায় মরছে।”
সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদের পিলা চমকে গেল! চোখ থেকে ঘুম উবে গেল! মুখমণ্ডলে রাগান্বিত ছাপ ফুটিয়ে তুখোর বিব্রত প্রকাশ করল। পূর্ণদৃষ্টি মেলে সামিয়া আহমেদের দিয়ে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,

“পারবনা আমি ওদের ডেকে দিতে। চা টা নিতে এসেছি চা টা করে দাও। বাড়তি কিছু পারবনা আমি।”
পাশ থেকে সাবরিনা আবরার কটু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালেন। বিষয়টা তিনি বেশ মনে নিলেন! অকপট গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“কী হলো? তুই নূর এবং মাহিনের কথা শুনে এভাবে রিয়েক্ট করলি কেন?”
জিভ কাটল চাঁদ। অতিশয় বিপাকে পড়ে মাথা নুইয়ে নিলো। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা সাবরিনা আবরার খুব আঘাত পেয়েছেন চাঁদের রূঢ় আচরণে। তাই সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মরিয়া হয়ে উঠল। ক্ষোভ ভুলে জোরপূর্বক হাসল। মাথা উঁচিয়ে সাবরিনা আবরারের দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকালো। আমতা আমতা গলায় বলল,,

“কোথায় কী করলাম খালামনি? আমি তো জাস্ট এমনি বলছিলাম। আচ্ছা আমি ওদের ডেকে দিচ্ছি। তোমরা বরং আমাকে একটু চা টা করে দাও। মাথাটা খুব ধরেছে”
পরিস্থিতি কোনোরকমে আয়ত্তে এনে চাঁদ তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলো। মাথা চুলকে ঝড়ের বেগে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলো। সদর দরজাটা বাইরে থেকে ভালো করে লাগিয়ে সে বুকে হাত রেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। হাঁফছাড়া গলায় বলল,,

“জোর বাঁচা বেঁচে গেলাম বাবা। খালামনি কী না কী ভাবছিল আমাকে। হয়তো ভাবছিল আমাদের বাড়িতে এসেছে বলে আমি তাদের সহ্য করতে পারছিনা। কতধরনের ভাবনা মানুষের।”
এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি টপকে চাঁদ নিচে নামতে লাগল। হাঁপিয়ে ওঠা গলায় পুনরায় নাক সিটকে বলল,,

“লু’চুগুলোর সামনে যেতেও এখন লজ্জা করছে! না জানি আমি যাওয়ার পর আরও কী কী দেখেছিল! আচ্ছা ওরা কী এখনও ওসব দেখছে?”
বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলে চাঁদ বমি করার ভাব নিলো! নাক-মুখ উল্টিয়ে বলল,,

“ওয়াক! ঐ খারাপ সিনটা এখনও আমার চোখে ভাসছে! কীভাবে দেখল ওরা এসব? রুচিতে বাঁধলনা একটুও? আর তাছাড়া আমিই বা কেন নক-টক ছাড়া বেয়াক্কেলের মতো তাদের রুমে ঢুকতে গেলাম? আমি যাওয়ার পর পরই কেন ঐ বাজে সিনটা আসতে হলো? ধ্যাত। নিজের প্রতিই নিজের এখন রাগ লাগছে।”

নিজেকে একতরফা দোষারোপ করে চাঁদ ভীরু পায়ে হেঁটে আয়মনদের ফ্ল্যাটের সামনে পা বাড়ালো। দরজার সামনে যেই না স্থির হয়ে দাঁড়ালো অমনি হঠাৎ দরজা খুলে নূর বের হয়ে এলো! চোখ তুলে চাঁদ অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভয়াল দৃষ্টিতে অস্ফুটে রক্তিম চক্ষু জোড়ায় নূরকে আবিষ্কার করল চাঁদ। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে বিক্ষিপ্ত চেহারা নূরের।

নীলাভ লোচনদ্বয় প্রখর ক্লান্তিতে মুর্ছানো। দেখে মনে হচ্ছে যেনো শত সহস্র রজনী সে নির্ঘুম কাটিয়েছে। যার প্রভাব ভয়াবহভাবে তার মুখমণ্ডলে পড়েছে। জীর্ণ-শীর্ণ নেতানো শরীর। হৃদয়ে বহন করছে একরাশ ব্যাকুলতা। প্রেয়সীর থেকে পাওয়া ভারী বেদনার বোঝা। নূরের এহেন নিথর চাহনি চাঁদ ভয়ে ঘাবড়ে উঠল।

থতমত খেয়ে নূরের হাত থেকে পালানোর জন্য মুখে হাত চেপে ধরে দৌঁড়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো৷ প্রথম সিঁড়িতে পা বাড়াতেই অমনি নূর হন্ন হয়ে চাঁদের পিছু নিলো। পেছন থেকে চাঁদের হাতটা টেনে ধরে তাকে হেঁচকা টানে সিঁড়িতে বসিয়ে দিলো! কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই চাঁদের কোলে মাথা রেখে নূর বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল!

ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে চাঁদ কিছু ঠাওড় করতে পারলনা। নূরকে বেগড়া দিতেও পারলনা। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কেবল নূরের চাতক পাখির ন্যায় তৃষ্ণার্ত মুখপানে তাকিয়ে রইল৷ স্নিগ্ধতায় চোখজোড়া বুজে নিলো নূর। চাঁদের উষ্ণতায় ভরা কোমল শরীরে প্রশান্তির ছায়া খুঁজে পেল! মানসিক শান্তিও খুঁজে পেল বটে! অশান্ত মনকে শান্ত করতে পেরে সে ভেতর থেকে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। প্রবল উন্মাদনায় ভরা তীব্র প্রেমে সিক্ত হয়ে চাঁদের ডান হাতটা তার মাথার উপর চেপে ধরল। বেশ অধিকার খাটিয়ে বলল,,

“নাও মাথাটায় হাত বুলিয়ে দাও। মাথার এই দুঃসহ যন্ত্রণাটা কমিয়ে দাও।”
চাঁদ ভ্রু যুগল কুঁচকালো। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া করলনা। বিরাট এক ঘোরে তলিয়ে পড়ল সে, যে ঘোর কাটিয়ে কিছুতেই বাস্তবে ফিরতে পারছেনা সে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ তড়পাচ্ছে। এক অজানা অনুভূতিতে মত্ত হয়ে উঠছে। মুখ খুলে বলতে চাইছে আপনার স্পর্শ আমার গাঁয়ে সইছেনা নূর ভাইয়া। দমটা শুধু যাই যাই করছে। দেহের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়শক্তি জাগান দিয়ে বলছে, এই ছেলেটার স্পর্শেই তোর মরণ লিখা আছে!”

নূরের এহেন অদ্ভুত আচরণ একদমই আশা করেনি চাঁদ। যার কারণে তার কৌতূহল এবং উদ্দীপনাও বেশি। চাঁদের নির্বিকতা দেখে নূর এবার বিরক্তিবোধ করল। পুনরায় কর্কশ গলায় শুধালো,,
“কী হলো? কানে শুনতে পাও নি? আমি কি ইংলিশ বলছিলাম?”

নূরের রোষপূর্ণ প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল চাঁদ। শুকনো ঢোক গিলে নূরের বিবর্ণ মুখমণ্ডলে তব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। না চাইতেও কাঠ কাঠ গলায় বলল,,
“পারবনা আমি নূর ভাইয়া। প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”
রাগে ফোঁস করে উঠল নূর। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“জেদ করবানা তো। অসহ্য লাগতেছে। গোটা রাত ঘুমাতে পারিনি শুধুমাত্র তোমার জন্য! সারারাত আমাকে কষ্টে রেখেছ। বিশ্বাস করো, এই মুহুর্তে আমার মানসিক শান্তির খু্ব প্রয়োজন।”
“তো আমি আপনাকে কীভাবে মানসিক শান্তি দিব নূর ভাইয়া? কীসব উদ্ভটের মতো আচরণ করছেন আপনি বলুন তো?”
“তখন ভুল বুঝে চলে গেলা কেন হ্যাঁ? তুমি বুঝো না? তুমি আমাকে একরত্তি ভুল বুঝলেও দুনিয়াটা অসহ্য লাগে আমার? শূণ্য শূণ্য লাগে সবকিছু?”

চাঁদ থমকালো। সচকিত দৃষ্টিতে নূরের নির্ভেজাল মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো। দুষ্টুমির কোনো ছাপ খুঁজে পেলনা নূরের বিমূর্ত মুখমণ্ডলে। প্রতিটা কথাই তার সত্যি মনে হলো। তবুও সন্দেহ কাটাতে সে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী বললেন আপনি? আমি আপনাকে ভুল বুঝলে আপনার অসহ্য লাগে?”

“হ্যাঁ লাগেই তো। খুব অসহ্য লাগে। তুমি কবে বুঝবা বলো তো এসব? একটু তো আমার চোখের দিকে তাকাতে পারো। মনের ভাব বুঝার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু না, তুমি তো আমার দিকে তাকাবানা। আমাকে দেখলেই দূরে দূরে থাকবা। এই বোকা-সোকা মেয়েটাকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো? যে আমার অনুভূতিই বুঝতে পারেনা।”

চাঁদ নিরুত্তর। কেবল কৌতূহলী দৃষ্টিতে নূরকে দেখতে লাগল। এই প্রথম প্রবল আগ্রহ নিয়ে চাঁদ নূরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চোখজোড়া তার মুগ্ধতায় ভরে উঠছে! নূরের স্নিগ্ধ, কোমল, শোভন মুখমণ্ডলে নির্দ্বিধায় অপলক তাকিয়ে রয়েছে। নূরকে দেখার রেশ যেনো কিছুতেই কাটছেনা তার। তবে এখনো একই জায়গায় শক্ত হয়ে বসে আছে সে। নূরের মাথায় একটুও হাত বুলিয়ে দিচ্ছেনা! তিক্ততা প্রকাশ করল নূর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“কী হলো? এভাবে চুপ করে বসে থাকার জন্যই কী আমি তোমার কোলে মাথা রেখেছিলাম হ্যাঁ? আমার ভেতরের যন্ত্রণাটা বুঝতে পারছ না তুমি? এতো নির্মম, নিষ্ঠুর, পাষাণ কেন তুমি?”
“ধ্যাত চুপ করুন তো। প্লিজ উঠুন এবার। কেউ এখানে আমাদের এভাবে দেখে নিলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
“হয়ে যাক! এসবের ধার ধারি না আমি। আমার এখন মানসিক শান্তির প্রয়োজন। যা তুমি ছাড়া এই দুনিয়ার কেউ দিতে পারবেনা!”

চাঁদের ডান হাতটা টেনে এনে নূর ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে হাতের নরম তালুতে আদুরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো! খুব অধিকার খাটিয়ে হাতটা তার মাথার নিচে রাখল। অমনি চাঁদ নড়েচড়ে উঠল। বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়তে লাগল। তার শরীর ক্রমাগত কাঁপতে লাগল। ভেতর থেকে রুদ্ধ শ্বাস বের হতে লাগল। কী করবে না করবে তা ভেবে হয়রান হয়ে উঠল। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় শরীর থেকে শীতল ঘাম ঝড়তে লাগল। হাঁসফাঁস করতে লাগল চাঁদ। হার্টবিট উর্ধ্বগতিতে চলতে লাগল। না চাইতেও সে নূরের দিকে আবিষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মগ্ন গলায় বলল,,

“আমার বুকটা খুব কাঁপছে নূর ভাইয়া! বুকের ভেতরে একটা তিপতিপ শব্দ হচ্ছে! শরীরটাও কেমন যেনো জাগান দিয়ে উঠছে। এই প্রথমবার আমার এমন ফিলিংস হচ্ছে নূর ভাইয়া! আপনারও কি আমার মতোই এমন ফিলিংস হচ্ছে?”
নিবদ্ধ দৃষ্টি খুলে নূর মোহময় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ম্লান হেসে নেশাক্ত গলায় বলল,,

“এই ফিলিংসটা আমার নতুন করে হচ্ছেনা চাঁদ! দীর্ঘ অনেকমাস আগে থেকেই হচ্ছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আমাকে খাঁক করে দিচ্ছে! তুমি আমার কাছে এলেই এই ধুকপুকানিটা বেড়ে যায় চাঁদপাখি! জানো? এই ফিলিংসটার নাম কী?”
চাঁদ সম্মোহিত গলায় বলল,,
“কী?”

নূর হালকা হাসল। উঁচু হয়ে চাঁদের নাকে নাক ঘঁষল। রহস্যময় গলায় বলল,,
“সময় হলে তুমি নিজেই বুঝবা!”

সোহানী পড়েছে বড়ো এক ফ্যাসাদের মধ্যে! ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজতে চলল অথচ সে এখনো নীড়কে ছেড়ে শোয়া থেকে উঠতে-ই পারলনা! জোর করে চেপে ধরে রেখেছে নীড় সোহানীকে। তার বলিষ্ঠ বুকের সাথে একাত্নভাবে মিশিয়ে রেখেছে সোহানীকে। যেনো চাইলেও সোহানী তার থেকে ছাড়া পেয়ে তার থেকে পালিয়ে যেতে না পারে।

দুর্বল জায়গা বুঝেই শক্তপোক্ত ভাবে ফোকাস করেছে নীড়। সোহানীর এই দমবন্ধকর হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে নীড় বাঁকা হাসল। সোহানীর অসহায় মুখশ্রীতে তাকিয়ে খুব মজা নিচ্ছে সে! ক্ষণে ক্ষণে সোহানীকে আরও একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য তার পিঠে হালকা নাক ঘঁষছে!

একটু একটু করে বিরক্ত হয়ে উঠছে সোহানী! নাক-মুখ সিটকে তিক্ততা প্রকাশ করছে। শেষ অবধি নিজের জেদকে সংবরণ করতে না পেরে সোহানী নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। জোরপূর্বক নীড়ের বলিষ্ঠ শরীর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উদ্দত হয়ে উঠল৷ হাত-পা নাড়িয়ে চাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“দেখি এবার ছাড়ুন তো। ঘুম থেকে ওঠে এতক্ষণ শুয়ে থাকা যায় নাকি?”
নীড় আরও তৎপর হয়ে উঠল৷ ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলিষ্ঠ শরীরে সোহানীকে গুরুতরভাবে চেপে ধরল। নেশালো গলায় বলল,,
“বিয়ের পর অনেককিছুই চেঞ্জ হয় বুঝলা? হাজবেন্ডকে সেটিজফাইড করার জন্য এভাবেই ঘুম ভেঙে ওঠে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে হয়!”

“এই ভুয়া নিউজগুলো কোত্থেকে পান আপনি শুনি? আসার পর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারছেন! শান্তি দিচ্ছেননা একফোঁটাও।”
“ওহ্ আচ্ছা! আমি চলে গেলে খুব খুশি হবা না? শান্তিতে থাকতে পারবা?”
“আমি কখন বললাম আপনাকে এসব হ্যাঁ? কেন অযথা কথার মাঝখানে দোষ খুঁজছেন বলুন তো? এভাবে আমাকে আটকে রাখার জন্য?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৭

নীড় ফিক করে হেসে দিলো। সোহানীকে ছেড়ে মৃদু ধাক্কা মেরে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। প্রখর রোমাঞ্চতায় বেখবর হয়ে ভারী শরীর নিয়ে সোহানীর গাঁয়ের উপর নিজেকে প্রতিস্থাপন করল! হতবাক সোহানীর ঠোঁটের দিকে নির্লজ্জ দৃষ্টিতে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,,
“এতোদিন তো জামাই জামাই করে মরছিলা! এখন জামাইয়ের লাভ টর্চার সহ্য করবা না?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৩৯