বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৪
জাওয়াদ জামী

নীরার শরীর খারাপ থাকায় ও তাহমিনা আক্তারকে বলে নিজের রুমে চলে যায়।
মা’য়ের ডাক উপেক্ষা না করতে পেরে, তাওহীদ নিচে এসে অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও পিঠা খেতে বসল।
তাহমিদ ড্রয়িংরুমে এসে তাওহীদকে দেখেই আবার নিজের রুমে চলে যায়। তাহমিনা আক্তার অনেকবার ডাকলেও ও কিছুতেই শুনলনা। বাধ্য হয়ে তাহমিনা আক্তার তাহমিদের রুমে পিঠা নিয়ে গেলেন।

কুহু বুঝতে পেরেছে আজ তাহমিদ ভিষণ রে’গে আছে। তাহমিদের রাগের কারন ও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। গতরাতে তাহমিদ ওকে পুরোটা না বললেও কিছুটা বলেছে। এদিকে ও মেডিকেল থেকে আসার পরে কিছুই খায়নি। হয়তো দুপুরেও খায়নি। মানুষটা এতক্ষণ না খেয়ে আছে ভাবতেই কুহুর বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। কিন্তু ও তাহমিদকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা। কিছু একটা ভেবে কুহু নিচে যায়। শ্বাশুড়িকে বলে খাবার রুমে নিয়ে আসল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাহমিদ বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। ডান হাত কপালের ওপর রেখেছে। ফলে চোখ খোলা না বন্ধ সেটা বোঝা যাচ্ছেনা।
কুহু সেন্টার টেবিলে খাবারগুলো রেখে গুটিগুটি পায়ে তাহমিদের কাছে যায়। হাত রাখে তাহমিদের মাথায়।
” ঘুমিয়েছেন? না ঘুমালে উঠুন। খাবার নিয়ে এসেছি, খেয়ে নিন। ”
” আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি সব খাবার ঢেকে রেখে দাও। তুমি খেয়েছ কিছু? ” তাহমিদ কি মনে করে কুহুকে জিজ্ঞেস করল।

” নাহ্। ক্ষুধা না থাকায় দুপুরে খেয়েছিলামনা। ” কুহু ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
” তুমি প্লেটে খাবার দাও, আমি মুখহাত ধুয়ে আসছি। ” তাহমিদ ওয়াশরুমের দিকে যায়৷
কুহু মৃদু হেসে প্লেটে খাবার তুলতে থাকে।

মুখহাত ধুয়ে এসে কুহুকে নিয়ে একসাথে খায় তাহমিদ। খাওয়া শেষ হলে বড়মার কাছে যায়। সেখানে তাওহীদ আফরোজা নাজনীনের সাথে কথা বলছিল। তাওহীদকে দেখেই আরেক দফা মেজাজ খারাপ হয় তাহমিদের।
” বড়মা, এই আহাম্মক যখন তখন এদিকওদিক ছোঁ ছোঁ করছে কেন? ওকে আমি বাসায় আসতে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও ও আমার কথা শোনেনি। ও যদি বাসা থেকে আজকেই না যায়, তবে আমি কুহুকে নিয়ে বাসা ছাড়ব বলে দিলাম। ”

আফরোজা নাজনীন পরেছেন বিপাকে। তিনি না পারছেন তাহমিদকে কিছু বলতে, না পারছেন তাওহীদকে বাসা থেকে বের করে দিতে। তবে তিনি এটা বেশ বুঝতে পারছেন, এই মুহুর্তে তাহমিদকে বোঝাতে না পারলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে।

” বাপ, তুই আমার কাছে এসে বস। আমার কথা মনযোগ দিয়ে শোন। তাওহীদ তুই এখন বাহিরে যা। তবে ভুল করেও নীরার আশেপাশে যাবিনা। পারলে তূরকে নিয়ে বাহিরে থেকে ঘুরে আয়। ” আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে তাওহীদ বেরিয়ে যায়।
এরপর আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে নিজের পাশে বসালেন।

” বাপ, এখন রাগ করার সময় নয়। আমাদের সব কিছু ভেবেচিন্তে করতে হবে। তাওহীদ এই বাড়ির ছেলে। হ্যাঁ, ও মারাত্মক ভুল করেছে। শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু বাড়ি থেকে বের করে দেয়া একমাত্র শাস্তি হতে পারেনা। এই যে তুই ওকে দেখে রে’গে যাচ্ছিস, নীরা ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমি কিছুক্ষণ আগেই ওকে থা’প্প’ড় মেরেছি, এগুলো কি শাস্তি নয়? এগুলো ছাড়াও অনেক ভাবেই ওকে শাস্তি দেয়া যায়।

বাড়ি থেকে বের করে দেয়া কোন সমাধান হতে পারেনা। এছাড়া ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, লোক জানাজানি হবে। আর মানুষের স্বভাব তুই, আমি, আমরা ভালো করেই জানি। এরা কারও বিপদে এগিয়ে আসবেনা ঠিকই, উল্টো কেউ বিপদে পরলে তাকে আরও ডুবিয়ে দিতে চায়। এছাড়াও কানাঘুষা করবে, কেন তাওহীদকে বাড়ি ছাড়া করলাম। দেখবি সব শেষে দোষ নীরার ঘাড়েই পরবে। নীরার সম্মান মানে এই বাড়ির সম্মান। আমি তোকে বোঝাতে পেরেছি, বাপ? ”
আফরোজা নাজনীন উত্তরের আশায় তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

” ঠিক আছে, বড়মা। তুমি যা বলবে, তাই হবে। তবে তুমি তাকে বলে দিও, ভাবি তার সাথে কোথাও যাবেনা। যতদিন ভাবি না চাইবে, ততদিন ভাবি এখানেই থাকবে। ”
” আমি ওকে বলে দেব। ” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আফরোজা নাজনীন। অবশেষে তিনি তাহমিদকে বোঝাতে পেরেছেন।
রাতে তাওহীদ রুমে এসে দেখল নীরা দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। মাঝখানে তূরকে শুইয়ে রেখেছে। তাওহীদের খুব ইচ্ছে করছে নীরার সাথে কথা বলতে। ও একবার মৃদুস্বরে নীরাকে ডাকল কিন্তু নীরার দিক থেকে কোন সাড়া পায়না। বাধ্য হয়ে ও নিজেও বালিশে মাথা রাখল। ওর যে এখনো নীরার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়নি। নীরা ক্ষমা করলেই তবে ও শান্তি পাবে।

সারারাত চিন্তা করে কাটাল তাওহীদ। ও নীরার সাথে যা করেছে, সে তুলনায় শাস্তি হয়তো কম পাচ্ছে। কিন্তু ও হয়তো নীরাকে হারিয়ে ফেলল! নীরা মনে হয়না কোনদিন ওর সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে। তবে কি সম্পর্কের মধ্যে রা’গ, জিদ, ঘৃ’ণা নামক বিষাক্ত মরিচীকা বাসা বাঁধল? এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি হতে পারে? একদিন সে সম্পর্ক নিজ দ্বায়িত্বে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাওহীদ, আজ সেই সম্পর্ক টেকাতে মরিয়া হয়ে উঠছে।

তাহমিদ বড়মার কাছ থেকে এসে সেই যে শুয়েছিল, উঠেছে ফজরের আজান শুনে। সারাদিনের ধকলের পর রাতটা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই কেটেছে। বড়মার নেয়া সিদ্ধান্ত ওর মনে ধরেছে। তাই নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিতে পেরেছিল।
ফজরের নামাজ কানে যেতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল তাহমিদ। ওর পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত তরুনীর দিকে চোখ পরতেই অজান্তে ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল। রাতে মেয়েটা কখন বিছানায় এসেছিল? বিয়ের পর আজই প্রথম ও কুহুর আগে ঘুমিয়েছে। ঘুমানোর আগে মেয়েটার ললাটে, অধরে প্রেমের পরশ দিতে পারেনি। বুকে জরিয়ে রাখতে পারেনি সারাটা রাত।

তাহমিদ একটু ঝুঁকে তার রমনীর ললাটে অধর ছোঁয়ায়। এরপর পরম আবেশে ঠোঁটে গভীর চুমু দেয়।
ঘুমের মধ্যে কুহুর মনে হচ্ছে ওর শ্বাস আটকে আসছে। ও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে চাইলেই বাধাপ্রাপ্ত হয়। নিজেকে একটু ধাতস্থ করতেই বুঝতে পারল, তাহমিদ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে ঠোঁটে চুমু দিচ্ছে। মুহুর্তেই কুহুর কি হয়ে গেল বলতে পারেনা, ও নিজেও তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল।

বেশ কিছুক্ষণ পর তাহমিদ কুহুকে ছেড়ে দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকে। কুহু স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে তার একান্ত পুরুষটিকে। এই পুরুষটি শুধুই তার। যতবারই কথাটা ভাবে, ততবারই কুহুর শরীর আবেশে ছেয়ে যায়। বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দনের গতি। শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় র’ক্তকনিকা তড়িৎ গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। এত মায়া কেন মানুষটার মাঝে? কুহু এত ভালোবাসে কেন তাকে? কিংবা এই মানুষটাই বা কুহুকে কেন পা’গ’লে’র ন্যায় ভালোবাসে? প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর অনেক খুঁজেও কুহু বের করতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করে কুহু হাল ছেড়ে দিয়েছে। অজানাই থাকনা কিছু প্রশ্নের উত্তর। যেসব প্রশ্নেরা হিয়ার মাঝে আলাদা অনুভূতির জন্ম দেয়, সেসব প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকলেও যেন সুখ দোলা দেয় হৃদয় আঙ্গিনায়।

কুহু কম্পিত হস্তে ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাহমিদের প্রশস্ত ললাট, ধনুকের ন্যায় বাঁকা ভ্রু-যুগল, সমুদ্রের ন্যায় গভীর আঁখিদ্বয়, ভরাট চোয়াল আর কালচে খয়েরী রঙের পুরুষ্ট ঠোঁটগুলি।
কুহুর এমন গভীর স্পর্শে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাহমিদ। এক ঝটকায় কুহুকে বুকের মাঝে আটকে নেয়। কুহুর সাধ্য নেই তাহমিদের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার।

” ভালোবাসি বউ, খুব ভালোবাসি। ”
” নামাজ পড়বেননা? মসজিদে যাবেন? ”
তাহমিদ কুহুর কথা শুনে বেশ ঝটকা খায়।
” আনরোমান্টিক মেয়ে একটা। জামাইয়ের মুখ থেকে ভালোবাসি শুনলে প্রত্তুত্যরে যে ভালোবাসি বলতে হয়, সেটা তোমার জানা নেই? এখনই বল ভালোবাসি, নতুবা আমার কাছ থেকে ছাড়া পাবেনা। আজন্ম আমার সাথে এভাবেই চিপকে থাকতে হবে। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এরইমধ্যে তাহমিদ ওর উন্মুক্ত গলায় মুখ ডুবিয়েছে। ছোট ছোট চুমুয় মাতাল করে দিচ্ছে তার রমনীকে।
এভাবেই কিছুক্ষণ খুনসুটিতে কাটাল দুজন। অনেক জোড়াজুড়ির পর তাহমিদের বাঁধন থেকে মুক্ত হল কুহু। তবে তাহমিদের আর মসজিদে যাওয়া হলোনা। দুজনেই একসাথে রুমে নামাজ আদায় করল।
তাওহীদ সকালে নীরাকে তৈরি হতে বলল। ওর ছুটি নেই, বিধায় আজকেই কর্মস্থলে রওনা দেবে। কিন্তু নীরার নড়াচড়ার কোন লক্ষ্মণই দেখলনা।

” নীরু, ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আমরা দুপুরেই রওনা দেব। ছুটি নিয়ে আসনি, তাই আজই যেতে হবে। ” মৃদু গলায় বলল তাওহীদ।
” আমি কোথাও যাচ্ছিনা। চাইলে আপনি যেতে পারেন। আপনাকে আটকাবোনা। সেই অধিকার কিংবা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। ”
” প্লিজ নীরু, এভাবে বলোনা। আমি ভুল করেছি। সেই ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ দাও। ” নীরার হাত ধরে তাওহীদ আকুতি করছে ক্ষমা পাওয়ার।

কিন্তু নীরা তাওহীদের হাত ছাড়িয়ে রুমের বাহিরে চলে আসে। দরজার চৌকাঠ মাড়িয়েই হু হু করে কেঁদে উঠল। এই মানুষটাকে ও বড্ড ভালোবাসে। আর ভলমালোবাসে জন্যই, দেড়টা বছর অনেক অবহেলা সহ্য করেও মানুষটার সাথে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। শুধু ভালোবাসার জন্যই সব সহ্য করেছে নীরা। কিন্তু আজ ওর মনটা বড্ড অভিমানী হয়ে উঠেছে।

ও চাইছে আগে তাওহীদ নীরার মতই অবহেলার আ’গু’নে পুড়ে খাঁটি সোনা হোক। তবেই ওর কাছে ফিরবে নীরা।
তাওহীদ বুঝতে পেরেছিল এমনটাই হবে। নীরার মনে অভিমান জমতে জমতে সেগুলো পাথুরে পাহাড়ে রূপ নিয়েছে। এই অভিমান গলাতে ওর বড্ড বেগ পেতে হবে, এটাও বুঝতে পারছে। তবে ও কিছুতেই হাল ছাড়বেনা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৩

নীরার মনের অভিমানের পাহাড় গলিয়েই তবে ছাড়বে। পূর্বের ন্যায় আপন করে নেবে ওর নিরু পাখিকে। দুজনে একসাথে আরও অনেক যুগ পথ চলবে। আরও অনেক ভালোবাসবে তার নীরু পাখিকে। আর কোন অভিযোগের সুযোগই দেবেনা।
( শরীরে অনেক জ্বর, সেই সাথে সর্দি-কাশি। ছেলেরও একই অবস্থা। তাই এর বেশি লিখতে পারলামনা। সবাই আমারদের জন্য দোয়া করবেন।)

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩৫