বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৩

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৩
সাদিয়া জাহান উম্মি

পরন্ত বিকেল বেলা।সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে প্রায়।আকাশটা লালাভ আভায় ছেঁয়ে গিয়েছে।পাখিরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে।ছুটতে ছুটতে আবার কখনো ভাসমান ওই মেঘের ভেলার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। অদূরে কদম ফুল গাছটায় ফুলে ফুলে গাছটা ভরে আছে।আরাবী মুগ্ধ হয়ে গোধূলি বিকেলের এই অপার সৌন্দর্য দেখছিলো।আরাবী দৃষ্টি সরিয়ে এইবার পুরো ছাদে চোখ বুলালো।

জায়ানকে খুজতে গিয়ে আরাবী যেন নিজেকে ফুলের রাজ্যে হারিয়ে ফেললো।এতো এতো ফুল গাছের সমারোহ আর ফুলের বাহার যে আরাবী এই ছাদটাকে ঠিক কি নামে আখ্যায়িত করবে তা ভেবে পেলোনা।হঠাৎ কাঠগোলাপ গাছের দিকে নজর যায় আরাবীর।সেখাকে কি সুন্দর ফুল ফুটে আছে।আরাবী ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেখানে।কাঠগোলাপ গাছটায় আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিতেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে আরাবী।নরম নরম ফুলের পাপরীগুলো ছুঁতে কি যে ভালো লাগছে। হঠাৎ আরাবী কেঁপে উঠে।কারন ওর পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।আর তার মুখশ্রীটা যে ঠিক ওর কাধের উপর তা বুঝতে পেরেছে আরাবী।মানুষটা যে জায়ান তা বুঝার আর বাকি রইলো না।জায়ানের গরম নিশ্বাসগুলো আরাবীর কানে এসে বারি খাচ্ছে।এতে যেন আরাবীর পুরো অস্থিত্ব জুড়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।জায়ান আরাবীর কানে কানে হালকা গলায় বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ কাঠগোলাপ! তুমি আমার এতো প্রিয় কেন?’
আরাবীর হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে শতোগুন।জায়ান কি ওকে ‘ কাঠগোলাপ!’ বলে সম্বোধন করেছে? নাকি ফুলগুলোকেই বলেছে?আর বললেও এইভাবে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কি হলো? আরাবী বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুট দূরে সরিয়ে নিলো জায়ানের থেকে।তারপর পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় জায়ানের দিকে।জায়ান পকেটে দুহাত গুজে বাঁকা চোখে আরাবীর দিকে তাকিয়ে আছে।সিল্কি চুলগুলো বাতাসে হালকা দুলছে।

সূর্যের লালাভ আভায় লোকটার মুখশ্রীতে পরছে।এতে যেন লোকটার সৌন্দর্যতা দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে।আরাবী নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো।বেহায়া চোখদুটো দৃষ্টি সরাতে নারাজ।আরাবী মাঝে মাঝে বেশ অবাক হয়। তার কপালে যে এমন একজন সুদর্শন পুরুষ লিখা আছে তা কাশ্মিনকালেও ভাবেনি আরাবী।নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হয় আরাবী।হঠাৎ জায়ান বড় বড় পা ফেলে একদম আরাবীর কাছে এসে পরলো।আরাবী জায়ান আকস্মিক এমন করায় ভড়কে যায়।পিছাতে নিতেই জায়ান আরাবীর বাহু ধরে একদম কাছে নিয়ে আসে।দুরুদুরু বুক নিয়ে আরাবী চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

-‘ কি করছেন আ..আপনি?’
জায়ান শীতল কন্ঠে বললো,
-‘ আগে চোখ খুলে তাকাও আমার দিকে।’
আরাবী জায়ানের এমন কথা শুনে পিটপিট করে চোখজোড়া খুলে জায়ানের দিকে তাকায়।জায়ান তাকিয়ে আছে ওর দিকে।সেই চোখে আরাবী দেখতে পাচ্ছে ওর জন্যে এক সমুদ্র ভালোবাসা।সত্যিই কি তাই?জায়ান কি ওকে ভালোবাসে?তবে ওই চোখের দৃষ্টি কেন বারবার আরাবী সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।জায়ান আস্তে করে আরাবীর কোমড়ে একহাত রেখে আরাবীকে একদম ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আরাবী সারা শরীর ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো।জায়ানের প্রতিটা স্পর্শ যেখানেই লাগছে সেই জায়গাটাই কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠছে আর মনে হচ্ছে অবশ হয়ে আসছে।আরাবী সহ্য করতে পারছে না আর।নিজেকে সামলাতে জায়ানের বুকের কাছের টি-শার্ট হাতের মুঠোয় আকঁড়ে ধরলো।জায়ান আরাবীর অবস্থা দেখে বাঁকা হেসে বলে,

-‘ কাঁপাকাঁপি বন্ধ হলো না আর তোমার?’
জায়ানের প্রশ্নে আরাবী লজ্জায় মাথা নিচু করে নিতেই জায়ান সাথে সাথে আরাবীর থুতনিতে হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে নিলো।রোষপূর্ণ গলায় বললো,

-‘ বার বার ওই দৃষ্টি নত কেন হয়?কেন নিজেকে সবার সামনে এতোটা দূর্বল প্রমান করো আরাবী?প্রতিবাদ কেন করতে শিখো না? চোখে চোখ রেখে দৃঢ় সাহস নিয়ে তাকাবে।গলা উঁচিয়ে নিজের জন্যে প্রতিবাদ করবে কেন করো না?এই দূর্বল আরাবীকে সবাই তাহলে কষ্ট দিবে প্রতি মুহূর্তে। আর আমি তা সহ্য করতে পারবো না!’
আরাবীর মনটা ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেলো।কিন্তু জায়ানকে আরাবী কিভাবে বলবে?আর যেমন হোক।কিন্তু জায়ানের সামনে আরাবী কখনো মাথা উঁচু করে তাকাতে পারেনা।ওই চোখে চোখ রাখতে পারেনা আরাবী। আর কোনদিন বোধহয় পারবেও না। জায়ান আরাবীর এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলো।তারপর ওই শক্তপোক্ত হাতটা দিয়ে আরাবীর নরম গাল অতি আদুরেভাবে স্পর্শ করলো।আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।জায়ান আরাবীর মুখে প্রগাঢ়ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে,

-‘ নিচে ওসব কি হচ্ছিলো?’
আরাবী জায়ানের এমন প্রশ্ন বুঝতে পারলো না।তাই কাঁপাকাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হ..চ্ছিলো?’
জায়ান হালকা আওয়াজে আওড়ালো,
-‘ তামিম তোমার বর?তাহলে আমি কে?আবার ওকে চুমুও দেওয়া হচ্ছিলো তাই নাহ? এই তাকাও আমার দিকে।’
লাস্ট কথাটা ধমকের রেশে বললো জায়ান।আরাবী ভয় পেয়ে চট করে চোখ খুলে তাকায়।জায়ান এইবার ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আরাবীর দিকে তারপর বলে,

-‘ তামিম তোমার বর না হয়েও তুমি ওকে চুমু খেলে।আর আমি তো তোমার সত্যিকারের বর।তাহলে আমি কেন বাদ যাবো?ওকে একটা দিয়েছো।বিনিময়ে আমি ডাবল চাই।’
আরাবী বিষ্ময়ে কি রিয়েকশন দিবে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।একটা মানুষ যে এইভাবে বাচ্চাদের সাথে হিংসা করতে পারে তা কখনো ভাবতেও পারিনি আরাবী।আর কি বললো লোকটাকে ডাবল চুমু দিতে হবে?আরাবীর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।গালগুলো লাল হয়ে গিয়েছে। নিশ্বাসের গতি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন।ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে।সেই কাঁপাকাঁপা ঠোঁটেই আরাবী মিনমিন করে বললো,

-‘ বাই এনি চান্স আপ..আপনি কি জ্বেলাস?’
জায়ান আরাবীর কথাত ভ্রু-কুচকে তাকালো।বিরক্তিকর গলায় বলে,
-‘ অফকোর্স আই এম! তুমি আমার সামনে অন্য একজনকে কিস করবে সেটা দেখে আমি জ্বেলাস হবো না?’
আরাবী জায়ানের এমন কাটকাট গলায় কথাগুলো শুনে হাসি পাচ্ছে ভীষন।লোকটা কেমন বাচ্চাদের মতো আঁচড়ণ করছে।আরাবী বলে উঠে,

-‘ ও একটা বাচ্চা ছেলে।’
-‘ তো?’
-‘ তো মানে আপনি ওকে নিয়ে কিভাবে জ্বেলাস হন।’
জায়ান শক্ত গলায় বলে,
-‘ আমি জ্বেলাস হচ্ছি দ্যাটস ইট।তুমি এখন আমাকে ফটাফট চুমু খেয়ে আমার জ্বেলাসি কমিয়ে দেও।’
আরাবী কি করবে ভেবে পেলোনা।এই ঠোঁটকাটা লোকটা কিসব উল্টাপাল্টা বলছে।আরাবী রিনরিনে কন্ঠে বলে,
-‘ কি করছেন? ছাড়ুন না আমায়।’
-‘ ছাড়বো না!’

জায়ানের সহজ স্বিকারোক্তি।আরাবী আর কিছুই বললো না।চুপচাপ সেভাবেই রইলো।জায়ানও নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আরাবীর মুখপানে।জায়ান হঠাৎ আরাবীর গাল হতে সেই হাতটা সরিয়ে তা আরাবীর মুখের সামনে আনলো। আরাবী জায়ানের হাতের দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলো।অস্থির কন্ঠে বলে,
-‘ এটা কিভাবে হলো?আপনি আমাকে আগে দেখালেন না কেন?’
জায়ান হাতটা সরিয়ে নিলো।আরাবীকে দুহাতে ধরে আরাবীর মাথাটা ওর বুকে চেপে ধরলো।আরাবীর এতে একটুও ধ্যান নেই।ওতো অস্থির হয়ে আছে জায়ানের হাতে ওই নখের আঁচড়ের দাগ দেখে।আরাবী ধরা গলায় বলে,

-‘ প্লিজ বলুন না ওটা কিভাবে হলো?’
জায়ান আরাবীর কানের কাছে ওষ্ঠ ছুইয়ে দিয়ে বলে,
-‘ হুশ! এটা আমার আমার প্রিয় মানুষটার দেওয়া দ্বিতীয় চিহ্ন।’
আরাবী বুকটা ধ্বক করে উঠলো।জায়ানের প্রিয় মানুষ সেটা আবার কে?আর যদি প্রিয় মানুষ থেকেই থাকে তাহলে ওর সাথে এমন করার কি মানে?জায়ানের ওর প্রতি করা প্রতিটা ব্যবহারে আরাবী স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে জায়ান ওকে ভালোবাসে।জায়ান মুখে না বলুক।তবে জায়ানের চোখ কখনো মিথ্যে বলেনা।

আর আরাবী জায়ানের চোখে ওর জম্যে অসীম ভালোবাসা দেখেছে।তবে এখন আবার প্রিয় মানুষ কাকে বলছে জায়ান? হঠাৎ আরাবীর খেয়াল এলো ড্রয়িংরুমে সাথি ওকে হঠাৎ ডাক দেওয়ায় ও ভয় পেয়ে পাশে কারো হাত খামছে ধরেছিলো।আর তা যে কার হাত বুঝতে বাকি রইলো না আরাবীর।লজ্জা পেয়ে জায়ানের বুকে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলো আরাবী।জায়ান দুহাতে আরাবীকে আকঁড়ে ধরে আছে। আরাবী জায়ানের হৃদস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

চোখ বুঝে অনুভব করছে জায়ানকে গভীরভাবে। এইভাবে কেটে যায় সেকেন্ট,মিনিট,ঘন্টা।কেউ কাউকে ছাড়েনা।দুজন ভালোবাসার মানুষ একে-অপরকে আঁকড়ে ধরে মনের মাধ্যমে ভালোবাসা আদানপ্রদান করছে।হঠাৎ আজানের ধ্বনী কানে আসায় আরাবীর ধ্যান ভাঙ্গে।দ্রুত জায়ানের বক্ষস্থল হতে মাথা সরিয়ে নেয়।ইস,কতোক্ষন ছিলো আরাবী এইভাবে জায়ানের সাথে লেপ্টে।ভাবলেই গালগুলো রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ে। আরাবী লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

-‘ আজান দিচ্ছে।এইবার তো ছাড়ুন।নিচে যাবো।’
জায়ান ছেড়ে দিলো আরাবীকে।চুলগুলোতে হাতের সাহায্যে ব্যাকব্রাশ করে স্থির চাহনী নিক্ষেপ করলো আরাবীর দিকে তারপর বলে,

-‘ চুমু তো দিলে না।ছেড়ে দিলাম যাও।তবে মনে রেখো বিয়ের পর কড়ায়গন্ডায় সব উশুল করবো আমি দেখে নিও।’
আরাবী শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে।সে জানে এখানে আর বেশিক্ষন দাড়ালে এই লোক ওকে লজ্জা দিতে দিতে মেরে ফেলবে।তাই আরাবী দ্রুত ছাদ থেকে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।সিড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে নামছে আরাবী।সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে ওর পিছন হতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ আসছে। আরাবী জায়ানের রুমে কাছে আসতেই।হঠাৎ একটা হাত আরাবীর বাহু আকড়ে ধরে দরজার কাছে আনলো।আরাবী কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা ঘোরলাগানো শীতল কন্ঠ ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২১+২২

-‘ আবার যদি বৃষ্টি নামে,
আমিই তোমার সঙ্গি হবো।
#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ টি,
কানের পিঠে গুজে দিবো।
লেপ্টে যাওয়া শাড়ির মতো,
অঙ্গে তোমার জড়িয়ে রবো।’
তৎক্ষনাৎ আরাবীর বাহু ছেড়ে দিলো।আর খট করে দরজা আটকানোর শব্দ হলো।আর থরথর আরাবী স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৪