বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৫

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৫
জাওয়াদ জামী

লাল-নীল আলোয় সেজেছে ‘ কুঞ্জছায়া ‘ র প্রতিটা কোন। কায়েস পরিবার নিয়ে ঢাকায় এসেছে। তবে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী শাহনাজ সুলতানার বাসায় উঠতে পারেনি। বড় বোনের অনুরোধে ‘ কুঞ্জছায়া ‘য় এসে উঠেছে। বিয়েতে কনে পক্ষের বাড়িতে অনেক কাজ থাকে, তাই তাকে আগে এখানেই আসতে হয়েছে।

তবে বিয়ের দিন বরযাত্রার আগে আবার তারা আনানদের বাড়িতে যাবে। একমাত্র মামা হওয়ায় তাকে একদিনে দুই পক্ষেই থাকতে হবে। নাজমা পারভিনও প্রথমে এসে বড় বোনের বাসায় উঠেছেন। পরদিন তিনি নিহান আর তার স্বামীকে সাথে নিয়ে আনানদের বাসায় চলে যান। তনয়া থেকে যায় ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কি হয়েছে! এভাবে সবার সামনে থেকে আমাকে টেনে নিয়ে আসলেন কেন? আপনার জন্য আমাকে বারবার লজ্জায় পরতে হয়। ছোটমা, মেজ ফুপু কেমন মুখ টিপে হাসছিল দেখেছেন? ” কুহু বিরক্ত হচ্ছে তাহমিদের কর্মকান্ডে।
” তুমি এভাবে রা’গ করছ বউ! আমি আমার একটামাত্র বউকে যখন খুশি তখন রুমে নিয়ে আসতে পারি। সেই সার্টিফিকেট আমার আছে। ” নিষ্পাপ মুখ করে বলল তাহমিদ।

” শেষ হয়েছে আপনার অভিনয়? এবার বলুন কেন রুমে নিয়ে আসলেন? তারাতারি করুন। আমার সময় নেই। বাহিরে অনেক কাজ আছে। হলুদের জন্য আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। তাদের আপ্যায়নের দ্বায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আমাকে। ”

” সবার দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের দিকে নজর দিয়েছ একবারও? হলুদে কি পরবে? সবাইকে ড্রেসকোড অনুযায়ী ড্রেস দেয়া হয়েছে। কিন্তু তোমার ড্রেস কোথায়? ”
” আমাকেও ড্রেসকোড অনুযায়ী ড্রেস দেয়া হয়েছে। সময়মত পরে নিব। ”

” না তুমি ঐসব ড্রেস পরবেনা। তুমি শাড়ি পরবে। আমার বউকে হলুদের শাড়িতে, হলুদের সাজে কেমন লাগে আমি দেখতে চাই। নিজের বিয়েতে কোন শখই পূরণ করতে পারোনি। তাই বলে কি আমি তোমার শখ অপূর্ণ রাখব! তুমি একঘন্টার মধ্যে কাজ সেড়ে রুমে চলে আসবে। পার্লার থেকে তোমাকে সাজানোর জন্য কয়েকজন আসবে। ”
” বলছেন কি এসব! ননদের বিয়েতে আমি সেজে কাঠের পুতুলের মত বসে থাকব! মানুষ বলবে কি? আর তাছাড়া আমি জীবনেও পার্লারের কারও কাছে সাজিনি। তাছাড়া সবাই এক ড্রেস পরবে, আর আমি আলাদা ড্রেস পরব এটা কেমন দেখায় না? ” অসহায়ভাবে বলল কুহু।

” তোমার কোন অযুহাতই আমি শুনবনা। আমার কথাই শেষ কথা। আলমিরায় তোমার শাড়ি রেখেছি, সেখানেই প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে যাবে। ঠিক একঘন্টা পর আমি তোমাকে রুমে দেখতে চাই। ”
কুহু বুঝল এই নাছোড়বান্দার থেকে আজ ওর মুক্তি নেই। তার ইচ্ছে অনুযায়ীই আজ কুহুকে সাজতে হবে। কেন যে সেদিন এই পা’গ’ল ডক্টরকে বলতে গেছিল, নিজের বিয়েতে গায়ে হলুদের সাজে সাজার খুব ইচ্ছে ছিল।
কুহু গোমড়া মুখে নিচে নামে। আজ ওকে সবার সামনে হাসির পাত্রী হতে হবে। সবাই কনের গায়ে হলুদে এসে, কনের ভাবিকে হলুদের সাজে দেখে হাসবে।

দৃষ্টি, তনয়া ব্যস্ত নিজেদের সাজ নিয়ে। তাহমিদ পার্লার থেকে বেশ কয়েকজনকে ডেকেছে ওদের সাজানোর জন্য। ওরা কিভাবে সাজবে সেই নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।
শিউলি আক্তার ননদের সাথে কোমড় বেঁধে কাজ করছে। সে তার সকল দ্বায়িত্ব পালন করতে তৎপর। সে কায়েসকে বলে সিক্তার জন্য সোনার হার, কানের দুল আর আনানের জন্য সোনার চেইন এনেছে। কায়েস শিউলির এরূপ পরিবর্তন দেখে ভিষণ খুশি হয়েছে।

দৃষ্টিকে দেখে চোখ ফেরাতে পারছেনা শিউলি আক্তার। এই সাজে মেয়েটাকে কি অপূর্বই না লাগছে। বিয়ের পর থেকেই যেখানে ওদের জীবন কেটেছে অভাবের সাথে যুদ্ধ করে। কোনদিন মেয়েটাকে ভালো পোশাক কিনে দিতে পারেনি। কুহু পরিশ্রম করে ভাই-বোনের চাহিদা যতটুকু পারে মিটিয়েছে। এতদিনে ওদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর কোন কিছুরই অভাব নেই ওদের।

ইচ্ছে করলেই হাজার হাজার টাকার শখের জিনিস কিনতে পারে। পোশাকের পেছনে খরচ করতে পারে হাজার হাজার টাকা। অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে দু ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরল শিউলির দুচোখ বেয়ে।
কুহু নিজের রুমে গাঁট হয়ে বসে আছে। রুম থেকে বেরোবে কিভাবে সেই চিন্তাই ও করছে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারছেনা ও। মেয়ে দুটোকে কত করে বলল হালকা করে সাজাতে। কিন্তু তারা কুহুর কথা শুনলে তো। তারা তাহমিদের কথামত কুহুকে সাজিয়েছে।

” আমি এই সাজ নিয়ে নিচে কেমন করে যাব! আল্লাহ তুমি একটা উপায় বের করে দাও। আমি সবার সামনে কেমন করে যাব। ” কুহু চিন্তায় পা’গ’ল হওয়ার দশা।
” মাশা-আল্লাহ, আমার বউকে চেনাই যাচ্ছেনা। যেন আসমানের পরী একটা। ও বউ, তোমাকে দেখে বুকটা কেমন ধুকপুক করে উঠল। সেই প্রথমবার তোমাকে দেখে বুকের ভেতর যেমন দামামা বেজেছিল, আজকেও ঠিক তেমনটাই হচ্ছে।

এ কি নেশায় আমাকে জড়ালে তুমি! তোমাকে ছাড়া চারপাশে আঁধার দেখি সর্বদাই। হৃদয়ের অন্তঃপুরের চিলেকোঠায় তোমার বিরাজ। শুধু চিলেকোঠায় বলছি কেন! আমার সর্বত্রই তুমি প্রতিটা ক্ষনে বিরাজ কর। ভালোবাসি বউ। অনেক ভালোবাসি তোমায়। এই ধরায় এমন কিছু আজ অব্দি সৃষ্টি হয়নি যেটা আমার ভালোবাসার সাথে পাল্লা দিতে পারবে। একি ভ’য়ং’ক’র মায়ায় জড়িয়ে গেছি আমি! ”

তাহমিদের ঘোরলাগা গলা শুনে কুহুর বুক ধুকপুক করছে। এই মানুষটার ঘোরলাগা গলা শুনলে কুহু নিজেকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ওর বুকটা শুকিয়ে আসছে। ঠিক সেইদিনের মত যেদিন ও বুঝতে পেরেছিল, ও তাহমিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। সেদিনও এমনই পিপাসা পেয়েছিল। পর পর কয়েক গ্লাস পানি পান করেও সেই পিপাসা মেটেনি। আজও কুহুর তেমন পিপাসাই পেয়েছে।

কি করবে ও? কিছু ভেবে পায়না মেয়েটা। যখন পিপাসাকে আর দমিয়ে রাখতে পারলনা, ঠিক তখনই তাহমিদের বুকে নিজের মাথা রাখল। সর্ব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল তার একান্ত পুরুষটিকে। যে পুরুষের ছোঁয়ায় ও ধন্য হয়েছে। যে ওকে করেছে গরবিনী। যে পুরুষের হৃদয়ে রাজত্ব করছে ও। নিজের রমনীকে বুকের মাঝে পেয়ে সেই পুরুষটিও তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল।

পারলে যেন তার সাধের নারীটিকে বুকের পাঁজর ভেঙে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। সারাজীবনের মত আটকে রাখে সেখানে। তারপর দুনিয়াকে বলতে চায়, যেটা আমার, সেটা একান্তই আমার। এই নারী একান্তই আমার।
কুহুকে এমন রূপে দেখে আফরোজা নাজনীন হা হয়ে গেছেন। তাহমিনা আক্তারতো এসে কুহুকে জড়িয়েই ধরলেন। তিনি তার ছেলের বউকে আর কোন কাজ করতে দিলেননা।

ড্রয়িংরুমে কুহুকে বসিয়ে দিলেন জোড় করে। যত মেহমান আসছিল সবাইকে কুহুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসে শ্বাশুড়ির এমন পা’গ’লা’মি উপভোগ করছিল।
সন্ধ্যার আগেই মেয়েরা হলুদের ডালা, নানানরকম ফল,মিস্টিসহ হলুদের প্রয়োজনীয় সকল কিছু নিয়ে রওনা দেয় বরের বাড়িতে।

ওদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে নীরা আর তাহমিদ। যদিওবা তাহমিদ মেয়েদের এসব কর্মকান্ডে যেতে চায়নি। কিন্তু আফরোজা নাজনীন জোড় করে ওকে পাঠিয়েছেন। কারন তিনি জানেন, তাহমিদ ছাড়া এই মেয়েদের দলকে কেউ সামলাতে পারবেনা।
গাড়িতে তাহমিদ কুহুর পাশেই বসল। ক্ষণে ক্ষণে এটাসেটা বলে কুহুকে লজ্জা দিচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে দৃষ্টি, তনয়ার সাথে কথা বলছে।

আনানদের বাগানে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে সকল আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশিরা জমায়েত হয়েছে। বাগানের একপাশে স্টেজে আনান বসে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। শাহনাজ সুলতানা ভিষণ ব্যস্ত। তার দেখা পাওয়াই দায়।
একে একে দশটা গাড়ি গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে, মেয়েরা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রথমেই নীরা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর একে একে সবাই বেরিয়ে আসল। মেয়েরা তাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিল।

নীরা সোজা দৃষ্টি, তনয়া আর কুহুকে নিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটতে থাকে। ওদের প্রত্যেকের হাতে ডালা।
কনের বাড়ি থেকে তত্ত্ব আসতেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ছেলেকে হলুদ মাখালেন শাহনাজ সুলতানা ও তার স্বামী। এরপর একে একে সবাই আনানকে হলুদ মাখাতে থাকল।

আনান উসখুস করছে। ও তাহমিদের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছে। অনেকক্ষণ পর সেই সুযোগ আসল।
কুহু আনানের পাশে বসেছে সিক্তাকে ভিডিও কল দিবে জন্য। ও সিক্তার সাা আনানকে দেখাতে চায়। তখন সেখানে তাহমিদও আসে। ও কুহুকে এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করছেনা।
” তা অর্ধেক বর কেমন লাগছে বল? বিয়ের ফিলিংটা কেমন মনে হচ্ছে? ইনজয় করছিস? ” তাহমিদ আনানের আরেক পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।

” ভাই, এই ফিলিংস বোঝানোর মত নয়। কিন্তু তোমরা একটা কাজ মোটেও ঠিক করনি। ”
আনানের কথা শুনে তাহমিদ কুহু একে অপরের দিকে তাকায়।
” কি ঠিক করিনি বলতো? ”
” তোমরা সবাই এসেছ কিন্তু সিক্তকে আননি। এটা কেমন কথা! ওর খালাতো ভাইয়ের বিয়ে অথচ ওকে না এনে তোমরাই ড্যাং ড্যাং করে চলে আসলে! ওর ও তো ইচ্ছে হয় খালাতো ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে আসতে। ইশ, বেচারি বাসায় একা একা বসে কতইনা বোর হচ্ছে! ”

আনানের এমনধারা কথা শুনে কুহু হো হো করে হেসে উঠল। আর তাহমিদ চোখমুখ কুঁচকে আনানের দিকে তাকায়।
” এক কাজ করি। কালকে তুই তোর খালাতো বোনকে বিয়ে করতে যাসনা বুঝলি? বরং তোর খালাতো বোনই কনে যাত্রী নিয়ে তোকে বিয়ে করতে আসুক। আজকে ও একা বসে বোর হচ্ছে।

কালকে তুই কনে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে বসে বোর হবি। বিষয়টা ভালো না? আর আজ একটু পর আমাদের সাথে গিয়ে তোর খালাতো বোনকে হলুদ মাখিয়ে আসিস। নইলে বিয়েটা ঠিক জমবেনা। ” তাহমিদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
তাহমিদের কথা শুনে কুহু আরেক দফা হেসে উঠল।

” এই কোকিলা, তুই এভাবে হাসছিস কেন? তোর এই পা’গ’ল ডক্টর আমার দুঃখ বুঝবে কি! যার কাজ মানুষের হার্ট নিয়ে, সে যদি হার্টের দুঃখ না বুঝে তাকে কি মানুষ বলা যায়! সে পা’গ’ল। সার্টিফিকেটধারী পা’গ’ল৷ আমিতে শুধু আমার খালাতো বোনকে নিয়ে আসার কথা বলেছি। এতেই সে কিভাবে রিয়্যাক্ট করল! তুই এখন থেকে এই পা’গ’ল’কে সামলা বুঝলি। নইলে দেখবি এই পা’গ’ল কোনদিন তোকে কামড়ে দিয়েছে। আমিতো সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকি। ”

” কাল তোর বিয়ে, তাই তুই বেঁচে গেলি। নইলে সবার সামনে তোকে কিভাবে সাইজ করতে হয়, তা আমার ভালোই জানা আছে। তোর মত দশটা আনানকে ঠেঙ্গিয়ে হসপিটালে ভর্তি করা কোন বিষয়ই নয়। সাতদিন পাড় হোক, তোকে সাইজ আমি করব। ” আনানের চাচিকে আসতে দেখে থেমে যায় তাহমিদ। আনানও হাঁফ ছাড়ল।

” তুই এভাবে সেজেছিস কেন? সবাই কেমন তোর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখেছিস? তুই সাজবি আমার জন্য। শুধু আমি তোকে দেখব। কিন্তু তুই এইভাবে সাজুগুজু করে বিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষজনের সামনে ঘুরছিস! তোর বুদ্ধি কবে হবে বলতো?

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৪

সারাজীবন কি এমনিভাবেই আমাকে পো’ড়া’বি? আমার কষ্ট হয় বুঝিসনা? সবাই তোকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে, সেটা দেখতে আমার ভালো লাগছে? ” আনানদের বাসার ছাদে দৃষ্টির হাত মুচড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিহান। দৃষ্টি নিহানের এমন কাজে ভয় পেয়ে যায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সাথে সাথে নিহান দৃষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৬