বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ গল্পের লিংক || জাওয়াদ জামী

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১
জাওয়াদ জামী

” এইযে সিনিয়র রাশেদিন, এভাবে কতদিন বসে বসে খাবে? আমার মনে হয়, তোমার বাবা তোমার মত একজন অকর্মন্য সন্তানকে নিয়ে সারাজীবন আফসোস করে গেছেন। খালি বসে বসে খাওয়া, আর ভুঁড়ি প্রসারিত করাই তোমার কাজ। এভাবে জ’ল’হ’স্তি’র মত বসে থাকার কারনে মস্তিষ্কের বুদ্ধি এসে ভুঁড়িতে জমা হয়েছে। অবশ্য এটা আমার একান্তই নিজের মনোভাব। এভাবে বসে না থেকে সংসারের কাজকর্মও তো করতে পার। ” তাহমিদ বার্গারে কামড় দিয়ে, মুখ ভর্তি বার্গার নিয়ে কথাগুলো বলে।

” আফরোজা, তোমার এই অ’স’ভ্য, ব’র্ব’র, বেয়াদব ছেলেকে চুপ করতে বল। ওকে মনে করিয়ে দাও, আমি ওর বাপের বড় ভাই, ওর দুলাভাই নই। নেক্সট টাইমে যেন আমার সাথে এভাবে কথা না বলে। আমি ওর বাপেরও খাইনা, আর আমার বাপেরও খাইনা। আমি নিজের রোজগারের টাকায় খাই। ও বোধহয় ভুলে গেছে আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। যথেষ্ট রোজগার করি আমি। আর সে-তো নিজেই একটা পরজীবি। বাপে যদি না দিত, তবে তার এত ফুটানি থাকতনা। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সানাউল রাশেদিনের গলা দিয়ে যেন অ’গ্নি’গো’ল’ক বেরিয়ে আসছে।
তাহমিদ ততক্ষণে একটা বার্গার আয়েশ করে সাবাড় করেছে। এবং হাতে আরেকটা নিয়েছে।
” উম্ বড়মা, তোমার হাতের বার্গারের স্বাদই আলাদা। আমি একাই কিন্তু চার-পাঁচটা খাব। কিন্তু ভুলেও ঐ বয়স্ক ভদ্রলোককে দিওনা। সে হচ্ছে এক নম্বরের পেটুক। তার মাথায়তো গোবর পোড়া, কিন্তু রা’গে’র বেলায় ষোলআনা। তারউপর আবার রোজগারের বাহাদুরি দেখায়। তাকে লেখাপড়া কে শিখিয়েছিল? নিশ্চয়ই আমার দাদু। তাই তার এই জবের পেছনে তার কোন ক্রেডিট নেই। সব ক্রেডিট আমার দাদুর। তাইনা দিদুন? ” তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে থাকা দিদুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

” আহ্ তাহমিদ, এবার থামবি? বড় চাচ্চুর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তা তোর জানা নেই? ”
তাহমিনা আক্তার ছেলেকে ধমক দেন। তাহমিনা কথা বলেছে দেখে দিদুন আর কিছু বললেননা, শুধু ঠোঁট টিপে হাসেন।
” তাহমিনা, তুই চুপ কর। ছেলেটাকে খবরদার কিছু বলবিনা। ও ভুল কিছু বলেছে? তোর ভাসুর তো শুধু বসে বসেই খায়। সে হোক অফিস, হোক সেটা বাড়ি। সংসারের কোন কাজে কখনও সহযোগিতা করেছে সে? বাপ, তুই পেট ভরে খা। মায়ের কথা মাথায় নিসনা। ”

” এজন্যই তোমাকে এত ভালোবাসি বড়মা। তবে আমাকে খাইয়ে সবগুলো শেষ করোনা। সিক্তর জন্যও রাখ। কিন্তু ভুল করেও সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাকে দিওনা। তার পেটে এসব সইবেনা। সে জোর করলেও দিবেনা। শেষে দেখা যাবে সে পুরোটা দিন ওয়াশরুমেই বসে কাটাবে। তখন যদি তার শরীর থেকে সব বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে যায়, তার ভুঁড়ি কমে যায়! তাকে ভুঁড়ি ছাড়া দেখতে কেমন লাগবে, সেটা ভেবে এখন থেকেই আমার হাসি পাচ্ছে। ”

” মা, তোমার এই বেয়াদব নাতিকে চুপ করতে বলবে? না আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাব? আর আফরোজা, তুমি যদি এবার ওকে কিছু না বল তবে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বনা। ”
” কি করবে শুনি? আমার বড়মাকে কিছু বলার সাহস তোমার আছে? বড়মা, যদি একদিনের জন্য বাসার বাইরে থাকে, তবে তুমি চলতে পারবে? ” যত গর্জে, তত বর্ষেনা ” ভাবটা যেন এমন। তা তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে? এক্সের কাছে? সিনিয়র রাশেদিন, তোমার এক্সও আছে বুঝি! তার কাছে পাত্তা না পেয়ে কি আমার বড়মাকে বিয়ে করেছিলে! এটা যদি করে থাক, তবে তুমি ভিষণ অন্যায় করেছ। ”

” বাপ, তুই মেডিকেলে কখন যাবি ? দুপুরে খাবার আগে বাসায় আসতে পারবি? ” আফরোজা নাজনীন স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, ভদ্রলোক বেজায় ক্ষেপেছেন। তাই তিনি কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন।
” আমি একবারে রাতে আসব। তোমার ছেলে এখন ডক্টর বড়মা । তার কি এখন শুয়ে-বসে কাটিয়ে, ভুঁড়ি বাড়ানোর সময় আছে! ” সানাউল রাশেদিনের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল তাহমিদ।

এবার সানাউল রাশেদিন তেড়ে আসেন তাহমিদের দিকে। তাহমিদের ততক্ষণে খাওয়া শেষ। সানাউল রাশেদিনকে নিজের দিকে আসতে দেখেই, ও এ্যাপ্রন হাতে নিয়ে একছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
সানাউল রাশেদিন তাহমিদকে ধরতে না পেরে মুখ কালো করে নিজের রুমে যান। তিনি চলে যেতেই হেসে উঠেন আয়েশা সালেহা।

” আমার ছেলেটা আর বড় হলোনা। হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে লাগতে যায়! ”
” আম্মা, এখানে তাহমিদেরও দোষ আছে। সে কেন আগবাড়িয়ে তার বড় চাচ্চুর লাগতে যায়? আপনারা কেউ তাকে শাসন করেননা, বিধায় সে এমন বেপরোয়া হয়েছে। ”
” মেজো বউমা, তোমার ছেলে বেপরোয়া নয়। নিজের সন্তানকে যদি চিনতে না পার, তবে তুমি কিসের মা! তাহমিদ ওর বড় চাচ্চুর সাথে এসব করে মজা পায়৷ তাই সে সুযোগ পেলেই তাকে রা’গি’য়ে দেয়। সব দোষ আমার বড় ছেলের। ওর কেন একটুতেই রা’গ’তে হবে!

তাহমিনা আক্তার বুঝে গেছেন, এই বাসায় তার ছেলের পক্ষে কথা বলার মানুষের অভাব নেই।
তাই তিনি শ্বাশুড়ির কথার কোন জবাব দেননা।
সানাউল রাশেদিন মুখ ভার করে নিজের রুমে বসে আছেন। যেন অফিসে যাওয়ার কোন তাড়া
তার নেই।

” কি ব্যাপার, তুমি অফিসে যাবেনা! এখনও দেখছি রেডি হওনি! আজ কি অফিসে যাবেনা? শরীর ঠিক আছে তোমার? ” আফরোজা নাজনীন উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
” তোমার চিন্তার কোন কারন নেই। আমার শরীর ঠিক আছে আর অফিসও যাব। বাসায় থেকে তোমার আর তোমার ঐ ব’র্ব’র ছেলের খোঁ’টা শোনার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। দুইদিন হলো ডক্টর হয়েছে, তাতেই কত অহংকার! যেন বাংলাদেশে আর কোন ডক্টর নেই! এই দিন দেখার জন্যই ব’র্ব’র’টা’কে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি! ” সানাউল রাশেদিন ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

” তুমি কি দিনদিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ! তাহমিদকে কখনো দেখেছ, কারও সাথে খারাপ আচরণ করতে? কারও কথা বেশি কথা বলতে দেখেছ? এমনকি ওর বাবার সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কখনও কথা বলেনা। একমাত্র তোমার সাথেই দুষ্টুমি করে, তুমি রে’গে যাও বলে। ওর কোন কথায় রিয়্যাক্ট না করে চুপচাপ থাকবে, দেখ ও আর তোমাকে কিছুই বলবেনা। ”

” হুম, তোমার ছেলে একবারে সাধু-সন্ন্যাসীর পর্যায়ে চলে গেছে। আমি চুপচাপ থাকলেই, তার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে! ওর পক্ষে কোন সাফাই গাইবেনা বলে দিলাম। এখন সব দোষ আমার! নিজের বিয়ে করা বউ যদি তার স্বামীকে না বোঝাে, তবে আমার কপালে দুর্ভোগ আছে, এ আর নতুন কি! ” সানাউল রাশেদিন অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করেছেন।
আফরোজা নাজনীন মাথায় হাত দিয়ে অবুঝ মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছেন। না জানি কবে লোকটা বুঝবে।
কাঠফাটা রোদের ঝলকানিতে চোখমুখ ঝলসে যাবার জোগাড়। গরমে জনজীবনে অতিষ্ঠ। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বাড়ির বাইরে আসছেনা।

পথের কু’কু’র’গু’লো একটু ছায়ার খোঁজে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এক চিলতে ছায়ার দেখা পেলেই সেখানে গুটিসুটি মেরে বসে থাকছে।
পরনে সাদা সুতির থ্রিপিস। লম্বা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। কাঁধে একটা বেঢপ আকৃতির লেডিস ব্যাগ। ভালো করলে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ওড়নার নিচ দিয়ে একটা লম্বা বেনী হাঁটু ছুঁয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
কপাল বেয়ে কয়েকটা ঘামের সরু রেখা শুকনো নদীর মত এঁকেবেঁকে নিচে নামছে। মেয়েটি ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে মুখমন্ডল মুছে নেয়।

শ্যামলা মুখে সূর্যের আলো যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
খাঁড়া নাক আর বাঁকানো ভ্রুর নিচে মায়ময় আঁখিযুগলের কাছে তার গায়ের রং মলিন হয়ে গেছে। তার আঁখিযুগলে যেন মায়ার সাগরের টলটলে জল উপচে পড়ছে।
মেয়েটি অনেকক্ষণ যাবৎ হেঁটেই চলছে। কয়েকটা রিক্সাওয়ালা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি সহাস্যে তাদের না করে দেয়।

প্রায় আধাঘন্টা পর মেয়েটি একটা পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর গন্তব্য নিচতলায়। সেখানে সাইনবোর্ড ঝুলছে। তাতে লিখা আছে ” সাধারন বীমা কর্পোরেশন ”
মেয়েটি আরেকবার ওড়নার প্রান্ত দিয়ে মুখ, গলা ভালোভাবে মুছে নেয়। এই মুহুর্তে তার ভিষণ পিপাসা পেয়েছে। ব্যাগে থাকা বোতলের পানি সেই কখন শেষ হয়েছে। ওর প্রথম কাজ হলো অফিসে ঢুকেই প্রানভরে পানি পান করা। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি।

মেডিকেল থেকে বাসায় পৌঁছাতে তাহমিদের রাত হয়ে যায়। তবে ও জানে মা আর বড়মা দুজনেই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। তাহমিদ বাসায় যাওয়ার পরই সেই দু’জন মমতাময়ী রাতের খাবার খাবে। ওর নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। অনেক ভাগ্য করলেই এমন মা, বড়মা পাওয়া যায়।

তাহমিদ ভালো করেই জানে বাড়ির সকলেই ওকে ভিষণ ভালোবাসে। এমনকি সিনিয়র রাশেদিনও। কিন্তু ভদ্রলোক যে ওকে ভালোবাসে তা একটিবারও বুঝতে দেয়না। এমনকি তাহমিদ যতক্ষন বাসায় না পৌঁছায়, ততক্ষণ সে জেগে থাকে। তাহমিদ বাসায় ঢোকার পরই সে ঘুমাতে যায়। কিন্তু এটা সে অতি গোপনে করে। অবশ্য তাহমিদ সেটা অনেক আগেই বুঝ গেছে।

পরিবারের সদস্যদের কথা মনে করে তাহমিদ আনমনে হেসে ফেলে। ওর পরিবারের মত পরিবার এখন খুব একটা দেখা যায়না। মা, বড়মা, চাচিদের মধ্যে কত মিল। যেখানে দিদুন বটগাছের ন্যায় সবার মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছে।
এসব চিন্তা করতে করতে আগামীকাল সিনিয়র রাশেদিনকে কিভাবে উৎপাত করবে সেই চিন্তায় মগ্ন হয় তাহমিদ।
রাত এগারোটা। মেয়েটি বই নিয়ে বসেছে তার ঘরে। মাঝারি সাইজের একটা ঘর। পাকা ঘরের মাথার ওপর টিনের ছাউনি ।
ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছুই নেই। একটা মান্দাতার আমলের খাট, টেবিল-চেয়ার, একটা আলনা। আর দেয়ালে ঝোলানো একটা আয়না।
মাথার ওপর ঘরঘর শব্দে ফ্যান ঘুরছে। এই তীব্র গরমে এটাই শান্তি যে ওর শহরে লোডশেডিং নেই। সারাদিন গরমে ঝলসে অফিসের কাজ করে, বাসায় এসে রাতটুকু শান্তিতে কাটাতে পারে।
মেয়েটি মনযোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি গাইড পড়ছে। ওর কোচিং করার মত সামর্থ নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে নোট আর বিভিন্ন বই পড়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে অ্যাডমিশনের।

পাশের ঘরে বাবার আর্তনাদ শুনে বই বন্ধ করে প্রায় ছুটে যায় সেখানে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পায়, বাবা ঘুমের ঘোরে এমন করছে। মেয়েটি দৃঢ় পায়ে বাবার কাছে যায়। খাটের পাশে চেয়ার টেনে বসে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর বাবা শান্ত হলে ফিরে আসে নিজের ঘরে। তার চোখের কোনে জমা হয়েছে কষ্টের বারিধারা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২