বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৪

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৪
সাদিয়া জাহান উম্মি

আজ সকালটা বেশ ফুড়ফুড়ে মেজাজে উপভোগ করছে আরাবী।ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া, সাথে নানান ফুলের মনমাতানো ঘ্রান।আরাবী প্রানভরে শ্বাস নিলো আরাবী।কাল রাতের গেট টুগেদারটা বেশ ভালো গিয়েছে।সকলেই বেশ ভালো ছিলো।অনেক জলদি তারা আরাবীর সাথে মিশে গিয়েছে।শুধু ওই আদিকে একদম ভালো লাগেনি আরাবীর।খারাপ লোকটার দৃষ্টিতেই কেমন যেন নোংরামো দেখতে পেয়েছে আরাবী।

কি বিশ্রিভাবে বারবার তাকাচ্ছিলো আরাবীর দিকে। এই একটা কারনেই যা একটু খারাপ লেগেছে।নাহলে বেশ ভালোই কেটেছে পুরোটা সময়।সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তামিমকে।ছেলেটা এতো কিউট।কাল একটু সময়ের জন্যেও আরাবীর কাছ থেকে সরেনি।খাবার টাইমে মারিয়া এতো চেষ্টা করেছিলো পারেনি খাওয়াতে।কিন্তু আরাবী খাইয়ে দিতেই কি সুন্দর সব খেয়ে নিয়েছে।যাবার সময় সেকি কান্না তার।সে আরাবীকে ছাড়া যাবেই না।অবশেষে আরাবী অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে।আরাবী ভীষন মিস করছে তামিমকে।আরাবী এসব ভাবছে আর মুচঁকি হাসছে।আচমকা কারো গলার স্বর শুনতে পেলো আরাবী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ কি ব্যাপার আরাবী?একা একা হাসছো যে?’
আরাবী ভাবনা সমাপ্ত করে কথা বলা ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা নিহাদ।নিহাদকে দেখে আরাবী আগে হাসিমুখে সালাম জানালো।সালামের জবাব নিয়ে নিহাদ বললো,
-‘ এতো সকালে এখানে কি করছো আম্মু?’
নিহাদের কথাগুলো শুনতে আরাবীর এতো ভালোলাগে। এই মাত্র ওকে ‘আম্মু!’ বলে সম্বোধন করলো এতে যেন আরাবীর হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো।আরাবী হালকা হেসে বললো,

-‘ ও কিছু না আংকেল আসলে আমার নামাজ আদায় করে আর ঘুম আসেনা।মূলত অভ্যাস নেই।গ্রামে থাকতেও আমি নামাজ পরে ঘরের বিভিন্ন কাজ করতাম মায়ের সাথে।কিন্তু এখানে তো মামুনি কিছুই করতে দেয়না।তাই আর কি করার প্রতিদিন সকালে বাগানে চলে আসি প্রকৃতি বিলাশ করতে।আপনাদের বাগানটা বেশ সুন্দর।’
নিহাদ হাসলেন আরাবীর কথায়।বললেন,
-‘ এই পুরো বাগানটা সাজিয়েছে আমার ছেলে জায়ান।ছেলেটার ফুল এতো পছন্দ। তাই দেখো না বাগানটা পুরো ফুল গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে।’

আরাবী বাগানের চারপাশে আবারও চোখ বুলালো।আসলেই বাগানটা খুব সুন্দর। তাইতো আরাবী যখন সময় পায় ছুটে চলে আসে এখানে।আরাবী মনে মনে ভাবলো,
-‘ ওই খারুস,গুমড়ামুখো লোকটারও যে এতো সুন্দর পছন্দ হবে।তা লোকটাকে দেখলে বুঝা যাবে না।’
নিহাদ আরাবীর কাছাকাছি এসে দাড়ালো।নম্র কন্ঠে বলেন,
-‘ আরাবী?আমি এই টাইমে হাটতে বের হয়।একাই হাটি আমি।ডায়বেটিস আছে তো আমার।তবে আজ কি আমার সঙি হবে তুমি?বাবা মেয়ে চমৎকারভাবে ভোরের পরিবেশ উপভোগ করবো।’
আরাবী এতো মায়ামাখানো বাক্যগুলো শুনে চোখ ভরে উঠলো।এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। তা দেখে নিহাদ বিচলিত কন্ঠে বলেন,

-‘ আরে আরে।কি করছো?কাঁদছো কেন তুমি?’
আরাবী চোখ মুছে নিলো দ্রুত।ধরা গলায় বলে,
-‘ আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর কখনো এভাবে বাবার মতো আদরমাখা কথাগুলো শুনতে পায়নি বছর হলো। কিন্তু এখানে আসার পর পাপা আর আপনি যেভাবে কথা বলেন। এতো সুন্দর ভাবে মায়া মাখিয়ে।আমার বাবার কথা মনে পরে যায়।আমার বাবা থাকলেও তো ঠিক আপনাদের মতো এইভাবে আমাকে স্নেহমাখানো কন্ঠে কথা বলতো আমার সাথে।আমাকে আদর করে ছোট নামে ডাকতো।আপনাদের দেখে আমার বাবার কথা মনে পরে যায়।’

নিহাদ সাহেব আরাবীর কথা শুনে। আরাবীর মাথায় স্নেহপূর্ণ হাত বুলিয়ে দিলো।বললো,
– ‘ বোকা মেয়ে এইজন্যে কাঁদতে হয় নাকি?তুমি যেমন আদুরে একটা মেয়ে।তোমাকে আদুরেভাবে কথা না বলে থাকা যায়?বলো? আর কাঁদবে না কেমন?তোমার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখতে বেশি ভালো লাগে।তা এখন যাবে আমার সাথে?’
আরাবী হেসে সম্মতি জানালো নিহাদের কথায়।

তারপর নিহাদের সাথে হাটতে বেড়িয়ে গেলো।প্রায় ঘন্টাখানিক হেটে বাড়িতে ফিরে আসলো নিহাদ আর আরাবী।আরাবী নিহাদকে বলে বাড়ির ভীতরে চলে গেলো।নিহাদও তার বাড়ির দিকে হাটা ধরলো।নিহাদের মনে অজস্র ভাবনারা উকিঝুকি দিচ্ছে।অবশেষে মন মস্তিষ্কের মাঝে বনাবনি করে নিহাদ সাহেব একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।এখন উনার এই সিদ্ধান্তটায় সকলে একমত হলেই হবে।আর একমত না হলেও সমস্যা নেই।উনি যা ভেবে নিয়েছেন এইবার তাই করবেন উনি।অনেক হয়েছে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে সব কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া।এইবার নিহাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কঠিন সিদ্ধান্ত। আর তিনি জানেন তার এই সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হতে পারে না।

নিহাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে নাস্তা খেতে বসেছে।নিহাদ আঁড়চোখে সবাইকে ক্ষনে ক্ষনে পর্যবেক্ষন করে নিচ্ছেন।সবার খাওয়া শেষ।তাই উঠে চলে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে নিহাদ বলে উঠলেন,
-‘ দাড়াও সবাই।আজ আমার সবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
সবাই থেমে গেলো।সাথি বেশ অবাক হলেন স্বামির কথায়।তিনি বললেন,
-‘ কি এমন বলবে যে সবাইকে থাকতে হবে।নূরের ভার্সিটি আছে,জায়ানের অফিস আছে।তুমিও তো যাবে অফিসে।’
নিহাদ বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো সাথির দিকে বললো,

-‘ দরকার দেখেই থামিয়েছে। অহেতুক কারন হলে কি ওদের দাড়াতে বলতাম?’
জায়ান কপালে আঙ্গুল ঘষলো।তার বাবা মা এখনই ঝগরা লেগে যাবে।তাই জায়ান বলে,
-‘ কি বলবে বাবা?জলদি বলো?’
নিহাদ সাহেব নড়েচড়ে বসলেন ছেলের কথায়।বেশ সময় নিয়ে ধীরকন্ঠে বললেন,
-‘ তুমি কি বিয়ে করবে না?’
জায়ান শান্ত স্বরে জবাব দিলো,

-‘ আমি তো বলেছি বাবা সময় হলে আমিই তোমাকে বলবো?’
নিহাদ রেগে বলেন,
-‘ সেই সময়টা তোমার কখন হবে জায়ান?বয়স তো কম হলো না।ত্রিশ চলছে তোমার।’
সাথি কর্কশ কন্ঠে বলেন,
-‘ আমার ছেলের বয়স নিয়ে কথা বলবে না।কি এমন বয়স হয়েছে হ্যা?আমার ছেলের জন্যে হাজার হাজার মেয়ে পাগল।ওর জন্যে কি মেয়ের অভাব পরবে নাকি?ওর জন্যে তো আমি লাল টুকটুকে বউ আনবো।’
সাথির কথায় নিহাদের বেশ রাগ লাগলো।তাও নিজেকে সামলে বলেন,

-‘ সেটা ভাবলে তো আরো আগেই করতে।এতোদিন এমন হেলাফেলা করতে না। সে যাই হোক আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আর আমার সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত।এইটা আর বদলাবে না।আমি অনেক ভেবে চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আশা করি আমার সিদ্ধান্তকে সবাই সম্মান করবে।আর না করলেও না।আমি এখন যা বলবো সেটা হবেই হবে।’
নূর জানে ওর বাবা কখনো এমন সিরিয়াস হয় না।হয় খুব কম।তবে আজ মনে হচ্ছে ওর বাবা অনেক বেশিই সিরিয়াস।নূর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘ কি ডিশিসান নিয়েছো বাবা?’
নিহাদ শান্ত চোখে একবার সাথির দিকে তাকালেন।তিনি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে।আবার জায়ানের দিকে তাকালো জায়ান শান্তভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছেন।নিহাদ ফুঁস করে শ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
-‘ আমি জায়ানের বিয়ে ঠিক করেছি।’
সাথি আর নূর বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন।সাথি অবাক কন্ঠে বলেন,
-‘ এইগুলো কি বলছো তুমি?মাথা ঠিক আছে?আর আমার থেকে তো তুমি একবার জিজ্ঞেসও করোনি।’
নিহাদের শান্ত উত্তর,

-‘ প্রয়োজন মনে করিনি।’
জায়ানের দিকে তাকালেন।জায়ান এখনো শান্তভাবে তাকিয়ে আছে।জায়ান বললো,
-‘ তা বিয়ে ঠিক করেছো ভালো কথা কার সাথে তা তো বলবে?’
নিহাদ সাহেব ছেলের কথায় হেসে জবাব দিলেন,
-‘আরাবীর সাথে।মেয়েটাকে এই কয়দিন আমি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করেছি।মেয়েটা অনেক ভালো।আমি এতোদিন অনেক ভাবনা চিন্তা করেছি।তারপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জায়ান তোমাকে আরাবীকেই বিয়ে করতে হবে।ভাব্বে তোমার বাবা তোমার কাছে তার শেষ আবদার করেছে।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১২

জায়ান হাতমুঠো করে দাঁড়িয়ে সব কথা নিরবে শুনলো বাবার।বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে তারপর অফিসের ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৫