বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৩

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৩
জাওয়াদ জামী

” সিক্তা, এই সিক্তা, আর কত ঘুমাবি, মা! এবার ওঠ। এখন থেকে অভ্যাস না করলে, শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কি করবি বলতো? মেয়েদের এত বেলা করে ঘুমাতে নেই। ” আফরোজা নাজনীন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছেন।
” মা, আমাকে আরেকটু ঘুমাতে দাওনা। এত সকালে ডাকছ কেন? ” সিক্তা ঘুম জড়ানো গলায় বলল।
” এখন বাজে সকাল দশটা। আর বলছিস এত সকাল! বিয়ের কনে তুই। আর কয়দিন পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি। তোর কি এত বেলা করে ঘুমালে চলবে? শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কি করবি বলতো? ”

আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে সিক্তা ঝট করে চোখ খুলে উঠে বসল। ও ঘুমের ঘোরে বিয়ের কথা ভুলেই ছিল। কিন্তু মা’য়ের মুখে পুনরায় বিয়ের কথা শুনে ওর কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হু হু করে কেঁদে উঠল। কান্নাকে কিছুতেই নিজের বশে আনতে পারছেনা সিক্তা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” সিক্তা, তুই কাঁদছিস কেন! এমনিতেই বেরা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস তোর গেলনা। তারউপর আমার কথা শুনে কাঁদছিস! শ্বশুর বাড়িতে এসব কেউ দেখবে বলতো? সেখানে সব দ্বায়িত্ব তোরই পালন করতে হবে। ”
” আমাকে বিয়ে না দিলে তোমাদের চলছিলনা, মা? আমি কি বোঝা হয়ে গেছি? একবারও আমার মতামত নেয়ার কথা তোমরা ভাবলেনা। নিজেরাই সব ঠিক করছ। ” সিক্তা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
” তোর আবার কিসের মতামত! বিয়ে দেব আমরা। আমরাই যা করার করব। তুই শুধু চুপচাপ বিয়ের পিঁড়িতে বসবি। ”
” তুমি এই কথা বলছ, মা! একটাবার আমার পছন্দ কি তা শুনবেনা? ”

” তোর পছন্দ আমাদের জানাই আছে। তুই নিজে যেমন, পছন্দও করবি তেমন কাউকেই। বেশি কথা না বলে উঠে পর। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। তোর আবার আবার সেগুলো গরম করতে হবে। আজ দুনিয়ার কাজ আছে। ছেলের বাড়িতে বিয়ের দিন ঠিক করতে যেতে হবে। কুহুর সাথে গিয়ে কয়েক রকম ফলমূল আর মিষ্টি কিনে নিয়ে আসবি তুই।

নীরা থাকলে তোকে বলতামনা। মেয়েটাতো রাস্তাঘাট এখনো খুব একটা চেনেনা। ওকে তুই ফল, মিষ্টির দোকানে নিয়ে যাবি। তোর বাবা অফিস থেকে সোজা জামাইয়ের বাসায় যাবে। আর সে কেনাকাটায় অপটু এটা তুই জানিস। আমি আর তাহমিনা যাব শপিংয়ে। জামাইয়ের বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করব। তাই মিষ্টি কেনার দ্বায়িত্ব কুহুর ওপর থাকবে। তুই শুধ ওকে গাইড করবি। আমরা তিনটার সময় এখান থেকে বেরিয়ে পরব। ”

আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে সিক্তা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
” আমি এ বিয়ে করবনা, মা। আর তুমি কি জামাই জামাই করছ? যাকে তাকে জামাই বললেই হলো নাকি! আমি এসব মেনে নিতে পারছিনা, মা। ”
” আমি নাহয় তোর সব আলসেমি, আবদার সহ্য করছি। তাই বলে কি শাহনাজও করবে ভেবেছিস? তোকে কি দেখে যে আনান পছন্দ করেছিল, আমি ভেবে পাইনা। তুই ওর যোগ্যই না। আমার বোনটার জীবন তুই জ্বা’লি’য়ে খাবি এটা বুঝতে পারছি। ”

আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে বসে থাকে সিক্তা। এরপর মা’কে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে উঠে। ও বিশ্বাসই করতে পারছেনা ওর বিয়ে আনানের সাথে হবে!
” তুমি সত্যি বলছ, মা! অন্য কোথাও আমার বিয়ে হবেনা? ”
” না মিথ্যে বলছি। তলে তলে এসব করেই বেরিয়েছিস! বেয়াদব মেয়ে। বাপের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল। এবার যদি না উঠেছিস, তবে থাপ্পড় মা’র’ব। ” আফরোজা নাজনীন মেয়ের সাথে কৃত্রিম রা’গ দেখালেন।

সিক্তা মায়ের ধমক খেয়ে উঠে পরল। আফরোজা নাজনীনও নিচে গেলেন। আজ তার অনেক কাজ।
এগারোটার দিকে তাহমিনা আক্তার ও আফরোজা নাজনীন শপিংয়ে বেরোলেন। তবে সাথে কুহুকেও নিলেন। সিক্তার ফল,মিষ্টি কিনতে যাওয়ার প্ল্যান বাতিল করলেন আয়েশা সালেহা। তিনি চাননা তার নাতনি আজ বাহিরে যাক। তার দুই ছেলের বউ, তার কথা অমান্য করলেননা।

সিক্তা খুশির ঠ্যালায় নাওয়াখাওয়া ভুলে সাড়া বাড়িময় ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। এদিকে আনান ওকে ফোন দিয়ে দিয়ে অসহ্য হয়ে গেছে। তবুও সিক্তা ফোন রিসিভ করলনা। বারোটার দিকে নিজের রুমে এসে, ফোন হাতে নিয়ে দেখল আনানের ফোন এসেছে একশোটার বেশি। তবে আজকে একটুও ভয় লাগলনা সিক্তার। ও জানে আনান ওকে বিশাল একটা ঝাড়ি দেবে। কিন্তু আজ ও কোন ঝাড়ির পরোয়া করছেনা।

” এই তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? কতবার ফোন দিয়েছি, দেখেছিস? আমার কি টেনশন হয়না? আজ ভার্সিটিতে আসিসনি কেন? ”
” শোন, তুমি আজ বিকেলে বাসায় থেক। ভার্সিটি থেকে সোজা বাসায় যাবে। আর এক মুহুর্তের জন্যও বাহিরে কোথাও যাবেনা। ” সিক্তা আনানকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে।

” কেন বাসায় থাকব! তুই আসবি? এই শোন তাহলে আমি বিকেলে ঘুমাব, বুঝলি? তুই বাসায় এসে সোজা আমার রুমে আসবি। তোকে জড়িয়ে ধরব। আজ কিন্তু কোন বারন শুনবনা। অনেকক্ষণ তোকে বুকে জরিয়ে রাখব। ”
” শুধু আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসে তোমার? চুপচাপ ফোন রাখ, আর বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে শরীরে সাবান ঘষে গোসল করবে উসকোখুসকো থাকা যাবেনা মোটেও। ”

” ঘটনা কি রে, সিক্তা! আমাকে সাবান দিয়ে গোসল করতে বলছিস কেন? ব’লি দিবি নাকি আমাকে? শুনেছি ব’লি’র পাঁ’ঠা’কে ভালোভাবে গোসল করানো হয়। তোর ভাবসাব আমার কাছে ভালো লাগছেনা। ” একটু ভরকে গেছে আনান।
” তুমি নিজেকে পাঁ’ঠা ভাব নাকি! জব্বর একটা দিয়েছ নিজের। ভাইয়াকে বলতে হয়। তোমার নাম ভাইরাল করার দ্বায়িত্ব ভাইয়ার। ” সিক্তা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

” ভাইয়ের চামচিকে চুপ কর। কিছু হলেই শুধু ভাইয়া ভাইয়া করবে। ফোন রাখ আমি বাসায় যাব। ”
” যাও। তবে ভালোমত গোসল কর কিন্তু। ”
আনান এবার রে’গে ফোন কে’টে দেয়।

সিক্তা ফোন হাতে নিয়ে হাসতে থাকে। ভাগ্যিস ওর বিয়ের কথা গতকাল আনানকে বলেনি। ছেলেটা ভিষণ কষ্ট পেত তবে।
বিকেল চারটা পঁয়তাল্লিশ। শাহনাজ সুলতানা রান্নাঘরে ব্যস্ত নাস্তা বানাতে। তার স্বামী-সন্তানেরা বাসায় আছে। প্রতিদিন বিকেলে তাদের জন্য নানানরকম নাস্তা বানাতেই হয়। আরোশিও মা’কে টুকটাক সাহায্য করছে। শাহনাজ সুলতানা সিঙ্গাড়া তেলে ছেড়েছেন মাত্রই, তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। তিনি আরোশিকে এদিকটা দেখতে বলে দরজা খুলতে গেলেন।
দরজা খুলেই শাহনাজ সুলতানার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।

” কি শালিকা ভেতরে আসতে বলবেনা? আমরা কিন্তু খালি হাতে আসিনি। ” সানাউল রাশেদিন রসিকতা করে বললেন।
” দুলাভাই, আপনি পারেনও বটে! আসেন ভেতরে আসেন। ”
শাহনাজ সুলতানা আয়েশা সালেহাকে ধরে ভেতরে নিয়ে আসলেন। তিনি আসলে খুবই অবাক হয়েছেন একসাথে সবাইকে দেখে।

শাহনাজ সুলতানার স্বামীও সবাইকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। ঐ বাড়ির সবাই এসেছে। শুধু সিক্তা ছাড়া।
ড্রাইভার এসে সব ফলমূল আর মিষ্টি আর কাপড়চোপড়ের প্যাকেট ড্রয়িংরুমে রাখল। আরোশি সবাইকে দেখে নিজের দ্বায়িত্ব ভুলে দৌড়ে আসে ড্রয়িংরুমে। রান্নাঘর আপাতত মেইড সামলাচ্ছে।

বাসায় শোরগোল শুনে আনানের ঘুম ভেঙে যায়। ও ফ্রেশ না হলেই ড্রয়িংরুমে আসল। সেখানে বড় খালামনির পরিবারের সবাইকে দেখে সবার মত সে-ও অবাক হয়েছে বৈকি। সবাইকে সালাম দিয়ে, বেসিনেই চোখমুখে পানি দেয়। এরপর গিয়ে বসল তাহমিদের পাশে। সানাউল রাশেদিনের নির্দেশে তাহমিদকেও কাজ ফেলে আসতে হয়েছে। এমনকি শফিউল রাশেদিনও এসেছেন।

” দিদুন, তোমার কি অবস্থা? কেমন আছো তুমি? ” আনান হাসিমুখে কথা বলছে।
” আমি ভালোই আছি দুলহা মিঞা। তবে তোমার ভালো থাকার দিন ফুরোলো। ”
দিদুনের মুখে দুলহা মিঞা ডাক শুনে কপাল কুঁচকে তাহমিদের দিকে তাকায় আনান। তনহমিদ ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

” দুলাভাই, আমি কিন্তু সত্যিই অবাক হয়েছি, আপনাদের সবাইকে একসাথে দেখে। আমি ভাবতেই পারিনি আপনারা সবাই একসাথে কখনো আমার বাসায় আসবেন। তবে টুকটুকিকে নিয়ে আসলেই পারতেন। মেয়েটাকে বাসায় একা রেখে এসেছেন কেন? ”

” ঐটা আর কয়দিন পর এখানেই তো পারমানেন্ট হবে। তাই আজকে তাকে টেম্পোরারিভাবে এখানে আনার দরকার কি বল? তা ফুপু শ্বাশুড়ি রান্নাঘরে কি করছিলে? ” তাহমিদ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল।
” অনেক কিছুই করছিলাম, জামাই বাবা। তুমি কি খাবে বল। যা খেতে চাইবে তাই তৈরি করব। একটামাত্র মেয়ে জামাই বলে কথা। ”

” আগে কাজের কথা, তারপর খাওয়া। কাজের কথা শেষ হলে যা ইচ্ছে খাওয়াবে। ”
” কাজের কথা! ” শাহনাজ সুলতানা অস্ফুট স্বরে বললেন।
” শোন মা শাহনাজ, আমরা এসেছি আনানের সিক্তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি না বললে এরা সবাই হেয়ালি করে যাবে। আমাদের মেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ের প্রস্তাবও আসছে। গতকালও এসেছিল। ছেলের এবং তার পরিবার সম্পর্কে সবকিছু শুনে আমরাও কথা বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তাহমিদ জানায়, ওর ইচ্ছে সিক্তার সাথে আনানের বিয়ে হোক। ওরা নাকি দুজন-দুজনকে পছন্দ করে। তাই আমরা অন্যদিকে পাত্র না দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবার তোমাদের মতামতের পালা। ” আয়েশা সালেহা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন।

আয়েশা সালেহার কথা শুনে শাহনাজ সুলতানার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সিক্তাকে তার সব সময়ই পছন্দ। টুকটুকি তার ছেলের বউ হয়ে আসবে ভেবেই তার আনন্দ হচ্ছে।
এবার কথা বললেন শাহনাজ সুলতানার স্বামী।
” আম্মা, আপনি এসেছেন একটা প্রস্তাব নিয়ে, আর সেটা আমি ফিরিয়ে দেব, এটা ভাবতেই আমার কষ্ট হয়। আর তাছাড়া সত্যিই যদি ছেলে-মেয়ে দুজন-দুজনকে পছন্দ করে, তাহলে আমাদের কোন উচিত নয় বলে আমি মনে করি। আনান, তুমি কি বল? ”

আনান কিছু না বলে মাথা নিচু করে রাখে।
” কি রে, এখন কথা বলছিসনা কেন? এতদিন এটাসেটা বলে আমার মাথা খেয়েছিস। তবে আজ চুপ কেন? ” তাহমিদ ফোঁড়ন কে’টে বলল।
” ভাই, আজ অন্তত কিছু বলোনা। ”
আনানের অসহায় মুখ দেখে তাহমিদের হাসি পায়।

” দাদুভাই, তুমি কি সিক্তাকে বিয়ে করতে রাজি? তুমি রাজি হলেই, তবে আমরা কথাবার্তা বলব। ” আয়েশা সালেহা জিজ্ঞেস করলেন আনানকে।
” তোমরা যেটা ভালো মনে হয় সেটাই কর, দিদুন। আমার কোন আপত্তি নেই। ” আনান আর সেখাসে বসলনা। নিজের রুমে চলে আসল।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪২

বিঃদ্রঃ অনেকেই কমেন্টে জিজ্ঞেস করেছেন কেমন আছি। আলহামদুলিল্লাহ আগের থেকে ভালো আছি। তবে বিকেলে আরেকটা ছোটখাটো এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তারপরও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। সবাইকে ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৪