বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৪

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৪
সাদিয়া জাহান উম্মি

গ্রামের সেই চিরোচেনা পথটায় জায়ানের গাড়িটা প্রবেশ করতেই ভয়ে ঘামাতে শুরু করে আরাবী।হৃদয়টা মনে হয় কেউ কামড়ে ধরে আছে।বুকের ভীতরে যেই যন্ত্রটা আছে তা চলাচল যেন দ্বিগুন পরিমানে বেড়ে গেলো।আজ ওরা সকাল সলাল রওনা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে।সাথে ইফতি আর নূরও আছে।ইফতিকে জায়ান সাথে আসার জন্যে বলেছে।যদি কোন বিপদ হয় জায়ান যদি একা হাতে সামলাতে না পারে তাই।কিন্তু নূর এসেছে জেদ ধরে।ওকে নিবেনা বলেছিলো জায়ান এটা শুনেই নূর কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে।শেষমেষ না পারতে ওকেও সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে ।তপ্ত শ্বাস ফেললো আরাবী।ঠোঁট কামড়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ও।কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।জায়ান হঠাৎ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-‘ এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।’
আরাবীর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো জায়ান।সাথে সাথে আরাবীর মনটা ভালো হয়ে গেলো একদম।অজান্তেই হাসলো আরাবী।জায়ানকে একপলক দেখে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।অনেক মানুষই আরাবীদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। কারন সচরাচর গ্রামে এমন কার খুব কম দেখা যায়।জায়ান গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘ কোনদিকে যাবো আরাবী?সামনে দুটো পথ!’
জায়ানের কথায় আরাবী তাকালো।শান্ত সুরে জবাব দেয়,
-‘ এইতো ডানে গিয়ে চার নাম্বার বাড়িটার সামনেই গাড়ি থামাবেন!’
জায়ান আরাবীর কথা মতো গাড়ি ডানে ঘুরালো।তারপর চার নাম্বার বাড়ির সামনেই গাড়ি থামালো।গাড়ি থামতেই সবাই নেমে দাড়ালো।শুধু আরাবী নামছে না।

এটা দেখে জায়ান এসে আরাবীর সাইডের দরজা খুলে দিলো।আরাবীর দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো বেড়িয়ে আসার জন্যে।আরাবী করুন চাহনী নিক্ষেপ করে জায়ানের দিকে।জায়ান চোখের ইশারায় ওকে আসস্থ করলো।ভয় পেতে মানা করলো।দুরুদুরু বুক নিয়ে জায়ানের হাত ধরে আরাবী নেমে আসলো গাড়ি থেকে।এদিকে গাড়ির শব্দ শুনে তৎক্ষনাৎ ছুটে আসেন আরাবীর মা।এসেই আরাবীকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আরাবীও এতোদিন পর মা কে পেয়ে হুহু করে কান্না করে দিলো।আরাবীর মা মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিলেন।তারপর আরাবীকে বুক থেকে উঠিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো।পরম স্নেহে আরাবীর কপালে চুমু খেলো।আরাবী কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

-‘ কেমন আছো মা?’
-‘ আমি অনেক ভালো আছি।’
-‘ তুই ভালো আছিস তো?’
-‘ তুমি যাদের কাছে আমার দায়িত্ব দিয়েছো।তাদের মতো মানুষদের কাছে খারাপ থাকি কি করে বলো?’
মেয়ের কথায় আরাবীর মায়ের খুশিতে চোখ ভরে আসে।এদিকে জায়ান এতোক্ষন মা মেয়ের কথা শুনছিলো এইবার গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

-‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।কেমন আছেন?’
আরাবীর মা এইবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান জায়ানের দিকে।তিনি চিনতে পারছেন না।তাও সালামের জবাব দিয়ে বলেন,
-‘ আমি ভালো আছি বাবা।তা তোমাকে চিনতে পারলাম না।’
জায়ান মৃদ্যু কন্ঠে বলে,
-‘ আমি জায়ান।আপনার মেয়ের হবু জামাই।’

আরাবী চোখ বড় বড় করে তাকালো জায়ানের দিকে।আরাবী ভাবতেও পারেনি জায়ান এইভাবে নিজেকে ওর হবু মেয়ের জামাই বলে ওর মায়ের কাছে পরিচয় দিয়ে দিবে। আরাবীর মা অত্যন্ত খুশিতে কি করবেন ভেবে পেলেন না।তার মেয়ের কপালে যে এমন সুদর্শন আর ভালো মনের জীবনসঙ্গী পাবে লিখা আছে তা ভাবতেও পারিননি তিনি।মেয়ের এমন সাত কপাল দেখে মনে মনে অসংখ্যবার উপরওয়ালার কাছে ধন্যবাদ জানায়।এদিকে ইফতি এগিয়ে এসে বলে,

-‘ আমাকে চিনতে পেরেছো মামনি?আমি ইফতি!’
-‘ আল্লাহ ইফতি তুমি কতো বড় হয়ে গিয়েছো।মাশা-আল্লাহ!! ‘
ইফতি হাসলো এমন কথায়।নূরও নিজের পরিচয় দিলো।আরাবীর মা এইবার বললেন,
-‘ তোমরা ভীতরে আসো বাবা!’
জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

-‘ নাহ আন্টি আমরা ভীতরে যাবো না।আপনি আপনার জামা-কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আসুন!’
এমন সময় ঘর হতে কাজের মেয়ের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসে আসলেন আরাবীর দাদি।যদিও আপন না।তবে আপন দাদিও এমন এতো আদর করে না যতোটা তিনি করেন আরাবীকে।আরাবী তাকে দেখে একছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
-‘ কেমন আছো দাদু?’
তিনি হেসে আরাবীর মাথায় হাত রেখে বলেন,
-‘ আমার দাদুভাই যেইহানে ভালা আছে আমিও ভালা আছি। তা হুনলাম বিয়া ঠিক হইছে?তা হেইজন কই লগে আহে নাই?’
আরাবী হাসিমুখে বললো,

-‘ এসেছো তো।’
-‘ কই ডাক দে।আমিও একটু দেহি।’
আরাবী ঘার ঘুড়িয়ে জায়ানকে ডেকে উঠে,
-‘ শুনছেন?দাদু আপনাকে দেখবে।’
জায়ান আরাবীর ডাকে ওর দিকে এগিয়ে আসলো।ইফতি আর নূরও এগিয়ে আসলো।সবাই আরাবীর দাদুর সাথে কুশল বিনিময় করলো।আরাবীর দাদু তো জায়ানের প্রশংসা করতে করতে শেষ। এইভাবে অনেকক্ষন কেটে যাওয়ায় জায়ান তাড়া দিলো সবাইকে,

-‘ আন্টি আপনি আর দাদুর সকল জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত আসুন।আর দেরি করা চলবে না!’
আরাবীর মা আমতা আমতা করে বলেন,
-‘ সে কি বাবা? এতোদূর এসেছো।কিছু না খেলে হয়?’
জায়ান আরাবীর মায়ের এহেন কথায়।শান্ত সুরে বলে,

-‘ যেখানে আরাবী আর আপনাকে পদে পদে অপমানিত হতে হয়েছে সেই বাড়িতে যে আমি এসেছি এটাই অনেক।আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে রেখেছি।প্লিজ আন্টি জোড় করবেন না।’
আরাবী বুঝলো জায়ান নিজের রাগটাকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে।তাই পরিস্থিতি হাতের বাহিরে যাওয়ার আগে আরাবী ওর মা’কে তাড়া দিলো জলদি করার জন্যে।সব শুনে আরাবীর দাদু বলল,
-‘ লিপি গেলে যাক।আমি যাইয়া কি করমু?এমনেই আমি অসুখ্কা(অসুস্থ) মানুষ।আমারে বাপু তোমরা টানাহেছঁড়া কইরো না।’

আরাবী দাদুর কথায় মন খারাপ করে বললো,
-‘ দাদু এসব তুমি কি বলছো?তুমি যাবে না মানে?তোমাকে যেতেই হবে।’
-‘ কে কোথায় যাবে?’
পিছন থেকে কারো এমন কন্ঠস্বরে ভয়ে কেঁপে উঠলো আরাবী।ঠিক যার ভয় পেয়েছিলো সেটাই হলো। হানিফ আহমেদ এসেছেন।মাত্রই হাট থেকে ফিরেছেন উনি।এদিকে আরাবীকে দেখেই তিনি হা করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন।পরক্ষনে রাগে কটমট করে আরাবীর দিকে তেড়ে আসতে আসতে বলে উঠে,
-‘হারাম*জাদি।আমার মুখে চুনকালি লাগিয়ে ভেগে গিয়েছিলি।এখন আবার ফিরে এসেছিস।তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো। কু****!’
হানিফ আহমেদের এমন বিশ্রি গালিগালাজ শুনে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না জায়ান।রাগে ভয়ংকর ভাবে গর্জে উঠে,

-‘ জাস্ট সাট আপ।আর একটা স্ল্যাং ইউজ করবেন আমি ভুলে যাবো আপনি একজন মুরব্বি মানুষ।’
হানিফ আহমেদ সাথে সাথে থেমে গেলেন। রাগি চোখে জায়ানের দিকে তাকালো।তারপর আবার আরাবীর দিকে তাকাতেই আরাবী ভয় পেয়ে জায়ানের পিছনে নিজেকে লুকিয়ে নেয় আর জায়ানের শার্ট খামছে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।হানিফ আহমেদ বলেন,
-‘ শহরে এই নাগর জুটিয়েছিস তাই তো ভেগে গিয়েছিলি! চু******! তোরে কাইট্টা কুচিকুচি করুম!’
ইফতি এসব সহ্য করতে না পেরে হানিফ আহমেদের দিকে তেড়ে এসে উনার গলা চেপে ধরেন।ইফতি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

-‘ আর একটা খারাপ কথা আরাবীকে বললে আপনার জিহবা ছিরে ফেলবো আমি!’
জায়ান শান্তসুরে বলে,
-‘ থাম ইফতি। ছেড়ে দে উনাকে।’
ইফতি ভাইয়ের কথায় হানিফকে ছেড়ে দিলো।হানিফ গলা ধরে কাশতে লাগলেন।কিছুক্ষন পর চোখ তুলে জায়ানের দিকে তাকাতেই।তিনি ভয়ে আতকে উঠেন।জায়ানের চোখজোড়া ভয়ংকর লাল হয়ে আছে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
হানিফ ভয়ে তুতলাতে তুতলাতে বলে,
-‘ এইভাবে তাকালেই আমি পাবো ভাবছো নাকি?ভুলে যাও সেটা।আমার এতো টাকার লস হয়েছে ওই মা**** জন্যে।ওরে তো আমি…..’

জায়ান হানিফকে আর বলতে দিলেন নাহ।চপাট করে চ*ড় বসিয়ে দিলো তার গালে।দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
-‘ আগেই বলেছিলা।স্ল্যাং ইউজ করতে না।’
চ*ড় খেয়ে হানিফের মাথা ঘুরে উঠলো। থপ করে মাটিতে বসে পরেন তিনি।জায়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-‘ কতো টাকা হ্যা?কতো টাকা চাই? আমি দিবো তোকে।’

জায়ান সাথে সাথে চেকবুক বের করে সেখানে দশলক্ষ টাকার একটা চেক লিখে ছুড়ে মারে হানিফ আহমেদের দিকে।তারপর আরাবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।ইফতি আর নূরকে ইশারা করলো আরাবীর মা আর দাদুকে নিয়ে গাড়িতে বসতে।এদিকে আরাবীর দাদু কাঁদছেন।তবে ছেলের এই কষ্টে না।এই ভেবে কাঁদছেন এমন মানুষ তার গর্ভ থেকে কি করে জন্ম নিলো। ইফফি উনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলতেই তিনি জানান যাবেননা। তারা যেন চলে যায়।জায়ান আর আরাবীও অনেক রিকুয়েস্ট করেন তাকে কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না।

শেষে না পেরে আরাবীর মা’কে নিয়েই ইফতি আর নূর গাড়িতে উঠে বসলো।জায়ান এইবার আরাবীকে নিয়ে হানিফ আহমেদের সামনে আসলেন।হানিফ আহমেদ তখন এতো টাকার চেক পেয়ে তা বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে।একটু আগে যে জায়ানের হাতের শক্তপোক্ত হায়ের চড় খেয়েছে তা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে।আরাবী ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। জায়ান রাগি গলায় বললো,

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৩

-‘ ফারদার আর কখনো যেন আপনার এই বাজে ব্যবহার যেন আমি না দেখি।সেদিন আপনার শেষ দিন হবে এই দুনিয়াতে।আর হ্যা আমি কাল দুজন নার্স পাঠবো দাদুর জন্যে তারা দাদুর খেয়াল রাখবে।আর যেন কোন উল্টাপাল্টা না করতে দেখি।’
জায়ান কথাগুলো শেষ করে আরাবীর হাত ধরে নিয়েই এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ২৫