বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৬

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৬
জাওয়াদ জামী

একটা গোডাউনে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নেতিয়ে বসে আছে জমির মেম্বার আর সবুজ। ওদের সামনের চেয়ারে বসে বসে পা দোলাচ্ছে তাহমিদ। ওর দুইপাশে হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনান আর নিহান। কিছুক্ষণ আগে ওরা দুজন মিলে মেম্বার আর সবুজকে হালকাপাতলা থেরাপি দিয়েছে। ওরা আরও কয়েকটা দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাহমিদ নিষেধ করায় থেমে গেছে।

তাহমিদের মনে অন্য কিছু চলছে। ও এদেরকে কঠিন শাস্তি দেবে কিন্তু সেটা অন্যভাবে।
” তো মেম্বার এবার মুখ খোল। ফটাফট সবকিছু বলে দে। কিভাবে তুই এই জা’নো’য়া’রে’র সাথে হাত মিলিয়েছিস? অবশ্য তুই নিজেও একটা জা’নো’য়া’র। এর আগেই তোকে আমি কথায় কথায় সাবধান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই আমার কথা মনে রাখিসনি। এবার মুখ খোল। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহমিদের গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে কি ছিল তা মেম্বার জানেনা। কিন্তু তার কলিজা ভয়ে কাঁপছে।
” আমি তারে আগে চিনতামনা। একদিন সে-ই ফুলতলা আসছিল। তখনই তার সাথে আমার পরিচয় হয়। ” মেম্বার গড়গড় করে সব বলে দেয়।

তাহমিদ এবার তাকায় সবুজের দিকে। ওর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
” কি রে মুখ খুলবি? নাকি এরা আরেকদফা আপ্যায়ন করবে? তুই কাদের কলিজায় হাত দিয়েছিস, সে সম্পর্কে তোর কোন ধারনাই নেই। মুখ খোল, শুনি তোর কথা। ”

” আমি তিন-চার বছর আগে থাইকাই কুহুরে পছন্দ করতাম। তারে অনেকবারই কইছি, কিন্তু সে আমারে প্রতিবারই হতাশ করছে। বাধ্য হইয়া তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। কিন্তু তবুও তারা রাজি হয়নাই। রা’গে সিদ্ধান্ত নিলাম কুহুরে তুইলা নিয়া বিয়া করব। কিন্তু তার আগেই একদিন খবর পাইলাম তারা পরিবার নিয়া, নিজেদের বাড়িতে গেছে গা। আমার এত বছরের আশায় পানি ঢাইলা দিল তারা। তাদের প্রতিবেশিদের কাছেও খোঁজখবর কইরা কোন ঠিকানা পাই নাই। কিন্তু একদিন যখন কুহুর বাবায় মির্জাপুরের বাড়ি বিক্রি করবার লাইগা সেখানে যায়, সেখানকার অনেককেই নিজের গ্রামের ঠিকানা দেয়। ”

এ পর্যন্ত বলেই হাঁপিয়ে ওঠে সবুজ। গত তিনদিন ধরে তারা সারাদিন না খেয়ে থাকে। রাতে শুধু একটা দশ টাকা দামের পাউরুটি খেতে পায়। আবার আজকে আনান আর নিহান মিলে খারাপ মা’ই’র দেয়নি। না খেয়ে এমনিতেই শরীর কাহিল, তার ওপর হকিস্টিকের মা’ই’র, এতেই সবুজের অবস্থা খারাপ।
” শা’লা থামলি কেন? বলতে থাক। তোর কথা শোনার পরই সিদ্ধান্ত নিব তোদের সাথে কি করব। বল তোর কাহিনী। ” নিহান হকিস্টিক দিয়ে মেঝেতে বারি হাঁকাল।

নিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে সবুজ ভয় পেয়ে গেছে। ছেলেটার চোখ রা’গে জ্ব’ল’ছে। হালকা কেঁপে উঠল সবুজ। আবারও কথা বলার প্রস্তুতি নিল।
” এরপর আমি কুহুর গ্রামের ঠিকানা, জাইনা নিলাম পরিচিত একজনের কাছ থাইকা। সেই গ্রামে যাইয়া কায়েসের বাড়ির ঠিকানা নিয়া, দূর থাইকা সেই বাড়ি দেইখা আসি। মানুষজনের সাথে কথা কইয়া জানতে পারলাম, কুহুর বিয়া হইছে। সে এখন ঢাকায় আছে। তখন আমার সাথে মেম্বারের পরিচয় হয়।

এরপর আমি ঢাকায় আসি। তন্নতন্ন কইরা খুঁজি কুহুর শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু পাইনা। তারপর মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করি। তারে কই কুহু গ্রামে আসলেই যেন আমার খবর দেয়। কুহু গ্রামে গেলেই মেম্বার আমারে খবর দেয়। তারপরের দিনই আমি ফুলতলা যাইয়া, মেম্বারের বাড়িতে লুকায় থাকি। এরপর সুযোগ খুঁজি কুহুরে কাছে পাওয়ার। সেই সুযোগও আসে। আর আমরাও…….

সবুজ নিজের কথা শেষ করতে পারেনা। তাহমিদের দশাসই হাতের থা’প্প’ড় খেয়ে চেয়ারসহ উল্টে পরে যায়। তাহমিদ রা’গে থরথর করে কাঁপছে।
নিহানও রা’গে ফোঁপাচ্ছে।

” তোর একবারও মনে হয়নি, কুহুর হাজবেন্ড তোর সাথে কি করতে পারে? আর মেম্বার তুই? তুই কি জানতিসনা কায়েসের বোনদের কোন পরিবারে বিয়ে হয়েছে? তাদের ক্ষমতা কতটুকু? তারা চাইলেই, তোর মত মেম্বারকে নিমেষেই মাটিতে পুঁতে ফেলতে পারে। ” তাহমিদ মেম্বারের বুকে লা’থি হাঁকাল। মেম্বারও চেয়ারসহ উল্টে পরে যায়।
নিহান একটা সুযোগ খুঁজছে এই দুইজনকে শেষ করার। এবারও সে তেড়ে যায় মেম্বারের দিকে। এলোপাথাড়ি মা’র’তে শুরু করল মেম্বারকে। সবুজকেও ছেড়ে দিলনা। আনান এসে নিহানকে আটকায়।

তাহমিদ বড় বড় শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে।
” শোন, রাত বারোটার দিকে বস্তির ঘরে তোরা যাবি। সকালে আবার বেরিয়ে আসবি। ভুলেও কারও সাথে কোন কথা বলবিনা। মনে রাখিস, আমার লোকজন তোদের চারপাশে ছায়ার মত পাহারা দিচ্ছে। ইচ্ছে করলেই আমি এখনই এখানেই তোদের মে’রে পুঁতে রাখতে পারি। আমার কিছুই হবেনা। কিন্তু শুধু বাপ-চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে, আমি এই চরম সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। আমি চাইনা, আমার বাবা কিংবা চাচার দিকে কেউ আঙুল তুলে বলুক, এদের ছেলে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। তোদের আমি মা’র’ব ঠিকই, তবে সেটা অন্যভাবে। তবে তার আগে ঐ দুই মেয়েকে তোরা যে কষ্টটা দিয়েছিস, তার দ্বিগুন কষ্ট তোদের দেব। এবং ধরে নে সেটা শুরু হয়ে গেছে। ”

তাহমিদের কথা শুনে মেম্বার আর সবুজ ভয়ে ঢোক গিলছে। নিহানের মা’রে’র চোটে ওরা নেতিয়ে পরে আছে।
তাহমিদ রোগী দেখতে শুরু করেছে। সবাই মিলে ওকে বুঝিয়েছে, কতদিন ও এভাবে আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। যেহেতু কুহু তাহমিদের মেডিকেলেই আছে, সেহেতু রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে এসে কুহুকে দেখে যাবে। আর সার্বক্ষণিক কুহুর পাশে কেউনা কেউ থাকবেই। সবার পরামর্শ শুনে তাহমিদ আর না করেনা। সে নিয়মিত চেম্বারে বসছে। রোগী দেখছে, অপারেশন করছে। তবে তার মন পরে থাকে কুহুর কাছে।

আজ চব্বিশ দিন ধরে কুহু কোমায় আছে। নাজমা পারভিন দশদিন আগেই চিটাগং ফিরে গেছেন। তবে নিহান ঢাকায় থেকে গেছে। তাওহীদ প্রতি সপ্তাহে এসে কুহুকে দেখে যায়। নীরা কনসিভ করেছে, ওর শারীরিক অবস্থা ক্রিটিক্যাল হওয়ায়, ও এখন অব্দি কুহুকে দেখতে আসতে পারেনি।

তবে তিনবেলা করে কুহুর খোঁজ ঠিকই নেয়। ও পুরো বেড রেস্টে আছে।
তাওহীদ ওর মা’কে ফোন করে বারবার ওদের কাছে যেতে বলছে। কিন্তু তাহমিনা আক্তার কুহুকে এই অবস্থায় রেখে কোথাও যেতে রাজি নয়। কিন্তু নীরার অবস্থাও ততটা ভালো নয়। তাহমিনা আক্তার কি করবেন ভেবে পাচ্ছেননা।
তিনি মাথায় হাত দিয়ে আইসিইউর সামনে বসে আছেন। আফরোজা নাজনীনও সেখানেই আছেন। তিনি কয়েকদিন থেকেই তাহমিনা আক্তারের অস্থিরতা দেখছেন ঠিকই কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি জিজ্ঞেস না করে পারলেননা।

” তাহু, তোর কি হয়েছে? তোকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন? ”
” ভাবী, তাওহীদ বারবার নড়াইল যেতে বলছে। নীরার অবস্থা ভালো নয়। ওকে দেখারও কেউ নেই। কিন্তু আমি কুহুকে রেখে সেখানে কেমন করে যাই? অথচ ওরা দুইজনই আমার পুত্রবধূ। ওদের প্রতি সমান দ্বায়িত্ব পালন করা উচিত। আমি ভেবে পাচ্ছিনা, কি করব। ”

” আমার কথা শোন, তুই নড়াইল যা। সাতদিন থাক সেখানে। এরপর নীরাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আয়। এমনিতেও ওর ডেলিভারি ঢাকাতেই হবে। ও যেখানে ঢাকা ছয়মাস পরে আসত, সেখানে নাহয় এখনই আসল। বাসায় আসলে আমরা ওর যত্ন ঠিকমত নিতে পারব। তুই চিন্তা করিসনা। আমি তাওহীদের সাথে কথা বলব। আর আমার বিশ্বাস তাওহীদ আমার কথা কখনোই ফেলবেনা। ”

” কিন্তু ভাবী, এখন যদি আমি নড়াইল যাই, সেটা যদি তাহমিদ পছন্দ না করে? কুহুর এই অবস্থায় আমার কোথাও যাওয়ায় যদি ও রা’গ করে? ”
” ও কিছুই করবেনা। তুই যে কয়দিন থাকবিনা, সে কয়দিন আমি আর শাহনাজ এখানে থাকব। আর বাসা শিউলি সামলাবে। তুই কালকেই রওনন দে। আমি ড্রাইভারকে বলে রাখব। তোর কোন চিন্তা নেই, যা করার আমি করব। ”
বড় জায়ের কথায় ভরসা পান তাহমিনা আক্তার। তিনি মনস্থির করলেন, আগামীকাল সকালেই নড়াইলের উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।

দৃষ্টি আগের থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে মাঝরাতে চিৎকার দিয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গে। তখন শাহনাজ সুলতানা ওকে পরম মমতায় বুকে টেনে নেন। শান্তনা দেন ভাইয়ের মেয়েকে।
সারাদিন আরোশি আর সিক্তা মিলে দৃষ্টিকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে থাকে। দৃষ্টি ওদের খুনসুটি দেখে ঠোঁট চেপে হাসে।
তবে প্রতিদিনই আনান আর নিহানকে নির্দিষ্ট সময়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলে ওর মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু সকল কৌতুহল মাটি চাপা দেয় মেয়েটা।

কায়েসও এখন আগের থেকে ভালো আছে। তবে তার বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। তাহমিদ কায়েসকে অবজারভেশনে রেখেছে। সময় বুঝে তার বাইপাস করবে।
মেম্বার আর সবুজ নিজেদের মৃ’ত্যু কামনা করছে সর্বদাই। ওরা আর মা’র সহ্য করতে পারছেনা। তাহমিদ যখনই আসে তখনই ওরা বলে, ওদের শেষ করে দিতে। তাহমিদ ওদের কথা শুনে শুধু হাসে।

সবুজ নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শরীরের নানান জায়গায় মা’রে’র চিহ্ন। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয়ার উপায় নেই। আজ চারদিন যাবৎ তারা নতুন কোনও একটা জায়গায় আটকে আছে। চারদিন ধরে কোন খাবার জোটেনি কপালে। পানি চাইলে নিহান ওর শরীরে প্র’শ্রা’ব করে দিয়েছে। সবুজ বুঝতে পারে মেম্বার আর ওর ওপর নিহান ছেলেটার খুব রা’গ।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৫

” নিহান, আনান ওদের বস্তিতে দিয়ে আয়। তবে মনে রাখিস, তোরা কেউ ওদের সাথে যাবিনা। আমাদের ছেলেরা যেন এদের নজরে রাখে, সেটা ওদের বল দিস। আগামী তিনদিন এরা বস্তিতেই থাকবে। বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দে। ”
তাহমিদের নির্দেশে ওরা মেম্বার আর সবুজকে নিয়ে বস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৭