বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৪

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৪
সাদিয়া জাহান উম্মি

‘ ভাই কাজি আর হুজুর এসে পরেছেন।এইবার আরাবীকে আসতে বলো!’ ইফতির প্রশ্নে জায়ান নূরকে মেসেজ করে দিলো।আরাবীকে নিয়ে নিচে আসতে।
জায়ানের মেসেস পেয়ে নূর আরাবীকে বলে, ‘ ভাবি নিচে চলো।ভাইয়া মেসেজ দিয়েছে।’
আরাবী নূরের কথায় সম্মতি জানিয়ে নূরের সাহায্যে উঠে দাড়ালো।আসলে আদি যখন দিয়ে ওকে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিলো তখন পেটে খুব ব্যাথা পেয়েছিলো আরাবী।তাই এখন ওর হাটতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে।নূর আরাবীকে এইভাবে হাটতে দেখে প্রশ্ন করলো, ‘ আর ইউ ওকে ভাবি?’

আরাবী দূর্বল কন্ঠে বলে, ‘ হ্যা। আমি ঠিক আছি চিন্তা করো না।’
আরাবী সিড়ির কাছে আসতেই শুকনো ঢোক গিললো।এখন এই সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে ভেবেই আরাবীর গলায় শুকিয়ে আসলো।তাও আস্তে আস্তে নামতে লাগলো।এদিকে ইফতি নূর আর আরাবীকে দেখেই বললো, ‘ ভাই আরাবী এসেছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জায়ান পিছন ফিরে তাকালো।আরাবীও জায়ানের দিকেই তাকিয়েছিলো।জায়ানের চোখে আরাবী দেখতে পেলো একরাশ মুগ্ধতা।কিভাবে তাকিয়ে আছে লোকটা।আরাবী বেশ লজ্জা পেলো।চোখ নামিয়ে নিলো আরাবী।তবুও আঁড়চোখে তাকাচ্ছে।লোকটাকে শুভ্র পাঞ্জাবীতে অমায়িক সুন্দর লাগছে।জায়ানকে পাঞ্জাবিতে এই প্রথম দেখলো আরাবী।বেশ মানায় লোকটাকে পাঞ্জাবীতে।আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।তখন হুট করে একজোড়া বলিষ্ট হাত ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।লোকটা যে জায়ান ছাড়া কেউ না তা আরাবী ভালোভাবেই জানে।তবেআকস্মিকতায় আরাবী ঘাবড়ে গিয়ে জায়ানের ঘাড় আর বুকের কাছের পাঞ্জাবির অংশ খামছে ধরলো।ভীতু চোখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ এইভাবে হুট করে কোলে নেওয়ার মানে কি? ভয় পেয়েছি তো আমি।’

জায়ান হালকা রাগি স্বরে বললো, ‘ পেটে যে ব্যাথা হচ্ছে সেটা আমাকে জানাও নি কেন?আর নূরকেও মনে হয় বলোনি?এতো কেয়ারলেস কেন তুমি?’
আরাবী হা হয়ে গেলো জায়ানের কথায়।ও তো জায়ানকে ব্যাথার কথা বলেনি। তবে লোকটা জানলো কিভাবে।জায়ান আরাবীকে নিয়ে নিচে নামতে নামতে বললো, ‘ অবাক হওয়ার কিছু নেই।যেইভাবে পেট চেপে ধরে একটু পরপর নাক মুখ কুচকে ফেলছো।তাতেই আমি বুঝি গেছি।বেশি সমস্যা হলে বলো।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।থাক তা লাগবে না আমি ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বলবোনি।’

আরাবী মিনমিনে কন্ঠে বলে উঠে, ‘ আরে তা লাগবে না।একটু ব্যাথা করছে।ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এতো রাত হয়ে গিয়েছে শুধু ডাক্তারকে আনা লাগবে না।’
জায়ান আরাবীকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘ তোমায় বেশি পাকনামি করা লাগবে না আমি আমারটা বুঝে নিবো।তখনও ফোন দিতে চেয়েছিলাম তুমি ফোন দিতে দিলে না।বললে অল্প একটু ব্যাথা।কিন্তু এখন তো আমি দেখছি অন্য কিছু। আর একটা কথাও বলো না।’

আরাবী কথা বাড়ালো না।সে জানে এই লোককে এখন এসব কিছু বলে লাভ নেই।তাই চুপচাপ থাকলো।জায়ান ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে।তারপর সোফায় আরাবীর পাশে এসে বসলো। জায়ান ইশারা দিতেই আগে হুজুর নিজের কাজ শুরু করলেন।হুজুর যা যা করতে বললেন জায়ান সব যথাযতভাবে বললো।বাবার দায়িত্ব অবশ্য মিহান পালন করেছে। জায়ানকে কবুল বলতে বললে জায়ান বেশ স্বাভাবিকভাবেই তিন কবুল বলে ফেললো।

আরাবীর পালা আসলে আরাবী ছলছল চোখে ওর মায়ের দিক তাকালো। আরাবীর মা এসে মেয়ের পাশে বসলেন।আরাবী চোখের জল ফেলে দিয়ে মায়ের হাত আকঁড়ে ধরলো।আরাবীর মা, আরাবীর বাবার একটা ছবি আরাবীর দিক এগিয়ে দিলো।আরাবী সেটা হাতে নিলো।কি সুন্দর একটা ছবি।ওর বাবা ওকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আরেক হাতে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে আছে।সবার মুখে তৃপ্তির হাসি।আরাবী ছবিটা বুকে জড়িয়ে নিলো। তারপর ভাঙ্গা গলায় থেমে থেমে তিনবার কবুল বলে ফেললো। কাজিও নিজেও খুব সুন্দরভাবে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দিলেন।আর জায়ান ফটাফট সুন্দরভাবে সাইন করে দিলো।আরাবীও কোন আস্তেধীরে সাইন করে দিলো। সব কিছু সুন্দরভাবে হয়ে যেতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।আজ থেকে ধর্মীয়ভাবে আর আইনগতভাবে দুইভাবেই জায়ান আর আরাবী স্বামি স্ত্রী হয়ে গেলো। পূর্ণতা পেলো ওদের ভালোবাসা।সারাজীননের জন্যে একে-অপরের সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হলো।

বিয়ে সম্পূর্ণ হতেই সাথি আর মিলি মিষ্টি এনে সবাইকে খাইয়ে দিলেন।অবশ্য মিষ্টি ইফতি নিয়ে এসেছিলো।কাজি আর হুজুরকে নিয়ে আসার সময়।সাথি আরাবীকে নিজের সাথে নিয়ে একটু পরেই চলে গেলেন। আরাবী চুপচাপ নিজের শাশুড়ি মায়ের সাথে চললো।সাথি আরাবীকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি এসে সোজা নিজের রুমে নিয়ে গেলেন।আদুরে গলায় বলেন, ‘ তুমি এখানে একটু বসো কেমন আম্মু!’
আরাবী ধীরে বললো,’ আচ্ছা আন্টি।’

সাথি হালকা রাগ দেখালেন।বললেন, ‘ আন্টি কি আম্মু বলো!’
আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে বললো, জি আম্মু।’
সাথি খুশি হয়ে আরাবীর কপালে চুমু দিয়ে দিলেন।
হঠাৎ নূরের কন্ঠ পাওয়া গেলো, ‘ মা ডাক্তার আন্টি এসেছেন। ভাবির চেক-আপ করানোর জন্যে।’
সাথি অনুমতি দিতেই নূর ডাক্তারকে নিয়ে ভীতরে আসলেন।আরাবীকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে তিনি আরাবীকে সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেন।আরাবী আস্তে ধীরে সবটা বললেন।ডাক্তার ভালোভাবে আরাবীকে চেক-আপ করে নিলেন।

তারপর বেশকিছু ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করে দিয়ে চলে গেলেন।তিনি যেতেই সাথি আরাবীকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন।নিজেও আরাবীকে হাতমুখ ধুতে সাহায্য করলেন। তারপর আরাবীকে নিয়ে রুমে আসতেই।তিনি বললেন,’ বিয়ের জন্যে তো কতো শপিং করলাম তোমার জন্যে।কিন্তু এইভাবে হয়ে গেলো বিয়েটা।যদি তুমি বেশি অসুস্থ ফিল না করো।তাহলে বিয়ের শাড়িটা তোমায় পরিয়ে দেই আমি?আমার ছেলেটা বড্ড শখ করে কিনেছে তোমার জন্যে।অবশ্য তোমার বিয়ের সকল শপিং জায়ান নিজেই করেছে।কাউকে দেখতে দেইনি।শুধু আমাকে দেখিয়েছে। কি বলো পরবে?’

আরাবীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে অবশ্যই পরবে।কেন পরবে না?তার জায়ান তার জন্যে শাড়ি কিনেছে আর সে পরবে না?তারও তো অনেক শখ সে লাল টুকটুকে বউ সাজবে তার জায়ানের জন্যে।আরাবী হাসিমুখে সম্মতি জানালো। সাথি বেশ খুশি হলেন।সাথে সাথে নিজের ছেলের বউকে বিয়ের শাড়ি পরিয়ে দিতে লাগলেন।হাল্কা কিছু স্বর্ণের গহনাও পড়ালেন।তারপর নিজের হাতে আরাবীকে মেক-আপ করিয়ে দিলেন।চুলটাও বেশ সুন্দরভাবে সেট করে দিলেন।পুরো সাঁজ কমপ্লিট হতেই সাথি যেন চোখ সরাতে পারছে না আরাবী থেকে। আরাবীর কপালে চুমু দিয়ে হাসি মুখে বলেন,’ মাশা-আল্লাহ! আমার ছেলের বউকে একদম রানির মতো লাগছে।’

সাথি নিজের হাতে বালাদুটো খুলে আরাবীকে পরিয়ে দিলেন।তারপর বলেন,’ আমি যখন বিয়ে করে এসেছিলাম আমার শাশুড়ি আমাকে এই বালা দুটো দিয়েছিলেন।বাড়ির বড় বউদের জন্যে নাকি এটা বানানো হয়েছে।আমার শাশুড়িকে তার শাশুড়ি দিয়েছিলেন আর তিনি দিয়েছিলেন আমাকে।আর আমি আজ দিলাম আমার ছেলের বউকে।’

আরাবী হাতের বালা দুটো স্পর্শ করে হালকা হাসলো।তারপর আয়নার দিকে দিকে তাকালো। লাল টুকটুকে স্টোন ওয়ার্ক করা বেনারসি শাড়ি, মাথায় গোল্ডেন কালার ওড়না দেওয়া তাতেও স্টোন ওয়ার্ক করা,খোপা করা চুলগুলোতে লাল গোলাপ লাগানো, গলায় চিকন একটা স্বর্ণের নেকলেস, কানে স্বর্ণের দুল, নাকে ডায়মন্ডের নোসপিন,হাতে সাথির দেওয়া বালাজোড়া, আঙ্গুলে আজকের এংগেজমেন্টের আংটি আর সাথে এখন যোগ হয়েছে আরো একটা স্বর্ণের আংটি।বেশ হালকা মেক-আপ করে দিয়েছে সাথি।

আরাবী নিজেকে দেখে নিজেই অবাক।বিয়ের সাজে যে ওকে এমন অদ্ভূত সুন্দর লাগবে ভাবেনি আরাবী। নাকি আজ শাশুড়ি নামক আরেক মা সাজিঁয়ে দিয়েছে এই জন্যে সুন্দর লাগছে বেশি? আরাবী জানে না।আরাবী সাথির কাছে এসে সাথিকে জড়িয়ে ধরলো। ধরা গলায় বলে, ‘ ধন্যবাদ আম্মু।আমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।সব আপনার জন্যে।আমার মা আমাকে সাজিয়ে দিয়েছেন এই জন্যেই আমাকে এতো বেশি সুন্দর লাগছে।ধন্যবাদ আম্মু।অনেক অনেক বেশি ধন্যবাদ।’

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৩

সাথির চোখের কোনেও জল জমেছে।এমন একটা ভালো মনের মেয়েকে নাকি তিনি দেখত পারতেন না।কতো কথা শুনিয়েছেন।অপমান করেছেন।সেসব মনে পরলে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যান সাথি।সাথি আরাবীকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মনে মনে ওয়াদা করলো এউ মেয়েটাকে ছেলের বউ না নিজের মেয়ের মতো রাখবেন তিনি। কখনো ওকে কষ্ট পেতে দিবেন না আরাবীকে। ভাবতেই হালকা হাসলেন সাথি।

বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব ৩৫