বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৬

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৬
জাওয়াদ জামী

তাহমিদরা আনানদের বাসা থেকে আসার কিছুক্ষন পরই ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য় শুরু হয় হলুদের অনুষ্ঠান।
সিক্তাকে স্টেইজে বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর নীরার জোড়াজুড়িতে কুহুকেও বসতে হল সিক্তার পাশে। কুহু মুখ গোমড়া করে বসে থাকল।

প্রথমেই আয়েশা সালেহা আসলেন নাতনিকে হলুদ মাখাতে। তিনি সিক্তাকে হলুদ মাখিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন।
এরপর হঠাৎই দিদুন কুহুকে হলুদ মাখিয়ে দিলেন। কুহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় দিদুনের দিকে।
” কুহু সোনা, তোমাকেও আজ দেখতে হলুদের কন্যা লাগছে। তাই তোমাকেও হলুদ মাখালাম। তোমার বিয়েতে তো কোন অনুষ্ঠানই হয়নি। তাই ধরে নাও এই সুযোগে তোমারও হলুদ সন্ধ্যা হচ্ছে। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” দিদুন, সবাই কি ভাববে বলতো! তুমিও দেখছি, তোমার নাতির মতই পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছ। আজ সিক্তার গায়ে হলুদ, আমার নয়। ”
” তোর গায়ে হলুদ নয়তো কি হয়েছে? মা’র শখ হয়েছে তোকে হলুদ লাগাবেন । তাই লাগিয়েছেন। এতে আপত্তি করছিস কেন বলতো , সোনা মা? আয় আমিও তোকে হলুদ লাগিয়ে দেই। ”

এরপর তাহমিনা আক্তারসহ, রাশেদিন পরিবারের সবাই এবং আগত অতিথিরা সবাই সিক্তার পাশাপাশি কুহুকেও হলুদ লাগিয়ে দেয়।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত একটা পেরিয়ে যায়।
নিচে সবকিছু গুছিয়ে কুহুর রুমে আসতে আসতে প্রায় দুইটা বেজে যায়।
কুহু রুমে এসে ওয়াশরুমে ঢুকতেই তাহমিদ ওর হাত টেনে ধরল।

” তোমাকে সবাই হলুদ লাগালেও আমি কিন্তু এখনো লাগাইনি। চুপচাপ দাঁড়াও, আমি তোমাকে হলুদ মাখাই। ”
কথাটা বলেই তাহমিদ বাম হাতে থাকা বাটি সামনে এনে, সেখান থেকে কিছু হলুদ নিয়ে কুহুর গালে, গলায় মেখে দিল। এরপর কুহুর হলুদ মাখানো গালে আর গলায় নিজের গাল ঘষা দিয়ে, নিজে নিজেই হলুদ মেখে নিল।

কুহু ঠোঁট কা’ম’ড়ে তাহমিদের ছোঁয়া অনুভব করছে। এর কুহু ধীরেসুস্থে তাহমিদের বুকের সন্নিকটে এসে, তাহমিদের পাঞ্জাবির কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়ে, ওর গাল ছোঁয়ায় তাহমিদের বুকে। ধীরে ধীরে ওর পুরো মুখমন্ডল ঘষল তাহমিদের বুকে। ততক্ষণে ওর মুখের হলুদে হলুদ হয়েছে তাহমিদের বুক।

কুহুর এমন ছোঁয়ায় শিরশিরিয়ে উঠল তাহমিদের শরীরসহ পুরো সত্তা। নিজেকে ধরে রাখা ওর জন্য কঠিন হয়ে পরল।
” এভাবে আমাকে প্ররোচিত করছ কেন, বউ? যেখানে তোমার সামান্য ছোঁয়া আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়, আমার হৃদয়ের দুকূল ছাপিয়ে ভালোবাসারা হানা দেয় প্রতিটি শিরা-উপশিরায়, সেখানে তোমার এই গভীর ছোঁয়া পেয়ে নিজেকে সামলাই কেমন করে! আমাকে আর পা’গ’ল করোনা। আর যদি আদর পেতে চাও, তবে সেটা অন্য কথা। কি লাগবে নাকি? ”

তাহমিদের কথা শুনে একবারে দুই ধাপ পিছু হটে কুহু।
” অনেক রাত হয়েছে। যান ফ্রেস হয়ে এসে ঘুমিয়ে পরুন। ঘুমানোর সময় পাবেন তিন কি চার ঘন্টা। বড় ভাই হিসেবে নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। তাই আপাতত আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকুন। ”
কুহু ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল খুলতে শুরু করেছে। বেচারি গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার। গোসল না করলে হবেনা।

তাহমিদ কুহুর মনোভাব বুঝতে পেরে মুখ বেজার করে ওয়াশরুমে ঢুকল।
ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে যাওয়ার সাথে সাথে কুহুর ঘুম ভেঙে যায়। তাহমিদ ওকে জাপ্টে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

কুহু অনেক কষ্টে তাহমিদকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। এরপর সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে।
নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করল কুহু৷
কারো গুনগুন শব্দ শুনে তাহমিদের ঘুম ভেঙে যায়। ডান কাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছিল ও। চোখ মেলতেই মেঝেতে বসা কুহুর দিকে চোখ যায়। মেয়েটার লম্বা ঘোমটা ভেদ করে ওর মুখ দেখতে পায়না।

দীর্ঘ একটা হাই ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল তাহমিদ। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল নামাজের ওয়াক্ত এখনো আছে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকল। অযু করে রুমে এসে কুহুর জায়নামাজের পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়াল।

কায়েস দুপুরের আগেই এদিককার কাজ সামলে শিউলিকে নিয়ে রওনা দেয় শাহনাজ সুলতানার বাসায়। নাজমা পারভিনও ভাইয়ের সাথে সেখানে রওনা দিলেন। তবে তনয়া এখানেই থেকে যায়।
দুপুরের মধ্যেই বাসায় তাহমিদের বন্ধুবান্ধব, কলিগরা এসে যায়। সব মিলিয়ে তারা প্রায় একশোজনের মত এসেছে। তারা সবাই একসাথে সিক্তার কাছে এসে ওকে শুভেচ্ছা জানায়। এরপর খোঁজ করল কুহুর। কিন্তু কুহু ব্যস্ত থাকায় তাদের সাথে দেখা করতে পারেনা।

কুহু গোসল সেড়ে রুমে এসে দেখল গতকালের পার্লারের সেই দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে রুমে দেখে কুহু ফাঁকা ঢোক গিলল। আজকেও আবার ওকে সাজতে হবে নাকি!
ওর আশংকা সত্যি করে মেয়েরা বলল, আজও ওরা কুহুকে সাজাবে।
এমন সময় তাহমিদ রুমে এসে একটা শাড়ির প্যাকেট কুহুর হাতে ধরিয়ে দিল।

ডিপ পার্পল কালারের বেনারসীতে কুহুকে মোহনীয় লাগছে। লম্বা চুলে ঝুমকো খোঁপায় দুলছে অনেকগুলে ঝুমকো। খোঁপার ঝুমকোর সাথে মিলিয়ে কানেও শোভা পাচ্ছে বড় ঝুমকো। গলায় সাতনরি হার, হাতে কয়েক গাছা চুরি। হালকা মেকআপে কুহুকে কোন রাজমহলের রানীর থেকে কম লাগছেনা।

কুহুকে সাজিয়ে মেয়ে দুটো দৃষ্টি, তনয়াকে সাজাতে গেল। কিন্তু দৃষ্টি আজ খুব একটা সাজলনা। গতকাল নিহানের ধমক খেয়ে ওর সাজুগুজুর চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে আফরোজা নাজনীনের কথামত শাড়ি পরল। সেই সাথে নিল হালকা মেকআপ আর হালকা কিছু গহনা পরেই ওর সাজ কমপ্লিট করল। কিন্তু তনয়া ইচ্ছেমত সাজল।

কালচে খয়েরী রঙের বেনারসীতে সিক্তাকে পুতুলের মত লাগছে। ওর সারা শরীর ভর্তি গহনা। সানাউল রাশেদিন মেয়েকে কোন কিছু দিতে কার্পন্য করেননি। আফরোজা নাজনীনের নির্দেশে সিক্তাকে সাজানো হয়েছে ভারী ব্রাইডাল সাজে।
কাজের ফাঁকে আফরোজা নাজনীন মেয়ের কাছে আসলেন। মেয়েকে বউ সাজে দেখে তার দু-চোখ জুড়িয়ে গেল। তাই এই মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই যাকে বলে আ’গু’ন সুন্দরী।

তার বাকি তিন মেয়ের দুই মেয়েই তার মত দেখতে হয়েছে। আর দুই মেয়৷ হয়েছে তাদের বাবার মত। কিন্তু সিক্তা যেন একটু বেশিই সুন্দরী। সৌন্দয্যের দিক দিয়ে সে এই পরিবারের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। তাই আজ বউয়ের সাজে ওকে অতুলনীয় লাগছে।

মেয়েটা চিরতরে তার কাছ থেকে চলে যাবে ভাবতেই বুকটা হু হু করে উঠল। চোখ বেয়ে ঝরে পরল কয়েক ফোঁটা অশ্রু। মায়ের চোখে পানি দেখে সিক্তাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আজ থেকে ও এই বাড়ির অতিথি, এই কথা ভাবতেই কান্নারা দলা পাকিয়েছে বুকের গহীনে।

” সিক্ত, তুই আমার বড় আদরের মেয়ে। কিন্তু যতই আদর করিনা কেন, একদিন সব মেয়েদেরই এই বাঁধনের মায়া কা’টা’তে হয়। আজকে তোর পালা। এর আগে যেমন আমার বড় তিন মেয়ে সব মায়া কা’টি’য়ে, নিজেদের ঘরের রানী হয়ে আছে। আজকের পর থেকে তুইও অন্য ঘরের রানী হয়ে থাকবি। যে ঘর হবে তোর নিজের। যেখানে তোর অধিকার সীমাহীন। কিন্তু তাই বলে কখনোও অধিকারের অপব্যবহার করিসনা।

ঐ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখিস। তুই ওদের যতটুকু দিবি, ঠিক ততটুকুই তুই ফিরে পাবি। আমি জানি ঐ বাড়ি তোর পরিচিত, বাড়ির মানুষগুলো পরিচিত। কিন্তু তবুও তুই ঐ বাড়ির বউ হবি। তারা তোর পরিচিত বলে, তাদের প্রতি তোর দ্বায়িত্ব কিন্তু এতটুও কম হবার নয়। ভালোবেসে সবাইকে আগলে রাখবি। দেখবি সুখ এসে তোর চারপাশে ঘুরঘুর করবে।

আমি আমার বড় তিন মেয়েকেও এই শিক্ষায় দিয়েছিলাম, তারা যেন সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখে। ওরা আমার কথা মেনেছিল। আজ ওরা প্রত্যেকেই সুখি। তাদের জন্য আমাকে কোন চিন্তা করতে হয়না। তোর বেলায়ও যেন আমার তাই হয়, মা। আমার সম্মান, তোর বাবার সম্মান, এই পরিবারের সম্মান তোর হাতে। ”

” আমি তোমার সব কথা মেনে চলব, মা। কখনোই তোমাদের অসম্মান হতে দেবনা। কাউকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দেবনা। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো। ”

তাহমিনা আক্তার সিক্তার রুমে এসে দেখলেন তারা দুই মা-মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ওদেরকে কাঁদতে দেখে তাহমিনা আক্তারেরও চোখে পানি আসল। এই মেয়েটা তার চোখের সামনে বেড়ে উঠেছে। কতশত বায়না নিয়ে হাজির হয়েছে তার কাছে। তার নিজের মেয়ে না হওয়ার আফসোস পূরণ করেছিল সিক্তাকে দিয়ে। আজ সেই মেয়ের বিয়ে। আজকের পর থেকে আর এসে বায়না করবেনা। সেদিনের সেই ছোট্ট সিক্তা কবে যে এত বড় হয়ে গেছে, তা তিনি বুঝতেই পারেননি।

” আমাকে না নিয়ে দুই মা-মেয়ে কি করছে হুম? এখন মা আপন আর আমি পর হয়ে গেলাম বুঝি? ” চোখের পানি মুছে তাহমিনা আক্তার বৃথা হাসার চেষ্টা করলেন।
” ছোটমা, দুনিয়া উল্টে গেলেও যে তুমি পর হতেই পারনা, এটা কিন্তু তুমি বেশ ভালো করেই জানো। ”

সিক্তার কথা শুনে তাহমিনা আক্তার সিক্তার পাশে গিয়ে বসতেই, সিক্তা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
” আমি তোমাদের ছাড়া কেমন করে থাকব, ছোটমা? কার কাছ থেকে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এটা সেটা চাইব? কাকে সময়ে-অসময়ে বিরক্ত করব। এই বাড়ি ছেড়ে, তোমাদের ছেড়ে থাকতে আমার ভিষণ কষ্ট হবে, ছোটমা। ”

” এভাবে কাঁদিসনা, মা। দেখবি ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েদের জীবনটাই এমন। জন্ম নিবে, বেড়ে উঠবে, মায়া বাড়াবে যেখানে, কিন্তু সেখানে তার আসল ঠিকানা হয়না। তার আসল ঠিকানা অন্য কোথাও আগে থেকেই নির্ধারন হয়ে থাকে। মায়ের কোলে জন্ম নিয়ে, অন্য কোথাও ভালোবাসা ছড়াতে হয় মেয়েদের। এজন্যই তো মেয়েরা অনন্য, মায়াময়ী। তুইও সেই মায়াময়ীদের দলে।

তবে এটা মোটেও ভাববিনা, তোর কেউ নেই। তোর বাবা-মা আছে, ছোটমা আছে, দুইটা বড় ভাই আছে। তোর প্রতি সকল দ্বায়িত্ব তারা পালন করবে। সব সময়ই মনে রাখবি তোর দুইটা বাড়ি। ” তাহমিনা আক্তার অনেক কষ্টে নিজের কান্না সংবরণ করে বললেন । কিন্তু পরক্ষণেই আবার হুহু করে কেঁদে উঠলেন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৫

আফরোজা নাজনীন কেঁদেই চলেছেন। নীরা এসে রুমের পরিস্থিতি দেখে হায়হায় করে উঠল। অনেক কষ্টে সবার কান্না থামিয়ে ওর শ্বাশুড়ি আর বড়মাকে নিচে পাঠিয়ে দেয়।
এরপর নীরা সিক্তাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে, কিছু কথা বলল। যেটা সিক্তা না চাইলেও ওকে মনযোগ দিয়েই শুনতে হলো।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৭