বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৪
জাওয়াদ জামী

আফরোজা নাজনীন ড্রয়িংরুমে এসে সবাইকে তাড়া দেন গাড়িতে উঠে বসতে। তাহমিনা আক্তার তার শ্বাশুড়িকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন।
” বাপ, সকালে খেয়েই তবে বাসা থেকে বেরে হবি। দুপুরেও কিছু খেয়ে নিবি। তারাতারি বাসায় আসার চেষ্টা করবি। কিছু খেয়েই তবে ঘুমাবি। আর শনি-রোববারের দিকে অবশ্যই ফুলতলা যাবি। আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করব। মনে থাকবে তো? ”

” মনে থাকবে, বড়মা। আমি রবিবার সন্ধ্যার দিকে যাব। রোমিওকে বলো আমার জন্য তেঁতুল চকলেট কিনে রাখতে। যেমন ছোটবেলায় কিনে দিত। ”
” আচ্ছা, বলব। এবার আমাদের বের হতে হবে, বাপ। তুই সাবধানে থাকবি কিন্তু। ”
” আফরোজা, তোমাদের হয়েছে? এবার রওনা দিতে হবে। সিক্তা, তুমি দিদুনকে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যাও। তাহমিদ তুমি ব্যাগগুলো নিয়ে ঠিকঠাক গাড়িতে তুলে দাও। ” সানাউল রাশেদিন এসে হুকুম করলেন।
সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” বাবু, আমরা আসি। তুই দেখেশুনে থাকবি কিন্তু। বাসায় ফিরতে বেশি রাত করবিনা। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবি। আর প্রতিদিন অন্তত দুইবার আমাকে ফোন দিবি। ”
” আচ্ছা, মা। আমি তোমার কথামতই কাজ করব। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। তোমার ছেলে আর ছোটটি নেই, সে বড় হয়েছে। তোমরা তাকে নিয়ে নয়, বরং সে এখন তোমাদের নিয়ে চিন্তা করবে। এবার বের হও নইলে দেরি হয়ে যাবে। ”

সবাই বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠে। তাহমিদ ব্যাগগুলো একে একে গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। সব ব্যাগ উঠানো হলেই সানাউল রাশেদিন আর আফরোজা নাজনীন গাড়িতে উঠবেন। অবশ্য নাজমা পারভিনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
” খালামনি, তোমার দুলাভাইকে আবার বেশি খেতে দিওনা৷। শেষে দেখবে পেট ফাটিয়ে বসে আছে। সে কিন্তু খাওয়া ছাড়া কিছুই বোঝেনা। ” ব্যাগ তোলা হলে তাহমিদ নাজমা পারভিনকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে।
গাড়িতে বসে কুহু তাহমিদের কথা শুনছিল।

” আফরোজা, গাড়িতে ওঠ। এই বেয়াদবের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করোনা। ”
আফরোজা নাজনীন বোনকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করলেই আনান, সিক্তা, আরোশি, তনয়া, নিহান সবাই একসাথে চিল্লিয়ে তাহমিদকে বিদায় জানায়। তাহমিদও হেসে মাথা নাড়ায়।

ওরা পরন্ত বিকেলে ফুলতলা পৌঁছায়। কায়েসক আগেই তার বড় বোন জানিয়ে রেখেছিল। তাই আজ সে দুপুরের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে আসে। অনেক রকম বাজার করেছে কায়েস। সে বারবার শিউলিকে বলে দিয়েছে, তার বোনদের যেন কোন অসম্মান না হয়।
গাড়ির হর্ণ শুনে কায়েস বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ওর সাথে শিহাব আর দৃষ্টিও আছে। শিউলিও পেছন পেছন বেরিয়ে এসেছে।

পরপর পাঁচটা গাড়ি দেখে ওর চোখ কপালে উঠেছে। মনে মনে ভাবছে, ওর ননদরা এত বড়লোক!
সানাউল রাশেদিন প্রথমে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি সোজা এসে কায়েসকে জড়িয়ে ধরেন।
” কায়েস, কেমন আছো তুমি? কত বছর পর দেখলাম তোমাকে। এ কি হাল করেছ শরীরের! ”
” বড় দুলাভাই, আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? আমি কখনো ভাবিইনি আপনাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে। ”

ওদের কথার মাঝেই নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানার স্বামীরাও ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারাও কায়েসকে জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ বাক্যবিনিময় করেন।
একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমেছে।
আফরোজা নাজনীন তার শ্বাশুড়িকে ধরে কায়েসের কাছে নিয়ে আসেন।
” কায়েস, দেখ কে এসেছে। তোকে দেখতে কে ছুটে এসেছে দেখ। ”
কায়েস আয়েশা সালেহাকে দেখে চরমমাত্রায় বিস্মিত হয়েছে।

” আম্মা, আপনি! আপনি এসেছেন, আম্মা! কেমন আছেন আপনি? ” কায়েস বৃদ্ধার কাছে যেয়ে তাকে সালাম দেয়।
আয়েশা সালেহা সালামের উত্তর নিয়ে কায়েসের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
” আমি ভালো আছি, বাবা। কিন্তু তোমার তো দেখছি শরীরের অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। নিজের যত্ন নাওনা তুমি? ”
” একবার শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে, যত্ন নিলেও কিছু হয়না, আম্মা। ”

এবার আফরোজা নাজনীন তার শ্বাশুড়ির সাথে শিউলি আর তার দুই ছেলে-মেয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
কায়েস এবার নজর দিল তার ভাগ্নে-ভাগ্নীদের দিকে। কিন্তু সে কাউকেই চিনেনা। যখন বাড়ি ছেড়েছিল, তখন তার বড় বোনের তিন মেয়ে ছিল। আর মেজো ও ছোট বোনের দুজনেরই একটা করে ছেলে ছিল। তাদের বয়স তখন দুই কি তিন বছর ছিল। তাই আন্দাজে নিহান আর আনানের দিকে এগিয়ে যায়। ভাগ্নেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কে আনান আর কে নিহান। এবং সফলও হয়।

” তুমি আনান আর তুমি নিহান। আমি ঠিক বলেছি তো? ”
” হুম ভাই, তুমি ঠিকই বলেছ। ভাগ্নে-ভাগ্নীদের পেয়ে আমি যে আরেকটা বোন এসেছি সেটাও ভুলে বসে আছ। ” তাহমিনা আক্তার হাঁসছেন।
” আমি আপনাকে ভুলিনি, আপা। এতদিন পর সবাইকে একসাথে দেখে বুঝতে পারছিনা কি করব। আমি ভাবতেই পারিনি আপনারা আসবেন। তাহমিদ, তাওহীদ ওরা আসেনি? আর ভাই, সে আসেনি? ”
” তারা সবাই ব্যস্ত মানুষ, তাই আসতে পারেনি। তবে তাহমিদ কয়দিন পরই আসবে। ”
” আপা, তাহমিদ বুঝি অনেক বড় হয়েছে? কি করছে ও? এখনও কি আগের মত দুষ্টু আছে? ছেলেটার কথা খুব মনে হয়। ”

” তাহমিদ আগের মত নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। ও এখন ডক্টর। একজন হার্ট স্পেশালিষ্ট ও সার্জন। কিন্তু দুষ্টু সেই আগের মতই আছে। সে-ও কিন্তু তোমাকে মনে রেখেছে। তোমার সাথে নাকি তার অনেক কথা আছে। ও আসলেই সেগুলো তোমাকে বলবে। ”
” যাক অবশেষে ওর সাথেও দেখা হবে, ভাবতেই ভালো লাগছে। ”
ছেলেমেয়েদের দল হৈ হৈ করে মামার কাছে এসে দাঁড়ায়। সবাই নিজেদের পরিচয় দেয়। কায়েসও হাসিমুখে তাদেরকে বুকে জরিয়ে নেয়।

আজ কায়েসের বাড়িতে যেন চাঁদের হাট বসেছে। বহুদিন পর আবার বাড়িটা লোকজনের সমাগমে পরিপূর্ণ হয়েছে। দৃষ্টি আর শিহাব সবার সাথে মিশে গেছে। ওদের দেখে মনেই হচ্ছেনা যে কিছুক্ষণ আগেই সবার সাথে পরিচিত হয়েছে।
শিউলি ননদদের পরিবার দেখে থমকে গেছে। সবার সাথে সবার কত মিল! কিন্তু পরক্ষণেই ওর মুখ কালো হয়ে যায় এত লোকজনের জন্য রান্না করতে হবে ভেবে।
একটু ফাঁক পেতেই কায়েস কুহুর কাছে যেয়ে বসে। পরম স্নেহে হাত রাখে মেয়ের মাথায়।

” কুহু মা, তুই ভালো আছিস তো? ঢাকায় থাকতে ভালো লাগছেতো? পড়াশোনা ঠিকমত করছিস? সবাই তোকে ভালোবাসে? ”
” বাবা, একসাথে এত প্রশ্ন করলে আমি কোনটার উত্তর আগে দিব! আমি খুব ভালো আছি, বাবা। আমার ফুপুদের মত ফুপু বোধহয় সারা দেশ খুঁজলে একটাও পাওয়া যাবেনা। তাই খারাপ থাকার কোন প্রশ্নই উঠেনা। আর রইল পড়াশোনার কথা। সেটাও খুবই ভালো হচ্ছে। আগে কাজের চাপে পড়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু এখন আমার অফুরন্ত সময়। ”

” সবার সাথে মিলেমিশে থাকবি, মা। পথঘাট সব চিনে নে, পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে তোকে আমি হোস্টেল কিংবা ফ্ল্যাটে রাখব। আগে আমার সামর্থ ছিলনা তাই তোকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মেয়েকে ভালো জায়গায় রেখে পড়ানোর সামর্থ আছে, তাই আমি তাকে সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করব। আর তাছাড়া বেশিদিন এক জায়গায় থাকলে সম্পর্ক আগের মত থাকেনা, ফিঁকে হয়ে যায়।

আমি জানি আমার বোনেরা আর সবার বোন থেকে আলাদা। তারা আমার মা’য়ের থেকে কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু তবুও এর ভেতর অনেক কথা থেকে যায়। তাদের যৌথ পরিবার। আর সব পরিবারেই দুই-একজন আলাদা ধরনের মানুষ থাকবেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি চাইনা, আমার কোন ভুল সিদ্ধান্তে তুই কিংবা আমার বোনেরা কষ্ট পাক। তুই প্রতি সপ্তাহে ফুপুদের বাসায় বেড়াতে যাবি। এতে তোরও ভালো লাগবে আবার ফুপুরাও খুশি হবে। কি বলিস তুই? ”

” তুমি যেটা ভালো মনে হবে, সেটাই কর বাবা। আমিও চাইবনা আমার জন্য ফুপুরা তাদের সংসারে অসম্মানিত হোক। এই একমাসে মায়ের ভালোবাসা আমি তাদের কাছে পেয়েছি। তাই তাদের সামান্যটুকুও অসম্মান আমার কলিজায় আঘাত করবে। বাবা একটা কথা ছিল। ”
” কি কথা, মা? বল শুনি। ”

” তুমি এবার আমাদের সাথে ঢাকায় চল। ভালো ডক্টরের কাছে নিজের চিকিৎসা করাও। বড় ফুপা, ছোট ফুপার অনেক পরিচিত ডক্টর আছে। নিজের প্রতি আর অবহেলা করোনা, বাবা। মা’য়ের ভালোবাসা কি তা বুঝলামনা। তুমি ছোট থেকে বুকে আগলে রেখেছ। এখন যদি তোমার কিছু হয়ে যায়, তবে আমি বাঁচব কি করে। ” কুহু ডুকরে কেঁদে উঠে।
কায়েস মেয়ের কান্না দেখে ওকে বুকে টেনে নেয়।

” তোদের সাথে যদি না-ও যাই, তোরা যাওয়ার দুই-একদিন পরই আমি ঢাকা যাব। ভালো ডক্টরের কাছে চিকিৎসা করাব। এবার আমি সুস্থ হয়ে যাব, তুই দেখিস, মা। আমাকে যে তোদের তিন ভাই-বোনের জন্য বাঁচতেই হবে। তুই লেখাপড়া শিখে ক্যারিয়ার গড়বি। আমার দৃষ্টি লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। আমার ছেলেটা এখনও ছোট আছে। তাকে মানুষ করতে হবে। তাদের মা ভালো নয় জন্য, আমিতো তাদের ফেলে দিতে পারবনা। বাবা হিসেবে আমার দ্বায়িত্ব আমি পালন করে যাব। আমার কাছে তোরা তিনজনই সমান। ”

” তুমি কিন্তু ফুপার সাথে আগেই কথা বলে রাখবে । তাকে ভালো ডক্টরের সাথে কথা বলে রাখতে বলবে। তবেই আমি শান্তি পাব। আচ্ছা বাবা, আমাদের মির্জাপুরের ঐ বাড়িটা কি বিক্রি হয়েছে? সেখান থেকে কেউ তোমার সাথে যোগাযোগ করেছিল? ”

” আমি বাড়িটা বিক্রি করবনা, মা। মহল্লার একজন বৃদ্ধকে এমনিই দিয়ে দিব। একজনের সাথে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। ঐ বৃদ্ধর থাকার কোন জায়গা নেই। ছেলেরাও তাকে দেখেনা। একটা বিধবা মেয়ে আর দুই নাতিকে নিয়ে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। সব শোনার পর আমার মনে হয়েছে বাড়িটা তাকে দিলে তাদের উপকার হবে। ”
” খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ, বাবা। আমরাও একসময় কষ্ট করেছি, তাই অন্যের কষ্ট বুঝতে পারি। তোমার যদি মির্জাপুর যেতে হয়, তবে একা যেওনা। কাউকে সাথে করে নিয়ে যেও। সেখানে ঐ কাউন্সিলরের ছেলে আছে। সে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করতেই পারে। ”

” তুই চিন্তা করিসনা, আমি একা যাবনা। আর ঐ কাউন্সিলরের ছেলেকে আমি আর ভয় করিনা। ওরা জানেনা আমি কোন বাড়ির ছেলে। এতদিন আমি সেখানে নিজের দোষে থেকেছি। তাই সবাই ভেবেছে আমি অসহায়, আমার কেউ নেই। ”
” তবুও বাবা, তুমিও সেখানে গেলে সাবধানে থেক। ”

” আচ্ছা মা, তুই যা বলবি তাই হবে। এবার খেতে চল। সবাইকে নিয়ে অনেক বছর পর একসাথে খাব ”
তিনটা দিন বাচ্চারা হৈ-হুল্লোড় করে কাটায়। পেয়ারা বাগানে গিয়ে গাছে উঠে আম, লিচু, পেয়ারা খাওয়া, নদীতে নৌকায় চড়ে গোসল করা, কিংবা পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করা কোনটাই বাদ যায়নি। কুহুও কাজিনদের সাথে খুব ইনজয় করেছে। প্রথম দিকে কুহুর ভেতর একটু জড়তা থাকলেও পরে তা একদম শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছায়।
আনান গাছ থেকে একটা আম ছিঁড়ে সিক্তার দিকে ধরে।

” সিক্তা, দেখ এই আমের সাইজ ঠিক তোর বাপের পেটের মত। হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্স! গোলগাল একটা পেটের অধিকারী তোর বাপ। এই আমটা যেন তোর বাপের পেট নির্দেশ করছে। ”
” আনাইন্না, তুই যদি আমার হাতে ম’র’তে না চাস, তবে এখান থেকে ভাগ। আমি যদি তোকে একবার হাতের নাগালে পাই, তবে তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর চৌদ্দটা বাজিয়ে দিব। ”

” সত্যি কথা বললেই আমি খারাপ! দুনিয়া সুদ্ধ মানুষ জানে, তোর বাপ ভুঁড়ি সর্বস্ব একজন জীব। আমার মনে হয় তোর বাপের কলিজার জায়গায়ও ভুঁড়ি আছে। যদি কলিজার জায়গায় ভুঁড়ি থাকে তবে তার কলিজা কোথায় আছে? এই কোকিলা, তুই কি জানিস, ভুঁড়িওয়ালার কলিজা কোথায় আছে? ”

” ভাইয়া, তুমি ফুপাকে নিয়ে এভাবে বলতে পারনা। সে তোমার গুরুজন। ”
” তুই ব্যাকডেটেড মহিলা, বুঝলিরে কোকিলা? তাই বুঝিসনা আমার ভুঁড়িওয়ালা ডাকের মধ্যে কত মহব্বত লুকিয়ে আছে। তোর ফুপাকে, এমন মধুর করে ভুঁড়িওয়ালা ডাক আর কেউই ডাকবেনা।”

” আমার বাবা ভুঁড়িওয়ালা হলে তোর বাপ কি? তোর বাপ যে শুটকি মাছের মত। শরীরে মাংসের বালাই নেই, শুধু হাড় আর হাড়। দেখে মনে হয় জীবন্ত ক’ঙ্কা’ল। সে হাঁটলে মনে হয় কোন ক’ঙ্কা’ল হাঁটছে। সে হাঁসলে মনে হয় কোন ক’ঙ্কা’ল মুখ ভেংচি দিচ্ছে। আগে নিজের বাপকে দেখ, পরে আমার বাবাকে বলিস। ”
” জি-ও সিক্তাপু, জি-ও। আনান ভাইয়ার বলে তুমি ছক্কা হাঁকিয়েছ। বেস্ট অব লাক। ” দৃষ্টি বেশ উপভোগ করছে ওদের ঝগড়া।

” এখনই এত খুশি হওয়ার দরকার নেই, কুদৃষ্টি। রবিবার সন্ধ্যার পর দেখবি তোর বাপেও নিস্তার পাবেনা। আমিতো তাও গুরুজনকে দেখে নিষ্পাপ সাজি৷ আর সেই মহাশয় গুরুজনের সামনেই গুরুজনকে আকাশ থেকে টুপ করে ছেড়ে দেয়। তাই নিজেরটা ভাব। ভুঁড়িওয়ালার মেয়ে যদি ছক্কা হাঁকায়, তবে আমিও টুয়েলভ হাঁকাতে জানি। ”
সিক্তা-আনানের ঝগড়া দেখে তনয়া, নিহান হাসছে। কিন্তু আরোশি মুখ ভার করে আছে। ও পরেছে বিপদে। বাবা-বড় খালু দুজনেই ওর কাছে প্রিয়। কিন্তু প্রিয় দুইজন মানুষের নামে উল্টাপাল্টা কথা ওর শুনতে হচ্ছে।

” ভাইয়া, তুমি আমাকে কুদৃষ্টি বললে কেন? আমি যদি কুদৃষ্টি হই তবে তুমি টুথপিকের মাথায় বিষফোঁড়া। ”
” টুথপিকের মাথায় বিষফোঁড়া বলে কোন শব্দ অভিধানে আছে বলে আমার জানা নেই, বুঝলি কুদৃষ্টি? কিন্তু তুই দেখছি কোকিলার মত অবলা না। তুই একবারে রিনা খানের মত সবলা বিন্দু মরিচ। ”
” আমি আপুকে দেখেই শিখেছি, অবলা হলে পদে পদে বিপদ। তাই চলতে গেলে একটুআধটু সবলা হতেই হয়। তাইনা নিহান ভাইয়া? ”

” তোদের ঝগড়ার মাঝে আমাকে টানিসনা। শেষে দেখা যাবে আমার বাবাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। ”
এভাবেই চলতে থাকে ওদের ঝগড়া।
রবিবার সকালে কায়েস অনেক রকম বাজার করে এনেছে। আজ তাহমিদ আসবে সে উপলক্ষে ও বাজার করেছে।
” শিউলি, আজ আমার বড় ভাগ্নে আসবে। তুমি হাত খুলে রান্না করবে, বুঝলে? বড় আপা, গলদা চিংড়ি এনেছি তুমি নিজ হাতে রান্না কর। তাহমিদ কি কি খেতে পছন্দ করে সেগুলোই রান্না হবে। তুমি শিউলিকে বলে দাও ও কি খেতে পছন্দ করে। প্রয়োজনে তুমি রান্নাঘরে শিউলির সাথে থাক। ”

তাহমিনা আক্তার কায়েসের কথা শুনে চোখের পানি ফেলছেন। যেখানে তার নিজের ভাইয়েরা কোনদিন তাদের খোঁজ নেয়নি। দুইটা ভাগ্নের খোঁজ রাখেনি। আর সেখানে জা’য়ের ভাই এভাবে তার ছেলের ভালো-মন্দের চিন্তা করছে!
এদিকে শিউলি এত বাজার দেখে কপাল কোঁচকায়। এত টাকা খরচ করার কোনও প্রয়োজনিয়তা সে দেখছেনা। গত কয়েকদিনে কায়েস অনেক টাকার বাজার করেছে।

প্রতিদিন তিনবেলায়ই গরু,খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, বড় মাছ এসব থাকছেই। গত কয়দিনে দুইটা খাসি জ’বা’ই করা হয়েছে। কায়েস বাজার করতে কোনও কার্পন্য করছেনা। আজও তেমনটাই করেছে সে। গতকাল একটা খাসির মাংস দিয়ে কি যেন একটা রান্না করেছিল ওর বড় ননদ। যেটা চোখে দেখাতো দূর ও কখনও নামই শোনেনি। এরকম নানান পদ রান্না হচ্ছে প্রতিদিন। ও শুধু কেটে বেছেই দিচ্ছে। রান্না করছে ওর ননদরা। তাই খুব বেশি কষ্ট ওর হচ্ছেনা। কিন্তু কায়েসের এভাবে পয়সা উড়ানো ওর সহ্য হচ্ছেনা।

আফরোজা নাজনীনের অনুরোধে কুহু চিংড়ির মালাই কারি রান্না করেছে। এছাড়া রুই মাছের কোপ্তা কারী আর কৈ মাছের সর্ষে বাটা রেঁধেছে কুহু।
মাগরিবের আজানের আগেই আনান ফুলতলা বাজারে গেছে। ও একবারে তাহমিদকে নিয়েই তবে ফিরবে। কায়েসও আনানের সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বোনদের নিষেধের কারনে যেতে পারেনি।
এশার নামাজের আগে তাহমিদের গাড়ি ফুলতলা বাজারে প্রবেশ করে। আনান রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে ছিল। আনানকে দেখে তাহমিদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে।

পনের মিনিট পর ওদের গাড়ি প্রবেশ করে কায়েসের বাড়ির সীমানায়। গাড়ি থেকে নেমে তাহমিদ ফল মিষ্টির কয়েকটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয় আনানের হাতে আর বাকিগুলো ড্রাইভার নেয়।
” ভাই, করেছ কি! এতসব কিছু কেন আনতে গেছ! ”
” আজ কেমন যেন জামাই জামাই ফিল হচ্ছে, বুঝলি? বিয়ের পর তো নতুন জামাইয়েরা এভাবেই শ্বশুর বাড়িতে যায় তাইনা? ”

” কিন্তু তুমি এখনও বিয়ে করোনি। জামাই জামাই ফিল আসবে কেন! ”
” বিয়ে না করলেও আমি আমার না হওয়া বউয়ের জামাই। না হওয়া শ্বশুরের আদরের মেয়ের ভালোবাসার মানুষ। না হওয়া শালার বোনের জামাই। না হওয়া ছেলেমেয়েদের মায়ের জান-প্রান-কলিজা-ফুসফুস-কিডনি সবকিছু। তাই জামাই জামাই ফিল আসতে অসুবিধা কোথায়! আখেরে আমিতো জামাই-ই। ”
” মাফ কর, ভাই। তোমার ফিল গিলে খেয়ে এবার ভেতরে চল। ”

বাড়ির সবাই উঠানে বসে গল্প করছিল। দরজা খোলা থাকায় আনান বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। আনানকে ঢুকতে দেখেই কায়েস উঠে দাঁড়ায়। ও তাহমিদের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল।
আনানের পিছু পিছু তাহমিদও ভেতরে ঢোকে। সামনে দাঁড়ানো কায়েসকে দেখে তাকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয়না তাহমিদের৷

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৩

” আরে রোমিও যে, কেমন আছো? তুমি দেখছি আগের মতই ইয়াং এবং হ্যান্ডসামই আছ! তোমাকে দেখে কে বলবে, তুমি তিন বাচ্চার বাপ! ” তাহমিদের সম্মোধন এবং এহেন কথা শুনে কায়েসের মাথা ঘুরে ওঠে।
উঠানে বসে থাকা সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তাহমিনা আক্তারতো লজ্জায় পারলে মাটিতে মিশে যায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৫