বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৪
জাওয়াদ জামী

” দুলাভাই, এটা কি বললেন আপনি! আসি ছেলেকে বিয়ে করিয়ে, বউ বাপের বাড়িতে রাখব কেন! মানলাম আনান পড়াশোনা করছে। ওর কোন ইনকাম নেই। তাই বলে আমি বউমাকে কাছে রাখতে পারবনা! আমার যদি আরেকটা মেয়ে থাকত, তবে কি আমি ওকে ফেলতে পারতাম?

সিক্তা এ বাড়িতে আমার ছেলের বউ হয়ে আসবেনা, আসবে আমার মেয়ে হয়ে। তাই ওর সব দ্বায়িত্ব আমাদের। আর আনানের অনার্স ফাইনাল দুইমাস পর। এরপর মাস্টার্স করতে এক বছর লাগবে। আমার বিশ্বাস পড়াশোনা শেষ করলে ও ভালো চাকরি পাবে। আমার ছেলে পড়াশোনায় ভালো। তাই আপনার এসব নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবেনা। যতদিন আনানের কোন চাকরি না হবে, এমনকি ওর চাকরির পরেও ওদের দ্বায়িত্ব আমার। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সানাউল রাশেদিন চাইছিলেন আনানের পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিক্তাকে নিজের বাসাতেই রাখবেন। তবে মাঝেমধ্যে এখানে আসবে, আনান ঐ বাড়িতে যাবে। তাই তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন আনানের বাবার কাছে। কিন্তু তার প্রস্তাব শুনে আনানের বাবাও নিমরাজি হন। এবং শাহনাজ সুলতানাও। তিনি সরাসরিই সানাউল রাশেদিনকে তার মনের কথা জানালেন।
আনান রুমে এসে সিক্তাকে ফোনে ট্রাই করছে। কিন্তু সিক্তা ওর ফোন রিসিভ করছেনা। বেচারা আনানের মুডটাই খারাপ হয়ে গেছে।

” অবশেষে তুই আমাদের বাড়ির জামাই হতে চলেছিস। কত ভালো কপাল হলে ঐ বাড়ির জামাই হওয়া যায়, একবারও সেটা ভেবেছিস আনান? ” তাহমিদ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
” যেমন ভাগ্য হলে আমার মত ছেলেকে হাজবেন্ড হিসেবে কোন মেয়ে পায়, কুহুর মত মেয়েকে কোন পা’গ’ল ডক্টর পায়। আমার ভাগ্যটাও ঠিক তেমনই। তাইনা, ভাই? ” আনান কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকল।

” অপমান করলি বোধহয়? ” ডান ভ্রু উঁচিয়ে তাহমিদ আনানের দিকে তাকিয়ে আছে।
” নাউজুবিল্লাহ। তুমি আমার বউয়ের প্রানের ভাই। তোমাকে আমি অপমান করতেই পারিনা। আমিতো শুধু নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করলাম। কুহুকে পেয়ে তুমি ভাগ্যবান। আমাকে পেয়ে তোমার বোন ভাগ্যবতী। বিষয়টা এরকম। ”
” তাহলে বলতে চাচ্ছিস কুহু ভাগ্যবতী নয়! আর তুইও ভাগ্যবান না? যাকিছু ভাগ্যবান, ভাগ্যবতী আমরা দুই ভাইবোন! যাহ তোর বিয়ে ক্যান্সেল। যতই আমি তোর ভালো চাইনা কেন, তুই যে একটা শাখামৃগ আমি বারবার সেটা ভুলে যাই। আজ তোর আশায় এক ড্রাম পানি ঢালছি আমি। কিছুক্ষণ ওয়েট কর। ”

” তুমি পারবেনা, ভাই। বোনকে তুমি একটু বেশিই ভালোবাসো। বোনের চোখের পানি তুমি দেখতে পারবেনা। তুমি যতই ডক্টর হওনা কেন, এই বিষয়ে তুমি ফেইল। ”
” বিয়ের কথা হতে কি না হতেই আকাশে উড়ছিস? যদি এমন করি, বিয়ের পর এক বছর তুই সিক্তার চেহারা দেখতে পারলিনা। কেমন হবে বলতো? আর এটা কিন্তু আমি খুব ভালো করেই করতে পারব। তোর পরিবারের লোকজন যতই চাক সিক্ত এখানে এসে থাকুক। কিন্তু আমার একটা কথাতেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে। হাজার হোক তাদের জামাই বলে কথা। জামাইয়ের কথা কেউ কি ফেলতে পারে? ”

” মাফ কর, ভাই। কুহু ভাগ্যবতী আর আমি ভাগ্যবান। তুমি যা বলবে তাই মানব। তবুও বউ ছেড়ে থাকার কথা বলোনা। এমনিতেই তোমার বোনকে না দেখলে কষ্ট হয়। আর বিয়ের পর বউকে কাছে না পাওয়া মানে, আমার নামের বরাদ্দকৃত বিরিয়ানি মানুষের বাড়ির ফ্রিজে রাখার সমান। বিয়ের ছয়মাসেও যেখানে তুমি বউকে কাছ ছাড়া করনি। সেখানে আমার প্রতি এমন অবিচার তুমি করতে পারনা। জানোতো, তোমার মতই আমিও বউ ছাড়া অসহায়। সে যতই এখনো বিয়ে না হোক। মনে মনে তো ওকে বউ হিসেবেই মানি। ”

” আহাম্মক কোথাকার। একটুও লজ্জাশরম নেই তোর? বউয়ের বড় ভাইয়ের সামনে এসব বলতে তোর লজ্জা করছেনা? ছিহ্ আনান ছিহ্। ”
” আমিও তো তোমার বউয়ের বড় ভাই। তুমি আমাকে দেখে কখনোই লজ্জা পেয়েছ! আমি এসব তোমার কাছেই শিখেছি। তাই নো লজ্জা। শুধুই চিল করবা চিল। জেনে রাখ, কয়দিন পর আমরা ভায়রা ভাই হব। তাই একটুআধটু ইয়ার্কি লজ্জাহীন কথাবার্তা চলতেই পারে। দেখনি, আমার আব্বু আর আমার শ্বশুর দুই ভায়রা ভাই মিলে কত ইয়ার্কি করে। ” আনান তাহমিদকে চোখ মা’র’ল।

আনানের কথা শুনে তাহমিদ বুঝতে পারছে এই ত্যাঁদড় ছেলেটা ওকে চরম ভোগাবে। একে এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে মুশকিল আছে।
তাহমিদ ড্রয়িং রুমে এসে দেখল তারা বিয়ের দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনা করছে। সানাউল রাশেদিন তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন কবে বিয়ের দিন করলে ওর সুবিধা হবে। তাহমিদ জানাল, যেকোন দিনই করা যেতে পারে। তবে ও আরও জানাল আনানের পরীক্ষার আগেই যাতে বিয়েটা হয়ে যায়।

” আমিও বাবুর কথার সাথে একমত। যত তারাতারি সম্ভব দুটোর বিয়ে দেয়া উচিত। পরীক্ষার পর বিয়ের দিন করলে আনানের পড়ায় মন বসবেনা। আবার ছয়মাস পর সিক্তার পরীক্ষা। এদিকে কুহু গত ছয়মাস বাবার বাড়িতে যায়নি। ওদের বিয়ের পর কুহুকে ফুলতলা পাঠিয়ে দিব। পনের দিনের আগে ওর ঢাকায় আসা বারণ। সবদিক বিবেচনা করে আগামী পনেরদিনের মধ্যেই ওদের বিয়ে দেয়া উত্তম। ” তাহমিনা আক্তার নিজের মতামত জানালেন।

এদিকে তাহমিদ মায়ের কথা শুনে তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে। কুহুও বিষয়টা লক্ষ্য করল। ওর ফুলতলা যাওয়ার কথা শুনেই তাহমিদ ওর মা’য়ের দিকে তাকিয়েছে। তাহমিদের এমন কাজে কুহু হেসে উঠে। আরেকবার ওর মনে হয়, আনান ভাইয়া ঠিকই বলে। সে আসলেই পা’গ’ল ডক্টর।
অনেক আলোচনার পর আনান সিক্তার বিয়ে ঠিক হয়, আজ থেকে ঠিক পনের দিন পর।

একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে হবে সেই আনন্দে আরোশি লাফালাফি শুরু করেছে। ভাইয়ের বউ আবার সিক্তা আপু হবে, কথাটা ভাবতেই ওর মন আকুলিবিকুলি করছে, কেমন করে পনের দিন যাবে আর সিক্তা আপু এই বাসায় আসবে। ও সাথে সাথে ফোন করে ওর বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত করল। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কয়েকজন স্যার-ম্যামকেও দাওয়াত করবে। এছাড়া সামনের মোড়ের ঝালমুড়ি কাকু, ফুচকাওয়ালা, আইসক্রিম কাকু সবাইকে দাওয়াত করবে।
কুহু সিক্তাকে ফোন দিল বিয়ের কথা জানানোর জন্য। কিন্তু সিক্তা ফোন রিসিভ করলনা। ও ফোন সাইলেন্স রেখে নাক ডেকে ঘুম দিচ্ছে।

দুই পরিবারে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের লিস্ট করে, একে একে সবাইকে দাওয়াত করা হচ্ছে। বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পরই তাহমিদ ইনভিটেশন কার্ড ছাপাতে দিয়েছিল। দুইদিনের মধ্যেই ও কার্ড পেয়ে গেছে। আয়েশা সালেহা তাহমিনা আক্তারকে লিস্ট করতে দিয়েছেন। তিনি বলে দিচ্ছেন কাকে কাকে দাওয়াত করতে হবে।

সিক্তার যেন দিনরাত কাটছেনা। কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসতে আর দেরি নেই। আবার যখন বাবা-মা, ভাইয়া, দিদুন, ছোটমার কথা ভাবছে,নিমেষেই ওর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতদিনের আপনজন ছেড়ে ও কেমন করে থাকবে। যে মা-ছোটমার আঁচল তলে আদরে, আহ্লাদে বড় হয়েছে, সেই মা-ছোটমাকে ছেড়ে থাকবে কেমন করে! আনমনেই মাঝেমাঝে কেঁদে ফেলছে সিক্তা।

দিদুনের আদর, ভাইয়ার শাসন -স্নেহ সব সময় আর পাওয়া হয়ে উঠবেনা। বাবার কাছে আবদার করতে পারবেনা। আর সাতদিন পর ও সম্পূর্ণ অন্যকারো হয়ে যাবে। ওর সব কিছুতেই আনানেন একচ্ছত্র আধিপত্য আধিপত্য কিংবা অধিকার থাকবে। কথাগুলো ভেবেই আরেকবার চোখ মুছল সিক্তা।

এদিকে আনান প্রতিনিয়ত ফোন করে এটাসেটা বলে ওকে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা যে এত নির্লজ্জ তা ওর জানা ছিলনা।
কুহু শিউলিকে ফোন দিলে সে জানায়, বিয়ের দুইদিন তারা আসবে। সানাউল রাশেদিন নিজে গিয়ে ওদেরকে দাওয়াত করে এসেছে। আবার আনানের বাবাও গিয়েছিল ফুলতলা।

আর কায়েস পরেছে বিপদে। তার ছেলে-মেয়ে দুই দল হয়েছে। শিহাব থাকতে চায় আনানের সাথে। দৃষ্টি থাকতে চায় সিক্তার সাথে। আর তার দুই বোন বলে দিয়েছে, সমানভাবে দুই পরিবারেই সময় দিতে হবে।
নাজমা পারভিন কায়েকসে ফোন দিয়ে জানান, তার ছেলে-মেয়েও দুই দল হয়েছে। নিহান থাকবে আনানের সাথে। আর তনয়া থাকবে সিক্তার সাথে।

তারা দুই ভাইবোন ফোনেই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ের আগের দিন তারা শাহনাজ সুলতানার বাসায় যাবেন। সেখান থেকে দৃষ্টি আর তনয়াকে বড় বোনের বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। সেখান থেকেই হলুদ, মেহেন্দি সব অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। এরপর তারা বরযাত্রী হয়ে বড় বোনের বাসায় যাবেন।

” বউ, কি করছ? আজকাল আমাকে দিব্যি ভুলে বসে আছ। অথচ আমার তাবৎ দুনিয়া শুধু তোমাকেই খুঁজে বেড়ায়। ” তাহমিদ হুট করে রান্নাঘরে এসে কুহুকে জড়িয়ে ধরল।
তাহমিদের এহেন কান্ডে কুহু চমকে উঠল। ও চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কি না।
” এই এসব কি করছেন! কেউ দেখলে কি হবে বলেনতো? আপনি দেখি লজ্জাশরম সব বিকিয়ে দিয়েছেন! ছাড়ুন কেউ আসবে। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে ছাড়া পেতে ছটফট করছে।

” না ছাড়বনা। আগে কয়েকটা চুমু দিব তারপর ছাড়াছাড়ি। আমার বিপুলতর নীলিমার ভালোবাসা তোমাকে আজ বুঝিয়েই ছাড়ব। ”
” আপনার বিপুলতর নীলিমা কিংবা গভীরতম ফেনিল জলরাশিময় সাগরের ভালোবাসা আমি সেই কবেই বুঝেছি। আর নতুন করে কি বোঝাবেন বলুন! এবারতো ছাড়ুন। মা এসে যাবে। ” কুহু অসহায়ভাবে বলতে থাকে।
” আগে রুমে আসবে বল? তবেই ছাড়া পাবে। তার আগে নয়। বল আসবে? ” তাহমিদও বেঁকে বসেছে।
” ঠিক আছে আসছি। হাতের এই কাজটুকু সেড়েই আসছি। ”

” না কোন কাজ নয়। তুমি এখনই আমার সাথেই আসবে। নইলে সবার সামনে তোমাকে কোলে নিয়ে রুমে যাব। আর এসব কাজ করার জন্য মেইডরা আছে। তুমি কি আসবে নাকি কোলে নিব? ”
তাহমিদের কথা শুনে ভয় পায় কুহু। এই মানুষটাকে বিশ্বাস নেই। সবার সামনে কুহুকে কোলে নিতে সে একটুও দ্বিধা করবেনা। কুহু তারাতারি করে হাত ধুয়ে, তাহমিদের পিছুপিছু রুমে দিকে যায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৩

বিঃদ্রঃ আজকে একটু ছোট পার্টই পড়েন। আমার পরিবারে একের পর এক দূর্ঘটনা ঘটছে। মন খারাপ থাকছে বেশিরভাগ সময়। লেখায় মন দিতে পারছিনা। আমি দুঃখিত অনেকেই গল্পের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। কিন্তু আমি পরিস্থিতির কাছে অসহায়। আমাকে মাফ করে দিবেন।
আরেকটা কথা, সিক্তা আনানের বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিলাম। মন দিয়ে ওদের বিয়ে উপভোগ করুন। আর ওদের দোয়া করুন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৫