প্রেয়সী পর্ব ৬১

প্রেয়সী পর্ব ৬১
নন্দিনী নীলা

বাসার সবাই রেডি হয়ে কমিউনিটি সেন্টারে চলে গিয়েছে। শুধু তিন্নি আর মধু যেতে পারেনি ওরা পার্লার থেকে রেডি হয়ে একেবারে যাবে। ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ফুয়াদ আসবে। সবাই মোটামুটি আগে চলে গিয়েছে পার্টিতে সব আত্মীয়-স্বজন প্রায় অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হয়েছে। সবাই এখন বর আর বউকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে নিয়ে বসে আছে।

সবাই হালকা কোলড্রিংস খাচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছে। এদিকে ফুয়াদ বাসা থেকে রেডি হয়ে তিনি আর মধুকে আনতে যাচ্ছে। মধু ফুয়াদের পছন্দ করা লেহেঙ্গা পরে একদম গর্জিয়াস সেজে আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখছে। এদিকে তিন্নি কে সাজানো হচ্ছে মধুর সাজ কমপ্লিট করে। মধুর ফোনে একটা মেসেজ আসলো। মধু বিভিন্ন ভাবে নিজের সেলফি তুলছিল। হঠাৎ তখন একটা মেসেজ টোন বেজে ওঠে সেলফি তোলায় ব্যাঘাত হা‌ওয়া তে মধু বিরক্ত হয়, মেসেজ ওপেন করে দেখে মেসেজে কি লেখা আছে। একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আই লাভ ইউ।”
মধু কপাল কুঁচকে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে আছে। আননোন নাম্বার থেকে এমন একটা মেসেজ কে পাঠালো আজব। এটা আবার ফুয়াদ নয় তো? নতুন নাম্বার নিয়েছে হয়তো ওকে টেনশনে ফেলার জন্য। ও ফুয়াদ ভেবে রিপ্লাই করল,,” আই লাভ ইউ টু।”

ফোনের ওপাশে থাকা লোকটা মধুর রিপ্লাই পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। এমন একটা রিপ্লাই আশা করছিল না। ও ভেবেছিল মেসেজ এ ঝাড়ি খাবে, বা রিপ্লাই পাবে না। কিন্তু এমন একটা রিপ্লাই অপ্রত্যাশিত ছিল।
ফুয়াদ পার্লারের সামনে এসে মধুকে কল করে ওদের হয়েছে নাকি জিজ্ঞেস করল।

মধু ফোন রিসিভ করে বলে,,,”আপনি খুব দুষ্ট হয়েছেন তো। এখনো আমার সাথে মজা করেন? কিন্তু আমি আপনার সব প্ল্যানে ধরে ফেলি বুঝছেন। আমাকে আর বোকা বানাতে পারবেন না আমি আর অযথা টেনশন করি না।”
“অযথা টেনশন করো না ভেরি গুড। কিন্তু আমি আবার তোমার সাথে কি মজা করলাম সুইট হার্ট!”

“এই যে আবার না বোঝার ভান করছেন। দেখুন একটু আগে আপনি একটা আননোন নাম্বার থেকে আমাকে, লাভ ইউ টেক্সট করছেন। আমি কিন্তু ধরে ফেলেছি ওটা আপনি‌ কারণ আপনি ছাড়া খুব অপরিচিত মানুষ আমার ফোন নাম্বার জানে না। আর এমন মজা আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারে না আমি জানি।”
ফুয়াদ কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ও আবার কখন আননোন নাম্বার ইউজ করে মধুকে আই লাভ ইউ টেক্সট করল?

মধু নিচে আসছি বলে ফোন কেটে দিল। ফুয়াদ ওভাবে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তিন্নি আর মধু বাইরে এসে দেখল ফুয়াদ চিন্তিত মুখে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
মধু তিন্নি কে বলল,, তুই গাড়িতে বস তোর ভাইয়ের সাথে আমার কথা আছে।”
তিন্নি গাড়িতে গিয়ে বসল। মধু ফুয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,”কি হলো এমন স্ট্যাচু এর মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

“তখন তুমি কি বললে? কে তোমাকে আই লাভ ইউ টেক্সট করেছে দেখি!” বলে ফুয়াদ হাত পাতলো ফোনের নেওয়ার জন্য।
মধু বলল,,”আবার না জানার ভান করছেন। এখন নিশ্চয়ই প্রমাণ করবেন আপনি কিছুই করেননি। ওটা আপনি না অন্য কেউ আমি কিন্তু এসব বিলিভ করবো না।”

ফুয়াদ হাত বাড়িয়ে আছে তাই মধু ফোন ফুয়াদের হাতে দিল। ফুয়াদ ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার চেক করল তার কাছে ও অপরিচিত নাম্বারটা।
এখন নাম্বারটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করার সময় নাই। অনুষ্ঠানে যেতে হবে। তাই নাম্বারটা একটু দেখে ওরা গাড়িতে উঠে বসলো। পরে এটা কার নাম্বার দেখা যাবে‌। ফুয়াদের পাশে মধু বসলো, পেছনে তিন্নি।

ওরা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। ফুয়াদ মধুর হাত ধরে সামনে যেতে লাগলো। মধু যখন হেঁটে ভেতরে যাবে তখন ওর উপর ফুলের বর্ষণ হবে এমন একটা সিস্টেম করা ছিল। সেটাই বাস্তবে ফুটে উঠলো। মধু এসব অ্যারেজমেন্ট দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। এসব দেখে ও শুধু মুগ্ধ হচ্ছিল। সময়টা খুব সুন্দর ভাবে উপভোগ করছিল।

মধুর জন্য ভেতরের আরেকটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল‌। মধু ভেতরে এসে দেখে ওর খালামণি আর ওর আম্মু অনুষ্ঠানে উপস্থিত। এতদিন পরে নিজের আম্মুকে আর খালামণিকে দেখে ও দৌড়ে তাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। কিন্তু এত ভারী লেহেঙ্গার জন্য দৌড় দিতে পারল না। চোখ ছলছল করে উঠলো ওর।
ও অবাক হয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,,”আম্মু খালামণি এখানে কি ভাবে?”

“এটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ মাই সুইট হার্ট। এমন একটা বিশেষ দিনে তোমার পরিবারের কেউ থাকবে না তা কি হতে পারে? আমি তোমাদের বাসায় ইনভাইট করেছিলাম। কিন্তু তোমার ভাই তো জেলে সে আসতে পারবে না আর তোমার বাবা তো আসবেই না। পরে তোমার খালামণির সাথে যোগাযোগ করলাম সে তো শুনে আসবে বলল। আর বললাম তোমার মাকে কোনো ভাবে নিয়ে আসতে।”

মধু ছলছল চোখে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আমার এখন আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে আপনি এত ভালো কেন?”
” ধরোনা আমি তো তোমারই কেউ কিছু মনে করবে না।”
মধুর চোখে সুখের পানি ওর এতো খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারবে না। আনন্দে ওর চোখে জল চলে এসেছে। ফুয়াদ ওর চোখে জল দেখে বলল,,”আমার এত টাকার সাজ নষ্ট করো না জান। মোটা অংকের টাকা পার্লারের মহিলাকে দিয়ে আসতে হলো। অনুষ্ঠানের শুরুতেই যদি কান্নাকাটি করে সব নষ্ট করে ফেলো তাহলে কি হবে এখনো তো ফটো শুটিং বাকি আছে।”

বলে ফুয়াদ একজনকে ডেকে টিস্যু নিল তারপর মধুর চোখের কোনা আস্তে আস্তে মুছে দিল তারপর ওকে নিয়ে শাশুড়ি ও খালা শাশুড়ির কাছে নিয়ে আসলো। তারা নাফিসা বেগম ও আনিতা বেগমের সাথে কথা বলছিল।
মধুকে দেখে মধুর মা বুকে জড়িয়ে নিলো। মধু ও নিজের মাকে দুই হাতে জাপ্টে ধরল। কতদিন পর মমতাময়ী মা কে কাছে পেল। জড়িয়ে ধরতে পারলো চোখের পানি আটকাতে পারছে না কোনভাবেই।

মধুর চোখের নিচে মেকআপ চোখের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। মধু কে তিন্নি ভেতরের একটা রুমে নিয়ে গেছে। নিজেদের কাছে থাকা এক্সট্রা মেকআপ দিয়ে আবার জায়গাটা ঠিক করতেছে। আর ফুয়াদ নিজের ফ্রেন্ড সার্কেল নিজের কাজের জায়গার সবাইকেই ইনভাইট করেছে। সবাই মোটামুটি এসেছে। সবার সাথে কথা বলছে সবাই শুধু মধুকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। মায়ের সাথে কথা বলে তখন মধু ভেতরে চলে গেছে কান্নাকাটি করে। এক ঝলক সবাই দেখেছে কিন্তু ভালো করে কথা বলা হয়নি। এজন্য সবাই কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। ওদেরকে কথা বলবে মধু বলে ফুয়াদ মধুর খোঁজ নেওয়ার জন্য আসলো ভেতরে।

ফুয়াদ এসে দেখে তিন্নি মধুর মুখ ঘষাঘষি করছে অনেকটাই ঠিক করেছে। তিন্নিকে বের করে দিয়ে ফুয়াদ ভেতরে এসে মধু হাত ধরে একটা চুমু খেয়ে বলে,,” আমার এত টাকা নষ্ট করে এতো সাজগোজ করে কি হলো? কান্নাকাটি করে সব ঘেঁটে দিলে। এজন্যই বলেছিলাম পার্লারে আসতে হবে না তুমি এমনিতেই সুন্দরী। তোমাকে পার্লারের না সাজলেও সুন্দর লাগে। কিন্তু তখন তো আমার কথা শুনলে না। তোমার নাকি বিয়েতে কোন শখ পূরণ হয়নি তাই এখন তুমি মন মত সাজবে। নিজের সব শখ পূরণ করবে।”

“আপনি এত কৃপণ আগে জানা ছিল না তো‌। সেই তখন থেকে শুধু এক কথায় বলে যাচ্ছেন। বউকে একটু সাজার জন্য টাকা খরচ করেছেন তাই নিয়ে খোটা দিয়েই যাচ্ছেন দিয়েই যাচ্ছেন।”
মধুর অভিমানী কণ্ঠ শুনে ফুয়াদ হো হো করে হেসে উঠল।

মায়ের হাতেই খাবারটা খেল মধু তৃপ্তি করে। মধুর মা নাফিসা বেগমের হাত ধরে বললেন,, “আপা আমার একটাই মেয়ে আপনি এখন ওর গার্জেন মারবেন কাটবেন আবার আদর করবেন মেয়েটাকে আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছি। ওর বাবার যা রাগ মেয়েকে কোনদিন কাছে টেনে নেবে নাকি জানিনা। আজকে এখানেও এসেছি অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে। বাসায় গেলে আমার জন্য কি ওয়েট করছে আমি জানিনা। আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন। ছেলেমানুষি কিন্তু ওর মনটা ভালো আপনি যেমন বলবেন ও সেভাবে নিজেকে তৈরি করবে। মায়ের মত ওকে ভালোবাসা দিয়েন।”

নাফিসা বেগম কিছু বলতে পারলেন না। মধুর মা ফুয়াদ কেউ বললেন,,”বাবা এখন তুমি ওর সব তুমি ওর একমাত্র অভিভাবক। আমি জানি আমার মেয়ে তোমার কাছেও খারাপ থাকবে না তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো। তাকে দেখে রাখবে। তবুও বলবো কখনো কেনো ভুল করলে আমার মেয়েটাকে ক্ষমা করো। ‌ তোমার উপর ভরসা করে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি ওর হাত ছেড়ো না। সারা জীবন ওর হাতটা শক্ত ধরে রেখো। তুমি ওর একমাত্র আশ্রয়, ভরসার জায়গা তুমি ওকে কখনো ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না।”

“আপনি চিন্তা করবেন না যতদিন আমার নিঃশ্বাস চলবে মধু কে আমি আমার প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবো।”
যখন মধুর খালামণি আর মধুর মা চলে গেল তখন মধু আবার কান্না শুরু করে দিল। মাকে কোনভাবেই ছাড়তে মন চাইছিল না। মধুর মন বলছিল মা কে ও যদি নিজের সাথে রাখতে পারতাম। ফুয়াদ মধুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে রেখেছিল। মধু ফুয়াদের বুকে মাথা রেখে পাগলের মত হাউমাউ করে কান্না করছিল।

ফুয়াদ মধু কে অনেক কষ্টের শান্ত করে রেখে একটু বাইরে যায় কারণ ওকে ওদের স্যার কল করেছে। জরুরী কিছু কাজে ও বাইরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। কথা শেষ করে ভেতরে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে। মধুকে নাফিসা বেগম বুকে জড়িয়ে রেখেছে মধু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। নাফিসা বেগম মধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দৃশ্যটা দেখে ফুয়াদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। ও আর মধুর কাছে গেল না। বাইরে গিয়ে নিজের ফ্রেন্ড সার্কেলকে বিদায় জানালো।

মাকে আর মধুকে আবার এক হতে দেখে ওর খুবই ভালো লাগছে। দুজনের মধ্যে রাগ অভিমান সব ভুলে আবার এক হচ্ছে দেখে শান্তি অনুভব করে।
ফুয়াদ সবাইকে বিদায় জানায় সব আত্মীয়স্বজনরা চলে যায় অনুষ্ঠান শেষ করে। এবার শুধু ওদের পরিবারের লোকগুলো আছে। সবাই ভেতরে এখন একে একে ওরাও চলে যাবে। ও সবাইকে বিদায় জানিয়ে ভেতর আসছিল। তখনই পেছন থেকে কেউ ওকে মাথায় আঘাত করে আচমকা আঘাতে ফুয়াদের হাতে থাকা ফোন নিচে পড়ে যায়।

আঘাতটা এতটাই জোরে ছিল যে ওর চোখে সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে। ফুয়াদ দু হাতে মাথা ধরে নিচে বসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ফুয়াদ এর মাথায় আরেকটা বাড়ি মারা হয় এবার আর বসে থাকতে পারেনা। নিজের শরীরে ভারসাম্য হারিয়ে শুয়ে পড়ে কপাল বেয়ে রক্তের বন্যা নামতে থাকে। চিৎকারটা দেওয়ার সময়টা অব্দি পায় না।

প্রেয়সী পর্ব ৬০

ভেতরে কেউ জানতেও পারে না এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল ফুয়াদের সাথে। মধু ভাবতেও পারবেনা মায়ের চলে যাওয়ার শোক কাটাতে না কাটাতেই আর একটা দুঃসংবাদ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।

প্রেয়সী পর্ব ৬২