প্রেয়সী পর্ব ৬৪

প্রেয়সী পর্ব ৬৪
নন্দিনী নীলা

রাতে ফুয়াদের কথা শুনে মনে হয়েছিল ওর মুড ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু পরদিন সেই এক‌ই আচরণ। সকালে মধু আবার দেখল ফুয়াদ মুখটা গম্ভীর করে বসে আছে। ইদানিং বাসা থেকে বের হচ্ছে না বেশি, কি অদ্ভুত যাকে জোর করে বাসায় রাখা যায় না। সে এখন বের হতেই চাইছে না। মধু সকালে উঠে রান্নাঘরে আসলো। দেখল বিশাল আয়োজন চলছে।

ও আনিতা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন মেহমান আসবে নাকি।
আনিতা বেগম মাথা নাড়িয়ে স্বীকার করল। মধু বলল,,” আমি কফি দিয়ে এসে হাতে হাতে হেল্প করে দেব আন্টি।”
” ইচ্ছে হলে এসো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মধু কফির মগ নিয়ে রুমে এসে ফুয়াদ কে দেখল বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। এই মাত্র ও ভাবছিল বাসা থেকে বের হচ্ছে না এখনি বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে।
মধু কপাল কুঁচকে এগিয়ে এসে বলল,,” আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”
ফুয়াদ হ্যাঁ যাচ্ছি বলল‌। মধু অবাক হ‌ওয়া কন্ঠে বলল,,” ক‌ই আমাকে কিছু বললেন না যে।”
” এখন তো বললাম।”

” এখন কোথায় বললেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম বলেই তো বললেন। নয়তো বলতেন‌ই না মনে হচ্ছে।”
ফুয়াদ মধুর হাত থেকে কফির মগ নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,,” মধু সামান্য জিনিসটা কে কেন জটিল করছো?”
” আমি কোথায় জটিল করলাম? আপনার চোখে মুখে আমি স্পষ্ট বিরক্ত দেখতে পাচ্ছি। আমার উপস্থিতি আপনাকে স্বস্তি না দিয়ে অস্বস্তি কেন দিচ্ছে! এটাই আমি বুঝতে পারছি না।”
” আমি একটু কাজে যাচ্ছি অনেকদিন ধরে যেতে পারছি না। এখন প্লিজ ঝামেলা করো না আমাকে একটু শান্তিতে যেতে দাও।”

মধু বলল,,” আমি আপনাকে অশান্তি দেই এটাই বুঝাতে চাইছেন তাই না? এখন আর আমাকে আপনার ভালো লাগছে না। আগে আপনার কথার মাঝে যেই ভালোবাসা পেতাম এখন আর তার কিছু পায় না। সব ভালোবাসা বুঝি হাওয়া হয়ে গেল বিয়ে হতেই?” বলতে বলতে মধু কান্না করে দিল।

মধু অভিমান আর ধরে রাখতে না পেরে মনে যা ছিল ইচ্ছে মতো সব বলে কাঁদছিল। হঠাৎ জোরে কিছু আছড়ে পড়ে ভেঙে যাওয়ার শব্দে ও চমকে উঠে। ভালো করে খেয়াল করে দেখে ফুয়াদ রাগে নিজের হাতে থাকা কফির মগ ফ্লোরে আছড়ে ফেলেছে। ফুয়াদের মুখটা রাগে রক্তবর্ণ ধারণ করছে। মধু দুহাতে মুখ চেপে ধরে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে।

সামান্য কারণে ফুয়াদ নিজের ফেবারিট মগ ভেঙে ফেলবে ও বিলিভ করতে পারছে না। মধু হতবিহ্বল চক্ষে সুন্দর মগটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে দেখল। ফুয়াদ মগটা ভেঙে হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এখানে থাকলে আরো বাজে কিছু ঘটাবে তার থেকে চলে যাওয়া উত্তম। মধুর রুমে দৌড়ে এলো তিন্নি কেবলি ঘুম থেকে উঠেছে ও তখনি ফুয়াদের রুম থেকে কিছু ভাঙার আওয়াজ আসে ও তাই দৌড়ে এসে দেখে ফুয়াদ বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। আর ভেতরে এসে দেখে মধু মুখে হাত দিয়ে কাঁপছে ওর সামনে ভাঙা মগ পড়ে আছে। ও মধুর কাঁধে হাত রেখে বলল,,” মধু কি হয়েছে? এই মগটা ভাঙলো কিভাবে?”

মধু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিন্নি ওর কান্না দেখে আরো বিস্মিত হলো। মধু হেঁচকি তুলে কাঁদছে তিন্নি ওকে ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল,,” আরে কাঁদছিল কেন? তোর হাত থেকে পড়ে ভাঙছে নাকি? ভাঙলেও কি হয়েছে এই সামান্য মগের জন্য কাঁদছিল কেন এমন করে। দেখ ভাইয়ার এটা পছন্দের ছিল জানি এজন্য এতো কাঁদার কি আছে। এমন আরেকটা মগ কিনে আনলেই হবে।”

মধু কান্না মিশ্রিত গলায় বলল,,” আমার হাত থেকে পড়ে ভাঙে নাই। ফুয়াদ ইচ্ছে করে আমার সাথে রাগ দেখিয়ে এটা ভেঙেছে। আমি তাকে চিনতে পারছি না রে আমার সাথে এতো রুড আচরণ কেন করছে? কি করেছি আমি?”
তিন্নি নিজেও শঙ্কিত হয়ে শুনলো সবটা। ও নিজেও বিলিভ করতে পারছে না ভাইয়া মধুর সাথে এমন আচরন করতেছে। ভাইয়া মধু কে কতটা ভালোবাসা সবাই ওরা জানে।

তাই তার থেকে এই ব্যবহার শুনে ও নিজেও স্তম্ভিত।
কাজের মেয়েকে ডেকে রুম পরিষ্কার করতে বলল তিন্নি। তারপর তিন্নি মধুকে নিয়ে নিচে আসলো। তিন্নি রান্না ঘরের দিকে চেয়ে দেখল ওর মা রান্নাঘরে বিশাল আয়োজন শুরু করেছে। ও কপাল কুঁচকে মধু কে সোফায় বসিয়ে রেখে রান্না ঘরে উঁকি মেরে বলল,,” আম্মু এতো রান্নার আয়োজন করেছ যে? কোন স্পেশাল গেস্ট আসবে নাকি?”
আনিতা বেগম বললেন,,” হ্যাঁ আসবে তাড়াতাড়ি আয় একটু কাজ করে দে। মধু বলল আসবে ক‌ই সে মেয়ের তো আর পাত্তা নাই। তুই আয়।”

তিন্নি চোখ কপালে তুলে কাজ করা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এলো। আজকে সেই ছেলেটা তার মাকে নিয়ে আসবে বলেছে ওকে। আর এদিকে মা ও কি সুন্দর আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। কিছু‌ই‌ তো বুঝতে পারছি না এসব হচ্ছে টা কি?

তিন্নি মধুর পাশে এসে বসে দেখল সামনের সোফায় নাফিসা বেগম বসে পান খাচ্ছেন। চাচি কখন আসলো। তিন্নি মাথা নিচু করে ফিসফিস করে মধুর কানে কানে জিজ্ঞেস করল মায়ের কোন গেস্ট আসবে ও কিছু জানে নাকি!
মধু বলল, ও কিছু জানে না।
নাফিসা বেগম পান মুখে দিয়ে বলল,,” মধু কি হয়েছে! মনে হচ্ছে সকাল সকাল কেঁদেছো!”

মধুর সাথে নাফিসা বেগম এর অনেকটাই সম্পর্ক সহজ হয়ে উঠেছে। এখন আর নাফিসা বেগম ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। মধু সব বলতে গিয়েও থেমে গেল। স্বামীর নামে শাশুড়ির কাছে বদনাম করার ইচ্ছে জাগলো না মনে। তিন্নি বলতে যাচ্ছিল মধু তিন্নির হাত খামচে ধরে মাথা দিয়ে না বুঝায়। কিন্তু তিন্নি ওর কথা শুনলোই না। গড়গড় করে সব বিস্তারিত বলে দিল।

নাফিসা বেগম সব শুনে ফুয়াদ কে নিচে ডাকল কিন্তু ফুয়াদ তখন বাসায় নাই। তাই‌ তিনি কল লাগল ফুয়াদের নাম্বারে। ফুয়াদ ফোন রিসিভ করতেই বললেন,,” এখুনি বাসায় এসো।”
ওপাশ থেকে কি বলল ফুয়াদ ওরা কেউ শুনলো না। তিন্নি হাঁসফাঁস করছে নাফিসা বেগম কে জিজ্ঞেস করবে নাকি কে আসবে আম্মুর গেস্ট হয়ে। কিন্তু জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না। ভয় করছে কেন জানি।

অবশেষে তিন্নি জানতে পারল ওর মামা মামি আসছে। ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তবুও ভয় আছেই ওই ছেলেটা না‌ জানি কখন চলে আসে? সত্যি আসবে নাকি ওকে ভয় দেখাচ্ছে! সারাদিন আর ফুয়াদ বাসায় ফিরল না। এদিকে তিন্নির মামারা আসবে বলেছিল দুপুরের আগেই। তাই রান্না বান্না সব বারোটার আগেই কমপ্লিট করে ফেলেছে। এদিকে তারা এসে পৌঁছিয়েছে ৫ টায়।

তারা আসছিল রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তা নিয়ে রাস্তায় জ্যাম পড়েছে। সেজন্য তাদের রাস্তায় দুই ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। আনিতা বেগম ভাই, ভাইয়ের ব‌উ ও ভাইয়ের ছেলেকে এতোদিন পর পেয়ে আদর আপ্যায়ন করতে উঠেপড়ে লাগল। এদিকে তিন্নি সারাদিন পেরিয়ে গেছে তাই শান্তিতে কানে হেডফোন দিয়ে বসে গান শুনছে নিজের রুমে। ছেলেটা অযথাই ওকে ভয় দেখিয়েছে। ক‌ই আসলো না তো।

কিন্তু তাও ওর বুকের ভেতরে একটু কষ্ট অনুভব হচ্ছে এতো দিন ধরে একটা ছেলে ওকে ফলো করে, কল করে। ভালোবাসি বলে কিন্তু অদ্ভুত তাকে এখন অবধি ও এক বার দেখতে পারলো না। আসলে দেখা হতো। তিন্নি রুম অন্ধকার করে বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিল কানে হেডফোন দিয়ে।‌

তখনি কেউ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে ও আচমকা একটা পুরুষের কন্ঠ শুনে ভয়ে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে। অন্ধকারে তিন্নি সামনে কারো উপস্থিতি টের পায়।‌ তিন্নি ভয়ে ভীত হয়ে বলে,,” কে কে?”
একটা হাসির শব্দ আসে। তিন্নি ভয়ে তোতলাতে থাকে।

” কে আ পনি আ মার রু‌ মে আসলেন কী ভাবে? হাসছেন কেন অদ্ভুত?” ভয়ে তিন্নি তরতর করে ঘামছে। ও কপাল ও মুখের ঘাম হাত দিয়ে মুছে তাড়াতাড়ি উঠে লাইট অন করে। সারা রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে রুমে ও ছাড়া আর কেউ নেই। কি অদ্ভুত তাহলে হাসলো কে?
জোরেই কথাটা বলল তিন্নি,,,রুমে তো কেউ ছিল গেল কোথায়? ওর গলা শুকিয়ে আসছে সব কিছু অদ্ভুতুড়ে হচ্ছে।
তখনি বেলকনিতে থেকে কেউ ওকে ডেকে উঠল,,” তিন্নি আমি এখানে বেলকনিতে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। এখানে এসো।”

তিন্নি বেলকনিতে থেকে কথার আওয়াজ শুনে ভয়ে এক চিৎকার দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ওর চিৎকার শুনে মধু নিজের রুমে থেকে ছুটে আসে।
” কি হয়েছে তোর এতো জোরে চিৎকার করছিস কেন? ভয়ে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল।”
তিন্নি মধুকে জাপটে ধরে বলে,,” কে জানি আমার রুমে। ভূতের মতো হাসছিল এখন আমাকে বেলকনিতে ডাকছে। দোস্ত আমি খুব ভয় পাইছি আমার সাথে একটু আয় না।”

” তোর মামা মামি আসছে একটু আগে। এমন করে চিৎকার করিস না উনারা তোকে পাগল ভাববে। চল দেখি কোন ভূত আসলো আমার বান্ধবীকে ভয় দেখাতে।”
মধু আগে আগে যাচ্ছে তিন্নি ওর পিছনে। মধু শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে যথেষ্ট সাহসী হয়ে বেলকনিতে গেল তিন্নি ওর পিছনে থেকে উঁকি মেরে দেখে ওর মামাতো ভাই কাওসার বসে আছে। মধু অপরিচিত এক ছেলেকে বান্ধবীর রুমের বেলকনিতে বসে থাকতে দেখে রেগে কিছু বলতে যাবে। তখন ৪৪০ ডিগ্রি রাগ নিয়ে চিৎকার করে উঠে তিন্নি,,” কাওসার ভাই আপনি আমার রুমে এসে আমাকে ভয় দেখিয়েছেন?” দাঁত কিড়মিড় করে বলল।

মধু তিন্নি কে বলল,,” তুই চিনিস এই লোককে?”
তিন্নি বলল,,” হ আমার মামাতো ভাই।”
“ও তাইলে তো আর আমার কোন কাজ নাই তুই তোর ভাইয়ের সাথে কি করবি কর আমি যাই।”
মধু তিন্নি কে রেখে চলে গেল। তিন্নি রাগে চেঁচিয়ে উঠে বলল,,” আপনি তখন হাসছিলেন?”
কাওসার ফের তেমন করেই হেসে বলল,,” হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এতো ভীতু জানা ছিল না তো!”

তিন্নি বলল,,” ওমন করে কেউ হাসে। আপনি আসবেন জানতাম না তো। আমি তো ভেবেছি শুধু মামা মামি এসেছে। আর আপনি আমার সাথে তুমি করে কথা বলছেন কেন?”
” খালি শশুর শাশুড়ি আসলে কি হবে জামাই কেউ তো আসতে হবে।”
” শশুর, শাশুড়ি কি সব বলেছেন মাথা খারাপ হলো নাকি আপনার?”

কাওসার তিন্নি ফোন কল দিল। তিন্নি রাগে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোন টিপতে দেখে। তিন্নির ফোন বিছানায় ছিল বাজছে দেখে ও রুমে এসে দেখে সেই রং নাম্বারে থেকে কল ও ফোন কেটে দিল। ফোন দিয়েই বেলকনিতে আসলো। দেখল আবার কল এসেছে ও কাটতে যাবে কাওসার বলল,,” আরে কাটছিস কেন!”
তিন্নি চোখ কপালে তুলে বলল,,” এটা আপনার নাম্বার?”

প্রেয়সী পর্ব ৬৩(২)

কাওসার দাঁত কেলিয়ে বলল,,” হ্যাঁ।”
তিন্নি চিৎকার করে উঠল। কাওসার কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলল,,” কান ফেটে গেল আমার।”
” আপনার এতো বড়ো সাহস আমার সাথে মজা করেন। আমি এখুনি নিচে যাচ্ছি আপনার নামে মামার কাছে বিচার দিতে।”

প্রেয়সী পর্ব ৬৫