প্রেয়সী পর্ব ৬২

প্রেয়সী পর্ব ৬২
নন্দিনী নীলা

মধু হসপিটাল কডিটরে বসে কান্না করেই যাচ্ছে। ওর কান্না কিছুতেই থামছে না। চোখ দিয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে অনবরত কাঁদতে কাঁদতে ওর গলা ভেঙ্গে গেছে। হসপিটালে অধিকাংশ মানুষই ওর দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। সবাই হয়তো ভাবছে এতো সেজেগুজে মেয়েটা এখানে বসে আছে আজকে কি মেয়েটার বিয়ে ছিল নাকি? সবাই আহারে আহারে করছে।

কেউ কেউ এসে ওকে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? কার কি হয়েছে? আজ কি তোমার বিয়ে ছিল? নানান প্রশ্ন করছে। কিন্তু মধু না কারো দিকে তাকিয়েছে আর না কারো প্রশ্নের কোন জবাব দিয়েছে। ও কি কারো কথার জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় আছে? ওর হাতে ফুয়াদের মাথার রক্ত লেগে আছে। গাড়িতে ফুয়াদের রক্তমাখা মাথাটা ওর কোলেই ছিল‌। মধু নিজের লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের লাল রক্ত লেগে কালো হয়ে আছে।
কে এটা করল ওদের সাথে? কে ওদের সুখের পথে আবার বাধা এনে দিল!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হসপিটালে এসেছে মধু, ফুয়াদের বাবা, মা, চাচা ও রাহী। আর সমুদ্রের সাথে এখনো কন্টাক্ট করা যায় নি। রাহী এখনো সমুদ্রের সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করছে সে না হয় বেড়াতে গিয়েছে তাই বলে কি ভাইয়ের এই অবস্থা সে কি সেই খবরটা নিতে পারবেনা। এতোটা কেয়ারলেস ভাইয়া কবে হয়ে গেল?
এখন ভাইয়ার এখানে থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। নাফিসা বেগম হসপিটালে ভর্তি। একবার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তার যা অবস্থা হয়েছিল। এবার রক্তাক্ত ছেলেকে দেখে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন। দৌড়াদৌড়ি করছে ফুয়াদের বাবা আর চাচা।

রাহী নাফিসা বেগমের কেবিন থেকে বেরিয়ে মধুকে খুঁজতে আসলো। দেখলো মধু এখনো সেখানেই বসে কেঁদে যাচ্ছে। সাজগোজ নষ্ট হয়ে মুখের বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। গাড়িতে ওঠার আগে আনিতা বেগম গলার কানের স্বর্ণের গহনা গুলো খুলে নিয়ে গেছে বাসায়। হাত ভর্তি চুড়ি আর চুল এলোমেলো হয়ে একদম পাগলের মতো দেখা যাচ্ছে। লেহেঙ্গাটাও অবস্থা নাজেহাল রক্তে মাখামাখি।

ওড়না হসপিটালের ময়লা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দুজন মহিলা ওর পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বলে উত্তর না পেয়ে পাশে ফিসফিস করছে আর কেমন টেড়া চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। খুব বিরক্ত লাগল রাহীর। এরা রোগীর আত্মীয় হবে হয়তো। কিছু কিছু রোগীদের আত্নীয় আছে যারা সপ্তাহ খানিক রোগীর সাথে আসে থাকে। এরা রোগীর সেবা যত্ন করার থেকেও হসপিটাল ঘুরে ঘুরে কয়জন রোগী এডমিট হচ্ছে তাদের কেবিনে উঁকি ঝুঁকি মারে।

এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। এটা বোঝার চেষ্টা করে না হসপিটালে কেউ আনন্দে আসেনা। সবাই আসে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে‌। তারা এমন সবার কাছে নিজের হিস্টরি বলার জন্য বসে থাকে না। সেইটা বলার মত মন মানসিকতা থাকে না। কিন্তু তাদের অতিরিক্ত কৌতুহল দেখে মনে হয় যেন সব রোগীর সাথে মানুষ আসে তাদের কাছে এসব গল্প করে বেড়ানোর জন্য।

রাহী মধুর কাছাকাছি এসে ওর কাঁধে হাত রেখে ওর পাশে বসলো‌।
তারপর মহিলা দুটি দিকে তাকিয়ে বলল,,,” কোন সমস্যা আন্টি কিছু বলবেন?”
মহিলা দুটো কথা শুনে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,,”কতক্ষণ ধরে দেখছি মেয়েটা কাঁদছে তাই একটু মায়া হল তাই আসলাম একটু জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। কার কি হয়েছে? কিন্তু কি দেমাক না কথার উত্তর দিল আর না তাকাল।”
রাহী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,” কি দেমাক দেখলেন আন্টি? দেখতে পারছে ওর মানসিক অবস্থা কতটা খারাপ। ওকে দেখে আপনি বুঝতে পারছেন না ওর কি অবস্থা? এরকম ভাবে কেউ হসপিটালে আসে ও কি এখন আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় আছে?”

রাহীর রাগী গলায় কথা শুনে মহিলা দুটো বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে চলে গেলেন।
” মধু তুমি বাসায় চলে যাও, ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নাও। এদিকটা আমরা সামলাচ্ছি‌।”
মধু রাহীর দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলল,,” আপু উনি ঠিক আছে তো বলো না। এসব কি হয়ে গেল! কেন হলো?”

রাহী মধুর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,,” ডক্টর তো দেখছেন ভাইয়া কে। তুমি টেনশন করো না ভাইয়া একদম ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নাও। কেমন দেখা যাচ্ছে এভাবে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে।”
” আমি বাসায় যেতে পারবো না আপু। ওনাকে এখানে রেখে আমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে পারবো না।”
বলে মধু আবার ফুঁপিয়ে উঠলো।

সারারাত আর কাউকে ফুয়াদের কেবিনে ঢুকতে দেওয়া হলো না। তারা তাদের মত চিকিৎসা করছে। মধু কে কোনভাবে বাসায় পাঠানো গেল না তাই রাহী মধুর সাথে থেকে গেল। পরদিন সকালে মধুকে জোর করে রাহী বাসায় নিয়ে গেল। মধুকে গোসল করিয়ে ফ্রেশ করে খাবার খাওয়ার জন্য তিন্নি রাহী
অনেক জড়াজড়ি করতে লাগলো কিন্তু মধু কে এক দানা খাবারও কেউ মুখে দিতে পারল না। মধু ফ্রেশ হওয়ার পর থেকে শুধু হসপিটালে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। কারণ ডাক্তার বলেছে দশটার পর রোগীর সাথে দেখা করা যাবে। তাই ও আবার হসপিটালে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

রাহি বলছে, “একটু বিশ্রাম করো, একটু ঘুমিয়ে নাও তারপরে যেও।”
কিন্তু মধু বলছে, ওর কোন বিশ্রামের প্রয়োজন নাই।
ফাহাদ, তিন্নিও এবার রাহী আর মধুর সাথে হসপিটালে আসল। নাফিসা বেগম সকাল থেকে অনেকটা সুস্থ ফুয়াদের লাইফ রিক্স নাই শোনার পর থেকে।

একজন একজন করে দুজনকে দেখা করতে যাওয়ার কথা বললেন ডক্টর। কারণ ফুয়াদ মাথায় আঘাত পেয়েছে আঘাতটা ভালোই গুরুতর হয়েছে। এখন রোগীর কাছে বেশি মানুষ গেলে রোগী উত্তেজিত হয়ে বেশি কথা বলতে চাইতে পারে এতে তার মাথায় চাপ পড়বে।

প্রথমে গেল নাফিসা বেগম ডক্টর বারবার করে বলে দিলেন গিয়ে যেন বেশি কান্নাকাটি না করে। রোগীকে যেন বেশি উত্তেজিত না করে। নাফিসা বেগম গিয়ে কান্নাকাটি করে এক খান করে দিলেন তাই তাকে বেশিক্ষণ থাকতে দিল না জোর করে বের করে দিলেন। এরপরে মধুকে পাঠালো। মধু ভিতরে গিয়ে দেখল ফুয়াদকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে ওর চোখ খোলা।

মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ফুয়াদে এমন অবস্থা দেখে ওর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। ও শব্দ করে কান্না না করলেও চোখের পানি কিছুতেই বাদ মানল না টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো।
ফুয়াদের এক হাতে স্যালাইন লাগানো। রাতে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে শরীর থেকে আর মাথায় আঘাতের জন্য উঠে কিছু চিবিয়ে খাওয়ার মত অবস্থা নাই এজন্য সকাল থেকে স্যালাইন চলছে।

বাম হাতে ক্যানেলা লাগানো ডান হাত দিয়ে মধু কে দেখে ফুয়াদ কাছে ডাকলো। মধু কাছে যাওয়ার সাহস পেলো না। দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো মুখে হাত চেপে। মুখে অক্সিজেন মাক্স তাই ফুয়াদ কথা বলতে পারছে না। মধু কাছে যাচ্ছে না এজন্য বাধ্য হয়ে ডান হাত উঁচু করে মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্স খুলে ফুয়াদ বলল,,” আমার কাছে আসো।”

মধু দুহাতে চোখের পানি মুছে কান্না আটকানো বৃথা চেষ্টা করে ফুয়াদের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ডান হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দুই তিনটা চুমু খেল।
তারপর কান্না মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞেস করল,,”এসব কি হয়ে গেল। আপনাকে আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না। কে আপনার এ অবস্থা করেছে?”
মধুর কথায় ফুয়াদ দূর্বল হাসি দিল।

“এক রাতে স্বামীর বিরহে এই অবস্থা? সুইট হার্ট তুমি তো দেখি সত্যিই আমার প্রেমে পড়ে গেছ।”
“এ অবস্থা তেও আপনার মজা করতে হচ্ছে। আপনার কিছু হলে আমি মরেই যেতাম। আপনার ঐ অবস্থা দেখে আমার কি অবস্থা হয়েছিল জানেন? বুকের ভেতরটা এখনো কাঁপছে আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। আমাদের সুখে কার নজর পড়লো বলেন তো।”

” তোমার ছোট্ট মাথাটায় এতো চাপ নিও না সুইটহার্ট। আমার কিচ্ছু হয়নি দেখো একদম ফিট আছি।”
“হ দেখতে পাচ্ছি কত ঠিক আছেন। এতো কথা বলতে হবে না। ডক্টর কথা বলতে মানা করেছে চুপ করে থাকেন।”
ফুয়াদের কপালের ব্যান্ডেজে মধু কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল একটু ছুঁয়ে দিল।
ফুয়াদ মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কিন্তু সুইটহার্ট তুমি টেনশন করো না। যে বা যারা এ কাজ করেছে তারা পার পাবে না। ফুয়াদের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে রাত থেকে মনে হয় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ।”

মধু বলল,,” আপনার এই অবস্থা আর আমার গলা দিয়ে কি খাবার নামবে? আপনি নিজেও তো না খেয়ে আছেন।”
ফুয়াদ ক্যানেলা লাগানো হাত দেখিয়ে বলল,,” আমার খাবার তো যাচ্ছেই কিন্তু তোমার যা দেহ। গায়ে একটু জোড় নাই আবার এতো সময় না খেয়ে আছো এখনি খাবার খাবে যাও।”

” আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান।”
” আমি ঠিক আছি। তুমি টেনশন নিও না।”
মধু কেও নার্স এসে বের করে দিল আর থাকতে দেবে না তাই।
দুইদিন হসপিটালে থাকতে হবে। অনেক বলেও ছুটি পেল না। নাফিসা বেগম কে জোর করে বাসায় নিয়ে গেল রাহী। হসপিটালে র‌ইল শুধু মধু আর রাহী।

রাতে আরেক বিপদ ওত পেতে ছিল ওদের জন্য। ফুয়াদের কেবিনে কাউকে থাকার নির্দেশ দিলো না। রাহী আর মধুর জন্য পাশে আলাদা একটা কেবিন নেওয়া হলো। মধুর সে রুমে একটু ও মন টিকছিল না ফুয়াদদের মাথা যন্ত্রণা উঠেছিল এজন্য ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়। মধু এগিয়ে কিছুক্ষণের পাশে বসে থেকে আসলো। তখন ফুয়াদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

রাহী বলল,,,”ভাইয়া এখন ঘুমাচ্ছে। চলো আমরা একটু বিশ্রাম নেই। পরে কিন্তু তোমাকেও হস্পিটালাইজ করতে হবে। আমি কি আর কারো জন্য হসপিটালে থাকতে পারবো না।”
কষ্টের মাঝেও রাহীর কথা শুনে মধুর হাসি পেয়ে গেল। বিয়ে হয়েও রাহী আপু আগের মতই চটপটে টাইপের রয়ে গেছে এখনো। রাহী আর মধু বেরিয়ে আসার আগে নার্স কে বলে এলো সে যেন তার ডিউটি ঠিক মত করে। ফুয়াদ দেখভাল যেন ভালো করে করে।

প্রেয়সী পর্ব ৬১

রাহী আর মধু কেবলি শুয়েছে ওদের কেবল একটু ঘুম ধরেছে তখনই বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামিচের শব্দ পেয়ে ওরা ধরফরিয়ে ওঠে। দুজনে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখে ফুয়াদের কেবিনে থাকা নার্স চিৎকার চেচামেচি করছে।

প্রেয়সী পর্ব ৬৩