বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২০

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২০
সাদিয়া জাহান উম্মি

সাথি আনমনে আকাশপানে তাকিয়ে আছেন।তার মনের ভীতরে তোলপাড় হচ্ছে।নিজের ছেলের চোখে আর অসন্তোষ দেখেছেন তার জন্যে।আজ প্রথম তিনি ছেলেকে এইভাবে ব্যবহার করতে দেখলো।জায়ানের লাস্ট বলা কথাগুলো এখনো তার মন মস্তিষ্ক দখল করে আছে। সাথি আপন মনে বিরবির করলো,
-‘ আমি কি তবে সত্যি অন্যায় করেছি? জায়ান কি তবে ঠিক বললো?আরাবী সম্পূর্ণ নির্দোষ?’
মনের কোঠায় অনুশোচনাগুলো তীরের মতো আঘাত করছে ক্ষনে ক্ষনে।একফোটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো সাথির।আবারও উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলেন আঁধার কালো গগনে।

অফিস থেকে মাত্রই ফিরলেন নিহাদ।কিন্তু রুমে প্রবেশ করে স্ত্রীকে জানালার ধারে উদাসভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে এলো নিহাদের।কি এমন হলো?সাথি এমন করে আছে কেন?সাথিকে আগে কখনো এতোটা উদাসিন হতে দেখেনি নিহাদ।অফিস ব্যাগটা সোফায় রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যান স্ত্রীর দিকে।সাথির কাধে হাত রাখতেই সাথি চমকে পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিহাদ এসেছে।নিহাদকে দেখে সাথি হালকা হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ কখন আসলে?’
সাথি আপাততো নিজের উদাসিনভাব আর মন খারাপ লুকাতে ব্যস্ত নিহাদের থেকে।কিন্ত সাথি অক্ষম হলো।নিহাদ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাথিকে পরখ করে নিয়ে বললো,
-‘ কি হয়েছে?তোমার মন খারাপ কেন?’
সাথি জোড়পূর্বক হেসে বলেন,
-‘ আরে কি বলছো?কোথায় আমার মন খারাপ?’
নিহাদ সাহেব সাথির কথায় ফিচেঁল হেসে বলেন,

-‘ ভুলে যেওনা সাথি।তুমি কখনো কোনদিন আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতে পারোনি।বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত যেটা পারছো না।সেটা আজ কিভাবে পারবে ভাবলে তুমি?’
নিহাদের এমন কথা শুনে সাথি আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে।শক্ত মনের মানুষটা মুহূর্তে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন স্বামির বুকে।নিহাদ দুহাতে স্ত্রীকে সামলে নেন।যতোই স্ত্রীকে কথা শুনাক।বা স্ত্রী যতোই অন্যায় করুক না কেন?দিনশেষে এই মানুষটাই যে তার সব।এই মানুষ্কটাকেই যে তিনি নিজের থেকে বেসি ভালোবাসেন।তার চোখের পানি কিভাবে সহ্য করবেন?আর সাথি তো সহজে কেঁদে ভাসানোর মতো মানুষ না।তবে আজ কি এমন হলো?তার মানুষটা এইভাবে তার বুকে লুটিয়ে পরে কাঁদছে।নিহাদ সাথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

-‘ হুশ কাদেনা তো আর।কি হয়েছে আমাকে বলো?আমাকে না বললে কিভাবে বুঝবো সমস্যাটা কোথায়?’
সাথি সময় নিয়ে নিজের কান্না থামালেন।তারপর আস্তে আস্তে সবটা খুলে বললেন স্বামিকে।নিহাদ সাথির মুখে সব শুনে রেগে যান ঠিকই।তবে নিজেকে সামলাতে পারেন তিনি খুব ভালোভাবে।আজ কটু কথায় নয় ভালোবেসে ভালো কথায় বুঝাবেন সাথিকে।নিহাদ সাথির চোখ মুছে দিয়ে সাথিকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।তারপর নিজেও সাথির পাশে বসে।সাথির হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,

-‘ আমি এখন যা বলবো মন দিয়ে শুনবে! ‘
সাথি হ্যা বোধক উত্তর দিলো।নিহাদ বলতে শুরু করেন,
-‘ আজ কিন্তু দোষটা তোমারই।তুমি নিজেও জানো আদি কেমন চরিত্রের।সে আমাদের নূরের সাথে কি কি করেছে।জায়ান ওকে মারার পর যা একটু শান্তি দিয়েছে নূরকে।তবে আজ আবার আরাবীর সাথে তেমনটা করতে চেয়েছিলো।নিশ্চয়ই আরাবীর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে।তা নাহলে আরাবী যেই স্বভাবের মেয়ে।ওকে মেরে ফেললেও তো ও মুখ ফুটে কিছু বলবে না।

তুমি নিজের দিকটাই দেখো আজ তুমি ওকে যা যা বলেছে আমাদের নূর হলেই কিন্তু রেগে মেগে যা তা বলে ফেলতো। কিন্তু দেখো আরাবী একটা টু শব্দও করেনি।কারন কি জানো?কারন এই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে ও অনেক সম্মান করে,ভরসা করে। এইভাবে কাউকে কথা দিয়ে আঘাত করা ঠিক না।এটা তুমি নিজেই তো তোমার ছেলেমেয়েদের এতোদিন শিখিয়েছো।আরো শিখিয়েছো কখনো একপাক্ষিক কথা শুনে কাউকে বিচার করতে না।তবে আজ নিজের বেলায় কেন উল্টোটা করলে সাথি।যেখানে তুমি জানো এখানে একশো পার্সেন্ট দোষী আদিই হবে।আরাবীকে কেন তুমি সহ্য করতে পারো নাহ?’
নিহাদের প্রতিটা কথা যেন সাথির মন,মস্তিষ্কে বিশাল প্রভাব ফেলছে।সাথি কিছুই বললো না।চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো।নিহাদ আবারও বলেন,

-‘ সাথি তুমি নিজেও কিন্তু মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির ছিলে।তোমার বাবা,ভাইরা টাকার মুখ দেখেছেন কিন্তু এই আমাকে বিয়ে করেই। না আমি বলবো না আমি তোমাকে খোটা দিচ্ছি।জাস্ট বাস্তবতাটা বোঝাচ্ছি।আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে।আমার বাবা এতো ধনী হয়েও তোমাকে কেন তার ছেলের বউ বানালেন বলতে পারো?কারন তিনি তোমাদের কি আছে না আছে এসব দেখে তোমাকে তার ছেলের বউ করেননি।

করেছে তোমার অমায়িক ব্যবহারের কারনে।তোমাকে পছন্দ করেছেন তিনি।নাকি তোমার ফ্যামিলি ব্যালগ্রাউন্ড না তোমাদের টাকা পয়সা দেখেছেন।আমিও আমার বাবার কথামতো তোমায় বিয়ে করেছি।আর এক দেখাতেই তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম।তোমাদের অবস্থা কেমন বা কি?এসব আমি চিন্তাও করেনি আমি তো তুমিটাকে ভালোবেসেছি।তাহলে আরাবীর সময় আজ কেন তুমি এইভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো বার বার?তুমি কিন্তু ভুলে যেওনা জিহাদ ভাইয়ের যা সম্পত্তি আছে আরাবী কিন্তু ধনী আমাদের থেকে কোন অংশে কম না।কিন্তু মেয়েটা বোকা।

নিজের অধিকার আদায় করতে জানে না ও।তাই তো আজ যা ওর তা দিয়ে অন্যেরা আরাম আয়াশ করে দিন কাটাচ্ছে।আর ও পরে আছে অন্যের বাড়িতে।আরাবী কিন্তু অনেক ভালো মেয়ে সাথি।ওর মতো পূত্রবধু পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।দেখো আমাদের জায়ান অনেক সুখী হবে ওর সাথে।শুধু তুমি একটু মেয়েটাকে বুকে টেনে নিও।তাহলে দেখবে এই মেয়েটাই তোমাকে এমনভাবে আগলে রাখবে যে তুমি নিজেই একদিন অবাক হবে ভেবে যে এই মেয়েটাকেই তুমি একদিন কটাক্ষ করেছো।একটু ভাবো সাথি!’

নিহাদ সাথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলেন। সাথি অশ্রুসিক্ত চোখে একে একে স্বামির সব কথাগুলো ভাবতে লাগলেন।আর নিজেকে বুঝাতে লাগলেন।একসময় চোখ মুছে নিয়ে সাথি বেগম হাসলেন।মনে মনে যা ভাবার তিনি ভেবে নিয়েছেন।

নিশিরাত।চারদিক হতে নাম না জানা অসংখ্য পোকাদের ডাকাডাকি শোনা যাচ্ছে। একটা কাক পক্ষিও যেন জেগে নেই।মানুষজন এখন কাথামুরি দিয়ে ঘুমের রাজ্যে পারি জমিয়েছে বহুক্ষন আগে।আরাবীও এর ব্যাতিক্রম না।আরাবী ঘুমাচ্ছে।তবে ওর মুখশ্রীতে স্পষ্ট বিষাদের ছোঁয়া লেগে আছে।মায়াময়ী মুখটা যেন আজকের ঘটনা চুপসে গেছে অনেকটাই।নানারকম চিন্তা কর‍তে করতে ঘন্টা পেরিয়েছে বোধহয় আরাবী ঘুমিয়েছে।কিন্তু সেই ঘুমটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না।বালিশের নিচে থাকা আরাবীর ফোনটা প্রচন্ড জোড়ে ভাইব্রেশনের কারনে কেঁপে উঠলো।ঘুমের মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় প্রচন্ড হলো আরাবী।চোখ না খুলেই হাতরে বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে কানে রেখে যেই না হ্যালো বলতে যাবে তার আগেই অপাশের ব্যাক্তির জোড়ালো ধমকে রূহ যেন লাফিয়ে শরীর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো।,

-‘ তুমি এতো স্টুপিড কেন?বারান্দার দরজা খোলা রেখেছো কেন অসভ্য মেয়ে?আমি না দেখলে কি হতো?যদি চোর টোর এসে দরজা এইভাবে খোলা দেখতে তাহলে কি হতো ভাবতে পারছো তুমি?’
জায়ান এমন রাম ধমক খেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসে প্রাহি।আচমকা ঘুমের ঘোরে এইভাবে ধমক খেয়ে বুকটা এখনো ধুকপুক করছে।জায়ান বলেছে বারান্দার দরজা খোলা।আরাবী তাকিয়ে দেখলো আসলেই খোলা।জিভ কাটলো আরাবী।মিনমিনে গলায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে আওড়ালো,

-‘ সরি! আসলে খেয়াল ছিলো না।আর এমন হবে না প্রমিস।’
অপাশ হতে কোন সারাশব্দ পাওয়া গেলো না।শুধু জায়ানের বড় বড় নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো।অনেকক্ষন এইভাবে কেটে যায়।কেউ কোন কথা বলছে না।শুধু দুজনের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।কিয়ৎক্ষন বাদে আরাবী নিজেই এইবার মৌনতা ভঙ্গ করে বলে,

-‘ কিছু বলছেন না যে?’
এইবারও জায়ান কিছুই বললো না।আবারও মিনিত পাঁচেক নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো।হঠাৎ জায়ান সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে এক অন্যরকম মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বললো,
-‘ আরাবী?’
আরাবীর ঘোর লেগে গিয়েছে জায়ানের এমন কন্ঠস্বরে।আনমনে বলে,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ১৯

-‘ হু?’
-‘ আমার হৃদয় থমকে গিয়েছে আরাবী। একদিন তোমার কারনেই আমার মরণ হবে দেখো নিও।’
কথাগুলো বলে জায়ান সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো।আর আরাবী এখনো ফোন কানে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।কি বললো এইটা জায়ান?

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২১