বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৪
জাওয়াদ জামী

কুহু ফোন রুমে রেখে দিদুনের কাছে গেছে। দিদুনের রুমে বাসার সবাই মিলে গল্প করছে। শাজনাজ সুলতানা এবং নাজমা পারভিন নিজেদের বাসায় ফিরে যেতে চাইলেও, তাদের আয়েশা সালেহা যেতে দেননি। আগামীকাল সানাউল রাশেদিনের বাবার পনেরতম মৃ’ত্যু’বা’র্ষি’কী। সে উপলক্ষে বাসায় দোয়া মাহফিল ও কুরআন খতমের আয়োজন করা হয়েছে। আয়েশা সালেহা চাচ্ছেন আগামীকাল তারা সবাই আগামীকালের আয়োজনে উপস্থিত থাকুক। বৃদ্ধার অনুরোধ শাহনাজ সুলতানা, নাজমা পারভিন এবং কায়েস কেউই ফেলতে পারলনা।

আনান চলে যাওয়ায় সবারই মন খারাপ। ও থাকলে সবার সাথে আড্ডায় মেতে থাকত। নিহানের বেশি খারাপ লাগছে। আজ তাহমিদ মেডিকেলে যাওয়ায় ও সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছে। আনানকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, আনান ভার্সিটিতে আছে। বাসায় সন্ধ্যার পরে যাবে। আগামীকাল এই বাসায় আনানকে আসতে বললে, ও জানায় জরুরী ক্লাস থাকায় আসতে পারবেনা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গেস্ট রুমে শুয়ে শুয়ে বোর হচ্ছিল নিহান। এমন সময় ওর ফোন বেজে ওঠে।
” ভাইয়া, তোমার তো এখন আমাকে ফোন দেয়ার কথা নয়! বিয়ে করেছ, বউ হয়েছে এখন তাকে ফোন কর। ”
” তাকেই ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু সে রিসিভ করছেনা। তুই একটু দেখ ও কোথায়। ”
” কুহুকে দেখলাম দিদুনের রুমে আম্মু, খালামনিদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ”
” হয়তো ফোন ওর কাছে নেই। তুই একটু ওর কাছে যা। ওকে রুমে আসতে বল। ”

” এটা ঠিক নয়, ভাইয়া। একেতো আমি সিঙ্গেল, তার ওপর কুহু আমার ছোট বোন। ছোট বোনকে গিয়ে বলব, তোর জামাই ফোন করেছিল। তোর সাথে কথা বলতে চায়! আমার সিঙ্গেল বুকটাতে এভাবে আ’গু’ন না জ্বা’লা’লে’ই ভালো হয়। কোথায় বউ নিয়ে ছোট শালা-শালীদের সাথে আড্ডা দিব। কিন্তু তা না করে ছোট বোনকে তার জামাইয়ের খবর পৌঁছে দেয়ার দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ”

” চিন্তা করিসনা, আগে পড়াশোনা শেষ কর। তারপর নিজ দ্বায়িত্বে আমি তোর বিয়ে দেব। সুন্দরী একটা বউ এনে দেব। তখন যত খুশি বউকে নিয়ে লীলা করিস। এখন যা আমার বউকে ডেকে দে। যতদিন নিজের বউ না হয়, ততদিন আমার বউকে ডাকার দ্বায়িত্ব পালন কর। ”

” অগত্যা। কি আর করার। ডাকছি তোমার বউকে। ”
” যা। তবে সবার সামনে আবার যেন বলিসনা আমি ওকে ডাকতে বলেছি। জানিসই তো বউটা আমার লাজুক। ”
” খুব জানি। তুমি চিন্তা করোনা। আমি ওকে লজ্জায় ফেলবনা। রাখছি। ”
নিহাল ফোন কেটে দিয়ে দিদুনের রুমে যায়। সেখানে সবাইকে কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখে ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। এই বাড়ির মানুষগুলো কত ভালো।

” কুহু, একটু এদিকে আসবি? ” নিহানের ডাক শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়।
” কিছু বলবে, ভাইয়া? ”
” তুই একটু বাহিরে আয়। তোর সাথে কথা আছে। একটু পর আবার এসে গল্প করিস। ”
নিহানের ডাক শুনে কুহু রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
” কি বলবে, বল। এত জরুরী তলব কেন? ”

” তোর ফোন কোথায়? ভাইয়া তোকে ফোন দিয়ে দিয়ে হয়রান হয়ে আমাকে ফোন করেছে। গা’ধী মেয়ে ফোন কাছে রাখতে পারিসনা? তোকে ফোনে না পেয়ে টেনশনে যদি ডক্টর তার রোগীদের ভুল চিকিৎসা দেয়! যা রুমে যেয়ে ভাইয়াকে ফোন কর। ”
কুহু মনে হল কপাল চাপড়াচ্ছে। আধাঘন্টা আগেই না ও তাহমিদের সাথে কথা বলল! এতটুকু সময়ের মধ্যে সে আবারও ফোন দিয়েছে!

” কুহু, এই মানুষটা তোকে সব সময়ই চিপায় ফেলবে। বড় ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়ে, তার ছোট বোনকে সংবাদ দিতে বলেছে! ছিহ্ কি লজ্জা। ” কুহু বিরবির করে বলছে আর নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে।
রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, তাহমিদ দশবার ফোন দিয়েছে। কুহু মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পরল। এরইমধ্যে তাহমিদ আবারও ফোন দিয়েছে।

” জ্বি, বলুন। ” কুহু বিরসবদনে বলল।
” শুধুই জ্বি বলুন! তোমার স্টকে আর কোনও কথা ছিলনা? ” তাহমিদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
” আপনার সাথে আধাঘন্টা আগেই কথা হয়েছে। তখন অনেক কথাই বলেছি। তাই এই আধাঘন্টার মধ্যে আর নতুন করে কোন কথা জন্ম নেয়নি। আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন।”

কুহু এমন নিস্পৃহতা দেখে তাহমিদ চুড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়ে যায়।
” তুমি এটা কি বললে বউ! এই নিরীহ জামাইটার জন্য তোমার মনে একটুও দয়া হয়না? তোমার কাছে আধাঘন্টা মানে ত্রিশ মিনিট। কিন্তু আমার কাছে আধাঘন্টা মানে এক যুগের সমান। তোমার সাথে এই আধাঘন্টা রূপী একযুগ কথা না বলে আমার কত কষ্ট হচ্ছে জানো? ”

” আপনি রুগী দেখছেননা এখন? দেশ থেকে কি রোগবালাই দূর হয়ে গেছে? নাকি আপনার ব্যবসার পসার কমে গেছে? একজন ডক্টর হয়েও এক ঘন্টায় পঞ্চাশ বার ফোন দিচ্ছেন যে? ”
” বউ, আমি ব্যবসা করিনা। আমি একজন ডক্টর। আর দেশে রোগবালাই ঠিকই আছে, শুধু আমার প্রেম প্রেম ভাবটা বেড়েছে। এই যে দেখ, তোমার সাথে কথা বলব জন্য এক রুগীকে রিল্যাক্স করে বেডে শুতে বলেছি। সে একটু ঘুমিয়ে নিক, ততক্ষণ তোমার সাথে আমি কথা বলব। ”

” ফোন কি আপনি রাখবেন? নাকি আমি কা’ট’ব? সামনে রোগী রেখে আপনার প্রেম প্রেম পাচ্ছে? এখন মন থেকে এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে, পেসেন্টের দিকে মনযোগ দিন। ”
” আমার প্রেম পাওয়াকে তোমার আজেবাজে চিন্তা মনে হল, বউ! অধিকাংশ পুরুষের হার্টের সমস্যার মূল কারনই হল তাদের স্ত্রী। এই যে একটু আগে একটা চাচা এসেছিল। তার নাকি থেকে থেকেই বুকে ব্যথা করে। তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তার স্ত্রী নাকি তাকে ইদানীং কম ভালোবাসছে। বেচারা চাচা সেই চিন্তায় বুকের অসুখ বাঁধিয়েছে।

একবার চিন্তা কর, এই বয়সেও যদি চাচা, চাচির ভালোবাসা পেতে অস্থির হয়ে থাকে, তবে আমার কি করা উচিত? এবার তুমি বল, তুমি যদি এভাবে আমার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দাও, তবে আমারও বুকের অসুখ বাঁধতে সময় লাগবেনা। হার্টের ডক্টরের হার্টের অসুখের চিকিৎসা করবে কে? আর যে চিকিৎসা করবে তাকে কি জবাব দেবে তুমি? ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কেমন পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে।

” ওকে, রুগী দেখা শেষ করে ফোন করবেন। আমি কথা বলব। এখন রাখুন। ”
” যথাআজ্ঞা নিষ্ঠুর, বউ। এইটুকু শুধু বল, আসার সময় তোমার জন্য কি আনব? ”
” আমার কিছুই লাগবেনা। আপনি আসলেই হবে। রাখছি। ”
ফোন কেটে দিয়ে কুহু আপনমনেই হাসতে থাকে।

” কি রে নতুন বউ, এভাবে হাসছিস কেন? জানিসনা একা একা পা’গ’লে হাসে? ” সিক্তা এসে বিছানায় বসে বলল।
” তোর ভাইয়ার কাজকর্ম দেখে হাসছি। লোকটার মাথা খা’রা’প। ”
” ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে তাইনা? কিভাবে সবার সামনে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে! আবার গতকাল কিভাবে রিয়্যাক্ট করল! এই কুহু, তুই কি জানিস ভালোবাসা কাকে বলে? ”

” ভালোবাসা একটা আপেক্ষিক বিষয়। আমাদের আবেগ, আমাদের অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়াকেই সচারাচর আমরা ভালোবাসা বলে থাকি। তাকে আমি প্রচন্ডভাবে ফিল করি, এটা যেমন আমার ভালোবাসা। তেমনি সে আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারেনা, সেটা তার ভালোবাসা। একেকজন মানুষের সামনে ভালোবাসা একেক রূপে ধরা দেয়। তাই এর নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা হয়না। তবে আমরা নিজেদের আত্নিক চাহিদার পূর্ণতাকে ভালোবাসা নামে অভিহিত করি। তাই যদি হয় আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি, তেমনি সে-ও আমাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসে। জানিস সিক্তা, ভালোবাসা নামের মত ভালোবাসা জিনিসটাই মধুতে ভরা। ”

” সত্যিই কি আমরা যাকে ফিল করি তাকেই ভালোবাসি? ফিল না করলে ভালোবাসা হয়না? ”
” ভালোবাসলেই তবে তুই ফিল করবি, তার আগে নয়। তুই যাকে ভালোবাসবিনা, কখনোই ভুলেও তার কথা তোর মনে হবেনা। কেবলমাত্র যাকে ভালোবাসবি তাকেই প্রতি সেকেন্ডে তুই মনে করবি। তার কথা বলার ধরন, তার হাসি, তার চাহনি, তার চালচলন সবই তোকে মুগ্ধ করবে। এমনকি তার যা কিছু অন্যের কাছে অপ্রিয়, সেটাই তোর কাছে প্রিয় হবে। ”
” বাব্বাহ্, আমাদের অবলা কুহুও দেখছি প্রেম বিশারদ হয়ে গেছে! আমার ভাইয়ার ভালোবাসা তোকে বদলে দিয়েছেরে কুহু। চুপচাপ, শান্তশিষ্ট কুহু এখন প্রেমের জয়জয়কার করছে, ভাবা যায়! ”

” ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়। বাদ দে এসব। এখন বল তুই ভর্তি হচ্ছিস কবে? কবে যাচ্ছিস খুলনা? তুই চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব। ”
সিক্তা খুলনা যাওয়ার কথা শুনে কুহুর পানে উদাস নয়নে চাইল।

রাতে তাহমিদ বাসায় আসার আগে আনানকে ফোন দিয়ে, আগামীকাল বাসায় আসতে বলে। তবে আনান পরীক্ষার অযুহাত দিয়ে নিজের অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু আনান যতই পরীক্ষার অযুহাত দিক না কেন, তাহমিদ ওর কথা বিশ্বাস করলনা। ও বুঝতে পারছে আনানের কিছু একটা হয়েছে।

পরদিন সকাল থেকেই ‘ কুঞ্জছায়া ‘ লোকজনের পদচারণায় মুখর হয়ে গেছে। আয়েশা সালেহার বাবার বাড়ি থেকে আত্মীয় স্বজনরা এসেছে। সানাউল রাশেদিনের গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন এসেছে। আজ তাহমিদ বাসায়ই আছে। বাগানের একপাশে রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। তাহমিদ নিজে সব কিছুর তদারকি করছে। অবশ্য তাওহীদও বসে নেই।
নীরা রান্নাঘরে শ্বাশুড়িদের সাহায্য করছে। কুহুও সাহায্য করতে চাইলে তাহমিনা আক্তার ওকে ধমকে রুমে পাঠিয়ে দেন। তার একটাই কথা নতুন বউ এখন কোনও কাজ করবেনা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৩

তাহমিদ কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে কুহুর সাথে খুনসুটি করছে। কখনো কখনো ড্রয়িংরুম থেকে কুহুকে রুমে ডাক দিচ্ছে। এই ভরা বাড়িতে তাহমিদকে এভাবে রুমে আসতে দেখলেই কুহু লজ্জা পাচ্ছে। ও তাহমিদকে বারবার বোঝাচ্ছে, কিন্তু তাহমিদ শুনলেতো।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৫