বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৬

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৬
জাওয়াদ জামী

সকালে আনানের লা’থি খেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো তাহমিদের। ও নিহান আর আনান একসাথে শুয়েছিল। তাহমিদ মাঝখানে শুয়েছে আর নিহান ও আনান দুইজন দুইপাশে শুয়েছে। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙ্গলে আনানকে নিজের পায়ের কাছে দেখল তাহমিদ। ওর মাথা তাহমিদের পায়ের উপর, আর ওর পা তাহমিদের বুকে। এই অবস্থায়ই ও তাহমিদকে ঝেড়ে লা’থি মে’রে’ছে।
ঘুমের মধ্যে গালে লা’থি খেয়ে তাহমিদের মাথা ভনভন করে ঘুরছে। ও বুঝতে পারছেনা কেন ওর মাথা ঘুরছে। তবে কয়েক সেকেন্ড পর আরেকবার থুতনিতে লা’থি খেয়ে হুঁশ হয়।

” আনান, পা সরা বলছি। ” রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আনানের পা ধরে ঝাঁকুনি দেয় তাহমিদ।
” উফ্ আম্মু একটু ঘুমাতে দাও। এই রাতে ডাকছ কেন! ” ঘুম জড়ানো গলায় বলে আনান।
” আমি তোর আম্মু নই। তুই কি পা সরাবি ইডিয়ট? ”
আনানের কানে তাহমিদের বলা কোন কথাই ঢোকেনি। ও আরামে জাপ্টে ধরে তাহমিদের পা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কি মুশকিলে পরলাম! আনান, এই, আনান? আমি এখন উঠব। এবার আমাকে ছাড়। ”
” উমম, সিক্তা, আমার গুল্টমুল্টু সোনা, তোমাকে আজ আমি ছাড়ছিনা। তোমার ঐ ত্যাড়া ভাইয়ের জন্য, আমি তোমার সাথে ইটিশপিটিশ করার সুযোগই পাইনা। আজ যখন তোমাকে কাছে পেয়েছি, এত সহজে ছাড়ছিনা। ” আনান ঘুমের ঘোরে উল্টাপাল্টা বকছে আর আনানের পায়ে চুমু দিচ্ছে।

আনানের এমন কান্ডে তাহমিদের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। ও ভাবছে, কি করে আনানের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এদিকে আনানের অত্যাচার বেড়েই চলেছে। ঘুমের মধ্যে ওর হাত তাহমিদের দেহের এদিকসেদিক ঘোরাফেরা করছে। তাই তাহমিদ আর কিছু না ভেবে ওর পা আনানের হাত থেকে এতটু আলগা করে নিয়ে, সজোরে লা’থি মারে আর হাত দিয়ে ঠেলা দেয় আনানের পায়ে।

তাহমিদের মত দশাসই মানুষের লা’থি খেয়ে হ্যাংলা পাতলা আনান প্রায় উড়ে গিয়ে মেঝেতে পরে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ ও দম মেরে বসে থাকে। এখনও ওর ঘুমের ভাব কাটেনি। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওর হুঁশ হয়। ও ভাবছে, রাতে তো বিছানায়ই শুয়েছিলাম কিন্তু এখন নিচে এলাম কেমন করে!
তাহমিদ বিছানায় বসে বসে আনানকে দেখছিল।

” ভাই, আমি নিচে কেন? তোমাদের সাথেই তো খাটে শুয়েছিলাম। ”
” আমার লাথি খে’য়ে নিচে গেছিস বেয়াদব। তোর মনে এত নোংরামি আছে তা আমি আগে জানতামনা। তুই আমাকে বাজেভাবে স্পর্শ করেছিস। ”
তাহমিদের কথা শুনে আনান যেন আকাশ থেকে পরল।

” তুমি আমাকে পছন্দ করনা ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এমন অপবাদ দিতে পারনা। তুমি কি মেয়ে! যে তোমাকে আমি বাজেভাবে স্পর্শ করব! তোমাকে স্পর্শ করে আমি কি কোন মজা পাব? আমার শরীরে যা যা পার্ট আছে, সেসব তোমার শরীরেও আছে। তাই তোমাকে স্পর্শ করার প্রশ্নই আসেনা। নাকি আমার থেকে দুই-একটা পার্ট তোমার বেশি আছে! এক মিনিট ভাই, আমি কি তোমার কোন অতিরিক্ত পার্টে হাত দিয়েছিলাম? ”

” আনান, তুই যদি এখনই মুখ বন্ধ না করেছিস, তবে আরেকটা লা’থি মেরে তোকে ঘরের বাইরে ফেলব। ঘুমের মধ্যেও আমাকে যা নয় তাই বলিস! তোর বিয়ে করার সাধ আমি মেটাব। ”
ওদের দুজনের কথোপকথন শুনে নিহানের ঘুম ভেঙে গেছে। ও ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে আছে আনানের দিকে। আনান বেচারা বেকায়দাভাবে বসে রয়েছে।

” এই আনান, তুই ঐভাবে কেন্নোর মত গুটিয়ে আছিস কেন! তোর কি পেটে মোচড় দিচ্ছে? ”
” তুই বেশি বকবক না করে আমাকে টেনে তোল। যতসব অকর্মার দল। ”
” যা নিহান, ওকে তারাতারি টেনে তোল। ওকে ঠিকমত আপ্যায়ন করতে পারিনি। আজ এমন আপ্যায়ন করব, যেন সারাজীবন মনে থাকে। শোন নিহান, ওর যখন প্রকৃতির ডাক আসবে, তুই তখন টয়লেটে গিয়ে বদনা সরিয়ে ফেলবি। আর এক টুকরা সিরিশ কাগজ অথবা কচু পাতা ওর হাতে ধরিয়ে দিবি। ও আগামী সাতদিন এই কাজের জন্য পানি পাবেনা। ”
তাহমিদের কথা শুনে আনানের কলিজা শুকিয়ে গেছে। আর নিহানতো হো হো করে হেসে উঠে।

” ভাই, এমন নিষ্ঠুর হয়োনা। প্রকৃতি এখনই আমাকে ডাকছে। যে কোন মুহূর্তে তারা অ্যাটাক করবে। যে সে ডাক নয়, ভাই। এক্কেবারে জটিল ডাল। যাকে বলে বাঁধভাঙা ডাক। ”
” নিহান, তুই যেয়ে বদনা সরিয়ে ফেল। আর বড় দেখে দুইটা কচু পাতা ওর কাছে দে। ওকে জন্মের শিক্ষা আজ আমি দিব। ”

নিহান তাহমিদের কথামত কাজ করে। ও বেশ উৎসাহের সাথে কাজগুলো করে।
আনানকে সত্যিই পানি দেয়া হয়নি। বেচারা বাতকর্ম সেরে কচু পাতা ব্যবহার করেছে। এরপর কলপাড় থেকে গোসল করে ঘরে আসে।
তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল আনান মুখ কালো করে বসে আছে। ওর এই মুহূর্তে আনানকে দেখে ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু ওর সামনে এখন হাসলে চলবেনা।

” বাহ্ গোসলও করেছিস দেখছি! যাক অবশেষে তোর উন্নতি হয়েছে। ”
” যে কাজ তুমি করিয়েছ, গোসল না করে উপায় আছে! ছিহ্ এমন কাজ আমি করেছি, ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে। তুমি আসলেই নিষ্ঠুর। শুধু তোমার বোনকে ভালোবাসি বলে সবকিছু হজম করছি। তবে সুযোগ পেলে তোমাকে গাড্ডায় ফেলতে আমি ভুলবনা। ”

” সে পরে দেখা যাবে, কে কাকে গাড্ডায় ফেলছে। তবে আগামী সাতদিন তোর এই শাস্তি বহাল থাকছে। ”
” ওয়াক থু। তোমার পায়ে পরি ভাই, আমাকে মাফ কর। আর জীবনেও তোমাকে ছোঁয়ার সাহস করবনা। তোমার সাথে এক বিছানায় কোনদিন ঘুমাবনা। প্রয়োজনে একশবার কানে ধরে উঠবস করব। তবুও ঐ জঘন্য কাজ আমাকে করতে বলোনা। ” আনানের মুখ ভয়ে চুপসে গেছে।
তাহমিদের একটু খারাপ লাগছে আনানের চুপসানো মুখ দেখে।

” মনে রাখিস, আজ কি কি প্রমিজ করলি। এরপর কোন ভুলভাল কাজ করলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য টয়লেট পাবিনা। ঢাকায় থাকলে রাস্তার ধারে, আর গ্রামে থাকলে জমির আইলে কাজ সারতে হবে। ”
” মনে থাকবে, ভাই। ম’রা’র আগ পর্যন্ত মনে থাকবে। ”
” গুড। এবার খেতে চল। বড়মা, খেতে ডাকছে। ”

” খাওয়ার রুচি উঠে গেছে, ভাই। আগামী পনের দিন বোধহয় আমাকে না খেয়েই কাটাতে হবে। ”
তবে আনান মুখ যতই বলুক ঘেন্না লাগছে। ও ঠিকই তাহমিদের সাথে খেতে গিয়েছে এবং ভরপেট খেয়েছে।
খাবার পর ছেলেরা বাইরে ঘুরতে যায়। আর মেয়েরা একজোট হয়ে বাগানে যায়। সেখানে তারা কয়েকজন পাড়াপ্রতিবেশির সাথে আড্ডা দিচ্ছে।

কুহু কোন একটা কাজে বাড়ির ভেতরে আসে। সুযোগ বুঝে শিউলিও ওর পিছুপিছু আসে।
” কিরে হারামজাদি, ঢাকায় যাইয়া খুব পাখনা গজাইছে তাইনা? বাড়িতে আইসা নিজের ইচ্ছামত যা খুশি করতাছস, যেখানে খুশি যাইতাছস। একবারও আমার কাছে জিগাছস? বেশি বাড়সনা, তোর পা ভাইঙ্গা ঘরে ফালায় রাখমু। ”

” আমি আমার ফুপদের কাছ থেকে হুকুম নিয়ে সবখানে যাচ্ছি। আর বাবার কাছেও বলেই যাই। তাই তোমাকে জানানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। তুমি যেমন আমাকে সৎমেয়ে বলেই মনে কর, ইদানীং আমিও তোমাকে সৎমা বলেই মনে করছি। তুমি আমাকে যতটুকু ভালোবাসা দিবে, বিনিময়ে ততটুকু সম্মানও তোমাকে আমি দিব। তাই অযথা আমার বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজের বিষয়ে ঘামাও। কান খুলে শুনে রাখ, পাখনা আমার গজায়নি। তুমি মানুষটা অতিরিক্ত কুটিল, তাই আমার সবকিছুতেই খুঁত খুঁজে পাও। এখনও সময় আছে নিজেকে বদলাও, নইলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। ”

কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না। দৃঢ় পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
এদিকে তাহমিদ কেবলই বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। ঠিক তখনই ওর কানে শিউলির বলা কথাগুলো যায়। হঠাৎই তাহমিদের মন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই কুহুর প্রত্তুত্তর শুনতে পেয়ে ওর বেশ লাগে। কুহু বেরিয়ে যেতেই ও শিউলির সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর মাথায় একটা বদ বুদ্ধি এসেছে।

” আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, মামী? আর সবাই কোথায়? ”
” হেরা বাগানে গল্প করতাছে। ”
” একটু আগে বোধহয় কুহুকে দেখলাম। গতকাল থেকে দেখছি আপনাকে ও বেশ সমীহ করে। আপনিও ওকে হাতে রাখবেন। তবেই আপনার লাভ। ”
” এইসব কি কও! হেরে হাতে রাইখা আমার লাভ কি! ”

” আপনি অতিরিক্ত বোকা একজন মানুষ। তাই বুঝতে পারেননা। শোনেন, কুহুকে ওর ফুপুরা অনেক ভালোবাসে। ও বিবাহযোগ্য একটা মেয়ে। দেখবেন ভালো ছেলের সাথেই তারা কুহুর বিয়ে দিবে। এদিকে আপনার ছেলে-মেয়েরা এখনও ছোট আছে। আবার মামার শারিরীক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তাছাড়া মানুষের নিঃস্বাসের ভরসা নেই। কয়দিন আগেই আমাদের এ প্রতিবেশি ছোট একটা মেয়ে রেখেই মা’রা গেছে।

এমন যদি হয় আপনার কিছু একটা হয়ে গেল! মামা কিন্তু আইরিন মামীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সে মা’রা যাওয়ার পর মেয়ের কথা ভেবে আপনাকে বিয়ে করেছে। সে কিন্তু বিয়ে করেছে আইরিন মামীকে ভুলে। একবার ভাবুন, আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন মামা শিহাব, দৃষ্টির জন্য আবারও বিয়ে করেছে। আপনি যেমন কুহুকে ভালোবাসেন, ঠিক তেমনি সেই নতুন বউ এসে আপনার ছেলেমেয়েকে তেমনভাবেই ভালোবাসল। আবার কুহু বিয়ের পর আপনার ছেলেমেয়েকে আর পাত্তা দিলনা। কিন্তু সে ঠিকই সুখে সংসার করছে। এমন হলে আপনার কি ভালো লাগবে? ”

তাহমিদের কথা শুনে শিউলির মুখ শুকিয়ে গেছে। ও ভাবছে, ছেলেটাত ভুল কিছু বলেনি। ওর কিছু হয়ে গেলে দৃষ্টি, শিহাবের কি হবে!
” ও বাজান, আমি এহন কি করমু তুমি কইয়া দেও। আমার কইলজাডা কাঁপতাছে। আমার পোলা-মাইয়ার কোন কষ্ট আমি সইবার পারমুনা। ”

তাহমিদ এটাই চাইছিল। তাহমিদ লক্ষ্য করেছে শিউলি আক্তার দজ্জাল মহিলা হলেও, তার বুদ্ধি খুব একটা নেই। একবার শিউলির মনের মত হতে পারলে, তাকে দিয়ে সব কাজ করানো যাবে। সেই অনুযায়ী তাহমিদ ওর চাল চেলেছে।
” আমার কথা মনযোগ দিয়ে শোনোন, আপনি সবার সাথে ঠান্ডা ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে মামা আর কুহুর সাথে। একটা কথা মনে রাখবেন, কুহুকে হাতে রাখতে পারলে আপনার ছেলেমেয়েরা এমনিতেই মানুষ হয়ে যাবে। আপনাদের কারও কিছু হয়ে গেলে কুহুই কিন্তু দৃষ্টি, শিহাবের মূল অভিভাবক হবে। তাই কুহুকে হাতে রাখুন। ওর সাথে ভালো আচরণ করুন। তারপর দেখবেন সবকিছু আপনার হাতের মুঠোয় এসেছে। অন্য কারও কোন উপদেশ মাথায় নিবেননা। আমি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি? ”

” আমি বুজ্জি বাজান। এরপর থাইকা কুহুর সাথে ভালো কইরা কতা কমুনে। তুমি ঢাকায় যাইয়া আমার লগে কতা কইও। আমারে বুদ্ধি দিও। আমি কারো সাতেই পরিবার নিয়া কতা কমুনা। ”
” আপনার ফোন নম্বর আমাকে দিয়ে দিয়েন। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। ”
” আইচ্ছা, বাজান। তুমি কিনা খাইবা? বানায় দেই? ”
” নাহ্ এখন কিছুই খাবোনা। আমি ফোন চার্যে দিয়ে বাইরে যাব। ”

তাহমিদ শিউলিকে মানাতে পেরে ভিষণ খুশি হয়। কুহুর একটা দিক ও সামলাতে পেরেছে।
কুহু লক্ষ্য করল ছোটমা ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলছে। এটা-সেটা জানতে চাচ্ছে। কুহুর প্রতি কোনও বিরক্তি দেখাচ্ছেনা। ছোটমার হঠাৎই এরূপ পরিবর্তন কুহুকে অবাক করে।
আজ ওদের ঢাকা ফেরার দিন। সকাল দশটার দিকে রওনা দিবে। শিউলি সকাল সকাল রান্না শেষ করেছে। কুহু, সিক্তা, তনয়া, দৃষ্টি, আরোশি মিলে নদীর ধারে গিয়েছে। ওরা গ্রাম ছাড়ার আগে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখছে।

” সিক্তা, এখন চল যাই। সাড়ে আটটা বাজে। খেয়েদেয়ে সবাইকে তৈরি হতে হবে। ” কুহু সিক্তাকে ঠেলছে। কিন্তু এতে সিক্তার কোনও হেলদোল নেই।
” আপু, তুমি আবার কবে আসবে? তোমাকে ছাড়া বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ” দৃষ্টি মন খারাপ করে কুহুকে জিজ্ঞেস করল।

” এ্যাডমিশন হয়ে যাক। কোথায় চান্স পাই দেখি। একবারে ভর্তি হয়েই তবে বাড়িতে আসব। তোরা কিন্তু এরমধ্যে একবার ঢাকায় যাবি। বাবাতো আজ আমাদের সাথে যাচ্ছেনা। বাবাকে রাজি করিয়ে তার সাথেই ঢাকায় যাস। আমিও বাবাকে বলব। তোদের ছাড়া থাকতে আমারও ভালো লাগেনা। ” কুহুর চোখে পানি। দৃষ্টিও কাঁদছে।
” এই যে পাখিদের দল, তোমরা কারা? কোন বাড়িতে আসছ? ” জমির উদ্দিন মেম্বার কুহুদের পেছন থেকে ডাক দেয়।
কারও ডাক শুনে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

এদিকে কুহুকে দেখা মাত্রই জমির উদ্দীনের লোলুপ দৃষ্টি ওর সর্বাঙ্গে খেলা করছে।
জমির উদ্দিনের লোভী দৃষ্টি কুহুর চোখ এড়ায়না। এমনকি মেয়েরা সবাই বুঝতে পেরেছে।
” আমরা যেই বাড়িরই হইনা কেন, তাতে আপনার কি? যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যান। মেয়েদের দেখলেই জিহবা লকলক করে? ” দৃষ্টি জমির উদ্দিনকে দেখেই খেঁকিয়ে উঠে।
” পাখি মানে কি হ্যাঁ? বুড়া ভাম। তিনকাল যেয়ে এককালে ঠেকেছে। হাঁটুর বয়সী মেয়েদের পাখি বলছেন? লুচ্চা বুড়া। ” এবার তনয়া একহাত নেয়।

” আমার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছেন বুঝি! তাই এখনও বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে আছেন? ঘরে মা, বোন নেই? চেহারাই কেমন শেয়ালের মত। ” এবার আরোশি মুখ ঝামটা দেয়।
” এই তোরা একটু থাম। আমাকে বলতে দে। শোনেন আমরা যেখানেই আসিনা কেন, তাতো আপনার কি? আপনার ম’রা’র বয়স হয়েছে, তাই আল্লাহর নাম নেন। দৃষ্টি সংযত করেন। এই বুড়া বয়সে এমন দৃষ্টি মানয়না। এখনও যদি এমন শকুনের দৃষ্টি থাকে, তবে কোন যুবতী মেয়ে কপালে না জুটে পাঁচ সন্তানের মা জুটবে। তাই লুচ্চামি বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যান। ” সিক্তার কথা শুনে দৃষ্টি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।

” আপু, এই বুড়াকে পাঁচ বাচ্চার মা-ও দাম দেয়না। সব সময়ই খালি ছোঁকছোঁক করে বেড়ায় আর আর মেয়েদের মুখ ঝামটা খায়। এই বুড়ার সাথে কথা না বলে বাড়িতে চল। ”
মেয়েরা সব বাড়ির পথ ধরলে, জমির উদ্দিন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার একটা কথার জন্য মেয়েগুলো কত কথা শুনিয়ে গেল! বাপরে ঝাঁঝ এখনকার মেয়েদের!

আজ তাহমিদ, আনান, নিহান, কুহু, সিক্তা, তনয়া, আরোশি এক গাড়িতে উঠেছে। আনান বসেছে ড্রাইভারের পাশে। আর সবাই যে যার মত সিটে বসে। কুহু বসতে গিয়ে দেখল ওর পাশে তাহমিদ বসেছে। তাহমিদের সাথে এত রাস্তা যেতে হবে ভাবতেই কুহুর ভেতর কেমনযেন হতে থাকে। এই বেফাঁস মানুষ সবার সামনে আবার কিছু বলে বসবেনাতো!
কুহুকে আরোশির পাশে দিয়ে তাহমিদ জানালার পাশে বসেছে। ওর একপাশে আরোশি আরেকপাশে কুহু ছিল। দুইপাশে দু’জন মেয়ের বসাতে ওর সমস্যা হচ্ছিল। তাই কুহুকে আরোশির কাছে দিয়ে ও জানালার ধারে আসে।

সবার কাছে বিদায় নিতেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। আজও কুহুর বাবাকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। মেয়ের কান্নায় ভেঙে পরে কায়েস। সে জানায় আট-দশদিন পর সে ঢাকায় যেয়ে চিকিৎসা করাবে। অনেক বোঝানোর পর কুহু শান্ত হয়।

” আনান, সামনের বাজারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাবার কিনবি। অনেক রাস্তা যেতে হবে। এদের ক্ষুধা লাগতে পারে। তাছাড়া কেউ কেউ কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। তার ডিহাইড্রেশন হয়ে গেলে মুশকিল হবে। তার জন্য মনে করে এক প্যাকেট স্যালাইন কিনিস। ”
” আমার কাছে খাবার কিংবা স্যালাইন কেনার জন্য কোনও টাকা নেই, ভাই। তবে তুমি যদি দাও আমি নিজ দ্বায়িত্বে কিনতে পারি। ”

” বেয়াদব, আমি কি বলেছি তোর টাকায় কিনতে? টাকা আমি দিব। তুই শুধু কিনে নিয়ে আসবি। ”
” ভুল বলছ, ভাই। বেয়াদব আমি নই, বেয়াদব হলে তুমি। তা-ও তোমার সিনিয়র রাশেদিনের কাছে। এই উপাধি একমাত্র তোমারই প্রাপ্য। তাই নিজের অর্জন আমার দিকে ঠেলে দিওনা। আমি নিতে পারবনা। ”

” চুপ কর ইডিয়ট। সবাইকে জানাব সেদিনের ঘটনা? ”
” মাফ কর, ভাই। আমিই এক নম্বরের বলদ। পরিনতি জানা স্বত্বেও তোমার সাথে মুখ লাগাতে যাই। ”
” ভাইয়া, সেদিন সকালে কি হয়েছিল? একটু বলনা, প্লিজ। ” সিক্তা উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চায়।
” আনানের কাছ থেকে শুনে নে। ও-ই ভালো বলতে পারবে। সে সময় ওর পাশে আমি ছিলামনা। ”
” তুই চুপ থাক, মির্জাফরের মেয়ে ঘষেটি বেগম। খালি ছোঁকছোঁক করার স্বভাব। বড়দের বিষয়ে এত মাথাব্যথা কেন তোর? ” আনান ধমক লাগায়।

” আমি যদি ঘষেটি বেগম হই তবে তুই জঙ্গলের ভেতর আনারস, পঁচা মুলা, বেগুনের পোকা। ” সিক্তাও রে’গে উঠে।
” বড়দের সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখ৷ আমি কিন্তু বয়সে তোর বড়। তুই নিজে যে ঝগড়ুটে, কুচুটে মহিলা, তা কি তুই জানিস? ” আনানও মুখ চালায়।
” আহ্ সিক্তা, তুই কি শুরু করলি! আনান ভাইয়া তোর বয়সে বড়। তার সাথে এমন করে কথা বলিস কেন! চুপচাপ বসে থাক। ” এবার কুহু আনানের পক্ষ নিয়ে কথা বলে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৫

” কোকিলা, তুই আজ আমার মায়ের পেটের বোনের মত কাজ করলি। এদিকে আমার নিজের বোন মুখে কস্টেপ লাগিয়ে বসে আছে। তার ভাইকে যে একটা উটকো ঝামেলা হাজারটা কথা শোনাচ্ছে, সেইদিকে তার কোন নজরই নেই। তোকে আমার নিজের টাকায় কেনা চকলেট খাওয়াব। ”
” ভাইয়া, তুমিও চুপ থাক। আর একবার যদি ঝগড়া কর, তবে আমি গাড়ি থেকে নেমে যাব। ”
কুহুর হুমকিতে কাজ হয়। ওরা অবশেষে মুখ বন্ধ করে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৭