বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৯

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৯
জাওয়াদ জামী

তাহমিদেকে আসতে দেখেই কুহু রুমে ঢুকেছে। নুসরাত আন্টি এমনিতেই ওকে ভালো চোখে দেখছেনা। ওর ওপর ক্ষিপ্ত। তারপর যদি দেখে তাহমিদ ওর সাথে কথা বলছে, তবে নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা রিয়্যাক্ট করবে। এই বাসায় যে কয়দিন আছে, সে কয়দিন একটু নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চায় কুহু।
তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে আশেপাশে তাকাল। কিন্তু কুহুকে কোথাও দেখলনা। ওর এবার রাগ হচ্ছে।

” এই মেয়ে কি আমাকে মে’রে ফেলার প্ল্যান করেছে। নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে আমি এসেছি। তবুও সামনে আসার নাম নেই! ”
” তাহমিদ, একা একা কি কথা বলছ! এসো খেয়ে নাও। সামিহা খাবার নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও না খেয়ে আছে, তোমার সাথে খাবে বলে। ”
” যাচ্ছি, ফুপু। কিন্তু সামিহা এতক্ষণ না খেয়ে আছে কেন! অপেক্ষা না করে, খেয়ে নিলেই পারত? ”
” ওর ইচ্ছে হয়েছে আজ তোমার সাথে খাবে। তাই আমি আর কিছু বলিনি। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাহমিদ খেতে বসেছে, ওর পাশের চেয়ারে বসেছে সামিহা। ও নিজেও খাচ্ছে আবার তাহমিদকে খাবার তুলেও দিচ্ছে। তাহমিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নুসরাত।
আফরোজা নাজনীন আর তাহমিনা আক্তার ড্রয়িংরুম থেকে চুপচাপ সব দেখছিলেন। আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে খাওয়াতে চাইলে নুসরাত তাকে ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দেয়। তবে তিনি আবার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছেন। তাহমিনা আক্তার নুসরাতের এমন কান্ড দেখে আর নিজের রুমে যাননি।

” বড়মা, আমাকে একটু তরকারি দিয়ে যাও। তুমি দূরে বসে আছ কেন! জানোনা তুমি খাবার তুলে না দিলে আমি খেতে পারিনা। ”
তাহমিদের কথা শোনামাত্রই আফরোজা নাজনীন দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলেন। তিনিও এতক্ষণ উসখুস করছিলেন তাহমিদের কাছে আসার জন্য। তিনি তাহমিদের কাছে এসে দেখলেন ওর প্লেটে বোয়াল মাছের দুইটা পিস। কিন্তু তাহমিদ বোয়াল মাছ খায়না।

” বাপ, এই বাটিতে মাছগুলো রেখে দে। আমি তোকে রুই মাছ দিচ্ছি। এরপর চিংড়ি মাছের মালাই কারি দিচ্ছি। ”
” মামি, তাহমিদ ভাইয়াকে আমি বোয়াল মাছের ঝোল দিয়েছি। কিন্তু তুমি তুলে রাখতে বলছ কেন! ” সামিহা একটু বিরক্ত হয়ে বলে।
” সামিহা, আমি বোয়াল মাছ খাইনা। বড়মা তাই সেগুলো তুলে রাখতে বলেছে। তুমি না জেনেই বড়মাকে দোষারোপ করছ। আমার পছন্দ-অপছন্দ আমার মা’য়ের থেকে বড়মা বেশি জানে। সে আমার মা’য়ের থেকে কোনও অংশে কম নয়। বরং একটু বেশিই। ”

” তাহমিদ, ও বুঝতে পারেনি, তাই ভুল করেছে। এরপর থেকে আর কোন ভুল করবেনা। এখনতো তুমি দেশেই আছ। সামিহা তোমার আশেপাশে থেকে তোমার পছন্দ-অপছন্দ সব জেনে নিবে। ”
” সামিহা, তুমি বোধহয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছ? আমার পছন্দ-অপছন্দ জানার জন্য তুমি পড়াশোনা বাদ দিবে! তাছাড়া আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে হলে তোমাকে আমার সাথে মেডিকেলে যেতে হবে। আমি শুধু রাতে বাসায় থাকি। তুমি যদি রাজি হও তবে আমার এ্যাসিট্যান্টের জায়গায় তোমাকে রাখতে পারি। সারাদিন আমার আশেপাশেও থাকা হল, আর পছন্দ-অপছন্দও জানার সুযোগ হল। ”

” এসব কি বলছ, তাহমিদ! তোমার এ্যাসিন্ট্যান্ট হওয়া ছাড়াও সব কিছু জানার ব্যবস্থা আছে। তুমি কয়দিন ওকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াও। ওকে একটু সময় দাও। দেখবে ও সব জেনে নিবে। ” নুসরাত হাল ছাড়ার পাত্রী নয়।
” ফুপু, তুমিও কি সব বলছ! আমার এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোর সময় কই? সারাদিন রোগীর কলিজা পরীক্ষা করতে করতে চোখের দৃষ্টি কমে যাচ্ছে। তুমি কিনা আমাকে বলছ ঘুরে বেড়াতে! ”

” বাপ, এখন চুপচাপ খেয়ে নে। কয়টা দিন না জানি কত পরিশ্রম করেছিস। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করেছিস নাকি আল্লাহই জানেন। এখন পেট ভরে খা। ”
” তোমার মত রান্না সারা দুনিয়ার কোথাও পাইনা। তাই মুখের সামনে হাজার রকম খাবার থাকলেও খেতে পারিনা। বড়মা, সিক্তকে দেখছিনা যে? আমি এসেছি ও জানেনা? ”
” সে বাসায় থাকলে তো দেখবি। সে গেছে বান্ধবীর সাথে কেনাকাটা করতে। কত করে নিষেধ করলাম, কিন্তু শুনলে তো। তার নাকি আজকেই অনেক কিছু কিনতে হবে। সবাই মিলে আদর দিয়ে ওকে মাথায় তুলে রেখেছিস। তাকে মানানোর সাধ্য কার। ”

” বাদ দাও। দেখবে কয়দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনই তো ওর কেনাকাটা করার সময়। যখন তোমার মত সংসার হবে, তখন এসবের সময় পাবে, তুমিই বল? ”
” বাপ, তুই খা। ওকে নিয়ে আর কোন কথাই বলিসনা। ”
তাহমিদ মৃদু হেসে খেতে থাকে।
সামিহা মুখ কালো করে বসে আছে। ওর গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। কত আশা ছিল তাহমিদকে নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবে, কিন্তু তা আর হলোনা।

খাওয়া শেষ করে তাহমিদ নিজের রুমে যায়। কি মনে করে আবার বেড়িয়ে এসে সিক্তার রুমের সামনে দাঁড়ায়। দরজা ভেজানো, ভেতরে কেউ নিশ্চয়ই আছে। ও মৃদুভাবে দরজায় টোকা দেয়। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে রুমে ঢুকে যায়।
কুহু দরজায় টোকা শুনে বিছানা থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু দরজা ঠেলে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে থেমে যায়। দরজা খুলে তাহমিদ কয়েক পা ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে।

” আমার পাখিটা এভাবে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে কেন! তাকে যে কেউ একজন খুঁজছে, এটা কি সে জানে? ”
” আমার সাথে আপনার কি দরকার? আপনি আমাকে খুঁজবেন কেন! আপনি খুঁজবেন সামিহা আপুকে। ”
” আমি কাকে খুঁজব সেটা কি আমাকে অন্য কেউ বলে দিবে! আমার যাকে প্রয়োজন, আমি তাকেই খুঁজব। আর সামিহাকে আমার কোনও প্রয়োজন নেই, যে তাকে খুঁজতে হবে। এখন বেশি কথা না বলে আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এস। আমি রুমে অপেক্ষা করছি। ”

” সরি। আপনি অন্য কাউকে বলুন। এ বাড়িতে আপনার কাজ করে দেয়ার মানুষের অভাব নেই। পারলে সামিহা আপুকে বলুন। দেখবেন সে আপনার কাজ করে দেয়ার জন্য একপায়ে খাড়া হয়ে আছে। আরেকটা কথা কখনো সিক্তা না থাকলে এভাবে ওর রুমে আসবেননা। বিষয়টা খারাপ দেখায়। আমি যতদিন সিক্তার রুমে আছি, ততদিন আপনি নিজের ইচ্ছেকে লাগাম দিয়ে চলবেন আশা করি। যেহেতু আমি আপনাদের বাড়ির মেহমান , তাই আমি চাইবনা আপনার ছোট একটা ভুলের জন্য আমি সবার কাছে ছোট হয়ে যাই। আশা করছি আপনি যা বলতে এসেছিলেন, সেটা বলা শেষ হয়েছে? ”

” আমি আর কি বললাম! যা বলার বললেতো তুমি। ” তাহমিদ দুপদাপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আয়েশা সালেহা একটা হাদিসের বই পড়ছিলেন। খাটে হেলান দিয়ে পায়ের নিচে একটা বালিশ রেখে তিনি আধা শোয়া হয়ে ছিলেন।
তাহমিদ হুট করে এসে দিদুনের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে পরে।

” কি হয়েছে, দাদু, তুমি এভাবে শুলে কেন? এইপাশে এসে বালিশে মাথা রেখে শোও। ”
” সামিহার বিষয়টা কুহু জানে, দিদুন? ওর সামনেই কি আলোচনা হয়েছিল? ”
” হুম। ড্রয়িংরুমে সবার সামনেই কথা হয়েছিল। কেন দাদু ভাই? কোন সমস্যা হয়েছে? ”
” উহু, কিছুই হয়নি। ”

তাহমিদ আর কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকে। একটু পর ঘুমিয়ে যায়। আয়েশা সালেহা নাতির একটু উঠে বসে, নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
কুহু বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। ওর কিছুই ভালো লাগছেনা। ফুপা যেখানে তাহমিদ ভাইয়ার জন্য সামিহা আপুকে নিজে পছন্দ করেছে, সেখানে ওর উচিত নয় তাহমিদকে প্রশ্রয় দেয়া।
সেকারণেই একটু আগে ও তাহমিদকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়েছে। কুহু লক্ষ্য করেছে ওর কথাগুলো শুনে তাহমিদের মুখটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর কিছুই করার ছিলনা।

তাহমিদকে এভাবে কথা শুনিয়ে ওর যে ভালো লাগছে তা নয়। কুহু বুকের বামপাশে একটা চিনচিনে ব্যথার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। ব্যথাটা যেন ক্রমশই বাড়ছে। মানুষটাকে কত কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। ওর মা’য়ের কথা জানার ছিল। মানুষটাতো খুব কাছে থেকে মা’কে দেখেছিল। সে নিশ্চয়ই বলতে পারত ওর মা’য়ের হাসি কেমন ছিল, কিংবা ওর মা’য়ের কথা বলার ধরন। তা বুঝি আর হলোনা। এমনিতেই সামিহা কিংবা নুসরাত আন্টি ওকে পছন্দ করেনা। এরমধ্যে যদি ওকে তাহমিদের সাথে কথা বলতে দেখে, তারা নিশ্চয়ই ভালোভাবে নিবেনা। তাই সময় থাকতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়াই শ্রেয়।
সারাদিন কুহু রুম থেকে বের হয়না। এমনকি রাতেও খায়না। ওর ফুপু কয়েকবার করে খেতে দেখেছে, কিন্তু ও ক্ষুধা না লাগার অযুহাত দিয়ে রুমেই থেকেছে।

তাহমিদ নিজের রুমে বসে একটা ফাইলে চোখ বুলাচ্ছে। কাল থেকে শুরু হবে ওর গৎবাঁধা কাজ আর ব্যস্ততা। রাতে খাবার পর তাহমিদ রুমে এসে ঢুকেছে আর বের হয়নি। ও ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মনযোগ দিতে পারছেনা। বারবার কুহুর কথাগুলোই মনে হচ্ছে।

মেয়েটা নিশ্চয়ই চাইছেনা ওর ফুপার কোন অসম্মান হোক। তাই নিজেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছে। যে করেই হোক ওর সাথে কথা বলতে হবে। তার আগে প্রয়োজন সিনিয়র রাশেদিনের সাথে কথা বলা। আজ ভদ্রলোক এখনও বাসায় আসেননি। তাই তার সাথে কথা বলাও হয়নি। কালকে তার সাথে কথা বলতেই হবে।
রাত তিনটা। ধরনী ঘুমের কোলে। রাতজাগা পাখিরাও আজ কোন শব্দ করছেনা। বাইরে ঝিঁঝিঁরাও গাইছেনা। নিরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ।

কুহুর চোখে ঘুম নেই। ওর পাশে সিক্তা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কুহু ঘুমন্ত সিক্তার মুখপানে দৃষ্টি মেলে চায়। কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। কুহু মাঝেমধ্যে ভাবে সিক্তার মত জীবন কেন ওর হলোনা। যে জীবনে মা হারানোর শোক নেই, সৎমায়ের দূর্বিষহ অত্যাচার নেই, প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় নেই। প্রিয় মানুষ! হ্যাঁ, প্রিয় মানুষ। এই কয়েকদিনেই মানুষটা ওর অনেক কাছের হয়ে উঠেছিল। সামিহা আপু আসার পর থেকে এটা বেশ অনুভব করছে কুহু। কিন্তু আর কিছুদিন পর হয়তো সে পুরোপুরি সামিহা আপুর হয়ে যাবে। আজ খুব কান্না পাচ্ছে। একটা বুক ভিষণ প্রয়োজন। যে বুকে মাথা রেখে কাঁদলে সব দুঃখ নিমেষেই দূরে পালাবে।

অতি সন্তর্পনে বিছানা ছাড়ে কুহু। গন্তব্য ছাদ। এত রাতে নিশ্চয়ই কেউ জেগে নেই। রাত এগারোটার দিকে একবার সামিহা আপু এসেছিল, সে সিক্তাকে নিয়ে ছাদে যেতে চাইছিল। কিন্তু সিক্তা না যাওয়ায় সে একাই ছাদে যায়। অবশ্য এতরাত পর্যন্ত তার ছাদে থাকার কথা নয়। যদিও এতরাতে ছাদে যেতে ওর একটু ভয় হচ্ছে। কিন্তু তবুও মনকে পোষ মানায়। আজ কুহু জোছনার সাথে দুঃখ বিলাস করবে। কাউকে না বলা, চার দেয়ালের ভেতর বন্দী গোপন কথাগুলোকে আজ হাওয়ায় ভাসিয়ে দিবে। আজ কুহু ভিষন কাঁদবে। না পাক সে কারও বুক। আজ আকাশের বুকেই নিজের দুঃখগুলোকে সঁপে দিবে। আকাশকে বলবে, বিছিয়ে দাও তোমার প্রশস্ততার চাদর, তাতেই ঢেকে রাখি আমার সকল কষ্ট। তুমি হও আমার গোপন প্রনয়ের সাক্ষী।

গুটি গুটি পায়ে ছাদের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজও দরজা হাট করে খোলা! তবে কি গত কয়েকদিনের ন্যায় আজও সামিহা আপু দরজা না লাগিয়েই নিচে চলে গেছে! একটু বিরক্ত হয় কুহু। সামিহা গত কয়েকদিনে কে কয়বার ছাদে এসেছে, যাবার সময় একবারও দরজা লাগিয়ে যায়না। পরদিন সকালে মনি আপা ছাদে আসলে দরজা খোলা পায়। বাসার সবাইকে একথা জানালে সামিহা আপু নিজের দোষ স্বীকার করে।

দরজা দিয়ে অন্ধকার ছাদে উঁকি দেয় কুহু। ছাদের একটা বাতিও জ্বলছেনা। সাহস করে পা রাখে ছাদে। আস্তে আস্তে যায় রেলিঙের দিকে। পুব আকাশে চাঁদ স্তিমিত আলো নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
এতরাতে ছাদে কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাহমিদ মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। চাঁদের স্বল্প আলোয় বুঝতে পারে তার রাতজাগা পাখি এসেছে। অজান্তেই ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু ও এখনই নিজের অস্তিত্ব কুহুকে জানান দিতে নারাজ। দেখা যাক সে কি করে।

ছাদে আসার পর থেকেই কুহু একটা গন্ধ পাচ্ছিল। কিন্তু কিসের গন্ধ তা বুঝতে পারছেনা। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে এটা সিগারেটের গন্ধ। কিন্তু আশেপাশে তো কেউই নেই! কে সিগারেট খাচ্ছে! কুহু ভয় পেয়ে পুরো ছাদে দৃষ্টি বোলায়। অনেকক্ষণ পর ছাদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে একটু আলোর মত দেখতে পায়। ভয়ে ও একটা হার্টবিট মিস করে। ঢোক গিলে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ওকে থমকে দাঁড়াতে হয়।

” দাঁড়াও। ছাদে এসেছ, অথচ আমার সাথে কথা না বলেই চলে যাচ্ছ আমার, রাতজাগা পাখি? আমার কিছু কথা শুনেই তবে তুমি নিজের রুমে যাবে। ”
” আমি দাঁড়াতে পারবনা। আপনি ছাদে আছেন জানলে আমি কখনোই ছাদে আসতামনা। ”
কুহু দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে চলে আসতে চাইলেই তাহমিদ ওকে আটকে দেয়। এরপর আটকে দেয় ছাদের দরজা।
” চিন্তা করোনা, এতরাতে কেউ জেগে নেই। আমি যা বলি সেগুলো শুধু চুপচাপ শুনে যাও। ”
তাহমিদের মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। কুহু গন্ধ সইতে না পেরে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।

” ছিহ্ আপনি সিগারেট খান? ”
” তুমি বাধ্য করেছ। ”
” আমি! ”
” প্রিয় মানুষ আঘাত দিয়েছে কখনো? দেয়নি না? কিন্তু আমাকে দিয়েছে। তাই সিগারেটের প্রয়োজন হয়েছে। ”
কুহু কি বলবে ভাষা খুঁজে পায়না।
” আমি নিচে যাব। ”
” আরেকটু পর। আমার বউ হওয়ার জন্য তুমি মন থেকে প্রস্তুত আছো? হ্যাঁ অথবা না। যেকোন একটা উত্তর আমি চাই। উত্তর হ্যাঁ হলে ওয়েলকাম। আর উত্তর না হলেও কোন সমস্যা নেই। আমার জিনিসের দখল আমি নিতে জানি৷ এবার বল হ্যাঁ অথবা না। ”

কুহু নিরুত্তর থাকে। নিজের ভালো চাইতে গেলে ফুপার অসম্মান হবে। আর নিজের কষ্ট বুকে রাখতে গেলে সামনের মানুষটা ছেড়ে কথা বলবেনা। কি করবে ও! সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কুহু।
” তুমি একবার রাজি হও। দেখবে আমি সবাইকে রাজি করাব। সিনিয়রের চিন্তা তুমি করোনা। আমি যা বলব সে তাই করবে। সবকিছু নির্ঝঞ্ঝাটভাবে মিটে যাবে। কিন্তু তুমি রাজি না হলে আমি সিনক্রিয়েট করব। শেষমেশ রাজি তোমাকে হতেই হবে। মাঝখান থেকে সবাই অনেক কিছু জেনে যাবে। সিনিয়র রাশেদিন কষ্ট পাবে। তুমি কি আমার ভালোবাসা দেখনা, কুহু? আমাকে কি তোমার প্লে বয় মনে হয়?

আমার সাথে তোমাকে প্রেম করতে বলিনি কখনো। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। কিন্তু তার আগে চেয়েছি, তোমার মনে আমার জন্য একটু আবেগ জন্মাক। সিনিয়র রাশেদিন সেই সুযোগ যখন দিলইনা, তখন দুজনে এক হতে দোষ কোথায়? তোমার যদি কাউকে ভালো লেগে থাকে, সেটা আমাকে বল। আমি নির্দিধায় তোমার সামনে থেকে সরে যাব। কিন্তু তবুও এমন নিরুত্তর থেকোনা। আমার কষ্ট হয়। আমার ভালোবাসা একটু বোঝার চেষ্টা কর। দেখবে দুনিয়ার সবার ভালোবাসা তোমার কাছে বিস্বাদ লাগবে। প্লিজ কুহু, কিছু বল। ”

তাহমিদের এমন আকুতিভরা কথায় কুহুর শরীর কাঁপতে থাকে। আন্দোলিত হয় বুকের বাঁ পাশ। টলে যেতে শুরু করে এত বছরের ধৈর্যের মুখোশ। আবেগে কাঁপতে থাকে ওষ্ঠদ্বয়। ভিজে আসে চোখ।
তাহমিদ ব্যাকুলভাবে তাকিয়ে আছে ওর রাতজাগা পাখির দিকে। ও কিছু শুনতে চাইছে। যে কথা শুনতে শান্ত হবে ওর হৃদয় গাঙের ঢেউ। যে কথায় শুরু হবে নতুন প্রনয় গাঁথা। আজ সে কথাই শুনতে চায় তাহমিদ।

” ভালোবাসি। ” ফিসফিসিয়ে বলল কুহু।
এক মুহুর্ত পর কুহু আবিষ্কার করল তাহমিদের হাতদুটো ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।
” আজ আমাদের প্রনয়ের সাক্ষী থাকল ঐ চাঁদ, জোছনা আর ঐ অসীম অন্তরীক্ষ। সাক্ষী রইল মহাকাল। এবার নিচে যাও। নিশ্চিন্তে ঘুম দাও। কাল এই সময় তুমি আমার রুমে থাকবে। সিঙ্গেল জীবনের শেষ রাতটা ভালোভাবে উপভোগ কর। এরপর থেকে তোমার প্রতিটা রাত লিখব আমি। তোমার প্রতিটা দিন লিখা হবে আমার নামে। ”

” কিন্তু নুসরাত আন্টি? ”
” সেটা আমাকে বুঝতে দাও। তুমি শুধু রুমে থাকবে। বাকিটা আমি দেখব। ” কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বলে তাহমিদ।
কুহু লজ্জায় নুয়ে পরে। শিরশির করে ওঠে ওর সর্বাঙ্গ।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ১৮

বিঃদ্রঃ গতকাল ভুল করে খুলনা প্রোকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় লিখেছিলাম। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২০