বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৫

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৫
সাদিয়া জাহান উম্মি

-‘ শেষমেষ এই জন্যে ওই মেয়েকেই আমার ছেলের বউ বানাবে তুমি?ওর মেয়েকে কোন দিক দিয়ে আমার ছেলের সাথে মানাবে বলো তুমি?এটা কেমন সিদ্ধান্ত তোমার?’
সাথির এমন কর্কশ গলায় কথাগুলো শুনে। রাগি চোখে তালানে নিহাদ।চেঁচিয়ে বললেন,
-‘ আমি যা করেছি বেশ করেছি।আরাবীর মতো মেয়ে তো প্রতিটা মানুষ চাইবে তার ছেলের বউ হোক।কিন্তু তোমার এতে এতো সমস্যা কিসের?’
সাথি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন,

-‘ ওই মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে মানি না।আর মানবোও না।আমি এই বিয়ে কিছুতেই হতে দিবো না।’
নিহাদ উঠে দাড়ালেন।স্ত্রীর দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
-‘ তুমি মানো বা না মানো।জায়ানের সাথে আরাবীরই বিয়ে হবে আর এইটাই আমার ফাইনাল ডিশিসান।আর তোমার এটা ভালো না লাগলে তুমি নিজের রাস্তা মেপে নিতে পারো।অনেক স্বাধিনতা দিয়েছে তোমায় আমার ছেলেমেয়েদের বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত তুমি নিতে।আমি কিছু বলতাম না।তবে আজ আমি যা বলেছি বা করবো।সেটা সবার ভালোর জন্যে।আরাবীর মতো এমন একটা লক্ষী মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে এটা ভেবেই আমার গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে।এখন শুধু মিহান, মিলির সাথে কথা বলবো সন্ধ্যায়।আর আরাবী রাজি হলেই হলো।আমি জানি আরাবী আমার কথা ফেলবে না।মেয়েটা বড্ড আদুরে।’
নিহাদ সাহেব কথাগুলো বলেই রুম ত্যাগ করলেন।আর সাথি রাফে ফুসতে লাগলেন বিছানার এক কোনে বসে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সন্ধ্যা সাতটা।
মিহানের পরিবারের সবাই বেশ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।আজ অফিস থেকে ইফতি আর জায়ানকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে।কিন্তু জায়ান আসেনি। এতো জোড়াজুড়ি করেও আনতে পারিনি ইফতি জায়ানকে।তাই ইফতি একাই চলে এসেছে।নিহাদ সাহেব আজ অফিসে যাননি।আর হঠাৎ ওদের অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসতে বলায় বেশ অবাকই হয়েছে ইফতি।তাই তো জলদি বাড়িতে ফিরেছে।কিন্তু বাড়িতে ফিরে যখন নিহাদ সাহেব একটু আগে যেই কথার উল্লেখ করেছে তাতে যেন ইফতিসহ ওর পুরো পরিবার বিষ্মত হয়ে গিয়েছে।
মিহান অবাকের রেশ ধরেই বললো,

-‘ ভাই তুমি ভেবে বলছো তো সব?’
নিহাদ সাহেব হেসে বলেন,
-‘ আমি ভেবেছি।বহুদিন ধরে শুধু ভেবেই গিয়েছে।অবশেষে আজ ভাবনা শেষ করে তারপরেই তোর কাছে আসলাম।প্লিজ না করবি না।আরাবীর মতো একটা লক্ষী মেয়েকে আমি নির্দ্বিধায় আমার ছেলের বউ বানাবো।’
মিলি ইতস্ততভাবে বললেন,
-‘ কিন্তু ভাইজান।সব ঠিক আছে।তবে আমাদের কাছে আরাবী থাকবে ঠিক আছে।কিন্তু আরাবীর মা’র সাথে কথা বলতে হবে।আর সবচেয়ে বড় কথা।এখানে আরাবীর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

নিহাদ সাহেব বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন সবটা শুনছিলো আরাবী।বিষ্ময়ে কি রিয়েকশন দিবে সব যেন ভুলে গিয়েছিলো।আজ আচমকা যে নিহাদ সাহেব লোকটার জন্যে ওর হাত চাইবে। কাশ্মিনকালেও ভাবেনি আরাবী।ও কি ঠিক শুনছে না ভুল।বাস্তবে দেখছে না কল্পনা।সেটাও এখনো বুঝতে পারছে না।নিহাদ সাহেব আরাবীর কাছে এসে আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।চমকে উঠে আরাবী তাকালো।নিহাদ সাহেব হাসিমুখে বললেন,
-‘ কিরে মা? এই বুড়ো বাপটার শেষ ইচ্ছে রাখবি না?তোকে আমি পূত্রবধু না আমার মেয়ে বানিয়ে নিয়ে যাবো।বাবার সকল ভালোবাসা তোকে দিবো।আমি বেঁচে থাকতে তোকে কোন কষ্ট পেতে দিবো না।বল মা তুই কি রাজি এই বিয়েতে?তোকে আমি জোড় করবো না।তুই তোর মনের কথাটাই আমাদের বল।’

নিহাদ সাহেবের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি জবাব দিবে আরাবী তা ও জানে না।একে তো সাথি যে ওকে একটুও সহ্য করতে পারেনা তা ও ভালোভাবেই জানে।আর সবচেয়ে বড় কথা।জায়ান নিজেও তো ওকে দেখতে পারে না।সেখানে এই লোকটাকে বিয়ে করে তার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে।ভাবতেই তো কলিজার পানি শুকিয়ে যায় আরাবীর।আচ্ছা,নিহাদ যে এসব বললো? সে কি জায়ানের থেকে অনুমতি বা মতামত নিয়েছে?লোকটার মতামত ছাড়া তো এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিহাদ নিতে পারবে না। আরাবীর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।কোথা থেকে ঠিক কিভাবে সব মিলাবে তা জানে না আরাবী।এদিকে আরাবীকে এমন চুপ থাকতে দেখে নিহাদ আবারও বলেন,

-‘ কিরে মা? তাহলে কি ধরে নেবো তুই রাজি না?তুই রাজি না হলে আমি তোকে একদম জোড় করবো না!’
আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।থেমে থেমে জবাব দিলো,
-‘ আমি জানি না।আপনি আমার মায়ের সাথে কথা বলে নিলে ভালো হয়।আমার মা যা বলবে আমি তাই করবো।আমার মা যদি এতে রাজি হয়।তাহলে ধরে নিবেন আমিও রাজি।কারন আমার মায়ের খুশিতেই আমি খুশি।’
নিহাদ আরাবীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।তারপর বলেন,
-‘ আচ্ছা দেখি তোমার মায়ের এড্রেস দেও।আমি কালই যাবো সেখানে।’
আরাবী আৎকে উঠলো।না কিছুতেই সেখানে আর যাওয়া যাবে না।তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।ওই গ্রামের মানুষ ভালো না। আরাবী ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

-‘ না আংকেল আপনার ওখানে যাওয়া লাগবে না।আপনি ফোনেই কথা বলে নিন।’
-‘ কিন্তু ফোনে……!’
ইফতি আরাবীর ভয়টা স্পষ্ট টের পেলো। তাই তাড়াতাড়ি নিহাদকে সাহেবকে বললো,
-‘ বড় আব্বু।তোমাকে এতো কষ্ট করে যাওয়া লাগবে না।এখন হচ্ছে ডিজিটাল যুগ।একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ফোনের মাধ্যমেই অনায়াসে সব করা যায়।’
ইফতির কথা নিহাদ সাহেব মেনে নিলেন।তাই বললেন,
-‘ তবে তোমার মায়ের নাম্বারটাই দেও।’

আরাবী আমতা আমতা করে অবশেষে নাম্বারটা দিয়েই দিলো।নিহাদ সাহেব বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে প্রায় অনেকক্ষন কথা বললেন।কি কথা বললেন তা কেউ শুনতে পেলো না।প্রায় অনেকক্ষন পর তিনি হাতের ইশারায় আরাবীকে তার কাছে ডাকলেন।আরাবী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো নিহাদের ইশারা পেয়ে।আরাবী নিকটে আসতেই।নিহাদ হাতের ফোনটা এগিয়ে দিলো আরাবীর দিকে।তারপর বললেন,
-‘ নেও।তোমার মার সাথে কথা বলে নেও।’
আরাবী ফোনটা হাতে নিয়ে।মিষ্টি হেসে বললো,

-‘ তুই টাই ঠিক আছে আংকেল।আপনি আমাকে তুই বলে ডাকতে পারেন।’
নিহাদ যেন আরাবীর কথায় বেশ খুশি হলেন।আরাবী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে।আরাবীকে ওর মায়ের সাথে একান্তে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন।তিনি যেতেই আরাবী ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে উঠলো,
-‘ কেমন আছো মা?’
অপাশ হতে আরাবীর মায়ের উচ্ছাসিত কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
-‘ আমি অনেক ভালো আছি মা।আমার মেয়েটা যেখানে এতো ভালো আছে।সেখানে আমি ভালো না থেকে পারি।’
আরাবী কিভাবে কি বলবে খুজে পাচ্ছে না।আমতা আমতা করে বললো,
-‘ মা আসলে।ওইযে নিহাদ আংকেল…’

আরাবী মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আরাবীর মা।অত্যন্ত খুশি নিয়ে বলেন,
-‘ আমি শুনেছি আরাবী।মা আমার তোর এতো ভালো একটা পরিবার থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে এটা তো আমার কেমন যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।আমি চিনি তাদের মা।তারা অনেক ভালো মানুষ।তুই অনেক ভালো থাকবি মা। আমি জানতাম আমার মেয়েটা জীবনে অনেক সুখী হবে। আজ দেখ তা সত্যি হয়ে যাচ্ছে।’
আরাবী মায়ের এমন খুশি দেখে কি করবে ভেবে পেলো না।আজ অনেকদিন পর তার মা’কে এতোটা হাসিখুশি দেখলো আরাবী।হঠাৎ আরাবীর মায়ের আবার বলে উঠলেন,

-‘ তুই রাজি তো মা?আমি বলবো না তুই আমার কথায় এই বিয়েতে মত দে।তুই তোর মতামত স্বাধিনভাবে দিতে পারবি।তুই রাজি না হলে দরজার নেই।আমি নিহাদ ভাইকে বুঝিয়ে বলে দিবো।’
না আরাবী না করবে না।যা হবে পরে দেখা যাবে।ওর মায়ের খুশি যেখানে আরাবীও সেখানে খুশি।ওর মা যখন এই বিয়ের উছিলায় এতোটা হাসি খুশি হয়েছে সেখানে আরাবী কখনই অমত করবে না।আরাবী হাসিমুখে বলে,
-‘ আমি রাজি মা।আমি রাজি। তোমার মতামতই আমার সবচেয়ে বেশি।আমার মা যেখানে বলেছে এখানে আমি সুখী হবো।সেখানে আমি কিভাবে না করি বলোতো।’

-‘ আমি জানতাম আমার মেয়ে এটাই বলবে।’
আরাবী আরো অনেকক্ষন ওর মায়ের সাথে কথা বললো।কথা বলা শেষে আরাবী সবার দিকে তাকালো।ওর কেমন যেন ওখানে যেতে লজ্জা করছে।শরীরটা কেমন যেন লজ্জায় ভার হয়ে আছে।হঠাৎ ইফতি ডাকলো আরাবীকে,
-‘ এই আরাবী এখানে আয়?কথা বলা শেষ?’
আরাবী মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।ইফতি আবারও বললো,
-‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এদিকে আয়?কি বললো আন্টি?’
আরাবী না চাইতেও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেখানে।কেমন যেন চোখ মিলাতে পারছে না।লজ্জা, আর অসস্থিতে আরাবী পুরো কাবু হয়ে আছে।আরাবী সবার মাঝে আসতেই।নিহাদ অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলেন,

-‘ তোর মতামত কি?এইবার বল? তুই কি রাজি মা?’
আরাবী সময় নিলো খানিক।অতঃপর শুকনো ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।নিহাদ সাহেব সাথে সাথে ‘ আলহামদুলিল্লাহ! ‘ বললেন।আরাবী লাজুক দৃষ্টিতেই সবাইকে পরখ করলো।সবার মুখেই হাসি।আরাবী বুঝলো এই বিয়েটা হলে সবাই খুশি হবে।আচ্ছা আরাবী সবাই বলছে।কিন্তু যার সাথে বিয়ে হবে সে কি খুশি?সে কি রাজি এই বিয়েতে? আরাবীর মনটা বড্ড খচখচ করছে একবার জায়ানের মতামত জানার জন্যে।

ওই একটা ব্যাক্তির কারনেই আরাবীর হৃদয়টা বড্ড অশান্তিতে ভুগছে।আর সাথি? উনি কি রাজি?আর আজ নিহাদের সাথে সাথি এলেন না কেন?উনার ছেলের জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্তে উনি নেই।ব্যাপারটা কেমন যেন খটকা লাগলো আরাবীর কাছে। তবে মনের কথা মনেই চেপেই রইলো।আরাবী সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে রুমে দিকে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হচ্ছে।হঠাৎ ওর পাশাপাশি ইফতিও আসলো।ইফতি নিজেও রুমে যাচ্ছে।এখনো অফিসের পোষাক গায়ে। ফ্রেস হবে।ইফতি দুষ্টুমির স্বরে বললো,

-‘ কিরে?অবশেষ বিয়ের সানাই বাজলো তোর?আমি তো প্রচন্ড খুশি এখন একেবারে আমার বোনটা সারাজীবনের জন্যে আমাদের কাছে থেকে যাবে।আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।’
আরাবী বেশ লজ্জা পেলো ইফতির কথায়।তাই তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে চলে গেলো।আর ইফতি হাসতে হাসতে শেষ আরাবীর কান্ডে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকের হওয়া সকল ঘটনা ভাবছে আরাবী।রাত তখন ১২ টা বাজে।এতো রাত হয়ে গিয়েছে তাও আরাবীর চোখে ঘুম নেই।মূলত ঘুম থাকলেও অদ্ভুত এক চিন্তায় ঘুম আসছে না। কি হবে সামনে?কি হতে চলেছে ওর সাথে?জায়ান কি বিয়েতে রাজি নাকি জায়ানের মতামত ছাড়াই নিহাদ এসব করলেন।আর সাথিই বা কিভাবে রাজি হলেন?এসব নানান চিন্তায় আরাবীর মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

প্রচন্ড চিন্তায় হাসফাস করছে আরাবী।এমন সময় এই নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ খ্যাচ করে একটা শব্দ হওয়াতে কেঁপে উঠলো আরাবী।ডানপাশে ডাকাতেই চোখজোড়া বড় বড়ব বড় হয়ে যায় আরাবীর।জায়ান তাকিয়ে আছে ওর-ই দিকে।লোকটাকে ভালো দেখাচ্ছে না।কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সেই প্রখর দৃষ্টি।আরাবীর সর্বাঙ্গ কাঁপছে কেমন যেন?আরাবী চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিলো।হৃদয়টা এতো জোড়ে লাফাচ্ছে কেন?উফ! আরাবী সাহস নিয়ে খানিক এগিয়ে গেলো।মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৪

-‘ কি হয়েছে আপনার?আপনি ঠিক আছেন?’
এই প্রশ্নটাই করা বোধহয় ভুল হয়েছে আরাবীর।কারন হঠাৎ জায়ান যা করলো তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আরাবী।আরাবীর শ্বাস আটকে যাওয়াদ উপক্রোম হলো।এই বুঝি আরাবী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৬