বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৫

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৫
জাওয়াদ জামী

কায়েস এগিয়ে এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরে।
” ভাগ্নে, তুমিও কিন্তু কম হ্যান্ডসাম নও। একবারে সুপুরুষ যাকে বলে, তুমি তাই হয়েছ। এক কথায় যাকে বলে লেডি কি’লা’র। ” কায়েস সহাস্যে বলে।

” তুমি বলছ লেডি কিলার। কিন্তু লেডি কেন, লেডির একটা দাদীও এখন অব্দি পটলনা! আমার থেকে বড় হতভাগা আর কে আছে বল? তা-ও তুমি একটা উপাধি দিলে। কিন্তু আমার বাড়ির মানুষদের চোখেই পরেনা, তাদের ছেলে সুপুরুষ লেডি কি’লা’র হয়েছে। তাদের ছেলের একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার সেটা বোঝেনা। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কায়েসসহ উঠানের সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে তাহমিদের কথা শুনে। কুহু ভাবছে, লোকটা এমন ঠোঁটকাটা কেন!
আফরোজা নাজনীনেরা তিন বোন ঠোঁট চেপে হাসছেন। তারা জানেন তাহমিদের কথাবার্তার ধরন। কিন্তু কায়েস আর শিউলির তার সম্পর্কে কোন ধারনা না থাকায় তারা চুড়ান্ত পর্যায়ে বিস্মিত হয়ে গেছে।
উঠানে এসে সবার সাথে কথা বলে তাহমিদ। বড়মা ওকে শিউলি, দৃষ্টি, শিহাবের সাথে সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওদের সাথে কথা বলে আনানের সাথে ঘরে যায়।

” ভাই, তোমার জন্য সিলিন্ডার বোধহয় এখনও তৈরি হয়নি। এজন্যই মনে হয় দামড়া পুরুষ হয়েও সিলিন্ডার ছাড়াই জীবন কাটছে। দুঃখ করোনা ভাই, তোমার বোনকে একবার বিয়ে করি, তারপর তোমার জন্য আমি নিজে পাত্রী দেখব । ”
” কে বলল, আমার নামের সিলিন্ডার তৈরি হয়নি! অনেক আগেই সেই সিলিন্ডার একটু একটু করে আমার নামের অক্সিজেন নিয়ে এখন পরিপূর্ণ হয়েছে। তাহমিদের নজরে সে আটকে আছে, গেঁথে গেছে তাহমিদের বুকে। এবার শুধু তাকে আমার রুমে পারমানেন্ট করার ব্যবস্থা করা বাকি। আর সেটাও খুব তারাতারি হয়ে যাবে। শেষে দেখবি আমি দুই হালি বাচ্চা নিয়ে তোর বিয়ের বরযাত্রা যাচ্ছি। আর আমার বোনের কোলেও একটা বাচ্চা আছে। ”

” যাক অবশেষে ছোট খালামনির দামড়া ছেলের বিয়ে দেখব! তোমার বয়সী ছেলেরা বিয়ে করে দুই বাচ্চার বাপ হয়েছে। কিন্তু তুমি এতদিন নিজেকে কচি খোকা ভাবতে। বোনকে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার চিন্তা স্থগিত কর। আমার বহুদিনের ইচ্ছে তার সন্তানের বাপ হওয়ার। প্রয়োজনে আমি তোমাকে সাদকা হিসেবে দিব, তবুও তাকে বিয়ে করেই ছাড়ব। ”

” তুই সুযোগ পেয়ে আমাকে অপমান করছিস! আমি আজ টায়ার্ড, তাই বেঁচে গেলি। পরে তোর ক্লাস নিব আমি। ”
দৃষ্টিকে সাথে নিয়ে আফরোজা নাজনীন তাহমিদের কাচে আসলেন। দৃষ্টির হাতে একটা ট্রে। সেখানে শরবত রাখা।
” বাপ, আগে শরবত পান কর। তারপর গোসল করে নিবি। আজ সবাই একসাথে খাব। তোর বড় চাচ্চু বলেছে, উঠানে পাটি বিছিয়ে সেখানেই খাবে। ”
” ঠিক আছে, বড়মা। দৃষ্টি, আনানকেও শরবত দাও। নিজে না পেলে আমার দিকে নজর দিতে ওর দুই সেকেন্ডও সময় লাগবেনা। ”

দৃষ্টি তাহমিদের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে।
” তুমি একদম ঠিক বলেছ, ভাইয়া। আনান ভাইয়া মানুষটা সুবিধার নয়। তাকে শরবত না দিলে আমাকেও ছেড়ে দিবেনা। ”
” কুদৃষ্টি, তোকে তো আমি খাইছি। একটু সবুর কর। ”
” আহ, তোরা কি শুরু করলি! নে তোর জন্যও শরবত আছে। ”
তাহমিদ শরবত পান করে কলপাড়ে যায়।
উঠানে হাই ভোল্টেজের বাল্ব লাগানো হয়েছে। গোল করে পাটি বিছিয়েছে কায়েস। ছেলে-মেয়েরাসহ সবাই সারিবদ্ধভাবে বসেছে।

আজ অনেক বছর পর কায়েস এভাবে সবার সাথে বসে খাবে। ভাবতেই ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠছে। এত বছর নিজের দোষে সবকিছু থেকে নিজেও যেমন বঞ্চিত ছিল, তেমনি ছেলে-মেয়েদেরও বঞ্চিত করেছে।
কায়েস ওর একপাশে বসা মেজো দুলাভাই আরেকপাশে বসা তাহমিদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। শিউলি গত কয়েকদিন থেকেই লক্ষ্য করেছে, আগের কায়েস আর এখনকার কায়েসের মধ্যে অনেক তফাৎ। এই কায়েস যেন সবার মাঝেই নিজেকে ফিরে পায়। বিয়ের পর থেকে এই মানুষটার হাসি মুখ শিউলি কখনো দেখেনি। হাসলে মানুষটাকে দেখতে কত ভালো লাগে! হঠাৎ করেই ভালোলাগায় ছেয়ে যায় শিউলির মন।

কায়েস গ্রামে আসার পর রোজিনা নামক একজনকে বাড়ির কাজকর্মের জন্য রাখা হয়েছে। সে-ই সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছে। শিউলি চেয়েছিল রোজিনার সাথে সে-ও খাবার বেরে দিবে। কিন্তু আফরোজা নাজনীন রাজি হয়নি। সে শিউলিকে নিজের পাশে বসিয়েছে।
” রোজিনা আপা, আমার ভাগ্নের পাতে আরেকটু মালাই কারি দাওতো। ভাগ্নে আমার মালাই কারি দিয়েই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। এই কয়দিন বাসায় কেউ ছিলনা, ভাগ্নে আমার কিছু খেয়েছে কিনা আল্লাহই জানে। রোজিনা আপা, তুমি বড় দুলাভাইকে মাংস দিয়ে এদিকে এস। ”

” মামা, আর না। আমার পেট ভরে গেছে। বাসায় কেউ না থাকলেও আমি নিয়ম করেই খেয়েছি। তবে কয়দিনের মধ্যে আজ একটু বেশি খেলাম মালাই কারির জন্য। তবে তোমার বড় দুলাভাইকে একটু বেশি করে খাওয়াও। ভদ্রলোক শ্বশুর বাড়িতে এসেছে একটু বেশি সে খেতেই পারে। আর শালাবাবুর বউ যদি আপ্যায়ন করে, তাহলেত কথাই নেই। ”

” বাবু, তুই খাচ্ছিস খা, কিন্তু এখন চাচ্চুর পেছনে একদমই লাগবিনা। ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে সাবধান করে দেন।
” আমি চাচ্চুর পেছনে লাগছিনা, মা। আমিতো মামার সাথে কথা বলছি। তোমার বড় ভাসুরের মত কপাল কয়জনের হয় বল। যে বয়সে সে শ্বশুর বাড়িতে ভুঁড়িভোজ করেছে সেই বয়সে আমি মামার পাশে বসে খাচ্ছি। যেখানে সিনিয়র রাশেদিনকে তার শালাবাবু তদারকি করে খাওয়াচ্ছে, সেখানে আমার প্লেটে রোজিনা আপা মালাই কারি তুলে দিচ্ছে। আমার শালা-শালির কোন খবরই নেই। ”

কুহু ভয় পাচ্ছে। এই ঠোঁটকাটা লোক আবার কিছু বলে বসে যদি! এই লোককে কোন বিশ্বাস নেই।
” তাহমিনা, এবার ঢাকা যেয়ে তোমার ছেলের জন্য মেয়ে খোঁজ করবে। বেয়াদবটা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। অথচ ছয়মাস আগেও তাকে বিয়ের জন্য আমরা জোরাজুরি করেছি। কিন্তু সে তখন রাজি হয়নি। অথচ আজ আমার খাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছে! ”

” বড় দুলাভাই, তাহমিদের বিয়ে হলে আমরা আবার একসাথে হতে পারব। আপনি তারাতারি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন। অনেকদিন হল কারও বিয়ের দাওয়াতে যাইনা। ” মাংস চিবাতে চিবাতে বললেন শাহনাজ সুলতানার স্বামী।
” আমিও তাহমিদের বিয়ের সাতদিন আগে চিটাগং থেকে ঢাকায় আসব। বরযাত্রা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আমরা থাকব। পাত্রীর বাবা-মা’কে হয়রান করে ছাড়ব। হাজার হোক আমরা পাত্রপক্ষ। ” নাজমা পারভিনের স্বামীও সবার সাথে যোগ দেন।

” মেজ খালু, আর যাই কর, পাত্রীর বাবা-মা’কে হয়রান করতে তোমরা পারবেনা। আর কেউ হয়রান করতে চাইলেও তোমরা তা হতে দিবেনা। আমি ভালো করেই জানি, দুলাভাই হিসেবে তোমরা যথেষ্ট দ্বায়িত্ববান। ”
তাহমিদের কথার মানে কেউই বুঝতে পারেনা। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন।
এদিকে কুহুর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারছে হয়তো আর কিছুক্ষণ পরই ঐ নির্লজ্জ লোকটার মুখ পুরোপুরি খুলে যাবে।

” ফুপু, আমার খাওয়া শেষ। আমি উঠছি। ”
” সে কি, কুহুতান! তুই তো তেমন কিছুই খাসনি! আরেকটু ভাত নে, মা? ”
” সত্যিই আমার পেট ভরে গেছে, ফুপু। আমি আর একটুও খেতে পারবনা। আমি ভেতরে গেলাম। ” কুহু আর উঠানে থাকেনা। সোজা ঘরে চলে যায়।
রাতে খাবার পর সবাই মিলে উঠানেই আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় কায়েস একটা প্যাকেট তাহমিদের কাছে দেয়। তাহমিদ প্যাকেট খুলে দেখল ভেতরে অনেকগুলো চকলেট।
” থ্যাঙ্কস মামা। কতদিন এই খাইনা। মনে আছে মামা, সেই ছোটবেলায় তুমি কিনে দিতে? আজ যেন সেই ছোটবেলা ফিরে পেলাম। ”

” মনে নেই আবার! এই চকলেটের জন্য তুমি আমাকে কম হেনস্তা করনি। কি প্যাঁচেই না ফেলতে আমাকে! ”
” প্যাঁচ বলছ, কেন রোমিওন! বল, ব্ল্যাকমেইল। তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করে চকলেট, আইসক্রিম ভাগাতাম। অবশ্য তোমার জুলিয়েটও আমাকে সাপোর্ট দিত। আহা, তার মনটা ছিল খাঁটি সোনায় বাঁধানো। ” তাহমিদের কথা শুনে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত।

” বাপ, কার কথা বলছিস তুই! জুলিয়েট কে? ”
” মামীর কথা বলছিলাম। যে অনেক আগেই মামাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। ”
মুহূর্তেই যেন উঠানে নিরবতা রাজত্ব করে নেয়। আগে কেউ জানতইনা তাহমিদ আইরিনকে চেনে!
কায়েস কয়েকটা চকলেট হাতে নিয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
কুহুর চোখে পানি। তাহমিদ যে ওর মা’কে দেখেছে সেটা ওর কল্পনায়ই ছিলনা।
” বাপ, তুই আইরিনকে দেখেছিলি! কোথায় দেখেছিলি? ”

” আগে আমি যখন এখানে আসতাম, তখন প্রতিদিনই মামার সাথে ঘুরতে যেতাম। সেটা তো তোমরা জানোই। তখন মামা মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে মামীর সাথে দেখা করতে যেত। আমিও সেই সুযোগে মামাকে ব্লাকমেইল করতাম। তবে জানো কি বড়মা, মামী কিন্তু খুব ভালো ছিল। কি মিষ্টি করে হাসত। কথা কম বলত। রিনরিনে গলা ছিল তার। সে আমাকে উস্কে দিত মামাকে ব্ল্যাকমেইল করতে। সেই দিনগুলো খুব মধুর ছিল। ” তাহমিদ আপনমনে হাসছে।
শিউলির মনে হচ্ছে ওর গলায় কিছু একটা বিঁধেছে। কায়েস সব সময়ই আইরিনের কত প্রসংসা করে। আজ আবার তাহমিদও করছে। ননদরাও মাঝেমধ্যে বলে, আইরিন খুবই শান্ত ছিল। নিজেকে হঠাৎ করেই ছোট মনে হতে থাকে শিউলির।

” বাপ, তুই একদিনও আমাদের বলিসনি কেন আইরিনকে তুই দেখেছিস? এত বছর নিজের মধ্যে কিভাবে কথাটা লুকিয়ে রাখলি! ”
” কথা লুকানোর বদলে চকলেট, আইসক্রিম পেতাম। তাই আর ওয়াদা ভঙ্গ করিনি। কিন্তু দেখ, আজ বলেই ফেললাম। আচ্ছা শোন, তোমরা গল্প কর। আমি মামার সাথে একটু বাইরে যাব। মামা, চল একটু ঘুরে আসি। তনয়া, চকলেটগুলো তোরা ভাগ করে নে। ” তাহমিদ উঠে দাঁড়ায়। এরপর কায়েসকে টেনে তুলে।

” দুলাভাই, আপনারা গল্প করেন। আমরা একটু বাহিরে থেকে আসছি। ”
কুহু দেখল ওর বাবা তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বাইরে বেরিয়ে গেল। ওর কেবলই মনে হচ্ছে, তাহমিদ ওর মা’কে দেখেছে! ওর মা’য়ের সাথে কথা বলেছে! আজ হঠাৎই কুহু তাহমিদের প্রতি একটা টান অনুভব করছে।
” দেখেছ আফরোজা, ঐ বেয়াদব কত সেয়ানা! কায়েস যখন বাড়ি ছাড়ে ওর বয়স তখন আট কি নয়। ঐ বয়সেও একটা ছেলে কতটুকু সেয়ানা হলে এসব কথা পেটে লুকিয়ে রাখে! আজ এত বছর পর কথাগুলো বলল! ”

” ও ওর জায়গায় ঠিক ছিল। তুমি অযথাই ছেলেটাকে গালমন্দ করবেনা। আমার ছেলের মত ছেলে সারা দেশ ঘুরলে একটাও পাবেনা। তুমি ওকে গালি না দিয়ে গল্প কর। ”
স্ত্রীর ঝাড়ি খেয়ে সানাউল রাশেদিন মুখ কালো করলেন।
কায়েস আর তাহমিদ নদীর তীরে ঘাসের উপর বসে আছে। আজ কায়েস যেন সেই যুবা বয়সে ফিরে গেছে। কত বছর পর যে নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে তা ওর জানা নেই।

” তা রোমিও, শরীরের এই হাল করেছ কিভাবে? শুনলাম আজকাল নাকি হার্টেও অসুখ বাঁধিয়েছ? যেই হার্টে তোমার প্রথম ভালোবাসাকে আজও জিইয়ে রেখেছ , সেই হার্টেই অসুখকে কিভাবে ঠাঁই দিলে! তুমি তো মানুষ সুবিধার নও। একবারও তোমার মনে হয়নি, তোমার ছেলেমেয়ে আছে? তাদের মানুষ করতে হবে। সেসব না ভেবে ওদেরকেই চিন্তায় রেখেছ! ”

” আমার বিয়ে পরবর্তী জীবনটা সহজ ছিলনা, ভাগ্নে। আইরিনকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার পর, টাঙ্গাইল গেলাম। সেখানে একটা ভালো চাকরিও পেলাম। কিন্তু কুহু জন্মানোর ছয়মাস পর ওর মা মারা গেল। হঠাৎ করেই আমার সেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল। জীবিকার তাগিদে আরেকটা কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। ছোট মেয়েটার ভালোর জন্য আরেকবার বিয়ে করলাম। কিন্তু ভালো কিছু আমার মেয়ের সাথে ঘটলনা।

মেয়ের কষ্ট দেখে না পারতাম সহ্য করতে, না পারতাম শিউলিকে কিছু বলতে। শুধু মনে হত, আমি অফিসে থাকলে শিউলি যদি আমার মেয়েটার কোনও ক্ষতি করে। তাই চুপচাপ সব সহ্য করতাম। আড়ালে আবডালে মেয়েকে সাহস দিতাম। দিনের পর দিন এভাবে চলতে চলতে কখন যেন আমার মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে তা আমি টেরও পাইনি। মেয়েটা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন আমার হুট করেই হার্টের প্রবলেম ধরা পরে। এরপর চিকিৎসা শুরু করি। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চাকরিটা চলে যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় আমার মেয়ের দুর্বিসহ দিন। কিন্তু ভাগ্নে, বাড়িতে ঢোকার পরই কিন্তু তুমি আমাকে ইয়াং বলেছিলে! ”

” আরে রোমিও, এত বছর পর দেখা হলো তাই একটু তেল দিয়েছিলাম। তোমার মেয়ে যে হাসতে জানেনা, তার কারন আজ আমি জানলাম। কি মেয়ে মাইরি তোমার! রোমিও, ছোটবেলায় আমাকে কি নামে ডাকতে সেটা মনে আছে তোমার? আর কি কথা দিয়েছিলে আমাকে? ”

” মনে থাকবেনা কেন! তোমাকে মেয়ের জামাই বলে ডাকতাম। তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম আইরিনকে দেয়ার জন্য। আর আমি ওর স্কুলের সামনের দোকানে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন তোমাকে বলেছিলাম, আমার মেয়ে হলে তোমার সাথে বিয়ে দিব। বিনিময়ে তুমি চিঠিটা আইরিনকে দিয়ে এস। ”

” যাক ভালো লাগল কথাটা মনে রেখেছ দেখে। তবে কথাটা একদিনই নয় কয়েকদিন বলেছিলে। আর মামির সামনে আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলে। মামিও আমাকে জামাইবাবা বলত। ডাকটার মর্মার্থ তখন না ঝুঝলেও এখন বুঝি। এখন মনে হয় তুমি যদি বাড়ি না ছাড়তে, তবে আমাদের সবার জীবনটা অন্যরকম হত। আমিও অনেক আগেই তোমার মেয়ের সত্যিকারের জামাই হতাম। যদিও এতদিনে একটু দেরি হয়ে গেছে তবে সুযোগটা শেষ হয়ে যায়নি। আমার ছেলে-মেয়ের মুখে নানাভাই ডাক শোনার সুযোগ এখনও তোমার আছে। ”

কায়েস তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। সে তাহমিদকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে, তাহমিদ কথাটা সত্যি বলেছে কিনা।
” তুমি কি কথাটা ভেবে বলছ, ভাগ্নে? বড় আপার কাছ থেকে শুনেছি মাত্র কয়েকদিন আগে তুমি দেশে ফিরেছ। দেশে এসেই তুমি কুহুকে প্রথমবার দেখেছ। এত তারাতারি কোন ডিসিশান নেয়া কি আদৌ সম্ভব! ”

” আমাকে দেখে কি তোমার প্লেবয় মনে হচ্ছে? কিংবা ফ্রড? আর তোমার মেয়েকে আমি দেশে এসেই প্রথম দেখেছি এটা মোটেও ঠিক নয়। তাকে আমি আরও আগে দেখেছি। বাদ দাও সেসব কথা, শরীরে যে রোগ বাঁধিয়েছ তাতে তোমার কি মনে হয়না, এবার নাতি-নাতনির মুখ দেখা উচিত? আর তাছাড়া আমার বয়সও তো কম হলোনা। এখনই যদি ছেলে-মেয়েরা দুনিয়ায় না আসে, তবে তাদের মানুষ করব কবে! দেশের মানুষের গড় আয়ুতো আর দেড়শ-দুশো বছর হয়নি। দেড়শ-দুশো বছর বাঁচলে তখন ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার কথা চিন্তা করতে হতোনা। আরও দশ বছর পরেও ওরা দুনিয়ায় ল্যান্ড করলে সমস্যা হতোনা। তুমি মেয়ের বাবা হয়ে এসবের কিছুই ভাবছনা। যত ভাবনা আমার। জালিম শ্বশুর তুমি। ”

কায়েস তাহমিদের কথার উত্তর দিবে কি ও লজ্জা পাচ্ছে। কি নির্দধায় ছেলেটা ওর মনের কথা বলছে!
” আমি কি তোমার মা’র সাথে কথা বলব? ”
” এখনই না। আগে তোমার মেয়েকে রাজি করাও। তাকে দেখে রাখ। অন্য কোন দিকে যেন তার নজর না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখ। এখনকার মেয়েদের ভাবসাব বোঝা দায়। চোখের সামনে খাঁটি জিনিস থাকতে, তাদের নজর সবসময়ই পঁচা জিনিসে যায়। তাছাড়া আমার মত একটা যোগ্য পাত্র তার কাছে পাত্তা পায়না! এখনকার মেয়েরা কাঁচকে হীরা ভেবে লাফালাফি করে। যখন হাত – পা কে’টে র’ক্তা’র’ক্তি কান্ড হয়, তখন ওদের হুঁশ আসে। পরিবারের সম্মান নিয়ে খেলতে ওদের বাঁধেনা। দুনিয়ার বোকাবোকা কাজকর্ম ওদের দ্বারাই সম্ভব। শোন, তোমার মেয়েকে এখনই কিছু বলোনা। তাকেও আমিই বলব। ”

” আমার মেয়ের কপালে যে কি অপেক্ষা করছে তা আল্লাহই ভালো জানেন। তাহলে খাওয়ার সময় তুমি যেগুলো বলেছ সবই আমাদের নিয়ে বলেছ! এবার বুঝতে পারছি।
” তোমার মেয়ের কপালে আমার মত একটা রোমান্টিক জামাই আছে। যে তোমার মেয়েকে রোমাঞ্চের সাগরে ভাসিয়ে রাখবে। আর কি চাই তোমার? বাই দ্য ওয়ে, তুমি এখানে এসে ডক্টর দেখিয়েছ? ”

” এখনও ডক্টরের কাছে যাইনি। আগের প্রেসক্রিপশনের ঔষধই খাচ্ছি। তবে আপারা খুব জোড়াজুড়ি করছে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য। আবান কুহুও বারবার বলছে ঢাকা যেতে। সেখানে নাকি দুলাভাইদের পরিচিত অনেক ডক্টর আছে। তাদের ভেতর ভালো একজনের কাছে চিকিৎসা নিতে বলছে। ”

” দেখেছ, বাসায় ডক্টর থাকতে তোমার মেয়ে অন্য ডক্টরের কথা সাজেস্ট করেছে! দেশের সেরা দশজনের একজন হার্টের ডক্টর আমি। কিন্তু তোমার মেয়ে আমাকে দামই দেয়না! শোন তবে, তোমার চিকিৎসা আমিই করব। তোমাকে সুস্থ করে তোমার মেয়েকে দেখাব আমার যোগ্যতা। বাড়িতে যেয়েই তোমার চিকিৎসা শুরু করব। আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করেছে তোমার মেয়ে! তোমার নাতি-নাতনিদেরও ডক্টর বানিয়ে আমি আমার যোগ্যতার প্রমান আরেকবার দিব। ”

” ভাগ্নে, রিল্যাক্স। এত রাগ করতে নেই। আমার মেয়ে হয়তো তোমার সম্পর্কে জানেনা তাই বলেছে। ”
” এজন্যই সে বেঁচে গেল। সে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বলত, তবে তার খবর ছিল। ”
” এবার বাড়িতে চল। অনেক রাত হয়েছে। ”
” চল। মামা, আরেকটা কথা। এই মামিও কিন্তু দেখতে চমৎকার। তোমার সাথে মানিয়েছে। ”
” তার ব্যবহারও তেমনি চমৎকার। আমার মেয়েটার জীবন ও নরক বানিয়ে দিয়েছে। ”

” বাদ দাও এসব কথা। এবার থেকে তোমার মেয়ের জীবনে সুখ এসে লুটোপুটি খাবে। পুরোনো কথা ভেবে মন খারাপ করোনা। মামা, একটা কথা ঠোঁটের আগায় এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। তুমি হুকুম দিলেই কথাটা বলতে পারি। ”
” কি এমন কথা যেটা বলতে আমার কাছ থেকে হুকুম নিতে হবে! তুমি আসার পর থেকে একটু আগ পর্যন্ত যা যা কথা বলেছ, তার থেকেও উন্নত মানের কথা বলতে চাও? ”
” তোমার বউ ভাগ্য কিন্তু বেশ। জুলিয়েটও যেমন সুন্দরী, আকর্ষনিয় ছিল। এই মামীও তাই। এমন কপাল খুব কম মানুষেরই হয়। ”

” আমার মেয়েকে বিয়ে করলে আমরা সম্পর্কে তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি হব। তাই তোমার কাছ থেকে একটু সম্মানতো আশা করতেই পারি, তাইনা? ”
” তুমি আমার কাছে আগে যেমন ছিলে, তোমার মেয়েকে বিয়ে করার পরও তেমনই থাকবে। এবার বাড়িতে চল। এক মিনিট মামা। আগে তুমি আমাকে কাঁধে নিতে মনে আছে? ”
” তো! তুমি কি চাইছো এখনও তোমাকে কাঁধে নিই? সেটা সম্ভব নয়। তোমার ওজন আশি কেজির কম হবেনা। তোমাকে কাঁধে নেয়ার সাধ্য আমার নেই। ”

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৪

” আমি যদি তোমাকে কাঁধে নিই তবে? মনে কর, ছোটবেলার ঋণ শোধ করলাম। ”
” মাফ কর, ভাগ্নে। এই বয়সে আমার হাত-পা ভাঙ্গার শখ নেই। ”
” শ্বশুরকে সম্মান করতে চাইলাম। কিন্তু শ্বশুর রাজি হলোনা। এমন জামাই আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাবেনা। ”
” আমার ভবিষ্যৎ এখনই দেখতে পাচ্ছি। আপাতত এতটুকুই দেখে সন্তুষ্ট থাকি, জামাইবাবা? এবার বাড়ি চল। ”
” চল। ”
দুজন মিলে গল্প করতে করতে বাড়িতে ঢোকে। উঠানে তখনও আড্ডা চলছিল।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৬