বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২২

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২২
জাওয়াদ জামী

ধরনী ফজরের আজানের সুমধুর সুরে মুখরিত হতেই কুহু বিছানা ছাড়ে। তাহিমদকেও উঠতে বাধ্য করে। কুহু সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে।
দু’জন একসাথে ফজরের নামাজ আদায় করে। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিনের শুরুটাই সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যের মাধ্যমে করতে চাইছিল কুহু। সে সফলও হয় । তাহমিদ বাধ্য ছেলের মত কুহুর কথা মেনে নিয়েছে।
নামাজ শেষে তাহমিদ বিছানায় যায়। কুহুকেও ডেকে নেয়। কুহু ভালো করেই জানে , এখন বাইরে গেলে কাউকে পাবেনা। তাই ও তাহমিদের কথা মেনে নেয়।

” সুখ পাখি, এবার একটু ঘুমাও। তুমিও ঘুমাও, আমাকেও ঘুমাতে দাও। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে দাওনি। এবার একটু ঘুমাতে দাও। ” কুহুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ।
তাহমিদের কথাটা শুনে কুহু চোখ বড় করে তাকায়।
” কি বললেন! আমি আপনাকে ঘুমাতে দিইনি! নিজেই আমাকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছেন। শেষে বলছেন, আমিই ঘুমাতে দিইনি! ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” হুম, তুমিই দায়ী। তোমার মত একটা বউ যে পুরুষের আছে, তার রাতের ঘুম এমনিতেই হারাম হয়ে যাবে। আর তুমিতো আমার সাধনার ধন। তুমি পাশে থাকলে ঘুম আসবেনা এটাই স্বাভাবিক। আর আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে, তুমি ঘুমাবে এটা হতে পারেনা। এবং সেক্ষেত্রে আমার প্রেম প্রেম পাবে, এবং সেটা অতিমাত্রায় এটা আমি স্বীকার করছি। আর আমার প্রেম পাওয়া মাত্রই তোমাকে সাড়া দিতে হবে এটাও ঠিক। এবং তুমি সাড়াও দিয়েছ। সেক্ষেত্রে দায়ী কে? তুমি না আমি? ”
তাহমিদের কথার উত্তর কি দিবে কুহু ভেবে পায়না। লজ্জায় ওর কান গরম হয়ে গেছে। কি নির্লজ্জ মানুষ এইটা!
” আনান ভাইয়া ঠিকই বলে। আপনি আসলেই একটা তার ছেঁ’ড়া। কখন যে কোন তারের কানেকশন ছুটে যায় বোঝা দায়। ”

” বিয়ের চব্বিশ ঘণ্টা না হতেই ভাই ভালো, জামাই তার ছেঁড়া! বাহ্ তাহমিদ বাহ্। তোর বউ প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকালো। লজ্জা হওয়া উচিত তোর। এ জীবন নিয়ে কি করবি? বউয়ের মাঝেই ডুবে ম’রা উচিত তোর। এটাই তোর একমাত্র শাস্তি। ”
তাহমিদের কথার ধরন শুনে কুহুর একদিকে হাসিও পাচ্ছে আবার লজ্জাও লাগছে। তবে ও কিছু বলার সাহস পায়না। পরে না জানি এই লোক আরও কিছু বলে বসে।

” আজ ঘুম থেকে উঠেই, তোমার ঐ ভাইয়ের ট্রিটমেন্ট আমি করব। ঐটা বেশি বেড়েছে। আমার একমাত্র বউও তার পক্ষে কথা বলছে। এটা মানা যায়না। ওর লেগে আ’গু’ন আমি সকালেই দিব। ওর জন্য আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা জলে গেল। ”
” আপনি ভাইয়াকে কিছু বলবেননা। আপনার টাকা আছে, তাই ওরা নিয়েছে। টাকা না থাকলে নিশ্চয়ই চাইতনা। একটু আনন্দ করতে দিন না ওদের। আর শুনুন ভাইয়ের জায়গায় ভাই, জামাইয়ের জায়গায় জামাই। তাই আপনি এই বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখবেন। ”

” আচ্ছা, তাকে কিছুই বলবনা। তোমার জন্য বেঁচে গেল ঐ বজ্জাতটা। কিন্তু তুমি নতুন বউ হয়ে এত কথা বলছ কেন! তোমার কাজ জামাইয়ের কথায় সায় দেয়া আর তার আদর নেয়া। এখন চুপটি থেকে আমার চুমুর স্বাদ নাও। বাকিটা সকালে দেখব। ” তাহমিদ কুহুকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না। ওর অধরে অধর মিলিয়ে দেয়।

সকালে ফোনের শব্দে তাহমিদের ঘুম ভেঙে গেছে। বালিশের পাশে ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। কুহুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল ও। ঘুম ভাঙার পর থেকেই তাহমিদের হাতের তালুতে গরম অনুভূত হচ্ছিল। ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। তাহমিদের ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি। তবুও ও বেশ বুঝতে পারছে ওর হাতের তালু গরম হয়ে আছে। ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারল, ও কুহুর পেটে হাত রেখেছে। এবং কুহুর পেট অস্বাভাবিক গরম হয়ে আছে।
তাহমিদ তৎক্ষনাৎ উঠে বসে কুহুর কপালে হাত রাখে। জ্বরে মেয়েটার শরীর পু’ড়ে যাচ্ছে। তাহমিদ কিছু একটা ভেবে বিছানা থেকে নেমে আলমিরার দিকে যায়।

” বউ, ও বউ, একটু ওঠ। ” কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে ডাকল তাহমিদ।
তাহমিদের ডাক শুনে কুহু চোখ মেলে চায়। কিন্তু ও চোখ খুলে রাখতে পারছেনা।
” সকাল হয়ে গেছে? কেউ ডাকতে এসেছিল বুঝি? আল্লাহ্ প্রথমদিনেই দেরি করে ফেললাম। ” কুহু উঠে বসতে গিয়েই ককিয়ে উঠল।

” কি হয়েছে, বউ? তুমি এত তাড়াহুড়ো করছ কেন! কেউ ডাকতে আসেনি। আমিই ডেকেছি তোমাকে। কি হয়েছে তোমার? এভাবে আর্তনাদ করলে কেন? ” তাহমিদ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।
” শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। ” কুহু গলা নামিয়ে উত্তর দেয়।
তাহমিদ মুচকি হেসে কুহুর সামনে একটা বিস্কিটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। সেই সাথে একটা কাজুবাদামের প্যাকটও।

” দুইটা বিস্কিট আর একটু কাজুবাদাম খেয়ে ঔষধ খাও। এক ঘন্টার মধ্যে জ্বর, ব্যথা পালাবে। তারাতারি কর। ”
” মুখ না ধুয়েই খাব? ছিহ্ আপনি কি নোংরা। ”
” এখন মুখ ধোয়ার চাইতে ঔষধ খাওয়া তোমার জন্য বেশি প্রয়োজন। তাই কোন কথা না বলে বিস্কিট খাও। ”
তাহমিদ কুহুর আইগুঁই দেখে ওর মুখে বিস্কিট গুঁজে দেয়। বাধ্য হয়ে কুহুকে খেতে হয়। দুইটা বিস্কিট আর কয়েকটা কাজুবাদাম খেয়ে ঔষধ খায়।

” আচ্ছা, আপনি কি রাতে এসব খান? অনেক রাত অব্দি জেগে থাকেন বুঝি? ”
” জ্বি না, ম্যাডাম। এগুলো আপনার জন্যই এনেছিলাম। কিন্তু এবার তোমাকে কিছু দেয়ার সুযোগ পেলাম কই। নুসরাত ফুপুকে দেখেই তুমি নিজেকে ঘরবন্দী করেছিলে। সিক্তার জন্য যা এনেছিলাম সেগুলো ওকে দিয়েছি। কিন্তু তোমারগুলো থেকেই গিয়েছিল। ”

কুহু তাহমিদের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। মানুষটা ওকে কত ভালোবাসে। কেউ যে ওকে এতটা ভালোবাসতে পারে, তা কখনোই ওর কল্পনায় ছিলনা।
তাহমিদ কুহুকে বুকে জরিয়ে নিয়ে শুয়ে পরে। কুহুও বাঁধা দেয়না।
কুহু ক্লান্ত থাকায় কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তা বুঝতেই পারেনি।

সকাল দশটায় সিক্তা এসে তাহমিদের দরজায় নক করে। কুহু হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। এখন একদম ফ্রেশ লাগছে। জ্বরও নেই, শরীরের ব্যথাও যেন গায়েব হয়ে গেছে। কুহু শাড়ি ঠিক করে দরজা খুলে দেয়।
” কিরে নতুন বউ, আর কত ঘুমাবি? সবাই তোদের জন্য না খেয়ে বসে আছে, কিন্তু তোদের কোন খোঁজ নেই। তারাতারি নিচে আয়। ” সিক্তা কথাগুলো বলেই হাওয়ার গতিতে চলে গেছে।
কুহু রুমে এসে শাড়ি খুলে আবার পরে নেয়। চুল চিরুনি করে খোঁপা বাঁধে। সাইড স্ট্যান্ডে রাখা কানের দুল কানে পরে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে তাহমিদকে ডাক দেয়।

কুহু নিচে নামতে খুব লজ্জা পাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ও একাই নিচে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু তাহমিদ সেটা মানলে তো। তার একটাই কথা, সে কুহুকে নিয়েই নিচে নামবে।
” সোনা মা, এসেছিস? আয় আজ সবাই একসাথে খাব। কিন্তু তার আগে তোর বড় জা’য়ের সাথে পরিচিত হয়ে নে। ওরা আজ সকালেই এসেছে। ”

আফরোজা নাজনীন কুহুকে নিয়ে সুন্দরী একটা মেয়ের কাছে আসলেন।
” নীরা, এইযে কুহু। কুহু, এ নীরা। তোর বড় জা। তাওহীদের বউ। ”
কুহু সামনে দাঁড়ানো নীরাকে সালাম দেয়। কুহু অবাক হয়ে দেখছে সামনে দাঁড়ানো নীরাকে। খুব সুন্দরী একটা মেয়ে। কিন্তু যেন তার চেহারা জুড়ে বিষন্নতা ভর করে আছে।
নীরা সালামের উত্তর দিয়ে, কুহুকে জড়িয়ে ধরে।

” বাহ্ বড়মা, আমাদের কুহুতো দেখছি মিষ্টি একটা মেয়ে। এজন্যই বুঝি তাহমিদ ওর জন্য দিওয়ানা হয়েছিল! তূর সোনা এদিকে এস, নতুন বৌমনিকে দেখে যাও। ”
এরপর আফরোজা নাজনীন কুহুর সাথে তাওহীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাওহীদও বেশ হাসিখুশি একটা মানুষ। কুহু এই বাড়ির মানুষদের যতই দেখে ততই অবাক হয়। কেউ কখনো এতটাও ভালো হতে পারে!
খাওয়া শেষে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু কুহু খুব ভয়ে আছে। নুসরাত আন্টি হয়তো আজকেই আসবে। সে এসে এতসব কিছু দেখলে নিশ্চয়ই চুপ থাকবেনা। আজ না জানি কি হয়।

কায়েস এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মা ম’রা মেয়েটা যে এত ভালো সংসার পেয়েছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।
সানাউল রাশেদিন বাহির থেকে কেবলমাত্রই এসে সোফায় বসেছে। সেখানে বাড়ির সবাই ছিল।
” সিনিয়র রাশেদিন, তুমি আমার বউয়ের মুখ দেখে কি কিছু গিফ্ট করেছ? নাকি ফাঁকি দেয়ার চিন্তায় আছ? ”
” কুহু মা, ঐ বেয়াদবকে বল, তোমাকে কি কি গিফ্ট করেছি। আমি বললে সে বিশ্বাস করবেনা। ”
কুহু অসহায়ের মত ওর ফুপার দিকে তাকিয়ে আছে।

” আমাদের কত মিল তা কি দেখেছ, সিনিয়র? তোমার শ্বশুর বাড়িও যেটা, আমার শ্বশুর বাড়িও সেইটা! দুইজন একসাথে সেখানে বেড়াতে গেলে, দুইজনই বলতে পারব আমরা শ্বশুর বাড়িতে এসেছি। একটা কথা, তোমার শ্বশুর বাড়ির হিসেবে আমি তোমার শ্যালকের মেয়ের জামাই। সে হিসেবে তুমি আমার ফুপা শ্বশুর। তুমি নতুন জামাইয়ের মুখ দেখে কিছু গিফ্ট করলেনা তো! রোমিও তোমার দুলাভাইকে বল, নতুন জামাইকে কিছু গিফ্ট করতে হয়। ”

” তাহমিদ, কায়েস এখন তোর শ্বশুর। তাকে আর এভাবে ডাকবিনা। আর নিজের চাচ্চুর কাছে কিসের গিফ্ট চাস তুই? ” তাহমিনা আক্তার ছেলেকে থামাতে চাচ্ছেন।
” মা, রোমিও গতকাল আমার শ্বশুর হয়েছে। কিন্তু এত বছর সে আমার মামা ছিল। আর আজীবন তাই থাকবে। আর রইল সিনিয়র রাশেদিনের ব্যাপার। গিফ্ট তাকে দিতেই হবে। ”

” ভাই, হিসেব করলে আমরাও তোমার কাছ থেকে গিফ্ট পাই। আমরা তোমার বউয়ের বড় ভাই। এখনো স্টুডেন্ট মানুষ। কিন্তু তুমি বড় ডক্টর। তুমি চাইলে প্রতিমাসেই আমাদের গিফ্ট দিতে পার। ”
” আনান ভাইয়া ঠিক বলেছে। আমরা শালিকা হিসেবে তোমার কাছে গিফ্ট পেতেই পারি। ” আনানের সাথে তনয়াও তাল মেলায়।

” আমিও তোমার বোন, তোমার বউয়ের দুই মাসের বড় বোন হিসেবেও , তোমার কাছে গিফ্ট পাই। তাইনা, ভাইয়া? ” এবার সিক্তা মুখ খোলে।
তাহমিদ বুঝতে পারছে এরা সবাই একজোট হয়েছে। তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
” তবে কায়েস, তুমি পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসতে পারতে কিন্তু। এই সুবাদে ওদের সাথে দেখাও হয়ে যেত। বড় বোনের বিয়ে হল, অথচ ছোট ভাই-বোন থাকতে পারলনা। ” শফিউল রাশেদিন আফসোস করে বললেন।
” ওদের দুইজনেরই পরীক্ষা শুরু হয়েছে, ভাই। সেজন্য নিয়ে আসতে পারলামনা। ওরাও মন খারাপ করেছে। শিহাবতো কাঁদছিল। ও কুহুকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু ছেলেটার সেই বোনের বিয়েতে আসা হলোনা। ”

” মামা, ওদের পরীক্ষা শেষ হলে একবার নিয়ে এস। এখান থেকে আমার কাছে বেড়াতে যাবে। কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। কি যে ভালো লাগছে। তবে তোমার পুরো পরিবার থাকলে আরও বেশি ভালো লাগত। ” তাওহীদ হাসিমুখে বলল।

” তাওহীদ ঠিক বলেছে, কায়েস। আমার দাদুভাই, দিদুনের পরীক্ষা শেষ হলে, ওদের নিয়ে চলে আসবে। এখন থেকে ওরা শুধু ফুপর বাড়িতে নয়, বোনের বাড়িতেও বেড়াতে আসবে। ” দিদুন বললেন। বৃদ্ধা কুহুকে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছেন।
এমন সময় নুসরাত তার মেয়েকে নিয়ে ‘ কুঞ্জছায়া ‘য় প্রবেশ করল। ড্রয়িং রুমে একসাথে সবাইকে দেখে আপনাআপনি তার কপাল কুঁচকে আসে। হঠাৎই ওর চোখ যায় সোফায় বসা কায়েসের দিকে।

তখনই তার চোখের কোনে অশ্রু জমা হয়। কায়েসের সাথে বিয়ের কথা হওয়ার পর, তাকে মনে মনে ভালোবেসেছিল নুসরাত। আজ একদিন পর সেই মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে।
নুসরাতকে দেখে সবার গল্পে ভাটা পরল। আফরোজা নাজনীন আঁড়চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালেন। তিনি ভয় পাচ্ছেন কিনা কি হয়।

” খালা, আজ তো দেখছি তোমার বাসায় চাঁদের হাট বসেছে! বেশিরভাগই বড় ভাবির বাবার বাড়ির পক্ষের। তা কি উপলক্ষে সবাই একসাথে হয়েছে? ”
” তাহমিদ আর কুহুর বিয়ে উপলক্ষে সবাই একসাথে হয়েছে। প্রথম ভাতিজীর বিয়ে হচ্ছে, কিন্তু ফুপুরা থাকবেনা, তাই কি হয়, নুসরাত? ”
আয়েশা সালেহা নুসরাতকে অবাক করে দিয়ে বললেন।
” কি বললে খালা! কুহুর সাথে তাহমিদের বিয়ে! কিন্তু বড় ভাই আমাকে কথা দিয়েছিল, সামিহার সাথে তাহমিদের বিয়ে হবে। ”

” একটু সংশোধন করে বল, নুসরাত। আমি বলেছিলাম, তাহমিদ রাজি থাকলেই তবে এই বিয়ে হবে। সামিহাকে বিয়ে করতে তাহমিদ রাজি নয়। ও কুহুকে পছন্দ করে। ও কুহুকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা। তাই আমরা ওদের বিয়ে দিয়েছি। ” সানাউল রাশেদিনের কথা শুনে নুসরাত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।

” তোমরা আরেকবার আমার সাথে বেইমানী করলে! কি আছে ঐ মেয়ের মধ্যে? যার জন্য তাহমিদ পাগল হয়েছে? আর খালা তুমিও তাই মেনে নিলে? তোমার বড় ছেলের বউ তোমাকে কি যাদু করেছে, যে তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারছনা? একবার ওর ভাই আমাকে ঠকিয়েছে। আরেকবার ওর ভাইয়ের এই কুৎসিত মেয়ে আমার মেয়েকে ঠকালো। কি আছে এই মেয়ের মধ্যে? আমার মেয়ের নখেরও যোগ্য নয় ঐ মেয়ে।

সেই মেয়ের জন্য তোমরা তাহমিদকে বলি দি’লে? ঐ মেয়ের কি যোগ্যতা আছে এই বাড়ির বউ হওয়ার? সব দোষ তোমার বড় ছেলের বউয়ের। ও সবাইকে কব্জা করে সংসার নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আবার প্রতিনিধিস্বরূপ ভাইয়ের মেয়েকেও এনে তাহমিদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। আসলে তোমরা সবাই স্বার্থপর, সবাই বেইমান। খালা, তুমি নিজেও যেমন, তোমার পরিবারের সবাই তেমন। ” নুসরাত এই মুহূর্তে রা’গে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। ও কাকে কি বলছে সেই ধারনা ওর নেই।

নুসরাতের এমন আক্রমনাত্বক কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত। কুহুর চোখে পানি। কায়েস মাথা নিচু করে বসে আছে। আফরোজা নাজনীন অবাক হয়ে তাহমিনা আক্তারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাহমিনা আক্তার তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন।
রা’গে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ও সানাউল রাশেদিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাউল রাশেদিন বুঝতে পারছেন তার ভাতিজা এই মুহুর্তে কঠিন রে’গে আছে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য কারো নেই।

” চুপ কর, নুসরাত। তুই ভুলে গেছিস কাকে কি বলছিস? খবরদার আমার বড় বউমা আর কুহুকে নিয়ে আর কিছু বলেছিস তো তোকে আমি থাপ্পড় দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিব। তোর মেয়েকে তাহমিদের পছন্দ নয়। যে সংসার করবে তারই যদি পছন্দ না হয়, তবে আমরা জোড় করব কেন? ”
” জোর করতে হতোনা। তুমি বললেই তাহমিদ রাজি হত। কিন্তু তুমি তা চাওনি। তোমার বড় ছেলের বউ তোমার ব্রেইন ওয়াশ করেছে। এই বাড়িতে সে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তাই ভাইয়ের মেয়েকেও তাহমিদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। ”

” নুসরাত, তুই থামবি? অনেক হয়েছে। তুই আফরোজাকে অনেক অপমান করেছিস। আর নয়। মনে রাখবি সে আমার স্ত্রী। ওকে যে তুই এত অপমান করছিস, তুই ওর নখের যোগ্য? সংসারের দ্বায়িত্ব সম্পর্কে তোর ধারনা আছে? ধারণা থাকলে আফরোজার সম্পর্কে এমন চিন্তা তোর মনে আসতনা। ”

” কেন থামব আমি? তুমিও বউয়ের গোলাম হয়েছ অনেক আগেই, এটা আমি জানি। কিন্তু আমার কাছে অন্তত বউয়ের গোলামী করতে এসোনা। আমি তাহমিনা আক্তার, কিংবা আয়েশা সালেহা নই। ”
নুসরাত কথা শেষ করতেই তার গালে কারো থাপ্পড় অনুভব করল।
আয়েশা সালেহা উঠে এসে নুসরাতকে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছেন।

” তুই এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। আজ থেকে তোর সাথে আমরা সব সম্পর্ক শেষ করে দিলাম। ভুল আমারই ছিল, তোর মা’য়ের মৃ’ত্যু’র পর, তোকে নিজের কাছে রেখেছিলাম। নিজের মেয়ের মত করে মানুষ করেছি। যদি নিজের কাছে না রাখতাম, তবে সৎমার সংসারে ঘানি টেনে ম’র’তি। কায়েসের সেই ঘটনার জন্য অনেকবার তোর কাছে মাফ চেয়েছি। বারবার বলেছি, ঐ ছেলেটার কোন দোষ ছিলনা।

আমি না জেনে তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সব দোষ আমার ছিল। কিন্তু তুই সেকথা শুনলে তো। আমার ছেলে ভালো ঘরে তোর বিয়ে দিল। আজ আমার সেই ছেলেকেই তুই অপমান করছিস। বিয়ের পর যতবার এখানে এসেছিস, বড় বউমাকে আড়ালে-আবডালে কথা শুনিয়েছিস। তবুও আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু আজ তোর বেয়াদবি মাত্রা ছাড়িয়েছে। এই বাড়ির সাথে সম্পর্ক রাখার যোগ্যতা তুই হারিয়েছিস। এখনই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। আর কান খুলে শুনে রাখ কুহু এই বাড়ির বউ। তোর থেকে এই বাড়িতে ওর অধিকার বেশি। ” আয়েশা সালেহা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাহমিনা আক্তার তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দেন।

তাহমিদের রা’গ হচ্ছে সানাউল রাশেদিনের ওপর। সে নুসরাতকে বিয়ের কথা না বললে এত কিছু হতোনা। ও বড়মার অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। আবার নুসরাতকে কিছু বলতেও পারছেনা। যেখানে দিদুন প্রতিবাদ করেছে সেখানে ওর কিছুই বলার নেই। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। রা’গে থরথর করে কাঁপছে।
ড্রয়িংরুমের সবাই তাহমিদকে লক্ষ্য করল। কিন্তু কেউ ওর পাশে ঘেঁষতে সাহস করে উঠতে পারছেনা।
নুসরাত ব্যাগ গুছিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২১

অনেক সময় পরও ‘ কুঞ্জছায়া ‘র পরিবেশ স্বাভাবিক হয়না। কেউই আফরোজা নাজনীনের অপমান মেনে নিতে পারছেনা।
কিন্তু আফরোজা নাজনীন, সে তো অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি গুটিগুটি পায়ে তাহমিদের পাশে যেয়ে বসলেন। হাত রাখলেন তাহমিদের মাথায়। কারন তিনি জানেন, তার আদরের একটি বাক্যই তাহমিদকে শান্ত করতে পারবে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৩