বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৬

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৬
সাদিয়া জাহান উম্মি

নিস্তব্ধ রজনী।মৃদ্যুমন্দ বাতাস বইছে।সাথে মন মাতানো নানান ফুলের ঘ্রান বাতাসের সাথে।ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ।মোহময় এক পরিবেশ।
আরাবী ভয়ে একদম সিটিয়ে আছে রেলিংয়ের সাথে।আর ওর ওকে দুহাতের মাঝে আটকে রেখেছে জায়ান।আরাবীর হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গিয়েছে যে সেই শব্দ বাহিরের মানুষও শুনতে পাবে।

বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আরাবী।মনে হচ্ছে আর একটু পর বোধহয় ও শ্বাসকষ্টে মরে যাবে। একটু আগে যখন আরাবী জায়ানকে দেখে প্রশ্ন করেছিলো।জায়ান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রায় একপ্রকার লাফিয়ে আরাবীর বারান্দায় এসে পরেছে।আর তৎক্ষনাৎ আরাবীকে নিজের বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে নিয়েছে।জায়ান অন্যরকম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।আরাবী সেই চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম।অবশ্য বুঝবেই বা কি করে?চোখের ভাষা বুঝতে হলে আগে সেই চোখের দিকে তাকাতে হয়।কিন্তু আরাবী তো পারেনা ওই চোখের দিকে তাকাতে।নিতে পারেনা ওই চোখের দৃষ্টি।যেমন এখনো পারছে না।আরাবীর সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।তা দেখে জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ এখনো তো সামান্য স্পর্শও করেনি।দুজনের মাঝে এখনো বেশ তফাত আছে।তাতেই এমন কাঁপছে।কিন্তু বিয়ের পর তো প্রতিদিন,প্রতিনিয়ত আমার স্পর্শ থাকবে তোমার সর্বাঙ্গে তখন কি করবে মিস আরাবী?’
আরাবী জায়ানের এহেন লাগামছাড়া কথায় ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।এইগুলো কি বললো জায়ান ওকে?আরাবী শরীরটা কেমন যেন নেতিয়ে যাচ্ছে।হাতে পায়ে এমনকি পুরো শরীরে একফোটা শক্তি পাচ্ছে না।আরাবী ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নিতেই জায়ান তার শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দ্বারা আরাবীকে আকড়ে ধরে।

ঝংকার খেলে যায় পুরো শরীরে আরাবীর।এই প্রথম! এই প্রথম আজ ওর গায়ে স্পর্শ করেছে জায়ান।লোকটার শীতল হাতের স্পর্শ ভীতরের অন্তর আত্মা শুদ্ধু কাঁপিয়ে তুলছে আরাবীকে।জায়ান আরাবীর চোখের দিকে তাকালো।জায়ানের ঘোলাটে চোখজোড়া যেন একটা সমুদ্র।আরাবীর মনে হয় জায়ানের চোখের দিকে আরাবী তাকালে ওই চোখের সমুদ্রে আরাবী নিজেকে তলিয়ে ফেলবে বেশ বাজেভাবে।তাই তো তাকায় না ওই চোখজোড়ার পানে।জায়ান আরাবীর কানের কাছে মুখ নিলো।জায়ানের গরম নিশ্বাস আরাবীর কাধে এসে বারি খাচ্ছে।শিহরণে আরাবী জায়ানের হাত খামছে ধরে।জায়ান আরাবীর কানে কানে বললো,

-‘ ভেবেছিলাম প্রথম স্পর্শ বিয়ের পর করবো।কিন্তু তুমি তো তা হতে দিলে না।তার আগেই তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলে তুমি।’
জায়ান এইবার আরাবীর কানের অনেকটা কাছে ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,
-‘ আমার প্রথম স্পর্শে কেমন লাগছে মিস আরাবী? যদি আমি আরেকটু কাছে আসি তোমার?জড়িয়ে ধরি? এখন এইটুকু স্পর্শে আমার হাতটা রক্তাক্ত করেছো?তখন কি আমার পুরো শরীর করবে?’

আরাবী জায়ানের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ জায়ানের হাত ছেড়ে দিলো।তবে ওর কাঁপাকাঁপি মোটেও বন্ধ হলে না। আরাবী অবাকের শেষ সীমানায়। এ কোন জায়ানকে দেখছে আরাবী? এই জায়ানকে তো আরাবী চিনে না।আচ্ছা জায়ান কি মদ টদ খেলো নাকি?ও কি জিজ্ঞেস করবে কথাটা? মনে মনে সাহস নিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে বললো আরাবী,
-‘ আপনি এমন করছেন কেন?আপনি ড্রিংস করেছেন?’
জায়ানের উত্তর শোনা গেলো না।আরাবীও কিছু আর বললো না।মিনেট পাঁচেক নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে।তবে সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জায়ান বলে উঠে,

-‘ হ্যা, আমি ড্রিংস করেছি।’
আরাবী কথাটা শ্রবণ হওয়ার সাথে সাথে চমকে তাকায় জায়ানের দিকে।জায়ান আরাবীর সেই চমকিত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে আবারও বললো,
-‘ তবে এই নেশা সেই নেশা না।এই নেশা ভয়ানক নেশা।যা কোনকিছুর দ্বারাই কাটবে না।আর আমি এই নেশা কাটিয়ে উঠতেও চাইনা।’
আরাবী বার বার শুকনো ঢোক গিলছে জায়ানের ঠোঁট দ্বারা আওড়ানো প্রতিটি বাক্য শুনে। আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত জায়ানকে আরাবীকে হুট করে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে দিলো।তারপর দ্রুত অন্যদিকে ফিরে গেলো।সেইভাবেই গভীর কন্ঠে বললো,

-‘ দ্রুত রুমে যাও।অনেক রাত হয়েছে।ঘুমিয়ে পর গিয়ে।’
জায়ান ঠিক যেইভাবে এসেছিলো ঠিক সেইভাবেই চলে গেলো নিজের বারান্দায়।তারপর বারান্দায় লাইট নিভিয়ে দিয়ে রুমের ভীতর চলে গেলো।কিন্তু এক আকাশসম ধোয়াশার মাঝে রেখে গেলো আরাবীকে।জায়ানের করা কর্মকান্ডে আরাবীর মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে পরেছে প্রায়।এখনো আরাবী ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারছে না। হাসফাস করছে ভীষনভাবে।জায়ানের এমন ধা’ধার মতো বাক্যগুলো আরাবী মিলাতে পারছে না কিছুতেই।এমনিতে তো ভুলেও আরাবীর কাছে আসতো না।আর আজ একেবারে ওর বারান্দায় চলে এসেছে?লোকটা কি পাগল?

এইভাবে কেউ রেলিং টপকে কারো বারান্দায় আসে?যদি লোকটার কিছু হয়ে যেতো? আরাবী চিন্তায় চিন্তায় পাগলপ্রায়।আজ জায়ান যেগুলো বললো তা দ্বারা কি বুঝাতে চাইলো আরাবীকে?জায়ানের প্রতিটা বাক্যে তো এটুকু বুঝতে পারছে আরাবী।যে জায়ান নিজেও রাজি এই বিয়েতে।তবে কেন রাজি হলো?কিভাবে রাজি হলো?জায়ান তো প্রথম থেকেই আরাবীকে দেখতে পারেনা।তবে বিয়েতে মত দিলো কেন?আর আজ এসবই বা করার কি কারন? আরাবী আর ভাবলো না।আপাততো ঘুমানো যাক।শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে।আরাবী যখন রুমে প্রবেশ করবে ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই চেনা কন্ঠের গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেলো,

– বি প্রিপেয়ার্ড মিস আরাবী।বি প্রিপেয়ার্ড ফোর ম্যারি মি। প্রিপেয়ার্ড ওয়েল ইউরসেল্ফ টু বিকাম মিস টু মিসেস।মাই মিসেস।’
কথাগুলো শোনা মাত্র দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলো আরাবী।দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।লোকটা বোধহয় আজ পাগল হয়ে গিয়েছে।সাথে ওকেও পাগল বানিয়ে ফেলবে।আরাবী গিয়ে বিছানায় সুয়ে পরলো।চোখ বুঝতেই ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে আরাবীর।তাই তো তড়িঘড়ি করে কোনরকম নাকেমুখে খাবার খেয়ে দ্রুত মিলিকে বলে বাড়ির গেটের সামনে আসলো।নূর ইতিমধ্যে ওর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।আরাবী গিয়েই বললো,
-‘ সরি নূর।দেরি হয়ে গিয়েছে।চলো চলো। ‘
নূর নাক মুখ কুচকে বললো,
-‘ সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি তোমার জন্যে।তাড়াতাড়ি চলো।’

আরাবী মাথা নাড়িয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো।নূর উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।ঘুম না হওয়ায় আরাবীর ঘাড়ের রগ টনটন করছে।এই এক সমস্যা ঘুম না হলে আরাবীর ঘাড় ব্যাথা করে ভীষনভাবে।আরাবী চোখ বুজে পরে রইলো।হঠাৎ ওর কোলের মাঝে কিছু একটা ছিটকে পরায় চমকে চোখ মেলে তাকায় আরাবী।কোলের মাঝে তাকিয়ে দেখে মুভ মলম।আরাবী মুভটা হাতে নিয়ে সামনে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো।জায়ান গাড়িতে আছে সেটা তো আরাবী খেয়ালই করেনি।জায়ানের পাশে তাকাতে ইফতিকেও দেখতে পেলো। এদিকে আরাবীকে এইভাবে হাবার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়ান ড্রাইভ করতে করতেই বললো,

-‘ মলমটা লাগাতে দিয়েছি।এইভাবে হাতে নিয়ে বসে থেকে পূজো করার জন্যে না।’
আরাবী মুখটা থমথমে করে ফেললো।মুখ ফুলিয়ে মলমটা ব্যাথিত স্থানে ডলে নিলো ভালোভাবে।এইদিকে ইফতি আর নূর ঠোঁট টিপে হাসছে।নূরকে এইভাবে হাসতে দেখে যেন আরাবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
-‘ এইভাবে হাসছো কেন?হাসার কি হয়েছে?’
নূর ফিক করে হেসে দিলো।কোনরকম হাসি থামিয়ে বলে,
-‘ ও কিছু না।তুমি মলম ভালোভাবে লাগিয়েছো?নাহলে কিন্তু একজন খুব রেগে যাবে।’
নূরের কথা শেষ হতেই জায়ানের গম্ভীর কন্ঠস্বর,

-‘ নূর মার খাবি তুই!’
নূর সাথে সাথে একদম ভদ্র মানুষের ন্যায় বসে রইলো।এদিকে ইফতি দুষ্টুমির স্বরে বললো,
-‘ বাব্বাহ! বিয়ের আগেই বউয়ের জন্যে এতো দরদ?’
জায়ান ভ্রু উচু করে তাকালো ইফতির দিকে।ইফতি সাথে সাথে হাত উপরে উঠিয়ে হাসলো।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৫

এদিকে আরাবী ভাবছে কে বলবে এই গম্ভীরমুখো,রাগি,থমথমে স্বভাবের লোকটা কাল কিইনা করেছে ওর সাথে। কালকের ঘটনাগুলো আবারও মনে পরতেই। একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো আরাবীকে।নতমস্তকে বসে রইলো আরাবী।তবে ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি এখনো বিদ্যমান।আর সেই হাসিটুকু যেন চোখ এড়ালো না একজনের।তার হাসিটুকুই যেন সেই ব্যাক্তির হৃদয় থমকে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ঠ।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৭+১৮