বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩০

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩০
জাওয়াদ জামী

খাবার পর সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিচ্ছে । এরই মাঝে নীরার ফোন আসল। ওর মা ফোন করেছে। ভদ্রমহিলা একে একে বাসার সবার সাথে কথা বললেন। সবার সাথে কথা শেষ হলে নীরা ওর মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের রুমে যায়।
এরপর যে যার মত রুমে চলে যায়।

” বউ, আনানের খবর কিছু জানো? ও বাসায় এসেছিল? আমি বেশ কয়েকদিন থেকে ওর কাছে ফোন দেইনি। ”
” ভার্সিটিতে প্রতিদিনই ভাইয়ার সাথে দেখা হয়। আমার ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিনই একবার করে আসে। ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথেও পরিচয় করিয়েছে। আমি বাসায় আসার কথা বলেছিলাম। তখন ভাইয়া বলেছিল, আপনি যেদিন বাসায় থাকবেন, সেদিন সে আসবে। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ কিছু একটা ভেবে মুখ খুলল,
” সিক্তার সাথে আনানের দেখা হয়? ”
” হুম। রোজইতো ওরা টিএসসিতে বসে আড্ডা দেয়। আবার মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরতেও যায়। আমাকে অবশ্য ওদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রায়ই ডাকে। কিন্তু আমার ঐসব ঘুরাঘুরি ভালো লাগেনা। তাই যাইনা। ”

” যাওয়ার দরকারও নেই। ওরা ওদের মত ঘুরে বেড়াক। ক্লাস শেষ হলে ভার্সিটিতে এক মিনিটও থাকবেনা, বুঝলে? সিক্তা বাসায় না আসলেও তুমি চলে আসবে। তুমি বাসায় না আসা পর্যন্ত আমি টেনশনে থাকি। সারাদিন তোমাকে সময় দিতে না পারলেও, আমি তোমাকে রাতে সময় দেব। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। বুঝেছ আমার রাতজাগা পাখি? ” তাহমিদ কুহুর গাল আলতোভাবে টেনে বলল।

” আপনি ঠিকমত বাসায় আসবেন, তাহলেই আমার ভালো লাগবে। আপনার সাথে মাঝেমধ্যে ছাদে জোছনা বিলাস করতে পারলেই আমার শান্তি লাগবে। আবার হুটহাট বৃষ্টিতে ভেজার পারমিশন দিবেন, আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবেন এতেই চলবে। ” কুহুর ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি।
” যাক অবশেষে আমার বউয়ের চাহিদা জানলাম। তবে তুমিও জেনে রাখ, বউ। তোমার এই অবুঝ স্বামী, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে সদা তৎপর। তোমার স্বপ্ন পূরণের পরই, আমি তোমাকে নিয়ে দেখা আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করব। তোমার কোনও বাঁধা আমি মানবনা। ”

” আপনি কার বাঁধা মানেন? আর কার কথা শোনেন, সেটা আমাকে একটু বলবেন? ”
” এই নিষ্পাপ জামাইয়ের নামে এতবড় অপবাদ! এই অধম কার কথা শোনেনি! একটিবার সেই মহান ব্যক্তির নাম বল। ” তাহমিদের চোখেমুখে নিখাদ বিস্ময়।

” আপনি ফুপার কোনও কথা শোনেন? তিনি আপনাকে একটা কথা বললে, আপনি দশটা কথা শুনিয়ে দেন। আপনার মত একটা যোগ্য ছেলে থাকতে এই বয়সে তাকে আর বাবাকে সংসারের খরচ বহন করতে হয়। ফুপা এই বয়সে মাঝেমধ্যে কাঁচা বাজারে যায়। এটাতো অন্তত আপনি করতে পারেন? ভাইয়াও পরিবারে যতটুকু সম্ভব কনট্রিবিউট করে। কিন্তু আপনি নিজেও বাপ – চাচার খরচে খাচ্ছেন, এখন আবার বউকেও খাওয়াচ্ছেন! কতদিন এভাবে অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গবেন? আনান ভাইয়া সাধেই আপনাকে কিপ্টে বলেনা। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা কুহু ওকে এসব কথা বলল!
” সিনিয়র রাশেদিন নিশ্চয়ই তোমাকে এসব কথা বলেছে? দাঁড়াও একবার খালি রাতকে ঘুমাতে দাও, সূর্য ঘুম থেকে উঠলেই আমি তাকে চেপে ধরব। আমার নতুন বউটাকে এখনই আমার বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে! ”

” আপনি ফুপাকে কিছুই বলবেননা। আপনার বিরুদ্ধে আমাকে উস্কে দেবে, এত সাহস তার আদৌ আছে? আমি কি ছোট মানুষ যে কিছুই বুঝবনা? ভাইয়া বাসায় এসে ফুপুকে টাকা দিয়েছে আবার মা’কেও দিয়েছে। আমি দেখেছি। আবার দিদুনকে জিজ্ঞেস করে, তার কিছু লাগবে কিনা। কিন্তু আপনাকে এসব করতে আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। আমি নতুন মানুষ তাই মা’কে এসব জিজ্ঞেস করতে পারিনা। ”

” বাব্বাহ্, আমার বউটা কত কিছু খেয়াল করেছে! তবে শোন, সিনিয়র রাশেদিন এমনকি বাসার সবাই আমার স্বপ্নের কথা জানে। তারা এটাও জানে একটা হসপিটাল তৈরি করতে, সেখানে চিকিৎসা ব্যাবস্থা চালু করতে, এবং আরও আনুষঙ্গিক কাজে অনেক টাকা লাগবে। তাই যেদিন থেকে আমি মেডিকেলে জয়েন করেছি, সেদিনই সিনিয়র রাশেদিন আমাকে ডেকেছিলেন তার রুমে।

তিনি সেদিন বলেছিলেন, আমি যতদিন পর্যন্ত একটা হসপিটাল করতে না পারব, ততদিন যেন সংসারে একটা টাকাও খরচ না করি। তিনি এবং বাবা সংসারের যাবতীয় খরচ সামলাবেন। এটা আমার প্রতি তার আদেশ ছিল। সেজন্য আমি সংসারে কোন টাকা দিইনা। উল্টো প্রতিমাসেই বড়মা কিংবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিই। ভালো কথা মনে করে দিয়েছ , বউ। কাল সকালেই সিনিয়রকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এখন থেকে আমার বউয়ের খরচ কি আমাকেই দিতে হবে নাকি। ”

” আপনি ফুপাকে এসবের কিছুই বলবেননা। প্রয়োজনে আমার খরচ আমি নিজে চালাব। তবুও আপনি আমার জন্য ফুপা কিংবা বাবা৷ কাছে মাথা নত করবেননা। ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদের হাসিমাখা মুখে আঁধার নামে৷ ও ম্লান হেসে বলল,

” তুমি কি আমাকে এতটাই অকর্মা মনে কর! আমি আমার বউয়ের জন্য চাচ্চু অথবা বাবার কাছে হাত পাতব! আমিতো তোমার সাথে মজা করলাম। তাতেই তুমি নিজের খরচ নিজে চালানোর কথা ভাবলে। তুমি এখন সম্পূর্ণরূপে আমার। তাই তোমার সকল দ্বায়িত্বও আমার। আর সেই দ্বায়িত্ব আমি দ্বিধাহীনভাবে পালন করব। তবুও তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। ”
তাহমিদের দিকে তাকিয়ে কুহুর বুক ধক করে উঠল। ওর কথায় কি মানুষটা কষ্ট পেয়েছে!

” আমি আপনাকে মোটেও ভুল বুঝিনি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, আপনি সংসারে কমবেশি যাইহোকনা কেন কনট্রিবিউট করবেন। এই পরিবারের সন্তান হিসেবে এতটুকু দ্বায়িত্ব আপনাকে পালন করতেই হবে। ”
” এখন থেকে সব দ্বায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। দেখি কতটুকু করতে পারি। ” তাহমিদ হাসছে।
” শুনুন, আজ যেহেতু বাবা এসেছে, কাল সকালেই দেখবেন বাবা আর ফুপা মিলে কাঁচা বাজারে যাবে। আপনিও তাদের সাথে যাবেন। লিষ্ট অনুযায়ী নিজে সব বাজার করবেন। আর টাকাও আপনি দিবেন। কি করবেন তো? ” কুহু অসহায় চোখে জিজ্ঞেস করল।

” তোমার কথামতই আমি সবকিছু করব। তবে বাজার থেকে এসে যেন তোমাকে আমি ড্রয়িং রুমে দেখি। ”
” ঠিক আছে, আমি ড্রয়িংরুমেই থাকব। ”
” এইবার আমাকে বলুন, আপনি ফুপার পেছনে লাগেন কেন? একজন বয়স্ক মানুষের পেছনে লাগতে আপনার খারাপ লাগেনা। ”

” অন্য কেউ হলে খারাপ লাগত। কিন্তু তোমার ফুপার জন্য খারাপ লাগেনা। ভদ্রলোক আমার কিশোর বয়সের রঙ্গিন স্বপ্ন পু’ড়ি’য়ে ছাই করে দিয়েছে। ”
” মানে! আপনার স্বপ্ন ফুপা ছাই করতে যাবে কেন! খালি তার পেছনে লাগার সুযোগ খোঁজেন? ”

” তুমি ঐ সিনিয়র ভদ্রলোকের ভক্ত হলে কবে থেকে! যে ভদ্রলোক আমার না হওয়া প্রেমের গাছের গোড়া খুঁ’চি’য়ে সেখানে বি’ষ ঢেলেছে, আর সেই ভদ্রলোক পক্ষ তুমি নিচ্ছ! এটা কিন্তু অন্যায় হচ্ছে। তোমার যেকোনো পরিস্থিতিতেই আমার পক্ষ নেয়া ফরজে আইন। ” তাহমিদ কিঞ্চিৎ বাঁকা স্বরে বলে।
” আপনার না হওয়া প্রেমের গাছ মানে! একটু বুঝিয়ে বলবেন? ”

” কেন বলবনা! তবে শোন, আমি যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র, আমাদের বাসার সামনের বিল্ডিংয়ের এক আপু ইডেনে পড়ত। তাকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। দুই পরিবারের সম্পর্কও খারাপ নয়। আপুর সাথে প্রায়শই দেখা হত, কথা হত। যখন নাইনে উঠলাম, তখন থেকেই সেই আপুর প্রতি অন্যরকম ফিলিংস কাজ করত। আপুও আমাকে দেখলে মিষ্টি হাসি দিত। চকলেট/আইসক্রিম কিনে দিত। একদিন বিকেলে কোচিংএ যাচ্ছিলাম।

বাসা থেকে বের হতেই আপুর সাথে দেখা। আপু আমাকে নিয়ে সামনের পার্কে বসলে চাইল। আমিও খুশি মনে রাজি হয়ে গেলাম। তো পার্কে বসে বাদাম খাচ্ছি আর দুজন মিলে গল্প করছি। সেদিন আর কোচিংএ যাওয়া হয়নি। প্রতিদিন কোচিং শেষ করে যখন বাসায় ঢুকি, সেদিনও তাই ঢুকলাম। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখলাম সিনিয়র ভদ্রলোক শ’কু’নে’র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুভব করলাম, আমার কানের গোড়া টনটন করছে।

আর মাথা ঘুরাচ্ছে। সেই সাথে চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলাম। পরে শুনেছিলাম, আমি আসার আগেই বাসায় আমার ইজ্জত পাংচার করে দিয়েছে সিনিয়র ভদ্রলোক। সিনিয়র আপুর পেছনে ঘুরঘুর করার অপরাধে, এবং সেই সাথে কোচিং মিস দেয়ার অপরাধে কতদিন আপুদের কাছে আমার হেনস্থা হতে হয়েছে! রীতি আপু আমাকে দেখলেই পে’ত্নী’র মত হাসত। দ্যুতি আপু দুলাভাই বলে ডাকত। কারন সেই সিনিয়র আপু দ্যুতির আপুরও সিনিয়র ছিল। আর সুপ্তি বিয়ের আগ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। আহা আর কয়েকটা দিন গেলেই আপুকে প্রপোজ করতাম। ” তাহমিদ কাঁচুমাচু মুখে বলছে।

কুহু হতভম্ব হয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা এই মানুষটা একসময় সিনিয়র আপুর পেছনে লাইন মে’রে’ছে! ও হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছেনা।
” আপনি সিনিয়র আপুর পেছনে লাইন মে’রে’ছে’ন ! একটুও লজ্জা লাগেনি আপনার? আর সেই আপুও কিছু বলেনি! সে-ইবা কেমন মেয়ে! আপনি তার পেছনে ঘুরঘুর করেছেন, আর সে কিছু বলেনি! ”

“ও বউ, তুমি কি আমার ওপর রাগ করলে? শোন, ঐটা আমার কিশোর বয়সের আবেগ ছিল। ভালো আমি তোমাকেই বাসি। সেই ঘটনার দুইমাস পর শুনেছিলাম আপু পালিয়ে বিয়ে করেছে। তার কিছুদিন পর আপুর হাসবেন্ডকে দেখেছিলাম। জানো সেদিন আমার একটুও খারাপ লাগেনি। ” তাহমিদ কুহুকে বিশ্বাস করাতে চাইছে।

” আমি অন্য কিছুই ভাবছিনা। শুধু একটা কথা ভেবেই মাথায় জ্যাম লেগে গেছে। আপনি জুনিয়র মেয়েদের রেখে কেন সিনিয়রের পেছনে ঘুরতে গেলেন? দেশে কি মেয়ের অভাব ছিল! এজন্যই বুঝি, ফুপাকে সিনিয়র সিনিয়র বলে মুখ দিয়ে ফেনা তোলেন? আপনাকে এখন থেকে সিনিয়র প্রেমী জামাই বলে ডাকব। ” কুহুর কন্ঠে ব্যঙ্গ স্পষ্ট।
” সে তুমি যা খুশি তাই বলে ডেক। তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ এসব কথা আনানকে বলতে যেওনা। ফাজিলটা তাহলে আমার সম্মান নিয়ে ফুটবল খেলবে। ” তাহমিদ অসহায় চোখে স্তিমিত গলায় বলল।

” তাহমিদ, রুমে আছ? ” দরজার বাইরে থেকে নীরা ডাকল।
নীরার গলা পেয়ে ওদের আলোচনায় ভাটা পরল।
” ভেতরে এস, ভাবি। আমরা রুমেই আছি। ”
” এই যে নাও কফি। কফি ছাড়া আড্ডায় মজা পাওয়া যায়না। ” নীরা হাতের ট্রে টি টেবিলে রেখে বলল।
তাহমদি ভাবিকে কেন ডেকেছে, সেটা কুহু আঁচ করতে পেরেছে।

” তূর কোথায়, ভাবি? ও কি ঘুমিয়েছে? ” তাহমিদ জিজ্ঞেস করল।
” ওকে ঘুমিয়ে দিয়েই তবে আসলাম। ”
” ভাবি, তূর সোনা সিক্তার কাছে ঘুমায়না? ” কুহু নীরাকে জিজ্ঞেস করল।
” সিক্তা নাকি অর্ধেক রাত জেগে জেগে গল্প করে, তাই সেখানে আমার মেয়ের ঘুম হয়না। আজ বলল, ও আর ফুপির কাছে ঘুমাবেনা। ”

” বাসায় অতি শীঘ্রই আরেকটা বিয়ে হতে চলেছে, ভাবি। রাশেদিন পরিবারের ছোট মেয়ের বিয়ের সানাই বাজতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। ”
” ছেলে দেখা শুরু কর। আমাদের ছোট বোনের বিয়ে বলে কথা। আয়োজনে কোন কমতি থাকা যাবেনা। ” নীরাও হাসিমুখে বলল।

” জামাই আর কষ্ট করে খোঁজ করতে হবেনা। সময় হলে পায়ে হেঁটে জামাই তার শ্বশুর বাড়িতে আসবে। তোমরা শুধু চিন্তা কর, জামাইকে জব্দ করবে কিভাবে। ”
” বেশ বলেছ, জামাইকে জব্দ করতে হবে! কি কুহু পারবেনা? ” নীরা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। ও তাহমিদের কথা শুনে মজা পেয়েছে।

” তুমি আমার সাথে থাকলে সবই পারব, ভাবি। তোমরা কথা বল আমি ততক্ষণে তূরকে দেখে আসি। মেয়েটাকে একা রেখে এসেছ। ও যদি ভয় পায়? ” কুহু রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ও আসলে নীরার সাথে তাহমিদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিতে চায়।
” কুহু মেয়েটা বেশ। ও সবাইকে নিয়ে বাঁচতে জানে। এই কয়েকদিনে দেখলাম, ওর চাহিদাও সামান্য। তুমি ভাগ্যবান, তাহমিদ। কুহুর মত পেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করা তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। তোমার আদরের রত্নটিকে যত্ন করে রেখ। ”

” আমার ভাইয়া কি কম ভাগ্যবান! সে-ও একটা রত্নই বাছাই করেছিল। তোমার মত ভাবি কয়জন পায় বলতো? ”
তাহমিদের কথা শুনে নীরার হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে যায়। ওর দু-চোখ জলে ভরে উঠেছে। তাহমিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনই উপযুক্ত সময়।

” ভাবি, আজ সাত বছর ধরে তোমার সাথে এই বাড়ির সম্পর্ক। এই সাত বছরে তুমিও যেমন আমাদেরকে ভালোবেসেছ, তেমনি আমরাও তোমাকে ভালোবেসেছি। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ তোমাকে দেখে আমার কেন যেন ভালো লাগছেনা। বারবার মনে হচ্ছে তোমার কিছু একটা হয়েছে। তুমি আমাদের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছ। একটা কথা মনে রেখ, এই পরিবারে ছেলের বউরা মেয়ের মর্যাদা পায়। ছেলেরা কোন অন্যায় করলে, বাবা-মা ছেলের বউয়ের পক্ষই নিবে। তোমার সাথে ভাইয়ার কিছু হয়ে থাকলে সেটা আমাদের জানাতে হবে। তবেই আমরা এর সমাধান করতে পারব। তুমি মুখ বন্ধ রেখে নিজের বিপদ বাড়াচ্ছনাতো? ”

নীরা নিশ্চুপ। পুরো রুম জুড়েই নিরবতা বিরাজ করছে। তবে মাঝেমধ্যে নীরার ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
তাহমিদ নীরাকে স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আবার তাহমিদ মুখ খুলল।

” ভাবি, এভাবে কাঁদলেই সব সমস্যার সমাধান হয়না। ছোট ভাই মনে করে আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পার। আমি কথা দিচ্ছি যেকোন উপায়েই তোমার সমস্যার সমাধান করব। ”
এতটুকু ভরসার বানীই প্রয়োজন ছিল নীরার। ও তাহমিদের হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল।
” আমি ভুল করেছি, তাহমিদ। যার মাশুল আজ আমাকে দিতে হচ্ছে, তাওহীদ আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছেনা নীরা।
অনেকক্ষণ পর কান্না কমে আসলে আবার মুখ খোলে।

” আমি সেবছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছয়মাস পর পরীক্ষা। আব্বু একদিন একটা স্মার্ট ফোন আমাকে দিল। বড় ভাইয়া তার এক বন্ধুর কাছে পাঠিয়েছে। ভাইয়া তখন ইংল্যান্ড থাকত। ফোন হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। আত্নীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার সাথে কথা বলতাম ফোনে। একদিন কোচিং-এর স্যারকে ফোন করতে গিয়ে রং নম্বরে ডায়াল করেছিলাম। কারন সেই স্যারের নম্বর ফোনে সেইভ ছিলনা।

সেটাই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই রং নম্বর থেকে একদিন ফোন আসল। কৌতুহলী হয়ে রিসিভ করলাম। এরপর প্রায়ই সেই নম্বর থেকে ফোন আসত। আমিও কথা বলতাম। কিশোরী মন সেই অদেখা মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল। এস এস সি পাশ করে এইচএসসি তে ভর্তি হলাম। তখনও তার সাথে কথা হত। শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতাম।

তখনও আমাদের দেখা হয়নি। কলেজে উঠে বান্ধবীদের সহায়তায় ফেসবুক আইডি খুললাম। তাকেও জানালাম। তার আইডির সাথে যুক্ত হলাম। এভাবেই দুই বছর কেটে গেছে। আমি তাকে দেখিনি কিংবা সে আমাকে দেখেনি। একদিন আমার ছবি চেয়েছিল। তাই স্কুল ড্রেস পরা দুইটা ছবি তাকে দিয়েছিলাম। ততদিনে অবশ্য জেনেছি, তার বাড়ি ময়মনসিংহ শহরে।

এরপর এইচএসসি দিলাম। পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকেই তোমার ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা চলছে। তাকে আমি বারবার বলেছি সামনে আসতে। বাসায় এসে বিয়ের কথা বলতে। কিন্তু সে বারবার বিভিন্ন অযুহাত দিয়েছে। যখন তোমার ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হল, তাকে জানালাম। কিন্তু অবাক করা বিষয়, পরদিন থেকে তার ফোন বন্ধ পাই। সেদিন থেকেই তার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিই। বুঝতে পেরেছিলাম সে আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসেনি। একদিন তোমার ভাইয়া ফোন দিল দেখা করার জন্য। একটা রেস্টুরেন্টে তাওহীদের সাথে দেখা করে তাকে সবটা জানালাম। সে-ও হাসিমুখেই মেনে নিল।” নীরা দম নেয়ার জন্য থামল।

তাহমিদও চুপ করে থাকে। ও চাচ্ছে নীরা স্বেচ্ছায় সবটা বলুক।
নীরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। ও কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।
” নির্দিষ্ট দিনে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর আমাদের জীবন সুখেই কাটছিল। তোমার ভাইয়ার ভালোবাসা পেয়ে অতীতকে ভুলে গিয়েছিলাম। নিজেকে দোষী করতাম, কেন ঐ লোকটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম। গত দেড় বছর আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল।

দেড় বছর আগে একদিন হঠাৎ লক্ষ্য করলাম তোমার ভাইয়া কেমন পাল্টে গেছে। আমাকে সহ্য করতে পারছেনা, আমাকে ছুঁয়েও দেখেনা, ঘৃণা করতে শুরু করেছে আমাকে। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও তার কাছে কোন সদুত্তর পাইনি। এভাবেই কাটছিল। একদিন আমার ম্যাসেঞ্জারে একটা আইডি থেকে ম্যাসেজ আসল। আমি ম্যাসেজ ওপেন করতেই মাথা ঘুরে পরে যাই। সেখানে অনেককিছু লিখা ছিল। সাথে ছিল কয়েকটা ছবি। ম্যাসেজগুলো পড়ে বুঝতে পারলাম, তোমার ভাইয়ার বদলানোর কারন। ” নীরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

” কি লিখা ছিল সেই ম্যাসেজগুলোয়? আর কিসের ছবি ছিল সেগুলো? ” তাহমিদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জানতে চায়।
” সেখানে আমার কয়েকটা ন্যু’ড ছিল। আর ছিল একটা ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ছবি। সেই ছবিগুলো তোমার ভাইয়ার কাছেও পাঠিয়েছিল। আর সেসব দেখেই তোমার ভাইয়া আমাকে ত্যাগ করতে চায়। ও আমাকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, তাহমিদ, আমি কখনোই ঐসব অশ্লীল ছবি উঠাইনি। আর না বিয়ের আগে কারও সাথে আনহেলদি রিলেশন ছিল। ” নীরা মাথা নিচু করে কাঁদছে।

” কে পাঠিয়েছিল সেই ছবিগুলো? ” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তাহমিদ।
” রাকিব মানে সেই ময়মনসিংহের ছেলেটা। অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ছবিতে সে-ই ছিল। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর, তাহমিদ। আমি তার সাথে কখনো ভিডিও কলেই কথা বলিনি। শুধু স্কুল ড্রেস পরে দুইটা ছবি দিয়েছিলাম। ”
” তুমি আর আইডির লিংক আমাকে দাও। আর নিজেকে প্রুভ করতে পারবে? আমি যদি আইনের আশ্রয় নিই, তবে তুমি আমাকে তথ্য সাহায্য করবেতো? ”

” আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে সব করব। বিয়ের আগে যে ফেসবুক আইডি ছিল, এখনও সেটাই আছে। তুমি যদি পার রাকিবের সাথে করা চ্যাটিংও দেখ সেখানে পড়াশোনার বাহিরে অন্য কথা কমই হত। আমি তার সাথে একটা অশ্লীল কথা বলিনি কিংবা তাকে অশ্লীল কথা বলতে উৎসাহিতও করিনি। ”

” তুমি রুমে গিয়ে সেই আইডির লিংক আর ছবিগুলো আমাকে পাঠাও। তারপর বাকিটা আমি দেখছি। আর আগামী দুই-তিন দিন ভাইয়াকে তুমি ফোন দিওনা। যা করার আমিই করব। তুমি নিশ্চিন্তে থাক, তোমার কোন দোষ না থাকলে ভাইয়া তোমাকে ছাড়তে পারবেনা। আমি সেটা হতে দেবনা। এখন নিজের রুমে যেয়ে একটা লম্বা ঘুম দাও। আর ননদের বিয়েতে কি করবে সেসব প্ল্যানিং কর। তারাতারি গিয়ে আমার বউটাকে পাঠিয়ে দাও। ওকে ছাড়া নিজেকে কেমন অসহায় মনে হচ্ছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে নীরা আশার আলো দেখতে পায়। ও চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ২৯

বিঃদ্রঃ আমি গল্পের দ্বিতীয় পার্টেই বলেছিলাম, সপ্তাহে তিনদিন গল্প দেব। দিচ্ছিও তাই। কিন্তু অনেকেই অভিযোগ করছেন নিয়মিত কেন গল্প দিইনা। সংসার, সন্তান সামলে আমি গল্প লিখি। ছেলেকেও সময় দিতে হয়। সপ্তাহে তিনদিন গল্প লিখলে একটু ঝামেলা কম হয়। হাজবেন্ড সব মেনে নেয়, কিন্তু ছেলের পড়াশোনার কমতি সে মানতে চায়না। তাই সপ্তাহে তিনদিন গল্প লিখতে আমার জন্য সুবিধা হয়। এই গল্প লিখতে গিয়ে আমি দুইটা ইউটিউবের জন্য লিখা গল্পের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি নিয়মিত লিখার। তবুও আপনারা অভিযোগ করেই যাচ্ছেন। ইনবক্সে এসে জানতে চাচ্ছেন। আমি আবারও বলছি, সংসার, সন্তাচ,স্বামী, শ্বশুর-শ্বশুড়ি নিয়ে আমাকে বাস করতে হয়। আপনাদের ভালোবাসা আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আপনারা ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতামনা। তাই বলব একটু ধৈর্য ধরুন। পাঠকমহলকে আবারও ভালোবাসা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩১